২রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও তার সঙ্গীরা প্রতিবিপ্লবী ক্যু’দাতা ঘটাবার চেষ্টা করে

১৯৪৬ সালে জন্ম। বি. এস. সি গ্রাজুয়েট। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তিনি বিমান বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতেই সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যে দলটি সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল তিনি ছিলেন তাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও কৃতিত্বের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় তার অবদান উল্লেখযোগ্য।

শেখ মুজিবের স্বৈর শাসনকালে ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার নং ৯ (PO-9) এর প্রয়োগে তিনি চাকুরিচ্যুত হন। ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর তাঁকে সেনাবাহিনীতে পুর্ণঃনিয়োগ করা হয় এবং লেঃ কর্ণেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত হবার পর গণচীনে তাঁকে কূটনীতিক হিসাবে প্রেরণ করা হয়। ১৯৮০ সালে লন্ডন হাই কমিশনের সাথে তিনি এ্যটাচড্ড হন। ১৯৮২ সালে কমিশনার হিসাবে হংকং এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রদূত হিসাবে কেনিয়ায় পোষ্টেড হন। একই সাথে তাঁকে তানজানিয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।

ইউনেপ ( UNEP) এবং হেবিটাট ( HABITAT) এ বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সোমালিয়ায় যুদ্ধকালীন সময়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অংশ হিসাবে প্রেরিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সার্বিক তত্ত্বাবধানের বিশেষ দায়িত্বও তিনি পালন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর লাভ করেন। এরপর দেশে ফিরে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বিবাহিত এবং এক কন্যার জনক। তার শখ হল বই পড়া, ভ্রমণ, খেলাধুলা এবং সঙ্গীত।

 

…সমসাময়িক ভাবনা

জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ এবং অব্যাহতি আইনসমুহ

এই অবিস্মরনীয় দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। তখন থেকেই দেশবাসী শ্রদ্ধার সাথে এই দিনটি উদযাপন করে আসছেন। শুধুমাত্র শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী-বাকশালীরা দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করতে অস্বীকার করে আসছেন বোধগম্য কারণে। এমনটি করলে তাদের অতীত ঐতিহাসিক ব্যর্থতাকে মেনে নিতে হয়। তেমন ঔদার্য্য দেখানো শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা কখনোই সম্ভব নয়।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে হিজাব ধারণ করে, হাতে তাসবিহ্ নিয়ে নিজেদের অতীত ভুলভ্রান্তির জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে দেশবাসীর কাছে ভোট ভিক্ষা করেন শেখ হাসিনা৷ ছলনাময়ী আচড়ন, অস্থায়ী সরকারাধীন প্রশাসনের দুর্রনীতিবাজ সুযোগ সন্ধানী একটি গোষ্ঠীর চক্রান্তের পরও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পেরে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে সমর্থ হন হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ; দীর্ঘ ২১ বছর পর। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পরমুহুর্তেই হিজাব ও তাসবিহ্ এর লেবাস পরিত্যাগ করে অল্প সময়ের মধ্যেই জনসম্মুখে শেখ হাসিনা এবং তার সহচরগণ স্বরুপে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটান। জনগণ বুঝতে পারেন আওয়ামী লীগে কোন পরিবর্তন তো হয়নিই বরং জিঘাংসা ও প্রতিহিংসা চিরতার্থ করার জন্য তারা জলার পেত্নীর চেয়েও আরো বেশি হিংস্র ও ভয়ংকর মহিরুহতে পরিণত হয়েছে। যার ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের রাহুগ্রাস থেকে দেশ ও নিজেদের বাচাঁবার জন্য জাতি আওয়ামী লীগকে ছুড়ে ফেলে দেয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। শোচনীয় পরাজয় ঘটে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের। ক্ষমতা গ্রহণের পরেই জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে উদযাপনের জন্য ঘোষিত সরকারি ছুটির দিন বাতিল করে দেয় আওয়ামী সরকার। সংবিধানের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে ১৫ই আগষ্টের জনসমর্থিত সফল বিপ্লবের নায়কদের বিরুদ্ধে শুরু করা হয় ‘মুজিব হত্যা’ ও ‘জেল হত্যা’ বিচারের প্রহসন।

৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় একটা বিরল ঘটনা। এমন ঘটনা জাতীয় ইতিহাসে ঘটে বিশেষ কোনো ক্রান্তিলগ্নে বিশেষ এক পটভূমিকায়। আজ অব্দি ৭ই নভেম্বর নিয়ে নানা ধরণের বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রচারণা করা হলেও কি ছিল এর পটভূমি? কোন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, কিসের বিরুদ্ধে, কাদের নেতৃত্বে ঘটেছিল এই অভ্যুত্থান সেই সম্পর্কে কিছুই বলা হয়না। দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবি মহলও এই বিষয়টিকে রহস্যজনকভাবে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন সতর্কতার সাথে৷

৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে দেশবাসী বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মকে অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানতে হবে কয়েকটি প্রশ্নের জবাবঃ-

কি উদ্দেশ্যে, কোন চেতনা প্রেরণা যুগিয়েছিল সেই অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটাতে?

অগ্রণীর ভূমিকায় ছিলেন কারা?

১। কেন ঘটেছিল সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান?

২। কি উদ্দেশ্যে, কোন চেতনা প্রেরণা যুগিয়েছিল সেই অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটাতে?

৩। কিসের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল বিপ্লব?

(৪) অগ্রণীর ভূমিকায় ছিলেন কারা?

