‘মেডিটেশন’, ‘রিল্যাকসেশান’ বা ‘স্বসম্মোহন’ যে নামেই ডাকুন, সব একই ।
রিল্যাকসেশান করার প্রয়োজন তাঁদের, যাঁরা অত্যন্তবেশি রকমের মস্তিষ্কচর্চা করেন। হতে পারেন, তাঁরা রাজনীতিক, বহুজাতিক সংস্থার কর্তা-ব্যক্তি, বিজ্ঞানী, লেখক, চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ইত্যাদি। মস্তিষ্কচর্চাকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি দিয়ে মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে মেডিটেশন করা অবশ্যই ভালো।
কীভাবে মেডিটেশন বা রিল্যাকসেশান করবেন
মেডিটেশন বা রিল্যাকসেশানের সময় বাছুন এমন, যখন নিস্তব্ধ। বাইরের দুম-দাম আওয়াজ বা গাড়ি যাতায়াতের হর্ন ও আওয়াজ বিঘ্ন ঘটাবে না। আপনি যেখানে থাকেন, সেখানে পরিবেশটাই নিরিবিলি। এমনটাও আদর্শ পরিবেশ।
পোশাক হবে অত্যন্ত ঢিলে-ঢালা। অন্তর্বাসকে বিদায় দিন। দেখবেন, পোশাক যেন আরামদায়ক হয় ।
বিছানা হবে আরামদায়ক এবং অবশ্যই ধোপদুরস্ত। চাদর সাদা অথবা হাল্কা রঙের হলে ভালো হয়। মাথার বালিশ হবে অল্প উঁচু। পাশ বালিশ চলবে না। মশারি চলবে না। মশার উপদ্রব থাকলে জানলায় নেট লাগান। মশা তাড়াবার জন্য ধূপ না ব্যবহার করে লিকুইড ব্যবহার করুন। এতেও মশা না গেলে সাদা, উঁচু, নাইলনের মশারি টানাতে পারেন।
রিল্যাকসেশানের ঘরে আসবাবপত্রের ভিড় লাগাবেন না। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন ঘর রিল্যাকসেশানের পক্ষে আদর্শ।
ঘরে হালকা রঙের নাইটল্যাম্প জ্বালতে পারেন। নাইটল্যাম্প এমনভাবে লাগাবেন, যাতে আপনি বিছানায় শুলে ল্যাম্পের আলো চোখে না পড়ে।
লো ভলিউমে, মনকে আরাম দেওয়ার মতো ক্যাসেট বা সিডি বাজতে দিন। বাজাবেন রিল্যাকসেশান শুরু হওয়ার সামান্য আগে থেকে।
ঘরের বাইরে জুতো ছেড়ে আসুন। চোখে-মুখে ভালো করে জল ছিটিয়ে আসুন। খুবই ভালো হয় স্নান সেরে রিল্যাকসেশান করলে।
শুধুমাত্র নাইটল্যাম্পটা জ্বালুন। মিউজিক চালিয়ে দিন। হালকা পোশাক পরে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। শোয়ার আগে দরজাটা বন্ধ করে দিন। ল্যান্ডফোন ও মোবাইল বন্ধ রাখুন।
বালিশে মাথা রেখে চিত হয়ে শোবেন। দু’পায়ের মধ্যে ফাঁক থাকবে এক ফুটের মতো। হাত দুটো পায়ের দিকে লম্বা করে রাখুন। হাত থাকবে শরীর থেকে সামান্য দূরে। অর্থাৎ শরীরে হাত ছুঁয়ে আড়ষ্ট হয়ে শোবেন না। একদম রিল্যাক্স মুডে শোবেন।
চোখ বন্ধ করুন। এবার এক মনে ভাবতে থাকুন, আপনার ঘুম পাচ্ছে। ঘু…ম পাচ্ছে। চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে যাচ্ছে। চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুম। ঘুম আসছে। ঘু…ম…। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। এভাবে চিন্তা-শূন্য হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে আপনার ভালো লাগছে। আপনার কপালের চিন্তার রেখাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। কপালের পেশিগুলো নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনার গালের পেশি নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনার চোয়ালের পেশি নরম, শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। ঘু…ম…।”
“আপনার চোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। দু’চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুম। আপনার ডান কাঁধটা নিয়ে ভাবুন। ডান কাঁধের পেশি শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। আপনার ডান কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত পেশিগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত ভাবুন। কনুই থেকে কবজির পেশিগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। হাতের তালু ও আঙুলগুলোর পেশি শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতটা ভারী হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ডান হাতটা ভারী হয়ে গেছে।”
