অনন্ত বিজয়
ভূমিকা
আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় নানা কারণে অনেক বিশ্বাস-অপবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার, জড়তাবোধ আর বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে অপজ্ঞান এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসে আছে, যা কোনোভাবেই তুলে ফেলা যাচ্ছে না। হাজার বছর ধরে অযৌক্তিক চর্চার ফলে এই সকল অপজ্ঞানের শিকড় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে মিশে গেছে, রক্তের হিমোগ্লোবিনের মতো আমাদের শরীরে অবস্থান করছে । যা আমাদেরক আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। প্রতিমুহূর্তে পিছনে টেনে ধরছে ।
প্রথম পর্বঃ রাম জন্মভূমি
ভারতীয় দুই কালজয়ী মহাকাব্য হচ্ছে রামায়ণ এবং মহাভারত। যুগ যুগ ধরে অগণিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মহাকাব্য দু’টি ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। মহাকাব্য রামায়ণে বিধৃত পিতৃভক্তি, মাতৃভক্তি, ভ্রাতৃভক্তি, সীতার দুঃখময় জীবন, রামভক্তি, হনুমানের বীরত্ব, রাবণ ও মেঘনাদের বীরত্ব, রাবণের অহংকারি মনোভাব, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, বিভীষণের ভূমিকা, বালী বধ ও শম্বুক বধ ইত্যাদি ঘটনা আজ ভারতীয় প্রচার মাধ্যম দূরদর্শনের কল্যাণে হিন্দু ধর্মালম্বীদের মুখে মুখে। ১৯৮৮-৯০ সালে ভারতের দূরদর্শনে প্রথমে রামায়ণ এবং পরে মহাভারত ধারাবাহিকভাবে দেখানো হয়। টিভি সিরিয়াল দু’টি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। এ দু’টি কালজয়ী মহাকাব্যকে দূরদর্শনে পরিবেশন দোষণীয় কিছু নয়, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে যেভাবে ধর্মের লেবাস পরিয়ে উত্থাপন করা হয়েছে, এবং এর মাধ্যমে সনাতন ধর্মের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে সেটি দোষণীয়। এর ফলে ভারতের সেক্যুলার চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়েছে। এতে হিন্দু ধর্মবাদীদের প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। হিন্দু মৌলবাদীদের সংখ্যা বাড়ছে, অবশ্য এর সঠিক পরিসংখ্যান আজও জানা যায়নি। আদৌ জানা যাবে কিনা সন্দেহ?
যেই রাম, রামায়ণ, রাম জন্মভূমি অযোধ্যাকে কেন্দ্র করে এতো কাণ্ড হল এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে— গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গাকে ভারতের কলঙ্ক বলে সে সময় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী অভিহিত করছিলেন— সেই রাম, রামায়ণ, রাম জন্মভূমি অযোধ্যার কি কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে? ভারতবর্ষে? না কি স্রেফ গ্রীক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ এর মতো কল্পনার মহাকাব্য মাত্র। প্রবন্ধটিতে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে নিরাসক্তভাবে।
রামায়ণের রচয়িতারা
ঋষি বাল্মীকি রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা বলে পরিচিত। তার প্রকৃত নাম রত্নাকর। এক সময় পেশায় দস্যু ছিলেন। জীবনে এক পর্যায়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে তপস্যাবলে সরস্বতীর কৃপায় কাব্যশক্তি অর্জন করেন । বিশ্বাস করা হয় তিনি নারদের কাছ থেকে রামের বৃত্তান্ত শুনেন এবং পরবর্তীতে ব্রহ্মার নির্দেশে সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। বাংলাভাষীদের কাছে জনপ্রিয় হল কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা রামায়ণ। তার রচনায় বেশ কিছু নতুন সংযোজিত হয়েছে যেমন, রামের দুর্গোৎসবের প্রসঙ্গ। এদিকে তুলসীদাসের রামচরিতমানসের (বাংলা রামায়ণ) সঙ্গে বাল্মীকি রামায়ণের বেশ অমিল রয়েছে। প্রশ্ন হল বাল্মীকির রামায়ণ কতটা শুদ্ধ। বিশেষ করে যখন এ মহাকাব্যটি কয়েকশ বছর ধরে রচিত হয়েছে । বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণ রচিত হয়েছে যেমন, বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়া রয়েছে দশরথ জাতক রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, উত্তর ভারতীয় রামায়ণ, দক্ষিণ ভারতীয় রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ, যোগবৈশিষ্ট্য রামায়ণ, ভূষণ্ডি রামায়ণ, রামচরিত মানস বা তুলসী রামায়ণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ প্রভৃতি। এদের মধ্যে বেশ তারতম্য লক্ষিত হয়। তবে মূল কাহিনীটি ঠিক রয়েছে।
রামায়ণ রচনা কাল
বিশেষজ্ঞের মতে বাল্মীকি রামায়ণ পাঁচ কাণ্ডে (অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড বা যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত) সম্পূর্ণ ছিলো । অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড (যুদ্ধকাণ্ড) এবং পরবর্তীকালে আরও দুটি কাণ্ড জুড়ে দেয়া হয় প্রথমে বালকাণ্ড ও শেষে উত্তর কাণ্ড। বাল্মীকি রামায়ণে রামকে একজন যুদ্ধবিশারদ রাজা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। রামায়ণ রচনার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথম পর্যায় ছিলো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী ও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। এ সময়ে রামায়ণের পরম্পরা ছিলো মৌখিক অর্থাৎ অলিখিত- সূত (পাঠক) কিংবা কুশীলবেরা (চারণকবি) তখন রামায়ণ গান করে বেড়াতো। এই সময়ে অর্থাৎ প্ৰায় দুশো বছর ধরে প্রচলিত ছিলো শুধুমাত্র অযোধ্যাকাণ্ড থেকে যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত পাঁচকাণ্ডের অধিকাংশ ভাগ। দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিসর ছিলো খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় চারশ’ বছর। এ সময়ে প্রথম দুশো বছরের মৌখিক পরম্পরার যে পাঁচকাণ্ড রচিত হয়েছিলো তা লিখে ফেলা হয়, আর লিখবার সময় এই পাঁচ কাণ্ডের মূল কাহিনীতে বেশকিছু প্রক্ষেপণ ঘটে থাকে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে তৃতীয় শতাব্দী, প্রায় তিনশ বছরে ছিলো তৃতীয় পর্যায়! অনুমান করা হয় এই পর্যায়েই বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড সংযোজিত হয়।