এই প্রশ্নগুলির জবাব খুঁজে না পেলে জাতীয় সংহতি দিবস শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতাই হয়ে থাকবে। জাতীয় চরিত্রে এর মুল্যবোধকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা কখনোই সম্ভব হবে না। ৭ই নভেম্বরের চেতনা ও উদ্দেশ্য সম্পকে জানতে হলে ‘৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকেই শুরু করতে হয়।

২৫শে মার্চ ‘৭১ এর কালরাত্রিতে তদানীন্তন পাকিস্তানের অর্বাচীন সামরিক জান্তার নির্দেশে সামরিক বাহিনী যখন হায়নার মত নজিরবিহীন পাশবিক বর্বরতায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল তখন প্রস্তুতিহীন জাতিকে তোপের মুখে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবর রহমান স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব বরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপদ আস্তানায় পাড়ি জমান। যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি ছাত্র সমাজ ও আপামর জনগণের সব মিনতি ও অনুরোধ উপেক্ষা করে তার দলীয় নেতাদের প্রাণ বাচানোর জন্য পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান। জাতীয় প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার আকুতিকে শেখ মুজিব খারিজ করে দিয়েছিলেন এই বলে যে বন্দুকের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না। শেখ মুজিবের স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যগণ হলেন সরকারী অতিথি। তার এই ধরণের কাপুরুষোচিত বিশ্বাসঘতকতায় জাতি ক্ষণিকের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই সন্ধিক্ষনে সেনাবাহিনীর এক অজ্ঞাত তরুণ অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো কয়েকজন সমমনা তরুণ সহকর্মীদের পরামর্শে ও সহযোগিতায় চট্টলার কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জনগণের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার। জাতির প্রতি আহ্বান জানালেন প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার। তার সেই দিক নির্দেশিকার ফলেই সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যদের কেন্দ্র করে সকল স্তরের জনগণ গড়ে তুলেছিলেন দেশব্যাপী জাতীয় প্রতিরোধ। তারই পরিণতিতে গড়ে উঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম।

কিন্তু আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে ভারতের কর্ণধার চানক্য গোষ্ঠি। বন্ধুত্বের আবরণে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন চিরতার্থ করার জন্য প্রণয়ন করে সুদুরপ্রসারী এক নীলনকশা। মূল লক্ষ্য তাদের পরম শত্রু পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করে তার শক্তির ভিতকে দূর্বল করে ‘অখন্ড ভারত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চিরন্তন খায়েশ কায়েমের পরিকল্পনাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। একই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশকে তাদের করদ রাজ্যে পরিণত করা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সব কৃতিত্বের একক দাবিদার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর ভারতীয় সমর্থন ও অঙ্গিকারের পরিপ্রেক্ষিতে তদকালীন কোলকাতা নিবাসী অস্থায়ী প্রবাসী সরকার এবং পরবর্তীকালে মুজিব সরকার ভারতের সেবাদাসের ভূমিকা পালনের দাসখত লিখে দেয়। শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে এবং লাখো শহীদের রক্ত ও হাজারো মা-বোনের ইজ্জতের সাথে বেঈমানী করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ। শুধু কি তাই? ‘৭১ থেকে আজান্দি জাতিয় মুক্তি সংগ্রামের একচ্ছত্র দাবিদার বনবার নির্লজ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কব্জা করে দেশকে পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত করল মুজিব সরকার। মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং বাকশালী একদলীয় স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি এবং বিভিষিকায় আজো আতংকগ্রস্ত হয়ে উঠে বাংলার মানুষ।

শেখ মুজিবের উত্তরসূরী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তাদের বিগত ৫ বছরের অপশাসন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুজিব আমলের সেই বিভিষিকাময় ইতিহাসকেই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ভারত হয়ে ফেরার পথে সদ্য প্রসূত দেশের জন্য দুটো উপহার নিয়ে আসলেন।

১। তিনি ভারতীয় শাসনতন্ত্রের চারটি নীতিকে আমাদের শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভে প্রতিষ্টিত করলেন। হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্ফ’ এর অনুকরনে ‘মুজিববাদ’ নামক এক উদ্ভট রাজনৈতিক দর্শণ উদ্ভাবন করলেন। দেশবরেন্য রাজনীতি বিশারদ এবং চিন্তাবাদীদের কেউই তার সেই উদভট সৃষ্টিকে রাজনৈতিক দর্শণ হিসাবে স্বীকৃতি দিলেন না। বরং তারা ‘মুজিববাদ’ এর মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক এক নায়কত্বেরই পূর্বাভাষ দেখতে পান।

২। তিনি ভারতীয় জাতীয় সঙ্গিত রচয়িতার একটি কবিতাকেই পছন্দ করে সেটাকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিতের মর্যাদা দিলেন। এ ধরনের হঠকারিতা কার পক্ষে সম্ভব; একজন দেশ প্রেমিক না একজন দেশদ্রোহীর? এ বিচারের ভার থাকল স্বদেশবাসীর উপরই।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই চানক্যদের ওই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলন নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই। তাদের পক্ষে প্রবাসী সরকার ও শেখ মুজিবের সেবা দাসত্ব মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। তারা কখনোই শুধুমাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতার নামে ইসলামাবাদের গোলামীর পরিবর্তে দিল্লীর দাসত্ব মেনে নিতে পারেননি। তাদের চেতনা ছিলো সত্যিকার অর্থে স্বাধীন, সমৃদ্ধ, সূখী এক বাংলাদেশ। তাই স্বাধীনতা উত্তরকালে তারাই আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে গড়ে তোলেন সংগঠিত প্রতিরোধ সংগ্রাম। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শ্বেত সন্ত্রাসের জাতাকলে প্রতিপক্ষের শক্তিকে ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছিল সুপরিকল্পিতভাবে। তাদের বেশির ভাগই ছিল জানবাজ মুক্তিযোদ্ধা।