একইভাবে বাঁ কাঁধ থেকে সাজেশন দেওয়া শুরু করে হাত ভারীতে শেষ করুন। “আপনার বুকের কথা ভাবুন। বুকের পেশিগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে।”
“আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ ধীরে ও গভীরভাবে হচ্ছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
এভাবে চিন্তা-শূন্য হয়ে ঘুমোতে আপনার ভালো লাগছে।”
“আপনার পেটের পেশিগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে।”
“আপনার কোমরের পেশি শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে।”
“ডান পায়ের থাইয়ের পেশি নিয়ে ভাবতে থাকুন। থাইয়ের পেশি শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পায়ের কাফের পেশি নিয়ে ভাবুন। পেশিগুলো শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পায়ের পাতা ও আঙুলগুলোর পেশি শিথিল, নরম হয়ে যাচ্ছে। ডান পা’টা ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভারী হয়ে বিছানার উপর পড়ে আছে।”
একইভাবে বাঁ পা নিয়ে সাজেশন দিতে থাকুন৷
যে কথাগুলো ভাবতে বললাম, সে কথাগুলো তিনবার করে ভাবতে থাকুন।
এবার আপনি ভাবতে থাকুন, চিন্তা-শূন্য হয়ে এভাবে পড়ে থাকতে ভালো লাগছে। এক চিন্তা-ভাবনাহীন আনন্দের জগতে আপনি এখন আছেন। আনন্দ…আনন্দ…শুধুই আনন্দ…। এ হল ‘মেডিটেশন’ বা ‘রিল্যাকসেশান’।
আপনি এমন ভাবতে ভাবতে, আধা ঘুম আধা জাগরণের অবস্থা থেকে একসময় পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। অথবা ধীরে ধীরে জেগে উঠতে পারেন। স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে যা হতে চায় তাই হতে দিন। যতক্ষণ বিশ্রাম নিতে চায় নিতে দিন। কখনই জোর করে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করবেন না।
এই যে এতক্ষণ আপনি মনে মনে ভাবলেন–ঘুম পাচ্ছে থেকে পেশিগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি, এই ভাবনা আপনার মস্তিষ্ক কোষে এই ধারণাগুলো সঞ্চার করছে। এই ধারণা সঞ্চারকেই বলে ‘সাজেশন’।
শিথিলায়নের সাজেশন হবে পা থেকে মাথায় নয়, মাথা থেকে পায়ে
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে ঘুম। হাইপোথ্যালামাসকে ঘুমের বিষয়ে সাহায্য করে চোখ, পিনিয়াল গ্রন্থি ও পন্স ।
চোখের রেটিনা থেকে হাইপোথ্যালামাস খবর পায় দিন কি রাত। ঘুমের জৈব ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে তখন হাইপোথ্যালামাস কাজ করতে শুরু করে।
পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে ‘মেলাটনিন’ হরমোনের নিঃসরণ হতে শুরু হলে আমাদের ঝিম আসে, আধা-জাগরণ আধা-ঘুমের মতো অবস্থা আসে। তারপর আসে ঘুম।
পন্স পশ্চাত মস্তিষ্কে সংকেত পাঠিয়ে সুষুম্নাকাণ্ডকে তার কাজকর্মকে কমিয়ে দিতে সংকেত পাঠায়। ফলে হার্ট রেট, পাল্স রেট, ব্লাডপ্রেশার, শ্বাস-প্রশ্বাসের ডিউরেশন কমে যায় ।
আমরা যখন ঘুমোতে শুরু করি তখন মস্তিষ্কের কাছাকাছি পেশিগুলো শিথিল হতে থাকে। মুখের পেশি শিথিল হওয়ার জন্য অনেকের মুখ থেকে লাল গড়ায়। মুখের পরেই ঘাড়, পিঠ, বুক, হাতের উপরের দিকের পেশি, হাতের নিচের দিকের পেশি, হাতের পাতা, পেটের পেশি, পায়ের পেশি এবং তারপর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পেশিগুলো শিথিল হতে থাকে।
