রোকেয়া বেগম (পঞ্চগড়)

পঞ্চগড় চিনির মিল কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জনাব ইয়াসিন আলী ভূঞার নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগমের খোঁজে পঞ্চগড়ে যাই। প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যমণ্ডিত পঞ্চগড় আম ও লিচু বাগানে শোভিত। মাঠে প্রচুর আখ। ঢাকা থেকে দেবীগঞ্জে গিয়ে পৌছাই রাতে। সেখানে রাতে থেকে পরদিন কুয়াশাঘেরা সকালে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা হই। রাস্তার দু’পাশে প্রশিকার লাগানো নানাজাতের ফলজ ও বনজ বৃক্ষ। রাস্তার দু’পাশে অড়হর ও কলাইয়ের ক্ষেত। রবিশস্যের প্রাচুর্যে ভরপুর প্রকৃতি। দেখে নয়ন জুড়িয়ে যায়। মনের অজান্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একাত্তর। এই অনাবিল সৌন্দর্যের লীলাভূমি, আমার সোনার বাংলাদেশকে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা রণক্ষেত্র বানিয়েছিল। সীমাহীন শোষণ, নির্যাতন এবং অসম অর্থনীতির মুক্তির জন্য দামাল ছেলেমেয়েরা মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পুরুষের পাশাপাশি রোকেয়া বেগমও মুক্তিযুদ্ধেযোগ দেন।

রোকেয়া বেগম ১৯৫৫ সালের ৫ মে, পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থানার তীরনইহাট ইউনিয়নের মনিগঞ্জ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভী আঃ রহিম এবং মা সোমিরন নেছা। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকে তিনি রোগাটে এবং শান্ত প্রকৃতির ছিলেন । বৃদ্ধ বাবা তাকে ভীষণ আদর করতেন এবং লেখাপড়ার জন্য উপদেশ দিতেন। মনিগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি ৫ম শ্রেণী এবং শালবাহান হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ৮ এপ্রিল ১৯৬৮ সালে ময়মনসিংহ জেলার মোসলেম উদ্দিনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। একাত্তরে ষোড়শী রোকেয়া স্বামীর নিকট থেকে পাকিস্তানিদের বর্বরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে পাকবাহিনী তাদের এদেশের দোসরদের সহযোগিতায় ব্যাপক ধ্বংসযোগ্য চালাতে শুরু করলে রোকেয়া বেগম তাঁর স্বামীর সাথে ভারতে চলে যান। তাঁর স্বামী একাত্তরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। মোসলেমউদ্দিন ছিলেন স্বাধীনতার সপক্ষে একজন মুক্তিপাগল মানুষ। পাকিস্তানিদের শোষণ- নির্যাতনের কথা বিভিন্ন সময়ে পরিবারের সকল সদস্যদেরকে বলতেন। মোসলেমউদ্দিন আরো বলতেন, ‘ওরা আমাদের ছাড়বে না, পারলে জীবনে মারবে।’ ভারতে যাবার পথে ইয়াসিন নামক এক পুলিশ সদস্যের সাথে তাঁদের পরিচয় হয় । ইয়াসিন সাহেব রোকেয়া ও তাঁর স্বামীকে ডা. আতিয়ার রহমানের নিকট নিয়ে যান, জলপাইগুড়ি জেলার দেবগ্রাম শরণার্থী ক্যাম্পে। ডা. আতিয়ার রহমানের সহযোগিতায় প্রথমে শরণার্থী ক্যাম্পে এবং পরে মে মাসের প্রথম দিকে রোকেয়া বেগম সেবিকা হিসেবে অস্থায়ী হাসপাতালে যোগ দেন।

ডা. আতিয়ার রহমানের নিকট থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন । এই প্রশিক্ষণ হয় হাতে-কলমে । নার্সিং প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গ্রেনেড ছোড়া ও বিভিন্ন বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন তিনি। আগ্নেয়াস্ত্রের এ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় পাকিস্তানবাহিনী বা রাজাকারদের আক্রমণের যে- কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। ১৫ দিনের একটা প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করে তিনি কাজ শুরু করেন তেঁতুলিয়া অস্থায়ী হাসপাতালে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তেঁতুলিয়া এলাকা ছিল তখন শত্রুমুক্ত।