স্বাধীনতার পর মুজিব সরকার অনিচ্ছাসত্বেও বাধ্য হয় জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে। স্বৈরশাসনের স্বার্থে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে মুজিব সরকার এবং আওয়ামী লীগ কখনোই জনগণের বিরুদ্ধে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে পারেনি। এর মূল কারণ; বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গঠিত হয়েছিল পরিক্ষিত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান থেকে দীর্ঘ কারা নির্যাতন ভোগকারী সেনা সদস্যদের সমন্বয়ে। তাই যুক্তিগত কারণেই বিশ্বের অন্য কোন পেশাদার সামরিক বাহিনী থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর চরিত্র হল ভিন্ন প্রকৃতির। দেশ ও জনগণের স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য; কোন ব্যক্ত্যি, গোষ্ঠি কিংবা দলের কায়েমী স্বার্থ নয়। এর ফলে সামরিক বাহিনীকেও পরতে হয় মুজিব সরকারের রোষানলে। পরিণামে সেনাবাহিনীতেও সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে দুটি গোপন সংগঠন। ‘সেনা পরিষদ’ ও ‘গণবাহিনী’। জাতীয়তাবাদ ও দেশেপ্রেমের প্রশ্নে এই দুটি সংগঠন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী অন্যান্য সংগঠন-গ্রুপগুলোর অঙ্গীকার ছিল এক ও অভিন্ন। পার্থক্য ছিলো নীতি আদর্শের। সেনা পরিষদের আদর্শ ছিলো দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। গণবাহিনীর আদর্শ ছিলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আওয়ামী-বাকশাল শাসনামল ছিল বর্বরতার নজীরে পূর্ণ। হাজারো পৃষ্ঠায় তার বিবরণ শেষ হবার নয়। তবুও স্বৈরশাসনের একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হল।

আওয়ামী-বাকশালী শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেন। জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেন স্বৈরতান্ত্রিক এক দলীয় বাকশালী শাসনের জোঁয়াল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারসহ সকল রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। সরকারি নিয়ন্ত্রনে মাত্র ৪টি দৈনিক রেখে বাকি সব প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিচার বিভাগের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়ে বিচার বিভাগকে প্রশাসনের অধিনস্থ করা হয়। এভাবেই আইনের শাসনের কবর রচিত হয়। আওয়ামী- বাকশালী শাসনামল ছিল মূলতঃ হত্যার ইতিহাস, নারী নির্যাতনের ইতিহাস, লুণ্ঠনের ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস, চোরাচালানের ইতিহাস, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পায়ের তলায় লুটিয়ে দেবার ইতিহাস, জাতীয় অর্থনীতিকে বিকিয়ে দেবার ইতিহাস, রক্ষীবাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাসের ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও লাখো শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানীর ইতিহাস। রাষ্ট্রীয়করণের নামে আওয়ামী লীগ ব্যাংক, বীমা, মিল, কল-কারখানায় হরিলুট করেছিল। দেশে সম্পদ পাচাঁর করার জন্য সীমান্তকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আওয়ামী শাসনামলে অবাধ লুটপাটের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে ‘তলাহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের আমলে বিদেশী সাহায্যের বেশিরভাগ মালই ভারতের কোলকাতা ও বিশাখা পাট্টম বন্দরে খালাস পেতো৷ একাত্তরের যুদ্ধ আর ধ্বংসযজ্ঞের পর বাহাত্তরে কোন দুর্ভিক্ষ না হয়ে আওয়ামী লীগের শাসন ও শোষণের ফলে ‘৭৪-এ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকার তাদের শাসনামলে এ দেশের জনগণকে গণতন্ত্রের নামে দিয়েছিল স্বৈরাচার; সমাজতন্ত্রের নামে শুরু করেছিল সামাজিক অনাচার; বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে জাতিকে করেছিল বিভক্ত; আর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যুগিয়েছিল ধর্মহীনতার ইনদ্ধন।

এভাবে স্বৈর সন্ত্রাসের নাগপাশে সমগ্র জাতিকে আবদ্ধ করে শ্বাসরুদ্ধকর অসহায় অবস্থায় রাষ্টীয় সন্ত্রসের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সরকার বিরোধীদের সব শক্তি শেষ করে দেয়া হয়েছিল। সাংবিধানিক এবং গনতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের সব পথ বন্ধ করে দেয়ার লক্ষেই এসমস্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।

এভাবেই জাতির জীবনে নেমে আসে এক চরম হতাশা। চারিদিকে দেখা দেয় ঘোর অন্ধকার৷ প্রানভরে শ্বাস নিতেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরেছিল সাধারন জনগণ।

সেই সন্ধিক্ষনে আবারো শেখ মুজিবের জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতি সোচ্চার হয়ে উঠেন সেনাবাহিনীর আরেক তরুণ অফিসার বঙ্গ সার্দূল কর্ণেল জিয়াউদ্দিন। ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকালে সাপ্তাহিক হলিডে-তে কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি সরাসরি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। তিনি তার নিবন্ধে লেখেন, “Independence has become an agony for the people of this country. Stand on the street and you see purposeless, spiritless, lifeless faces going through the mechanics of life. Generally, after a liberation war, the new spirit carries through and the country builds itself out of nothing. In Bangladesh, the story is simply other way round. The whole of Bangladesh is either begging or singing sad songs or shouting without awareness. The hungry and poor are totally lost. The country is on the verge of falling into the abyss.”

নির্ভিক এই মুক্তিযোদ্ধা এই নিবন্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পঁচিশ বছরের গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন,

– We fought without him and won. If need be we will fight again without him.