* এভাবে প্রায় সাত আটশো বছরের পরিসরে মহাকাব্যটি বহু লেখকের সংযোজনে পুষ্ট হয়েছিল- এরপরও বাল্মীকি-রামায়ণে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এ এল বাশামের মতে গুপ্তযুগে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে রামের অবতারতত্ত্ব বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড রামায়ণে সংযোজিত হয়।) উক্ত যুগে বর্তমানে প্রচলিত রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্য দুটি সুসংহত রূপ লাভ করে । এর ফলে রামায়ণ মহাকাব্য থেকে হিন্দুদের একটি ধর্মগ্রন্থে উন্নীত হয়-
হতে পারে ইসলাম ধর্মের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে মধ্যযুগে হিন্দুধর্মের মধ্যে যে ভক্তি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিলো পয়গম্বর মোহাম্মদের বিপরীতে রামকে অবতার রূপে প্রচার এবং জনমনে অধিষ্ঠিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। রামকে বিষ্ণুর অবতারের আসনে স্থাপন করার পেছনে খ্রিস্টীয় পনেরো শতকে রচিত কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও খ্রিস্টীয় ষোল শতকে রচিত তুলসী রামায়ণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । বস্তুত ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হিন্দিভাষায় রামকাহিনী তুলসীদাস কর্তৃক লিখিত হওয়ার পরই অযোধ্যাতে রামকথা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । এবং অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে রামের নামে হিন্দু মঠ মন্দির নির্মিত হতে থাকে।
রামায়ণের আকার
আদি বাল্মীকি রামায়ণে পাঁচকাণ্ডে ২৪,০০০ শ্লোক ছিলো। বর্তমানে সপ্তকাণ্ড বিন্যাস করা রামায়ণে ৪০,০০০ এর বেশি শ্লোক আছে।
রামায়ণের চরিত্রগুলোর পরিচয় : বর্তমানে প্রচলিত রামায়ণের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিচে উল্লেখ করা হলো—
১. ইক্ষাকুঃ রামের পূর্বপুরুষ। অযোধ্যার রাজা। ইক্ষাকু বংশের প্রতিষ্ঠাতা। বৈবস্বত মনুর ছেলে ।
২. উর্মিলাঃ লক্ষ্মণের স্ত্রী। মিথিলার রাজা জনকের নিজের মেয়ে এবং সীতার বোন ৷
৩. কুম্ভকর্ণঃ রাবণের মেজভাই ।
৪. কৈকেয়ীঃ রামের অনুজ ভরতের মা। দশরথের দ্বিতীয় স্ত্রী। কেকয়রাজ অশ্বপতির মেয়ে, তাই তার নাম কৈকেয়ী।
৫. জনকঃ মিথিলার রাজা। প্রকৃত নাম ‘সীরধ্বজ’। ‘জনক’ একটি উপাধি। সীতার পালক পিতা ৷
৬. দশরথঃ রামের পিতা এবং অযোধ্যার রাজা। অজ ও ইন্দুমতীর পুত্র। রঘু বংশের আদি পুরুষ রঘুর নাতি । এর তিন স্ত্রী : কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা ।
৭. নারদঃ বিখ্যাত দেবর্ষি। দেববাণী বাহক, জিব্রাইলের কাউন্টার পার্ট । ব্রহ্মার মানসপুত্র । তিনি প্রথম ঋষি বাল্মীকিকে রামের কথা শোনান ।
৮. বালীঃ দক্ষিণ ভারতের কিস্কিন্ধ্যা দেশের বানর রাজা। সুগ্রীবের অগ্রজ।
৯. বাল্মীকিঃ আদি কবি। বলা হয়ে থাকে রামায়ণের রচয়িতা। প্রথম জীবনে দস্যু ছিলেন। নাম ছিলো রত্নাকর। তিনি দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে তপস্যা বলে কাব্যশক্তি অর্জন করেন।
১০. বিভীষণঃ রাবণের ছোট ভাই সদাচারী ও সত্যনিষ্ঠ । রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় রামের পক্ষে চলে আসেন ।
১১. বিশ্বামিত্রঃ ব্রহ্মর্ষি নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে ছিলেন ক্ষত্রিয়, কিন্তু কঠোর তপস্যায় তিনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন ।
১২. ভরতঃ দশরথ ও কৈকেয়ীর পুত্র। রামের একদিনের ছোট ভাই । লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের একদিনের বড়। জনকের ভাই কুশধ্বজের মেয়ে মাণ্ডবীর সাথে তার বিয়ে হয় ।
১৩. মেঘনাদঃ রাবণ ও মন্দোদরীর বীর পুত্র।
১৪. রামঃ রামায়ণের নায়ক। বিষ্ণুর অবতার বলে কথিত। দশরথের বড় পুত্র। মাতা কৌশল্যা । মিথিলার রাজা জনাকর পালক কন্যা সীতার স্বামী ।
১৫. রাবণঃ লঙ্কার রাজা। বিশ্রবা এবং নিষার পুত্র। এক মতে ব্রহ্মার নাতির পুত্র। দশমাথা ছিলো বলে আরেক নাম দশানন। লঙ্কেশ বা লঙ্কেশ্বরও বলা হয়ে থাকে। ত্রিভুবন বিজয়ী বীর যোদ্ধা।
১৬. লক্ষ্মণঃ দশরথ ও সুমিত্রার দুই যমজ ছেলে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের একজন। রামের একনিষ্ঠ অনুসারী ।
১৭. লব-কুশঃ রাম ও সীতার দুই যমজ সন্তান। এদের জন্ম বাল্মীকির আশ্রমে।
১৮. শত্রুঘ্নঃ দশরথ ও সুমিত্রার যমজ সন্তানের একজন ৷
১৯. সীতাঃ জনকের পালিত কন্যা। রামের স্ত্রী ও লব-কুশের মা। রামায়ণের নায়িকা। জনকের মেয়ে বলে ‘জানকী’, মিথিলা রাজ্যের মেয়ে বলে “মৈথিলা’ বলে ডাকা হয়ে থাকে। সীতা মানে লাঙলের দাগ। ক্ষেতে লাঙলের ফলায় টানা ‘সীতা’য় এঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে জনক এর নাম রাখেন ‘সীতা” ।
২০. সুগ্রীবঃ বানর রাজা। বালীর ছোট ভাই ।
২১. সুমিত্রাঃ দশরথের তৃতীয় স্ত্রী। মগধ রাজের মেয়ে। লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের মাতা।
* উভয় কাণ্ডেই প্রথমে রামের বিষ্ণু অবতার প্রসঙ্গটি আনা হয়। সম্পাদকমণ্ডলী।
* রত্নাকর সম্পর্কে আধুনিক বাল্মীকি মধুসূদনের উক্তিঃ
“নরাধম আছিল যে নর নরকুলে
চৌর্য্যেরত, হইল সে তোমার প্রসাদে,
মৃত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি!
হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর
কাব্যরত্নাকর কবি।” (মেঘনাদ বধ কাব্য)
প্রচলিত রামায়ণের সংক্ষিপ্ত কাহিনী
রামায়ণ কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া আছে বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর রামায়ণ (আনন্দ পাবলিসার্স প্রাঃ লিঃ কলকাতা-১৯৯৮) গ্রন্থে। নিম্নে এটি উল্লেখ করা হলো-
(ক) বালকাণ্ডঃ অযোধ্যার ইক্ষাকু বংশীয় রাজা দশরথ-এর তিন রানী। কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা। কোনও ছেলে হয়না। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলেন দশরথ। চার ছেলে হলো। কৌশল্যার গর্ভে রাম, কৈকেয়ীর গর্ভে ভরত, আর সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন ।
রাক্ষস মারীচ আর সুবাহুকে বধ করার জন্য রামকে নিয়ে যেতে দশরথের রাজসভায় এলেন ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বশিষ্ঠের পরামর্শে সম্মতি দিলেন দশরথ। রাম লক্ষ্মণকে নিয়ে চললেন বিশ্বামিত্র। পথে ভয়ঙ্কর তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করলেন রাম। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে যজ্ঞে বাধা দিতে এসে রামের বাণে ধরাশায়ী হলেন সুবাহু। মারীচ গিয়ে পড়লেন একশো যোজন দূরের সমুদ্রে। মিথিলায় ঢুকেই, গৌতম মুনির আশ্রমে শাপগ্রস্তা পাষাণভূত অহল্যাকে শাপমুক্ত করলেন রাম তার পদস্পর্শে ।
মিথিলার রাজা জনক ঘোষণা করেছিলেন যে, “হরধনু’তে শর জুড়তে পারবে, তার গলায় সীতা মালা দেবে। রাম ভাঙলেন সেই হরধনু। রামের গলায় মালা দিলেন সীতা । জনকের নিজের মেয়ে উর্মিলার সঙ্গে বিয়ে হলো লক্ষ্মণের। জনকের ভাই কুশধ্বজের দুই মেয়ে মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি মালা দিলেন যথাক্রমে ভরত ও শত্রুঘ্নের গলায়। সবাই মিলে ফিরে এলেন অযোধ্যায়। রাম অযোধ্যার সবার নয়নের মণি হয়ে উঠলেন।
(খ) অযোধ্যাকাণ্ডঃ দশরথের আদেশ, রামকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করার আয়োজন শুরু হলো। কৈকেয়ী ইতোপূর্বে দশরথের কাছে প্রাপ্য দুই বরের এক বরে চাইলেন ভরতকে রাজা করতে হবে, দ্বিতীয় বরে রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে।
রাম, লক্ষ্মণ আর সীতা বনবাসে চলে গেলেন । ভরত আর শত্রুঘ্ন ছিলেন মামার বাড়িতে। ফিরে এসে সব শুনে রেগেই আগুন। চিত্রকুটে গিয়ে ভরত কেঁদে জড়িয়ে ধরলেন রামের দু পা। রাম কিছুতেই ফিরতে রাজি হলেন না। অবশেষে রামের পাদুকা মাথায় নিয়ে এসে অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়ে রামের প্রতিনিধি হয়ে রাজকার্য দেখাশোনা করতে লাগলেন ভরত ।
(গ) অরণ্যকাণ্ডঃ দণ্ডকারণ্যে এলেন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ। রাক্ষস বিরাধকে বধ করলেন রাম অগস্ত্য মুনির পরামর্শে, চললেন পঞ্চবটীতে। পথে দশরথের বন্ধু জটায়ুর সঙ্গে পরিচয়।
লঙ্কার রাজা রাবণের বিধবা বোন শূর্পণখা সুন্দরী নারীর রূপ ধরে এসে প্রথমে রামকে এবং পরে লক্ষ্মণকে বিয়ে করতে চাইলেন। শূর্পণখার নাক আর কান কেটে দিলেন লক্ষ্মণ। প্রতিশোধ নিতে শূর্পণখা ছুটলেন দাদা রাবণের কাছে। রাবণের আদেশ খর, ত্রিশিরা আর দূষণ নামের রাক্ষস মহাবীর ছুটে এলেন পঞ্চবটীতে। তিনজনকেই যমালয়ে পাঠালেন রাম। রাক্ষস অকম্পের পরামর্শে, সীতাকে অপহরণ করার চক্রান্ত করলেন রাবণ। মারীচকে মায়ামৃগের রূপ ধারণ করে পঞ্চবটীতে ঘুরে বেড়ানোর আদেশ দিলেন রাবণ। রাবণের ফাঁদে কাজ হলো। “সোনার হরিণ চাই’ বায়না ধরলেন সীতা I
রাম চললেন হরিণ ধরতে। মারীচ রামের গলা নকল করে আর্ত চিৎকার করলেন। রামের বিপদ আশঙ্কায় সীতা লক্ষ্মণকে পাঠালেন রামকে ফেরাতে। সেই সুযোগ সন্ন্যাসীর ভেক ধরে রাবণ এসে হরণ করলেন সীতাকে। লঙ্কায় নিয়ে চললেন। পুষ্পক রথে করে পথে জটায়ুর সঙ্গে রাবণের ঘোরতর লড়াই হল । রাবণ জটায়ুর ডানা কেটে দিলেন। রাম-লক্ষ্মণ সীতার খোঁজে বেরিয়ে জটায়ুর কাছে সব শুনলেন ।
শুরু হলো পাগলের মতো সীতাকে খোঁজা। পথে কবন্ধকে বধ করলেন রাম । কবন্ধ দিলেন সুগ্রীবের খবর। পম্পা সরোবরের তীরে মতঙ্গ মুনির আশ্রমে রামের প্রতীক্ষায় দিন গুনছিলেন বৃদ্ধা তাপসী শবরী। তাকে দেখা দিলেন রাম। তারপর চললেন সুগ্রীবের খোঁজে ।
(ঘ) কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডঃ বানররাজ সুগ্রীবের সাথে বন্ধতত্ত্ব হলো রামের। সুগ্রীব কথা দিলেন, সীতাকে খুঁজে বার করবেন। রাম কথা দিলেন সুগ্রীবের দাদা বলীকে বধ করে, তার কাছ থেকে রাজ্য আর সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে আবার ফিরিয়ে দেবেন সুগ্রীবের কাছে। কথা রাখলেন রাম। শুরু হলো সীতা অন্বেষণ। জটায়ুর দাদা সম্পাতির কাছ থেকে সীতার সুলুক-সন্ধান পেলেন বালীর ছেলে অঙ্গদ । ঠিক হলো হনুমান যাবেন লঙ্কায় ৷
(ঙ) সুন্দরকাণ্ডঃ মহেন্দ্র পর্বতের মাথা থেকে এক লাফে হনুমান সাগর পার হয়ে এলেন লঙ্কায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সীতাকে দেখতে পেলেন অশোক বর্নে । সীতাকে প্রণাম করে, রাম লেখা রামের আংটি সীতার হাতে তুলে দিলেন হনুমান । সীতা আঁচল থেকে একটি গয়না বের করে দিলেন রামকে দেয়ার জন্যে। সীতাকে উদ্ধারের নিশ্চিত আশ্বাস দিয়ে হনুমান ফিরে এলেন। সীতার খবর পেয়ে আশ্বস্ত হলেন রাম-লক্ষ্মণ সাথে বানররাও আনন্দে হইচই শুরু করে দিল।
(চ) লঙ্কাকাণ্ড (যুদ্ধকাণ্ড): যুদ্ধযাত্রার তোড়জোড় শুরু করলেন রাম। এদিকে রাবণের ধর্মভীরু ভাই বিভীষণ সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দেবার অনুরোধ করলেন, কিন্তু ব্যর্থ ও অপমানিত হয়ে যোগ দিলেন রামের পক্ষে
বানরের দল বড় বড় পাথরের চাঁই আর গাছ দিয়ে লঙ্কা পর্যন্ত সেতু তৈরি করে ফেললেন। শুরু হলো যুদ্ধ। একে একে রাবণের পক্ষে ইন্দ্রজিৎ, অতিকায়, মহোদর, কুম্ভকর্ণসহ অনেকেই মারা পড়লো রাম-লক্ষ্মণের হাতে। বিভীষণ নানা কৌশল বলে দিয়ে যুদ্ধে সাহায্য করলেন রামকে। সবশেষে শুরু হলো রাম-রাবণ যুদ্ধ। অনেক চেষ্টার পর রাম ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে রাবণকে হত্যা করলেন। যুদ্ধ চলেছিল ১৭/১৮ দিন ।
বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করা হলো। সীতা রাবণের কাছে ছিলেন বলে, রাম লোকনিন্দার ভয়ে তাকে ফিরিয়ে নিতে চাইলেন না। আগুনে আত্মাহুতি দিতে চাইলেন সীতা । কিন্তু আগুন জ্বালতেই অগ্নিদেব সীতাকে কোলে করে রামের কাছে ফিরিয়ে দিলেন, বললেন : ‘সীতা অপাপবিদ্ধা! শুদ্ধা! পবিত্রতাস্বরূপিনী!”
সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলেন রাম আর লক্ষ্মণ চৌদ্দ বছর পর। রাম রাজা হলেন ভরত হলেন যুবরাজ ।
(ছ) উত্তরকাণ্ডঃ সীতাকে নিয়ে প্রজারা কানাঘুষা শুরু করে দিল। রাম লক্ষ্মণকে আদেশ করলেন সীতাকে তমসা নদীর তীরে বাল্মীকি মুনির আশ্রমে রেখে আসতে । বাল্মীকি আশ্রমে সীতার লব কুশ নামে দুটি যমজ সন্তান হলো ।
অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন রাম। কৃত্তিবাসী রামায়ণ মতে যজ্ঞের ঘোড়াটাকে আটকে রেখে একে একে হনুমানসহ শত্রুঘ্ন, ভরত, লক্ষ্মণ, রাম সকলকে পরাস্ত করলেন বালক লব, কুশ। বাল্মীকি মুনির মধ্যস্থতায় সবাইকে মুক্তি দেয়া হলো। এ কাহিনী আদি বাল্মীকি রামায়ণে নেই।
যজ্ঞক্ষেত্রে ঋষিবালকের বেশে লবকুশ শোনালেন বাল্মীকি রামায়ণ । বাল্মীকি রামকে জানালেন লব-কুশ ও সীতার কথা । সীতাকে আবার শুদ্ধতার পরীক্ষার কথা বললেন রাম । সীতার ক্ষোভে, দুখে ধরিত্রীমাতা বিদীর্ণ হলেন- আর সীতা সেখানে প্রবেশ করলেন।
কালপুরুষের কৌশলে, রামকে দুর্বাসা মুনির আগমন বার্তা দিতে গিয়ে পূর্বশর্ত মতো লক্ষ্মণকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো সরযূ নদীতে। অনুতপ্ত রাম কুশকে কোশল আর লবকে উত্তর দেশের রাজা করে দিয়ে নিজে প্রাণ বিসর্জন দিলেন সরযূ নদীতে। ভরত, শত্রুঘ্নও রামের পথ অনুসরণ করলেন।
বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড নিয়ে সমস্যা
রামায়ণে রামের অলৌকিকত্ব, বিষ্ণুর অবতাররূপে রামকে চিহ্নিত করার প্রয়াস তা শুধু বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড-এর মধ্যেই রয়েছে। বাকি পাঁচকাণ্ডের সমন্বয়ে রামায়ণ অন্যান্য সাধারণ কাব্য, মহাকাব্য, গল্পগাঁথার মতোই রচিত। প্রথমে উত্তরকাণ্ডের কথা বলা যাক । কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে উত্তরকাণ্ড বালকাণ্ডের আগে সংযোজিত হয়েছে। উত্তরকাণ্ডের সংযোজন যে মূল বাল্মীকি রামায়ণ রচনার কয়েকশ বছর পরে রচিত, তার প্রধান প্রমাণ এই কাণ্ডের ভাষা, রচনাশৈলী, যা অনেক পরবর্তী সময়ের সংস্কৃত ভাষা ও কাব্য রচনার পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মহাকাব্য কিংবা প্রচারধর্মী যে কোন কাব্য যেভাবে শেষ করা হতো, যুদ্ধকাণ্ড অর্থাৎ ষষ্ঠকাণ্ডের শেষে তার সব নিদর্শন রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ষষ্ঠকাণ্ডে রামরাজত্বের উৎকর্ষের বর্ণনা, রামায়ণ পাঠ ও শ্রবণের মাহাত্ম্য আর অনেক রকম ইহলৌকিক লাভের কথা বলা হয়েছে। উত্তরকাণ্ড বাদ দিয়ে যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত পড়লেই মনে হয় যেন কাহিনী শেষ হয়েছে (মহাভারতের বনপর্বের অন্তর্গত রামোপাখ্যানও এখানেই শেষ)। কিন্তু উত্তরকাণ্ডের শুরুতে যেন হঠাৎ করেই মুনি অগস্ত্যসহ কয়েকজন রাজপ্রাসাদে এলেন এবং নানারকমের গল্পের মাধ্যমে কর্মফল, সমাজতত্ত্ব, রামের অবতারতত্ত্ব প্রভৃতি বর্ণনা করতে লাগলেন। যা মহাকাব্যের আগের অংশের সঙ্গে রচনাগত কোনো সংযোগ নেই।
উত্তরকাণ্ডের মতো সমগ্র বালকাণ্ডও প্রাথমিক পর্যায়ের রামায়ণ রচনার অন্তত দু’তিনশো বছর পরের রচনা। বিশেষজ্ঞদের মতে বালকাণ্ডের ভাষা, শব্দচয়ন, রচনাশৈলী তুলনাক্রমে আধুনিক যুগের সাক্ষ্য বহন করে। তারমধ্যে আবার যে অংশে রামের আপাত অলৌকিক জন্মকাহিনী লেখা আছে, তা তুলনাক্রমে আরও অনেক পরে সংযোজিত। কারণ বালকাণ্ডের আরম্ভে বর্ণিত নারদের কাহিনীতে এবং বাল্মীকি রচিত রামায়ণের সংক্ষিপ্তসারে এতো বড় একটা ঘটনার উল্লেখমাত্র নেই।
তাই বলা যায় যে, বাল্মীকি রচিত রামায়ণ বলে প্রচলিত রামায়ণ রচনা করা হয়েছিলো তৎকালীন সময়ে ভারতীয় মানসপটে প্রতিষ্ঠিত মিথ-এর উপর ভিত্তি করে । ঐতিহাসিকগণ সে কথাই মনে করেন। এছাড়া খোদ রামায়ণ* থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বিশিষ্ট অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় তার মহাকাব্য ও মৌলবাদ গ্রন্থে (এলাইড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-২১) বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সিদ্ধান্ত টেনেছেন । এই অবতারণা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, নারদ নিজ স্মৃতি মন্থন করে বাল্মীকিকে একজন অসাধারণ রাজার কাহিনী বলেছেন, অবতারের কাহিনী নয়, দ্বিতীয়ত, এই অসামান্য রাজা সেই সময়ই বাল্মীকির আশ্রমের অনতিদূরে অযোধ্যা নগরে রাজত্ব করেছেন। রামায়ণের অন্যত্র রামরাজ্যের বিস্ত ,তির পরিচয় থেকে জানতে পারি যে, এই বাল্মীকির আশ্রম শুধু যে রামরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাই নয়, রাজধানীর খুব কাছে ছিল । অথচ রামের কাহিনী তো দূরের কথা, তার নামও মহর্ষি বাল্মীকি জানতেন না। ত্রিকালজ্ঞ এবং ত্রিভুবনে ঢেঁকি চড়ে অনায়াস বিচরণকারী কল্পচরিত্র দেবর্ষি নারদকেও এই নামটি বলবার সময় স্মৃতি মন্থন করতে হল। এ ধরনের অবতরণিকাই কি এই প্রাথমিক ইঙ্গিত বহন করে না যে রামায়ণের রচয়িতা এ কাহিনীকে বাস্তব ইতিহাস হিসেবে প্রচার করতে চাননি । এ থেকে কি বোঝা যায় না, বাল্মীকির নামে প্রচলিত রামায়ণটি একটি মহাকাব্য, ধর্মগ্রন্থ বা ইতিহাসও নয় ।
রামের অবতার তত্ত্বের বিশ্লেষণ
বাল্মীকি রামায়ণ বলে প্রচলিত রামায়ণ মহাকাব্যকে বাস্তব ইতিহাসে রূপান্তরিত করার প্রবণতা ধর্মবিশ্বাসের ফলশ্রুতি। আর এই মহাকাব্য ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে যাবার কারণ রামের অবতারত্বের কাহিনী। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিষ্ণুর অবতার হিসেবে রামের জন্মের তত্ত্ব মূলত রামায়ণের বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ডে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে বালকাণ্ডের এক অংশে আপাত অলৌকিক জন্মবৃত্তান্ত থাকলেও সেখানে কিন্তু অবতারত্বের কথা নেই। একমাত্র উত্তরকাণ্ডে এই কাহিনী বিস্তারিতভাবে স্থান পেয়েছে। বিশেষত, উত্তরকাণ্ডের ১০৪ নম্বর সর্গে কালরূপী ব্রহ্মার দূত এসে রামকে ব্রহ্মার হয়ে জানাচ্ছেন যে রামই স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার, পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং দেবতাদের রক্ষক। জনগণের উৎপীড়ক রাবণ বধের কারণেই তার মর্ত্যে আসা- যেহেতু সে উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, মহাকাল তাকে স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের কথা জানালেন। তারপর রাম ‘সশরীরে বৈষ্ণবতেজে’ স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করলেন।(৩) কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাম যদি বিষ্ণুর অবতার হয়ে থাকেন, তবে বিষ্ণু কে?