তাই রিল্যাকসেশানের সময় পেশিগুলো শিথিল হওয়ার সাজেশন দেওয়া হয় চোখ থেকে পায়ের দিকে। পা থেকে চোখের দিকে নয়।
মেডিটেশনে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ বিশ্রাম পায়। সঙ্গে দেহের স্নায়ুকোষ, শরীরের বিভিন্ন পেশি বিশ্রাম পায়। টেনশন, উত্তেজনা বা উদ্বেগ দূর হয়। রক্তচাপ বৃদ্ধি স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে। উদ্বেগ বা টেনশন থেকে ব্লাডসুগার ও হাঁপানি হয়ে থাকলে তার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। শরীর ক্লান্তিহীন ও ঝরঝরে লাগে।
যোগী-সন্ন্যাসী-স্বামীজি-মাতাজিরা যেভাবে যোগকে, মেডিটেশনকে রহস্যময় করে রেখেছেন, আসলে আদৌ তেমন নয়। বরং অত্যন্ত সরজ-সরল একটি পদ্ধতি।
অনেকেই আছেন, যাঁরা সহজ-সরল পদ্ধতির চেয়ে কঠিন,
অবোধ্য বিষয়ের দিকে আকর্ষিত হন বেশি। জ্ঞানী কিন্তু
সহজ-সরল মানুষের মুখোমুখি হলে জ্ঞানী মানুষটির
বিষয়ে আমাদের মনে তৈরি হওয়া
মুগ্ধতা মুহূর্তে খসে পড়ে।
ঘ্যামওয়ালা, দূরত্ব বজায় রাখা মধ্যমেধার মানুষকে নিয়ে মাথায় তুলে নাচি ৷ এটা আমাদের মূল জাতীয় চরিত্র। সুতরাং আমরা সহজ-সরল রিল্যাকসেশান তত্ত্বকে ছেড়ে যোগীদের পিছনে দৌড়তেই ভালোবাসি। এই জাতীয় ঐতিহ্যকে আমরা কি বিসর্জন দিতে পারবো? সাদাকে ‘সাদা’ এবং কালোকে ‘কালো’ বোঝার ও বলার মতো মেধাশীল ও সাহসী হতে পারবো?
সময়ই তা বলে দেবে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে—রিল্যাকসেশান, মেডিটেশন বা যোগ আসলে যাকে বলা যায় ‘রিল্যাকসেশান’, তা পাশ্চাত্যের কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য যতটা প্রয়োজন, আমাদের মতো আয়েশি, অলস প্রজাতির জন্য ততটা নয়। খেটে খাওয়া দীন মজুরদের ব্যায়ামের কোনো অভাব হয় না। তারা দিনের শেষে পেট ভরে খেয়ে টেনে ঘুম দিলেই তাদের রিল্যাকসেশান হয়ে যায়। শহুরে মানুষরা যাঁরা বসে কাজ করেন, কাজের ফাঁকে আড্ডা, ক্যারাম, পরচর্চা চলে, তাদের দরকার স্রেফ ব্যায়াম। জগিং অথবা কোনো আখড়া বা ‘জিম’-এ গিয়ে সঠিক ঘাম-ঝরানো ব্যায়াম। মিতাহারী না হলে রোগভোগ নিশ্চিত। বাকি রইল প্রচুর মাথার কাজ, পড়াশোনা, কম ঘুম, কাজের চাপ, টেনশন এর শিকার আধুনিক শিক্ষিত প্রজন্ম এবং বিভিন্ন সংস্থার বড় সাহেব বা রাজনৈতিক নেতারা। তাঁদেরই সত্যি দরকার, মানসিক টেনশন কমাতে ও শরীর ঠিক রাখতে হালকা ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন নামক রিল্যাকসেশান পদ্ধতি।
মনে পড়ছে খুশবন্ত সিংহের একটা কথা। উনি বলেছেন—“Work is worship but worship is not work” অর্থাৎ কর্মই সাধনা, কেবলমাত্র সাধনা বা পুজো কোনো কর্ম নয়।
ধর্মের নামে মনকে চিন্তাশূন্য, নির্লিপ্ত করা একটা
বোকামি, কারণ পৃথিবীর যত মহান কাজ—শিল্প,
সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার—সবেরই মূলে
আছে চঞ্চল, কৌতূহলী, জিজ্ঞাসু মন।
মনকে স্থবির, অনড় করে ধ্যান বা যোগসাধনা করার মধ্যে মহৎ কিছু দেখতে পান না এই নব্বই-উত্তীর্ণ রসিক সাংবাদিক, যাঁর লেখার ধার, স্মৃতিশক্তি, মেধা, বুদ্ধি আমাদের এখনো অবাক করে।
পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?
পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ
অধ্যায়ঃ এক
♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ Hysterical neurosis – Conversion type
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)
পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