১৫ই আগষ্টের বৈপ্লবিক পরিবর্তন যদি না হত তাহলে গণতন্ত্রের বধ্যভূমিতে আজকের শতাধিক রাজনৈতিক দলকে একদলীয় বাকশালের ধ্বজা বহন করেই বেড়াতে হত। এমনকি আওয়ামী লীগ নামক কোন দলেরও পুনর্জন্ম হত না। আওয়ামী-বাকশালীদের অনাসৃষ্টির জন্য বিধ্বস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ঘানি দেশবাসীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য টানতে হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র, গোলাবারুদ, স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু, যানবাহন, মিল-কারখানার মেশিনপত্র, কাঁচামাল ভারতের হাতে তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র জাতিকে প্রতিপক্ষ মনে করতে থাকে। এসমস্ত কিছুর পরও আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বাধীনতার সোল এজেন্ট বানাবার চেষ্টা করে আসছে নির্লজ্জভাবে। এসবের প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় দেশমাতৃকার অন্যতম সেরা সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল বীর উত্তম কে গ্রেফতার করা হয়েছিল; প্রাণ হারাতে হয়েছিল বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ও হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে। লাঞ্ছণার শিকারে পরিণত হতে হয় অনেক দেশপ্রেমিককে। ২৫ বছরের দীর্ঘমেয়াদী অসম চুক্তির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বন্ধক রেখেছিল আওয়ামী লীগই। লালবাহিনী, নীলবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, রক্ষীবাহিনীসহ ইত্যাকার নানা রকমের বাহিনী গঠনের দ্বারা দুঃসহ নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে বিনা বিচারে চল্লিশ হাজার রাজনৈতিক কর্মীর প্রাণ সংহার করার কালো ইতিহাস আওয়ামী-বাকশালীদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দী অবস্থায় রাজনৈতিক নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে নির্মমভাবে পাশবিক অত্যাচার করে হত্যা করার পর শেখ মুজিব স্বয়ং সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতার দম্ভে বলেছিলেন, “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?” ২৩/১/১৯৯২ তারিখে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ‘৭২ থেকে ‘৭৫ সালের আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসন প্রসঙ্গে জনাব মওদুদ আহমেদ বলেন,

“১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর দেশে জরুরী অবস্থা জারি করার পর ২৯শে ডিসেম্বর ভোরে আমাকে বিনা অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বন্দী করা হয়েছিল। অথচ সরকার আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই আনতে পারেনি সেদিন। এই তোফায়েল সাহেবই রক্ষীবাহিনীর ইনচার্জ ছিলেন। আর এই বাহিনীর হাতেই এ দেশের ৪০ হাজার নিরীহ মানুষ জীবন হারিয়েছে। সিরাজ সিকদারের হত্যার কথা আজো এ দেশবাসী ভুলে যাননি। ‘৭২ থেকে ‘৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট অব্দি আওয়ামী-বাকশালী শাসনকাল এ দেশের ইতিহাসে সবচাইতে কালো অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।”

জাতির আশা আকাংখাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সে ব্যবস্থা টিতে থাকেতে পারে না। জনসমর্থন ছাড়া কোন ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। জাতীয় বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকরা যখন জাতির কাঁধে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাতন্ত্রের বোঝা চাপিয়ে দেয়, জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয়, ব্যক্তি ও গোষ্ঠি স্বার্থ হাসিলের জন্য মীরজাফর বা রাজাকার-আলবদরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন তাদের অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন থেকে জাতিকে বাঁচানোর তাগিদে, তাদের দুঃশাসন উৎখাত করার জন্য দেশপ্রেমিকদের বিপ্লবের পথ অবলম্বন করতে হয়েছে যুগে যুগে। একই যুক্তিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বিপ্লব সংগঠিত করা হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের নেতৃত্বে। সেই বিপ্লব ছিল একটি সফল অভ্যুত্থান। দেশ ও জাতি মুক্তি পেয়েছিল দাসত্বের নাগপাশ ও স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে। বাকশাল সরকারের উৎখাত ও মোশতাক সরকারের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন এ কথাই প্রমাণ করেছিল জনগণের আশা আকাংখার সাথে বাকশালের কোন সম্পর্ক ছিল না৷ একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনসমর্থনও ছিল না। এমনকি আওয়ামী লীগের বৃহদাংশেরও সমর্থন ছিল না শেখ মুজিবর রহমানের একদলীয় স্বৈরশাসনের প্রতি। ১৫ই আগষ্টের অভ্যুত্থান স্বতঃস্ফুর্ত জনসমর্থন পেয়ে একটি জনপ্রিয় বিপ্লবে পরিণত হয়।

১৪ই আগষ্ট রাতে ঢাকা বিগ্রেডের নাইট প্যারেড তাই ১৫ই আগষ্ট সুবেহ্ সাদেক বিপ্লবের দিন ঠিক করা হল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে। বিপ্লবের শেষ পর্যায়ের সব প্রস্তুতি শেষ করে আল্লাহ্তা’য়ালার নাম নিয়েই বিপ্লব শুরু করা হল, প্রভাতের প্রথম প্রহরে সমগ্র জাতি তখন গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত। সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করা হল প্রথম প্রতিপক্ষের তরফ থেকেই। গুলিতে তিনজন বিপ্লবী শহীদ হলেন। শুরু হল পাল্টা আক্রমন। অল্প সময়ের মধ্যে সফল অভ্যুত্থানে ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন ঘটল। রেডিও বাংলাদেশের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হল, শেখ মুজিব সরকারের পতনের কথা। একই সাথে ঘোষণা করা হল, খন্দোকার মোশতাক আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। কারফিউ জারি করা হল দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। জনগণের কাছে আবেদন জানানো হল, বিপ্লবের সমর্থনে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য।