* বাল্মীকি রচিত ও হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত রামায়ণ, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনস কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ১৭।
প্রাচীনকালে স্বভাবতই বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব ছিল। মানুষ তখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভয়ে, বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ত এবং তাদেরকে দৈবশক্তি, আধিভৌতিক, অলৌকিক সত্তা হিসেবে কল্পনা করত। এভাবে আকাশ সূর্য, চন্দ্র, মেঘ, বিদ্যুৎ, ঝড়, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতিকে দেবদেবী রূপে কল্পনা করতো তেমনি পৃথিবীতে অগ্নি, জল, মাটি, পর্বত, নদী, বন প্রভৃতি অনেক প্রাকৃতিক বস্তুর মধ্যে দেবদেবীর অধিষ্ঠান কল্পনা করত । কিন্তু সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে তাদের কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর, শক্তিশালী এবং সর্বব্যাপী সত্তা ছিল সূর্য আর তার পরেই চন্দ্র। তাই সূর্যকে দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গণ্য করবার রীতি প্রাচীনকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সভ্যতায় প্রচলিত ছিল । অন্যান্য গ্রহ— বৃহস্পতি, শুক্র, শনি প্রভৃতি দৃশ্যত বড় বড় গ্রহকেও দেবতা জ্ঞান করা হত ৷ সূর্যের সৃজনী শক্তি এবং প্রখরতার জন্য তাকে পুরুষ দেবতা এবং চন্দ্রের স্নিগ্ধতার জন্য তাকে সাধারণত দেবী হিসেবে কল্পনা করা হত। প্রাচীন মিশরে ‘রা’ নামে আর গ্রীসে ‘এপোলো’ নামে সূর্যকে শ্রেষ্ঠ দেবতা রূপে পূজা করা হত । ভারতবর্ষেও বৈদিকযুগ থেকে পৌরাণিক যুগ পর্যন্ত সূর্যকেই সর্বপ্রধান দেবতা রূপে কল্পনা করা হত এবং বিভিন্ন মন্ত্রের মাধ্যমে অনেক নামে পূজা করা হত। তবে সব দেশেই স্থানীয় ভৌগোলিক, আর্থসামাজিক পরিবেশ দেবতার রূপ কল্পনায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে । যেমন, আমরা জানি প্রাচীনকালে মিশরে নীলনদই ছিল ব্যবসা বাণিজ্য এবং যাতায়াতের অন্যতম উপায়, তাই তারা কল্পনা করত সূর্য আকাশ পথে নৌকায় চড়ে যাতায়াত করেন, আর অন্যান্য দেবতারা নৌকার মাঝি। আবার অন্যদিকে, ভারতবর্ষসহ গ্রীসে অভিজাত শ্রেণী রথে চড়ে যাতায়াত করতেন, তাই এসব অঞ্চলে কল্পনা করা হয় সূর্য আকাশ পথে রথে চড়ে যাতায়াত করেন আর অন্যান্য দেবতারা রথের অশ্ব, সারথি ইত্যাদি । আবার প্রাচীনকাল এবং মধ্যযুগে রাজারা এবং তাদের অন্নে পালিত শাস্ত্রকাররা সূর্য এবং চন্দ্র থেকে রাজাদের বংশের উৎপত্তি বলে প্রমাণ করার হাস্যকর চেষ্টা করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিসরের ফারাও সম্রাটেরা নিজেদের বংশকে সূর্য থেকে উৎপত্তির দাবি করত । আর ভারতেও বিভিন্ন পৌরাণিক বিখ্যাত রাজবংশসমূহের উৎপত্তির দাবি করা হত সূর্য কিংবা চন্দ্র থেকে। রামচন্দ্রের ঈক্ষুকা বংশই তো সূর্য থেকে উদ্ভুত।
‘বিষ্ণু’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ (বি=বিস্তার+নু) যার বিস্তার বা ব্যাপ্তিই পরিচয়। বলাবাহুল্য, পৃথিবী থেকে আপাতদৃষ্টিতে দেখা আকাশের গ্রহনক্ষত্রের মধ্যে সূর্যের আছে একমাত্র এই পরিচয়। এখন খুব সংক্ষেপে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ(?) থেকে দেখা যাক যে, সূর্যই বিষ্ণু ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ২২ সূক্তের ১৬-১৭ঋকে একই সঙ্গে অশ্বীদ্বয়, সবিতা এবং বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। নিরুক্ত টীকাকার দুর্গাচার্য ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ ‘বিষ্ণুরাদিত্যঃ। ..সমারোহণে উদয়গিরৌ উদ্যন পদমেকং নিধত্তে। বিষ্ণুপদে মধ্যন্দিনেহন্তরীক্ষে। গয়শিরস্যস্ত গিরৌ ইতি ঔর্ণবাভ মন্যতে।’ ভাবার্থ হচ্ছে সূর্যই বিষ্ণু, তার উদয়কালীন, মধ্যাহ্নকালীন আর অস্তকালীন এই তিন পাদবিক্ষেপ। বিশেষত মধ্যাহ্নে অন্তরীক্ষে অবস্থিতিই সূর্যের বিষ্ণতত্ত্ব। ঋগবেদ সংহিতার প্রথম মণ্ডলের ১৫৫ সূক্তের ৫ঋকে বলা হয়েছে যে ‘মানুষেরা বিষ্ণুর দুই পাদই অবলোকন করতে পারে এবং ধারণা করতে পারে। তৃতীয় পাদ মানুষেরা ধারণা করতে পারে না, এমনকি উড্ডীয়মান পক্ষীরাও প্রাপ্ত হইতে পারে না।’ অর্থাৎ মধ্যাহ্ন সূর্যকে নিরীক্ষণ করা মানুষের পক্ষে কঠিন এবং পাখীদের পক্ষেও তার কাছাকাছি যাওয়া অসম্ভব। একই সূক্তের পরবর্তী ৬ঋকে বলা হয়েছে যে ‘বিষ্ণু চারটি নব্বই দিনকে চক্রের ন্যায় বৃত্তাকারে চালিত করেন।’ এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে বৈদিক যুগে প্রচলিত চার ঋতুর নিয়ন্ত ↑ হিসেবে সূর্যের কথা এখানে বলা হয়েছে। আরও উল্লেখ্য যে ঋগ্বেদের আরও অনেক সূক্তে (১/১৫৪/৪-৬, ১/১৫৫/৪, ১০/৩৭) বিষ্ণু এবং সূর্য উভয়কেই জ্যোতির উৎস, অন্ন উৎপাদক, জগতের রক্ষাকর্তা বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সূর্য, বিষ্ণু, সবিতা একই দেবতা, অশ্বীদয় তাদের রথের ঘোড়া। আর ঊষা এবং রাত্রি এই দুই দেবী সূৰ্য অথবা বিষ্ণুর গতি দ্বারাই সৃষ্ট। সামবেদ সংহিতাতেও অনেক জায়গায় সূর্যকেই বিষ্ণু বলা হয়েছে। যেমন সামবেদ সংহিতার ১৭/১/১/১৬২৫-২৬এ বলা হয়েছে যে ‘হে বিষ্ণু! এই যে তুমি বললে, ‘আমি বালরশ্মি সমূহের দ্বারা পরিবেষ্টিত, এই কি তোমার একমাত্র রূপ? তুমি সংগ্রামে (অর্থাৎ মধ্যদিনে) অন্যরূপ ধারণ করে থাক, আমাদের কাছে তোমার সেই অন্যরূপ প্রকাশিত কর। … সেই মহান আমি তোমাকে স্তব করছি। সামবেদ সংহিতার ১৮/২/৫/১৬৭০-৭৪ এ বলা হয়েছে “বিষ্ণু এই চরাচর বিশ্ব পরিভ্রমণ করেন। এর পদ সুদৃঢ়রূপে অন্তরীক্ষে স্থাপিত ।… যখন বিষ্ণু পৃথিবীর সর্বত্র পরিক্রমা করেন, তখন রশ্মিরূপ দেবগণ আমাদের জন্য পৃথিবীতে প্রবেশ করেন। বিশিষ্ট সামবেদ বিশেষজ্ঞ পরিতোষ ঠাকুর (দেখুন : সামবেদ সংহিতা, অনুবাদ ও সম্পাদনা পরিতোষ ঠাকুর, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৭৫, ভূমিকা) দেখিয়েছেন যে সামবেদে সূর্য ও বিষ্ণু এক ও অভিন্ন, ঋগ্বেদের মতো সামবেদেও অগ্নি, রুদ্র, ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ প্রভৃতি দেবদেবী সূর্যের বিভিন্ন শক্তি বিশেষ
অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, সূর্যের আরেক নামই বিষ্ণু। বিষ্ণুর উপাসনা ছিল বৈদিক ধর্মের সূর্য উপাসনারই নামান্তর মাত্র। আজ আমরা জানি সূর্য একটি জড়পিণ্ড। মহাকাশে সূর্যের চেয়ে অনেকগুণ বড় অগণিত নক্ষত্র রয়েছে। সূর্য হচ্ছে কতিপয় গ্যাসের সমন্বয়ে* গঠিত একটি নক্ষত্র একমাত্র বড় নক্ষত্র নয়; সূর্যের থেকে হাজারগুণ বড় এবং আলোেকাজ্জ্বল নক্ষত্র রয়েছে মহাবিশ্বে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই গ্যাসীয় পিণ্ড মানুষরূপী অবতার হতে পারে! আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিপুলসংখ্যক হিন্দুধর্মাবলম্বী যখন রামকে বিষ্ণুর (সূর্যের) অবতার বলে ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে দাবি করেন গলা ফাটিয়ে স্লোগান তুলেন ‘রাম ভক্তিই, রাষ্ট্র (ভারত) ভক্তি’, তখন তাদেরকে কি বলা যায়? জ্ঞানপাপী, সুবিধাবাদী না অন্য কিছু?
* সূর্যের ভেতরের মূল রাসায়নিক পদার্থসমূহ হচ্ছে, হাইড্রোজেন- ৯২.১%, হিলিয়াম ৭.৮%, অক্সিজেন ০.০৬১%, কার্বন ০.০৩%, নাইট্রোজেন ০.০০৮৪%, নিয়ন ০.০০৭৬%, লৌহ ০.০০৩৭%, সিলিকন ০.০০৩১%, ম্যাগনেসিয়াম ০.০০২৪%, সালফার ০.০০২৫% এবং অন্যান্য ০.০০১৫%।
আরোও কিছু রামায়ণ কথা
গত পর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলাম, বাল্মীকি রামায়ণ, তুলসী রামায়ণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ ছাড়াও আরও কিছু রামায়ণ প্রচলিত আছে। যেমন— প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যের অন্তর্গত দশরথ জাতক রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, উত্তর রামায়ণ, দক্ষিণ রামায়ণ ইত্যাদি। এসবের এক একটিতে একেকভাবে চিত্রিত রয়েছে রামায়ণ কাহিনী। কোথাও রাম, সীতা, লক্ষ্মণ ও ভরত ভাইবোন, কোথাও সীতা রাবণ ও মন্দোদরীর পরিত্যক্তা কন্যা, যাকে রাজা জনক ক্ষেতের আলে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। আবার পণ্ডিত শ্রী উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস তার গ্রন্থের পূর্বাভাস অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন যে রাম ও সীতা ভাইবোন। ভরত ছিলেন মালব রাজ্যের আর্যজাতীয় এক রাজন্য পরিবারের সন্তান এবং এক অর্থে রাম-সীতার দার্শনিক গুরু ।(৬) যাইহোক, এখন আমরা দশরথ জাতক রামায়ণ কাহিনীকে সংক্ষেপে উল্লেখ করবো।
দশরথ জাতক রামায়ণ
বিশিষ্ট অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় তার মহাকাব্য ও মৌলবাদ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা- ৩১) লিখেছেন, “বৈদেকি সাহিত্য, পানিনীর রচনা কিংবা পতঞ্জলির ‘মহাকাব্যে’ রাম অথবা রামায়ণের কোন উল্লেখ নেই, যদিও মহাভারতের অনেক চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম দু’টিতে। রামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘দশরথ জাতক’ নামক প্রাচীন বৌদ্ধ কাহিনীতে। …জার্মান ভারতবিদ অ্যালাব্রেকট ওয়েবার, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. সুকুমার সেনের মতে এটাই ছিলো আদি রামায়ণ।’ এর সময়কাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবু ঐতিহাসিকেরা ধারণা করেন, দশরথ জাতক রামায়ণ পালি ভাষায় ১৩টি গাথায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এটি রচিত হয়েছিলো । ভিন্নধর্ম এই রামায়ণের কাহিনী সংক্ষেপে হলঃ এই রামায়ণ কাহিনীর বিশেষত্ব হল রামপণ্ডিত-লক্ষ্মণকুমার ও সীতাদেবী হলেন ভাইবোন, বারানসীর ধার্মিক ও প্রজানুরঞ্জক রাজা দশরথের প্রথমা স্ত্রীর সন্তান সন্ততি। ভরতকুমার হলেন ২য় স্ত্রীর পুত্র, বয়সের দিক দিয়ে ভরত রামের পরবর্তী। প্রচলিত রামায়ণের গল্পের মতই ২য় মহিষীর ষড়যন্ত্রে রাম-লক্ষ্মণ-সীতাকে ১২ বছরের জন্য বনবাসে যেতে হয়। কিছুদিন পরে দশরথের মৃত্যু হলে ভরত রামকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে রামের সকাশে উপনীত হয়ে পিতার মৃত্যু সংবাদ জানান এবং অযোধ্যার শূন্য সিংহাসনে বসার অনুরোধ জানান। রাম বনবাসকাল পূর্ণ হওয়ার আগে দেশে ফিরতে অপারগতা প্রকাশ করলে ভরতকেই তার হয়ে রাজকার্য পরিচালনার নির্দেশ দেন। ১২ বছর পরে রাম সীতা ও লক্ষ্মণ অযোধ্যায় ফিরে এলে পুরবাসীদের অনুরোধে রাম পিতৃ সিংহাসনে আরোহণ করেন। সীতা অগ্রমহিষীর আসনে অলংকৃত হন।