দিনে আহত মুক্তিযোদ্ধারা আসত। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হতো অস্থায়ী হাসপাতালে। তাঁদের অবস্থা বেশি খারাপ হলে সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হতো। সেবিকা হিসেবে তিনি সাধারণত ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা, ব্যান্ডেজ করা, ইনজেকশন পুশ করা, সময়মতো ঔষধ খাওয়ানোর কাজ করতেন। এছাড়া ছোট অপারেশনের ক্ষেত্রে তিনি ডাক্তারদের সাথে থাকতেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো পাঁচ মাস চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন তিনি। সেবিকা হিসেবে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রশংসিত হন।

হাসপাতালে কর্মরত সময়ের অনেক স্মৃতি আজও তাঁকে ব্যথিত করে তোলে। এমন একটা ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি । তিনি বলেন, ‘অস্থায়ী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে একটা ঘটনা আজও আমাকে নাড়া দেয়। ঠাকুরগাঁয়ের একটি ছেলের বোমার আঘাতে একটা পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাকে তেঁতুলিয়া অস্থায়ী হাসপাতালে তাৎক্ষণিকভাবে আনা হয়। আহত ছেলেটির বয়স ১০-১২ বৎসর হবে। অচেতন অবস্থায় ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ৪-৫ ঘণ্টা পরে ছেলেটির জ্ঞান ফেরে কিন্তু তাঁর মুখে কোনো ভাষা নেই। শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চোখে তার শত জিজ্ঞাসার চিহ্ন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার জ্ঞান হারায়। ছেলেটাকে ব্যান্ডেজ করার সময় আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে। আমি জানি, এই পা আর জোড়া লাগানো যাবে না। ছেলেটি চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল। ব্যান্ডেজ করার পরে রক্ত বন্ধ করা গেল না। উপায় না দেখে তাকে ঠাকুরগাঁ হাসাপাতালে পাঠানো হলো। কারণ ঠাকুরগাঁ তখন স্বাধীন হয়েছে এবং চিকিৎসার মানও ভালো। ঘটনাটি মনে হলে আজও আমি শিউরে উঠি। আহত ছেলেটিকে দেখতে আমি ঠাকুরগাঁ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। যুদ্ধে পুনরায় যোগদানের জন্য ছেলেটির ব্যাকুলতা সেদিন যে দেখেছি তা ভুলবার নয়।’

রোকেয়া কখনো ভাবতে পারে নি, দেশ এত দ্রুত স্বাধীন হবে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সবাই যার যার ঘরে ফিরেছে। রোকেয়াও তার ঘরে ফিরেছেন। ১৯৭৮ সালের ২৩ আগস্ট রোকেয়া এক কন্যাসন্তানের মা হন। তিরস্কার ও গ্লানি নিয়েও সংসার করতে চেয়েছিলেন রোকেয়া কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্যে তার সুখ সইল না। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে ৩১ আগস্ট ১৯৭৯ সালে। একাত্তরে সেবিকার অভিজ্ঞতা তাকে পঞ্চগড় চিনিকলে চাকুরি পাইয়ে দিতে সহায়তা করল। আর সে অবদি পঞ্চগড় চিনি মিল হাসপাতালে সেবিকা হিসেবে কর্মরত আছেন রোকেয়া।

রোকেয়ার মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তাঁর জামাই- মেয়ে দুজনেই গর্বিত। রোকেয়াকে তারা ভীষণ শ্রদ্ধা করে।

মুক্তিযুদ্ধের ৩৩ বছর পর তার মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, “আজ নকল মুক্তিযোদ্ধারা আসল মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে নিগৃহীত। আমার আহ্বান সরকার ও সমাজের নিকট— এ যুগের ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর ব্যবস্থা করুন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করুন।’ মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভীষণভাবে গর্বিত রোকেয়া। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বামীর সংসার সবই এখন রোকেয়ার নিকট স্মৃতি, শুধুই স্মৃতি।

error: Content is protected !!