স্বৈরাচারী মুজিব সরকারের পতন ঘটেছে জানতে পেরে সমগ্র জাতি সেদিন স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিপ্লবকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে ঢাকার রাস্তায় লোকের ঢল নেমেছিল। জনগণ সারাদেশ জুড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলন স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে। মসজিদে মসজিদে লোকজন সেদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যদের জন্য বিশেষ দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেছিলেন। মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়ে গিয়েছিল মহল্লায় মহল্লায়৷ শেখ মুজিব ও তার দোসরদের জন্য সেদিন বাংলাদেশের জনগণ “ইন্নালিল্লাহে রাজেউন”। পড়তেও ভুলে গিয়েছিলেন। সবারই এক কথা, “দেশ জালিমের হাত থেকে বেঁচে গেছে।

বাকশালী শাসনে জনগণ ছিলেন অতিষ্ঠ। কিন্তু আওয়ামী-বাকশালী গোষ্ঠি যে এতটা ধিকৃত হয়ে উঠেছিল জনগণের কাছে সেটা উপলব্দি করতে পারা গিয়েছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর জনগণের অভূতপূর্ব ও স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনের বহিঃপ্রকাশে। বাংলাদেশের মানুষ জাতির ক্রানি-লগ্নে অতীতে সবসময় সঠিক রায় দিয়ে এসেছেন সেটাই তারা আরেকবার প্রমাণ করলেন ১৫ই আগষ্টের বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়ে। আগষ্ট বিপ্লবের নৈতিক বৈধতার প্রমান দেশবাসীর স্বতঃস্ফুর্ত সমৰ্থন।

১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল জাতীয় সংসদে মরহুম শেখ মুজিবের উপর একটি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। তখন দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মরহুম জিয়াউর রহমান এবং স্পীকার ছিলেন মির্জা গোলাম হাফিজ। কোন মৃত ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করতে গেলে প্রথাগতভাবে তার জীবন বৃত্তান্ত পড়ে শোনানো হয় এবং সংসদের কার্যবিবরণীতে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল শেখ মুজিবের উপর যে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় তা উত্থাপন করেন স্বয়ং মীর্জা গোলাম হাফিজ। তার পঠিত শেখ মুজিবের জীবন বৃত্তান্তের শেষ লাইনে বলা হয়, “১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।” (সংসদ কার্যবিবরণীর সংরক্ষিত দলিল। )

এটাই মূল কথা। শেখ মুজিবের মৃত্যু একটি সাধারণ হত্যাকান্ড নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু হয়েছিল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ায়। একই দিনে শেখ মুজিবের পতনের রাজনৈতিক দিকটি খুব পরিষ্কার ও স্বচ্ছ করে ব্যাখ্যা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। সেটা তিনি করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনুমোদনক্রমে। তিনি বলেছিলেন,

-১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে যে কুখ্যাত কালা কানুন পাস করে বাকশাল নামক একদলীয় স্বৈরাচারী জগদ্দল পাথর দেশের তৎকালীন ৮ কোটি লোকের বুকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল; সেটা ছিল একটা সংসদীয় ক্যু’দাতা। ঐ একদলীয় স্বৈরাচারী অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট সংগঠিত হয় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান।” (সংসদ কার্যবিবরণীর সংরক্ষিত দলিল। )

একই অধিবেশনে পরে তিনি ইনডেমনিটি বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। বিলটি ২৪১ ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হয়ে আইনে পরিনত হয়। ফলে ইনডেমনিটি আইন পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে সংবিধানের অংশে পরিণত হয়। এভাবেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ও নির্বাচিত সাংসদরা ১৫ই আগষ্টের বিপ্লবের স্বপক্ষে চূড়ান্ত ফয়সালা করে বিপ্লব ও বিপ্লব সংগঠনকারীদের সাংবিধানিক বৈধতা দান করেছিলেন।

আজঅব্দি অতিত এবং বর্তমান সরকার প্রদত্ত ইনডেমনিটিগুলোর সাংবিধানিক বৈধতা দান করার বিষয় সম্পর্কে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি এবং লিখিত প্রতিবেদন জনগনের সম্মুখে পেশ করা হয়েছে, পক্ষে ও বিপক্ষে। এর বেশিরভাগই অস্বচ্ছ এবং প্রশ্নবোধক। এইসব আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার দেখা যায় আওয়ামী লীগকে। বিশেষ করে দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে অতিমাত্রায় বিশেষভাবে বিষেদ্‌গার করে চলেছেন। আওয়ামীপন্থী কিছু চিহ্নিত বুদ্ধিজীবি ও ঐ কোরাসে একই সুরে তান তুলেছেন।

একজন সচেতন নাগরিক এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ইনডেমনিটি সম্পর্কে কিছু বিস্তারিত তথ্য পাঠকদের সম্মুখে তুলে ধরছি যুক্তিসঙ্গত কারণেই। কিছুটা হলেও এই তথ্যসমূহ জনমনে ধুম্রজাল সৃষ্টি করার যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকেই জাতীয় রাজনৈতিক প্রবাহে ঘটিত বিশেষ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে নিয়ে; সেই কথার মারপ্যাঁচের আচ্ছাদনের ভেতর থেকে সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারেন সেই প্রত্যাশায়।

ইনডেমনিটি শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘ক্ষতিপুরন থেকে আইনি অব্যাহতি প্রদান।’ এ ধরনের ইনডেমনিটি দেয়ার রেওয়াজ বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম চালু করা হয়নি। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কোন বিশেষ কার্যক্রম এবং তদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিশেষদের আইন আদালতের উর্দ্ধে রাখার জন্যই এই ধরনের আইন প্রণয়ন করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। আজকের বিশ্বে তথাকথিত সভ্যতার প্রতিক, পশ্চিমা দেশগুলি যারা বর্তমানে বিশ্ব পরিসরে মানবাধিকার- গণতন্ত্র ইত্যাদির একছত্র প্রচারক ও ধারক-বাহক হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছে তারাই এই ইনডেমনিটি দেবার রীতি চালু করেছে। শুধু তাই নয়, আজঅব্দি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেশের প্রচলিত আইনের আওতা বর্হিভুত রাখার রীতিটাও তাদেরই প্রণীত।