উল্লেখ্য যে রামায়ণের যে মূল আকর্ষণ রাবণ, সীতা হরণ ও রাম রাবণের মধ্যে যুদ্ধের কোন প্রসঙ্গ এই রামায়ণে নেই। আরও একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল সীতা রামের অনুজা হওয়া সত্ত্বেও তার মহিষী হন। ভাই বোনে বিবাহ সে কালের একটি সামাজিক প্রথার কথা মনে করিয়ে দেয়। জাতক রামায়ণ রচনার কালে ব্যাপকহারে না হলেও এই প্রথা তখনও চালু ছিল মনে হয়। এখানে আরও একটি বিষয় যে পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে লক্ষ্মণ ও সীতার মত রাম শোকে ভেঙে পড়েননি, অত্যন্ত শান্ত ও সংহত চিত্তে তিনি এই শোক সংবাদ গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি এর কারণ হিসেবে ১২টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন গাঁথার আকারে।
অনার্য রামায়ণ উপাখ্যান
কাহিনীটি এরকম, যা ঘটেছিল পূর্বকল্পে বা প্রাক সত্য যুগে । এই কাহিনী অনুসারে প্রায় ৬,০০০ খ্রিস্টপূর্বে ভারতবর্ষে তখন জড় ও প্রকৃতি পূজা, যেমন সূর্য, চন্দ্র, বরুণ,… এবং যাগ-যজ্ঞ, পশুবলি ইত্যাদি প্রচলিত ছিল, যাকে বলা যেতে পারে ‘আর্য ধর্ম’। শাসন ছিল রাজতন্ত্র আর বিবাহ প্রথা অনুলোম।
এই ধর্ম-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে সে সময় ভারতের তিন স্থানে তিনজন নায়ক আবির্ভূত হয়েছিলেন, যেমন মালবে আর্য ভরত, যার গাত্রবর্ণ ছিল শুভ্র, বারানসী বা অযোধ্যায় সীতাদেবী, তিনিও আর্যবংশীয় শ্বেতবর্ণা, আর সিংহলে বা লঙ্কায় আবির্ভুত হয়েছিলেন শম্বর, আর্যভাষী হলেও তার বর্ণ ছিল কালো এবং গোত্র ও বংশ বিচারে অভিজাত কুলের নন।
*শ্রী উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের মতে, সত্যযুগ হচ্ছে-৮০০০ খ্রিস্টপূর্ব হতে ৭৫০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে যখন আর্যনামীয় শ্বেতকায় একটি জাতি বাইরে থেকে উত্তর-পশ্চিম গিরিপথ দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তখন এ দেশে দ্রাবিড় ও অন্যান্য কয়েকটি জাতি (কালো চামড়ার মানুষ) বাস করতো। আর্যরা ক্রমিকভাবে রাজ্য ও প্রাধান্য বিস্তার করতে করতে ৬১০০ খ্রিস্টপূর্বের কাছাকাছি সময়ে পূর্বে মিথিলা এবং দক্ষিণে গোদাবরী নদী ও সেখান থেকে সিংহলে নিজেদের ধর্মমত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি এবং ভাষা প্রতিষ্ঠা করেছিলো । এই দীর্ঘ সময় বুঝানো হয়েছে।
**বিবাহের ব্যাপারে আর্যদের কতকগুলো বিশেষ প্রথা। পুরোহিত সম্প্রদায়ের যুবকগণ নিজেদের ইচ্ছেমত যে কোন বর্ণের কন্যা, রাজন্য সম্প্রদায়ের যুবকগণ পুরোহিত ভিন্ন অন্য যেকোন বর্ণের, বৈশ্য সম্প্রদায়ের যুবকগণ শুধু নিজ সম্প্রদায়ের এবং আর্যীকৃত অনার্যদের কন্যা এবং আর্যীকৃত অনার্যরা শুধু নিজ বর্ণের কন্যাগ্রহণ করিতে পারতো। একই প্রথাকে অনুলোম বলে।
জ্যেষ্ঠ ভরত কালক্রমে প্রচলিত যাগযজ্ঞ নির্ভর ধর্মের বিপরীতে ‘ব্ৰহ্মবাদ’ নামে এক নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সিংহলবাসী শম্বরও এক সময় ভারতে এসে ভরতের কাছে এই মতবাদে দীক্ষা নেন। কিন্তু পরে তিনি সিংহলে এই মতবাদের আরও প্রসার ঘটিয়ে একটি সার্বজনীন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা বিশ্বে ‘চক্ৰধৰ্ম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অনেক মত পথ ও দর্শন সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই সার্বজনীন, যাতে ব্রহ্মবাদেরও স্থান ছিল, অচিরেই ভারতে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে শম্বরের নাম।
এই মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে অযোধ্যার আর্যবংশীয়া সীতাদেবী ও তদীয় ভ্রাতা রামচন্দ্র শম্বরের নিকট এই নতুন ধর্মে দীক্ষা নেন । তখন শম্বর ধর্মপ্রচারের নিমিত্ত দক্ষিণ ভারতে গোদাবরী নদীর তীরে একটি আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। কালে সীতা ও শম্বরের মাঝে গড়ে ওঠে প্রগাঢ় প্রেমের বন্ধন— সীতা হয়ে ওঠেন শম্বরের একান্ত সহচরী ও সাধন সঙ্গিনী। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে সীতাভ্রাতা রাম চক্রধর্ম পরিত্যাগ করে অযোধ্যায় ফিরে আসেন, এবং কিছুদিন পরে সনাতনধর্মীদের প্ররোচনায় শম্বরকে তার আশ্রমে হত্যা করেন।
এ সময় লঙ্কার রাজা ছিলেন রাবণ, যিনি সম্পর্কে শম্বরের মাতুল। আর্যবংশীয় হলেও রাবণ ছিলেন একজন মুক্তমনা ও সমাজ সংস্কারক। ভাগনেয় হত্যায় ক্রুদ্ধ হয়ে রাবণ হত্যাকারী আর্যধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন, কিন্তু এই যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও সবংশে নিহত হন। শম্বরের অনেক অনুসারীসহ সীতা দেবী আর্যদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। সীতাকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয়। এই সমুদয় কাহিনী উপাখ্যান, গালগল্প না ইতিহাস তা বিচারের দায়িত্ব গবেষকদের।
রামায়ণের ঐতিহাসিকতা অনুসন্ধানে
অনেকে প্রশ্ন তোলেন, রামায়ণ কি নিছক কল্পনা নির্ভর কাহিনী, না তার অন্তর্লোকে কিছুটা হলেও আছে ইতিহাসের উপাদান? যদি সত্য হয় তবে রামায়ণের কাহিনী কোন সময়ের ঘটনা? আবার আরও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে, রামায়ণ কি ভারতীয় মিথ নির্ভর কাব্য, না কি এতে বিদেশি কাব্যের প্রভাব আছে? ইত্যাদি। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজি। তবে এর আগে বলে নেয়া ভাল যে, আর্যরা ইরানীয় অঞ্চল থেকে
* আর্য হচ্ছে একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম। সংস্কৃত, ল্যাটিন ও গ্রীক- প্রধানত এই তিনটিই হচ্ছে আর্য ভাষা । বর্তমানে ব্যাপকভাবে ভুল প্রয়োগের ফলে আর্য, আর্যজাতি, আর্যভাষী- সব একাকার হয়ে গেছে। ভারতীয় পণ্ডিতদের মতে আর্যজাতি ভারতে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে ভারতে প্রবেশ শুরু করেছিল- যা অব্যাহত ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অবধি। – সম্পাদকগুলী
