
৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন (অব.) ও মুক্তিযোদ্ধা এম. এ. মান্নানের কাছ থেকে জানতে পাই মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম হেনার কথা। রোকেয়া বেগম হেনার খোঁজে পিরোজপুরের উদ্দেশে রওনা হই ১১ অক্টোবর ২০০২ সালে। ঢাকা থেকে বাস যোগে পিরোজপুর পৌঁছালাম বেলা তিনটার দিকে। হাজার বছরের পুরনো জনপদ পিরোজপুর। পুরনো জনপদ হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন উন্নয়ন ঘটে নি। আদিকালে একমাত্র নৌপথই ছিল এখানকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। পুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে নারিকেল, সুপারিসহ নানান জাতের বৃক্ষরাজি। এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে মুক্তিযোদ্ধা এম. এ. মান্নানের সাথে একটা রিকশা নিয়ে পৌছালাম রোকেয়া বেগমের বাসায়। রোকেয়া বেগমের বাসা পিরোজপুরের রাজারহাট এলাকায়। রোকেয়া বেগম থাকেন তাঁর মায়ের বাসায়। মায়ের অবর্তমানে তিনি ভাইবোনদের আগলে রেখেছেন মাতৃস্নেহে। রোকেয়ার বাসার পশ্চিম পাশে বলেশ্বর নদী। এই বলেশ্বর নদীর পাড়ে ছিল একাত্তরের আর একটি বধ্যভূমি।
রোকেয়া বেগম হেনা ১৯৫২ সালের ১৭ জানুয়ারি তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমা সদরের রাজারহাট মহল্লায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হাবিবুর রহমান এবং মা আমেনা বেগম। চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে রোকেয়া বেগম দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা করতেন, গান শিখতেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকতেন।
একাত্তরে ম্যাট্রিক পাশ করেন। রোকেয়া বেগম হেনা ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। পিরোজপুরে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে তিনি নিয়মিত যোগ দিতেন। পাকিস্তানিদের শাসন ও শোষণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল হেনার।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের পর থেকেই পিরোজপুরের সকল স্তরের জনগণের মধ্যে অভূতপূর্ব জাগরণ শুরু হয়। ১০ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বাঁশের লাঠি ও লোহার বল্লম হাতে নিয়ে মাথায় লালটুপি পরে মুক্তির আন্দোলনে প্রস্তুত হিসেবে মিছিল বের করে। মিছিলে অন্যান্য মেয়েদের সাথে রোকেয়া বেগম হেনা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মার্চের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘মার্চের প্রতিটি দিনে আমাদের কোনো না কোনো কর্মসূচি ছিল। ২২ মার্চের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা ঘরে বসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করে এবং ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। ২৩ মার্চ প্রথম পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ওমর ফারুক। একই দিনে সারা পিরোজপুর সদরে সকল দোকানে উত্তোলন করা হয় প্রথম পতাকা।’ নিজের বাড়িতেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন রোকেয়া।
ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে ২৫ মার্চ পরে পাকসেনাদের ‘প্রতিরোধ প্রস্তুতি’ হিসেবে পিরোজপুরে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। কার্যত এই প্রতিরোধ প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। পাকবাহিনীর অত্যাচার থেকে পিরোজপুর এলাকাকে রক্ষা করার জন্য ২৮ মার্চ ছেলেদের জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেদের পাশাপাশি একই সময়ে পিরোজপুর শহর ও পাশের গ্রামগুলো থেকে মেয়েদেরকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য বাছাই করা হচ্ছিল। প্রথম ব্যাচে বাছাইকৃত ২০জনের মধ্যে রোকেয়া বেগম হেনা অন্তর্ভুক্ত হন । তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য এই বাছাই প্রক্রিয়া এবং প্রশিক্ষণের সার্বিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা এমএ মান্নান, আলী হায়দার খানসহ অনেকে। একাত্তরের ২৯ মার্চ রোকেয়ার প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
পিরোজপুর ওয়াপদা স্কুলের মাঠে (বর্তমান পানি উন্নয়ন বোর্ড) তাঁদের প্রশিক্ষণ হয়। প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল পিটি, প্যারেড, গ্রেনেড নিক্ষেপ, রাইফেল চালানো এবং বিভিন্ন বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার। মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক ও মুক্তিযোদ্ধা সফিউদ্দিন তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন। আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি তিনি নার্সিং প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন । নার্সিং প্রশিক্ষণ দেন ডা. শ্যামাচরণ সাহা এবং ডা. মমতাজ উদ্দিন। একমাস তাঁদের প্রশিক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলে। প্রশিক্ষণ শেষে সংগঠিত হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা।
৪ মে ১৯৭১ পাকসেনারা পিরোজপুরে আসে। পাকবাহিনী হুলারহাট লঞ্চঘাটে নেমেই নির্বিচারে গুলি চালায় এবং বাড়িঘর ও দোকানে আগুন দেয়। ঐদিন পিরোজপুরের এসডিও ও এসপিওসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তাকে বলেশ্বর নদীর ধারে হত্যা করে। মানুষ হতবাক হয়ে পড়ে এই বীভৎস দৃশ্য দেখে।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা মাসব্যাপী পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল, পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের কাছে তা কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। পিরোজপুরে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে জুন মাসে রোকেয়া বেগম হেনা তাঁর পরিবারের সাথে স্বরূপকাঠি চলে যান। স্বরূপকাঠি থেকেও তিনি নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করেন। ওই সময় ছালাম নামে এলাকায় পরিচিত এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সন্ধান পান। পরিবারের সকল বাধা উপেক্ষা করে হেনা ও তাঁর বোন শিরিন কমান্ডার ছালামের নিকট যান এবং ইতোপূর্বে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও প্রশিক্ষণের বর্ণনা দেন। কমান্ডার ছালাম রোকেয়ার আগ্রহে খুশি হন এবং তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের অনুমতি দেন। ছালামের অনুমতি পেয়ে রোকেয়া বেগম হেনা নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। মূলত ইনফরমার হিসেবে কাজ শুরু করেন হেনা। তিনি বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অস্ত্র গোলাবারুদ এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে আনা-নেয়ার কাজ করতেন। মাঝে মাঝে তিনি আহতদের সেবা- শুশ্রূষাও করেছেন। তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব অতিশয় গুরুত্বের সাথে পালন করতেন তিনি। দায়িত্ব পালনের জন্য কমান্ডার আঃ ছালাম বহুবার তাঁকে প্রশংসা করেছেন। হেনা পরে জানতে পারেন এই আঃ ছালামই ছিলেন সিরাজ শিকদার।
দেশের স্বাধীনতার পর পিরোজপুরে চলে আসেন হেনা। একদিকে লাশের গন্ধ, মৃত্যু, কান্না অন্যদিকে বিজয়ের আনন্দ! একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আমরা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি। আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তবে এতটুকুই চাই যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বেড়ে ওঠে।’
১৯৭৪ সালে রোকেয়া পিটিআই পাশ করেন এবং পিরোজপুর সদরে একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে ৪ আগস্ট কাউখালী থানার চিরাপাড়া ইউনিয়নের সুবিতপুর গ্রামের খলিলুর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে এক ছেলের মা। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তিনি নাম লেখানোর ব্যাপারে অতীতে কখনো আগ্রহ প্রকাশ করেন নি, বর্তমানেও করেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলে গর্ববোধ করেন।