এই ধরনের ইনডেমনিটি প্রদানের নৈতিক ভিত্তি হচ্ছে বৃহত্তর রাষ্ট্রিয় এবং জাতীয় স্বার্থ যথা: একনায়কত্ব, স্বৈরশাসনের অবসান, বর্হিশক্তির আগ্রাসন থেকে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এই প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি ফেরানো যাক বাংলাদেশের প্রতি।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের সরকারই ইনডেমনিটি প্রবর্তনের ইতিহাস সৃষ্টি করে। ১৯৭২ সালে সরকারি এক অধ্যাদেশ জারি করে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সব কর্মকান্ড, ঘটনাবলী এবং যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়। এই আইন পাশ করানোর যুক্তিও ছিল রাষ্ট্রিয় এবং জনস্বার্থ। সামরিক স্বৈরশাসন, অন্যায়, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামকে আইনী বৈধতা দান করা হয়েছিল ঐ আইনের মাধ্যমে। ৬ই মে ১৯৭৪ শেখ মুজিবর রহমানের সরকার দ্বিতীয় ইনডেমনিটি আইন পাশ করেন কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী এবং তাদের সমস্ত পাশবিক কার্যক্রমকে আইনি বৈধতা দান করে।

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার প্রদত্ত প্রথম ইনডেমনিটির বিষয়ে জনাব আবদুল জলিল সাধারন সম্পাদক আওয়ামী লীগ বলেছেন, “১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত একটি ইনডেমনিটি আওয়ামী লীগ সরকার জারি করেছিল।” (দৈনিক যুগান্তর ১৩ই মার্চ ২০০৩)। বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও এই সত্যতা সংসদে স্বীকার করেছেন ১১ই মার্চ ২০০৩ প্রধাণমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে। কিন্তু তারা দুজনই রক্ষীবাহিনীকে দেয়া ইনডেমনিটি বিষয়টির ব্যপারে নিঃশ্চুপ থাকেন।

তৃতীয়বার ইনডেমনিটি জারি করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জনপ্রিয় বিপ্লবের পর। ১৫ই আগষ্ট ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশে সাময়িকভাবে জরুরি অবস্থা এবং মার্শাল ল’ জারি করা হয় ফলে রাষ্ট্রপতি খন্দোকার মোশতাক আহমদ ১৫ই আগষ্টের ঘটনাবলী এবং বিপ্লবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষদের এক অর্ডিনেন্স জারির মাধ্যমে ইনডেমনিটি প্রদান করেন। এই অর্ডিনেন্স জারি করার যুক্তিও ছিল জাতীয় ও জনস্বার্থ।

এক দলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনের নাগপাশে আবদ্ধ শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে জাতিকে মুক্ত করে দেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন পূণঃ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষেই সংগঠিত হয়েছিল ১৫ই আগষ্টের বিপ্লব। এরই ধারাবাহিকতায় ৩রা নভেম্বর জাতীয় স্বার্থ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক ক্যু’ ঘটায়। বন্দী করা হয় আগষ্ট বিপ্লবের পর সেনা পরিষদের প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট খন্দোকার মোশতাক আহমদকেও। এই প্রতি বিপ্লবী ক্যু’ দাতার উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও জাতিকে ১৫ই আগষ্টের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পূর্ব্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসনের পুনঃ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে চক্রান্তকারীদের সব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয় ৭ই নভেম্বরের মহান সিপাহী-জনতার বিপ্লব চক্রান্তকারী নেতাদের কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে ক্ষিপ্ত সিপাহী-জনতার হাতে। অন্যদের বন্দী করা হয়। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবে অগ্রণীর ভূমিকায় ছিলেন ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যরাও। যার ফলে যুক্তিগত কারণেই সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদে প্রেসিডেন্ট খন্দোকার মোশতাক আহমদের জারিকৃত ইমডেমনিটি অধ্যাদেশের পরিসীমা বর্ধিত করে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রম ও তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষদের স্বার্থে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সংশোধিত ইনডেমনিটি বিলটি সংসদে পাশ করানোর ফলে উক্ত ইনডেমনিটি আইন হিসাবে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর অংশে পরিগনিত হয় ১৯৭৯ সালে। এই ঐতিহাসিক আইনটি প্রণয়ন করেছিল শহীদ জিয়ার নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত তৎকালিন বি.এন.পি সরকার।

২০০১ সালের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশের ও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বি.এন.পি এর নেতৃত্বে জোট সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্ট সার্বিক নৈরাজ্য ও ভেঙ্গে পড়া আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামরিক প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনে আনতে ব্যর্থ হয়ে জাতির প্রতি অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে জোট সরকার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে পরিক্ষিত দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে নিয়োগ করে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা করার জন্য। ফলে অতি অল্প সময়ে সারা দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। যার ফলে শান্তিপ্রিয় আপামর জনসাধারন অভিনন্দন জানান ‘ অপারেশন ক্লিনহার্ট’-কে।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ করিয়ে আইনে পরিনত করা হয়েছে তৃতীয় ইনডেমনিটি বিলটি। এ ক্ষেত্রেও প্রেক্ষাপট জাতীয় এবং জনস্বার্থ।

দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি ইনডেমনিটি বিলটির বিষয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও প্রথম এবং দ্বিতীয় ইনডেমনিটি সম্পর্কে নিশ্চুপ থেকে তৃতীয় এবং চতুর্থ ইনডেমনিটি আইন দুইটির বিরুদ্ধে জোর গলায় সোচ্চার হয়ে নানা ধরনের উদ্ভট অযৌক্তিক প্রচারনায় মেতে উঠেছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা বি. এন. পি নেতৃত্তাধীন জোট সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে। শুধু কি তাই?

১৯৯৬ এর নির্বাচনের পর ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়েই সংবিধান কিংবা প্রচলিত আইনের বিধি বিধানের কোন তোয়াক্কা না করে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর অংশ ১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে প্রদত্ব ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে ‘মুজিব হত্যা বিচার’ এবং ‘জেল হত্যা বিচার’ এর প্রহসন শুরু করে চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দেয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের সংবিধান বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আদালতের শরনাপন্ন হলে, সরকার মনোনিত কয়েকজন আওয়ামী পন্থী আইনজীবির দ্বারা গঠিত একটি ‘এমিকাস কিউরি’ সৃষ্টি করে সরকারের পক্ষে বক্তব্য দেয়ানো হয় যে, “সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর ইনডেমনিটি অংশটি একটি ‘কালা কানুন’ বিধায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা ছাড়াও ঐ আইন বাতিল করার সরকারি সিদ্ধান্ত সঠিক !”

এরপর আদালত এই বিষয়ে আর কোন যুক্তিতর্ক শুনতে রাজি হয়নি। হঠকারি উন্নাসিকতার এক অদ্ভুত নিদর্শন !

কোন আইনের ব্যাখ্যা সংবিধানের বিধান অনুযায়ি অবশ্যই আদালত দিতে পারেন। কিন্তু আইনজিবীদের দ্বারা শুধুমাত্র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে কোন আইন বাতিল করা কিংবা কোন সাংবিধানিক পরিবর্তন করার সরকারি সিদ্ধান্তকে সঠিক বলানো শুধু যে সংবিধানের অবমাননা তাই নয়, এ ধরনের আচরন সমস্ত নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-আদর্শ যার উপর সামাজিক আইন প্রতিষ্ঠিত তার মূলেই কুঠারাঘাতের শামিল।

সরকারি চাঁপের মুখেই হউক, আর লাঠির ভয়েই হউক, কিংবা ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্যই হউক, যে সমস্ত আইনজীবি নৈতিকতা এবং পেশাগত দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে সরকারের তাঁবেদারী করে আইন বিভাগের সুনাম ক্ষুন্ন করেছেন তাদের স্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে; জনধিকৃত, বিবেকবর্জিত আইন লঙ্ঘনকারী হিসাবে। তাদের এই ধরনের হঠকারিতা ক্ষমার অযোগ্য হয়ে থাকবে চিরকাল।

আইন এবং সংসদ বিষায়ক মন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ১২ই মে ২০০৩ তার মন্ত্রনালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “যৌথ অভিযান ছিল সময়ের দাবি। ১৪ কোটি মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য যাদের মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে তাদের বিষয়টি ব্যক্তি পর্যায়ের ত্যাগ হিসাবে সরকারকে মেনে নিতে হচ্ছে।”

দায়মুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন,

“রক্ষীবাহিনী ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী কাজ শুরু করে, ৮ই মার্চ আইন করে বৈধতা দেয়া হয়। এই বাহিনী ৪০ হাজার লোককে খুন করে কিন্তু একটি খুনের ও বিচার হতে পারেনি। ১৯৭৪ সালের ৬মে এই আইনটি সংশোধণ করে বাহিনীটিকে দায়মুক্তি করতে ১৬এ ধারা সংবিধানে সংযোজনের ফলে এ বিচার সম্ভব হয়নি। ৪০ হাজার লোকের হত্যার জন্য রক্ষীবাহিনীকে দায়মুক্তি প্রদানের পর যৌথ অভিযাণের দায়মুক্তির ব্যপারে সমালোচনা করার অধিকার আওয়ামী লীগের আর থাকতে পারে না।” (দৈনিক যুগান্তর ১৩.৩.২০০৩)। ঠোস্ যুক্তি বটে !

তার এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই বলা চলে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বর সম্পর্কে প্রদত্ব দায়মুক্তি আইনটি শুধুমাত্র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাতিল করে বিচারের প্রহসন করার অধিকার ও আওয়ামী লীগের ছিল না। এই বিষয়ে কিন্তু মহামান্য মন্ত্রী তার বিবৃতিতে কিছুই উল্লেখ করলেন না। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এ বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন কিনা সেটা সময়তেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে। যাই হউক না কেন, তার এই একই যুক্তির ভিত্তিতে জনগণের প্রশ্নঃ

“মহামান্য আইনমন্ত্রী জনাব মওদুদ আহমদ, বর্তমান সরকারের আমলে ১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বরের নায়কদের কারা প্রকোষ্ঠের ডেথ সেলে এখনো বন্দী করে রাখা হয়েছে কোন অধিকারে?”

বর্তমান জোট সরকারের কাছে দেশপ্রেমিক, সচেতন জনগনের প্রত্যাশা: ইনডেমনিটির বিষয়ে প্রয়োজনে এমন শক্ত আইন প্রণয়ন করা হউক যাতে করে দেশ ও জাতিয় স্বার্থবিরোধী কোন অপশক্তিই ভবিষ্যতে কখনোই সংবিধানের অবমাননা করার ধৃষ্টতা দেখাতে সক্ষম না হয়। একইসাথে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার অসংবিধানিকভাবে জিয়া সরকারের প্রদত্ব ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল করে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ‘৭৫ এর নিঃস্বার্থ সূৰ্য্য সন্তানদের বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে কারা প্রকোষ্ঠে তিলে তিলে মারার যে হীন পরিকল্পনা করেছিল; আইনগতভাবে সেই পরিকল্পনাকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষিত করা হউক।

এটা সত্যিই এক নির্মম পরিহাস! জাতীয় বীররা এখনো কারা প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর দিন গুনছে জোট সরকারের আমলেও! জনমনের সব সন্দেহের অবসান ঘটানোর জন্য বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের উচিত কালবিলম্ব না কর্বে তাদের মুক্তি দান করে এবং যারা বিদেশে নির্বাসিত অবস্থায় রয়েছেন তাদের দেশে ফেরার পথ সুগম করে দিয়ে জনগণের কাছে প্রমাণ করা যে, জোট সরকার সংবিধানের পবিত্রতা বজিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।

একটি সত্য আজ সবাইকেই বুঝতে হবে জাতির গৌরব আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করার সুযোগ কারোর জন্যই সৃষ্টি করার কোন অবকাশ নেই। কারণ জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা এবং অস্তিত্ব কায়েম রাখার শেষ আধার তারাই।

ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান জোট সরকারের নেত্রী শহীদ জিয়ার যোগ্য উত্তরশুরী সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আপোষহীন হিসাবে বিশেষভাবে শ্রদ্ধেয়। তাঁর এই ইমেজকে আরো দৃঢ়ভাবে জনগনের মনে প্রথিত করতে হবে যাতে করে আগামীতে যে কোন ক্রান্তিলগ্নে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদীরা তাঁর উপর নিরংকুশ বিশ্বাস এবং আস্থা রেখে তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে চিহ্নিত জাতিয় বিশ্বাসঘাতক এবং তাদের দোসর এবং বিদেশী প্রভুদের দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী সব চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক অপরাজয়ী শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।

বিভিন্নমুখী চক্রান্তের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে শুধুমাত্র দল বা জোট নয়; সেনাবাহিনী এবং জনগনের আস্থা ও শক্তির উপরেই শুধুমাত্র বর্তমান জোট সরকারকেই নয় আগামীতেও যে সমস্ত সরকার নিজেদের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক হিসাবে দাবী করবেন তাদের সবাইকেই নির্ভরশীল হতে হবে। কারো পক্ষেই অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই যে জাতীয় রাজনীতির ধারা প্রবাহে এই প্রপঞ্চটি একটি ঐতিহাসিক সত্য হিসাবেই প্রমানিত।

চারিত্রিক দৃঢ়তা সততা, বিচক্ষনতার সাথে সময়ের দাবি মেনে নেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। তেমনটি না করা হলে অতীতের অত্যাবশ্যক ঘটনাসমুহ যথাঃ-২৬-২৭শে মার্চ ১৯৭১ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনা ৷

১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন।

৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব এবং অপারেশন ক্লিনহার্ট এর মতো প্রতিটি ঘটনার সাথে যেখানে জড়িয়ে আছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং দেশের সাচ্চা ও নিবেদিত প্রান জাতীয়তাবাদী জনগণ তার পুনরাবৃত্তি কখনও ঘটবে বলে আশা করা যায় না। তাদের কেউই ভবিষ্যতে জাতীয় সংকটের সন্ধিক্ষনে বৃহত্তর স্বার্থে আত্মত্যগের মহৎ উদ্দেশ্যে আগুয়ান হওয়ার উদ্দীপনা, উৎসাহ, প্রেরনা কিংবা সাহস কখনোই পাবেন না। পরিশেষে জাতি নিমজ্জিত হবে আত্মঘাতী এক চরম হতাশায়। দেশকে যারা ভালোবাসেন তারা এমন হতাশাগ্রস্ত বাংলাদেশ কখনোই চান না।

দুঃখজনক-শক্তিহীন নেতিবাচক মানসিকতার শিকড় জাতীয় পরিসরে প্রথিত হবার আগেই এর আশু প্রতিবিধান একটি অত্যাবশ্যিক করণীয়।

বর্তমানে প্রচলিত যে আইন ও সংবিধানীক বিধিবিধান রয়েছে তাকে আরো জোরদার করতে হবে। নিচ্ছিদ্র করতে হবে আইনকে সব ফাঁক ও চোরা গলিগুলো বন্ধ করে দিয়ে। প্রয়োজনে প্রণয়ন করতে হবে নতুন আইন এবং সংবিধানিক বিধিবিধানে এই বিষয়ে এমনভাবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে যাতে সেনাবাহিনী ও জাতীয়তাবাদীদের কে কেউই ভবিষ্যতে যেন আর কখনোই কাঠগড়ায় টেনে নিয়ে যাবার সাহস না পায় জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে সংকট মোকাবেলার দায়িত্ব পালন এবং কৃতকর্মের জন্য। এই ধরনের ঔদ্ধ্যত্ব তাদের জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের প্রকাশ্য অপমান বিধায় অসহনীয় এবং সম্পূর্ণরুপে অগ্রহনীয়। শুধুমাত্র এ ধরনের ফলপ্রসু আইন এবং সংবিধানিক বিধিবিধানের পরিবর্তনই হতে পারে বর্তমান ও ভবিষ্যত বাংলাদেশের একমাত্র রক্ষাকবচ। শুধু তাই নয় সর্বকালের জন্য বাংলাদেশ পরিনত হতে পারে এক দুর্জয় ঘাঁটিতে। যত সত্বর শুভ বুদ্ধির উদয় হবে জনগণ ও নেতা নেত্রীদের মানসিকতায় এবং উপরে যা লিপিবদ্ধ করা হল তারা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন ততই মঙ্গল হবে দেশ ও জাতির।

♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত

♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ

♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার

♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন

♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ

♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার

♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী

♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম

♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান

♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ

♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব

♦ রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্নেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম

“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!