ধীরে ধীরে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। তবে এই আর্যদের এ অঞ্চলের প্রবেশের সময়কাল নিয়ে কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে । তবে এক ব্যাপারে এক মত যে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ এর পর ধীরে ধীরে আর্যভাষীদের এ অঞ্চলে প্রবেশ ঘটেছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০-১৫০০ শতাব্দীর তিন চারশ বছর ধরে আর্যভাষীরা পারস্য অঞ্চল (অন্য নাম ইরান) থেকে উত্তর ভারতে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে দক্ষিণমুখে ছড়িয়ে পড়ে। আর্যরা যাযাবর পশু শিকারজীবী ছিল, এ অঞ্চলে এসেই কৃষিজীবী দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সাথে পরিচিতি ঘটে এবং ধীরে ধীরে কৃষি সভ্যতার সাথে মিশে যায়। অনেকেই দাবি করেন, উত্তর ভারতের আর্যভাষী জনপদগুলোর মানুষেরা ধীরে ধীরে দক্ষিণে এগিয়ে গিয়ে অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় জনজাতিগুলোর কোনটাকে বশীভূত করে, কোনটিকে পরাস্ত করে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার কাহিনীই রামায়ণে বিধৃত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সাঁওতালী লোকপুরান- কাহিনীর মধ্যে একটি ‘কুদুম’ বা ‘ধাঁধা’ আছে, যা বাংলায় অনুবাদ করলে পাওয়া যায়- ‘রাম ছিল । হরধনু ভেঙে সীতাকে ঘরে আনল । তারপর রাবণ তাকে চুরি করে নিয়ে গেল। সীতাকে পরে উদ্ধার করল রাম। তখন হল অগ্নিপরীক্ষা। এরপরে সীতার কোলে জন্মাল লব-কুশ। রাম তাদেরকে ঘরে আনল। কিন্তু সীতা লুকালো মাটির তলায়।’…
এই কাহিনীর মধ্যে যে ঐতিহাসিক স্তর-বিবর্তন প্রতিফলিত হয়েছে, তা হল এই রকম :
রাম=রা-(অর্থাৎ, জনপদের মানুষের রাজা)
রাবন= রা-বন (অর্থাৎ, বনের মানুষদের রাজা
সীতা= লাঙলের ফাল হরধনু ভেঙে রাম সীতাকে লাভ করলেন, তার অর্থ শিকারজীবী মানুষ রূপান্তরিত হচ্ছে কৃষিজীবীতে।
জীবিকার উপজীব্য পরিবর্তিত হচ্ছে, অর্থনীতির পরিভাষায় উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বদল ঘটছে। সীতাহরণের রূপকে বোঝানো হচ্ছে বনচর মানুষদেরও কৃষিকর্মের জ্ঞান আয়ত্ত করে ফেলার ইতিবৃত্ত। রাম-রাবণের সামাজিক স্তরের মানুষদের দ্বন্দ্ব এবং পরিণামে আদিবাসীদের পরাভবের কথা। অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে বনে পড়ে থাকার ফলে লাঙলে জমা মরিচাকে পুড়িয়ে ফের ব্যবহার উপযোগী করা। লব-কুশের অর্থ কৃষিসভ্যতার দ্যোতনাবাহী এবং লব ও কুশ যথাক্রমে শস্য ও তৃণের প্রতীক । তাদেরকে ঘরে নিয়ে আসার অর্থ ফসল গোলায় তোলা। আর মাটিরতলায় সীতার লুকিয়ে পড়ার অর্থ ফসলী মরশুমের পরিসমাপ্তি ধীরে ধীরে মাটির ওপরের হল কর্ষণের দাগগুলো (সীতা) মিলিয়ে যাওয়া। তাহলে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে রামায়ণের ‘বানর’ শব্দ দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে? এ ব্যাপারে একটি লৌকিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন অধ্যাপক জয়ান্তনুজ বন্দোপাধ্যায় তার মহাকাব্য ও লৌকিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় তার মহাকাব্য ও মৌলবাদ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৫); তিনি বলেছেন,
‘বন শব্দের সঙ্গে ইক্ প্রত্যয় যোগে বান শব্দ হয়, যেমন বানপ্রস্থ প্রভৃতি শব্দে। তারপর বান শব্দের সঙ্গে নর শব্দের সন্ধি করলে এবং সন্ধির একটি বিশেষ নিয়ম অনুযায়ী পুনরাবৃত্তিমূলক অক্ষরের একটিকে বাদ দিলে, বনে বসবাসকারী মানুষ অর্থে বানর হতে পারে। এমনও সম্ভব যে বানর, ভালুক প্রভৃতি জীবজন্তু বিভিন্ন বনবাসী আদিম জাতির টোটেম কিংবা প্রতীকি জাতিচিহ্ন ছিল। পৃথিবীর সব দেশেই প্রাচীনকালে আদিম জাতি-উপজাতিদেরমধ্যে এ ধরনের টোটেম কিংবা জাতি চিহ্ন প্রথা প্রচলিত ছিল। আর এই টোটেমের নামেই সেসব জাতি পরিচিত ছিল। যে প্রাচীন ভারতীয় সমাজের পটভূমিতে রামায়ণের কাহিনী রচিত হয়েছিল, সেখানেও এই টোটেম প্রথা নিঃসন্দেহে প্রচলিত ছিল। আর বানর বলতে হয়ত এমন একটি বনবাসী আদিমজাতিকে বোঝাত, যার টোটেম ছিল বানর। রামায়ণের বর্ণনাতে দেখাদেখি বানরদের রাজধানী কিস্কিন্ধ্যা একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। সে কারণে বনবাসের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের ভয়ে রাম নিজে সেখানে না গিয়ে লক্ষ্মণকে পাঠিয়েছিলেন সুগ্রীবের সঙ্গে আলোচনা করতে, এবং কিস্কিন্ধ্যার বাইরে বনের ভিতরে তার সঙ্গে দেখা করাবার ব্যবস্থা করেছিলেন।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ঐ সময় আর্থসামাজিক বিবর্তনকে অবলম্বন করে যে ভাবের সঞ্জাত হয়েছিল, রামায়ণ কাহিনী তার উপরেই বহির্কাঠামো (সুপার- স্ট্রাকচার) রূপে নির্মিত হয়েছে, কালক্রমে এমন একটা ব্যাখ্যা চলে আসছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে রামায়ণ তথা সকল মহাকাব্যেরই উৎস লুকিয়ে রয়েছে লৌকিক সাহিত্য প্রকরণের মধ্যে। অধ্যাপক পল্লব সেনগুপ্তের মতে,
‘আদিম মানুষের প্রথম সাহিত্য গড়ে উঠেছিল সৃষ্টি রহস্য, ব্রহ্মাণ্ডের আদি কারণ, প্রাণের উদ্ভবের সূত্র প্রভৃতি বিষয়ে তাদের বিচিত্র কল্পনায় গড়ে তোলা এবং অতিলৌকিক নানান সত্তা ও ঘটনাকে অবলম্বন করে কাহিনী তৈরি করার মাধ্যমে। এগুলোকে বিশেষজ্ঞরা নাম দিয়েছেন ‘মিথ’ বা লোকপুরাণ বলে। প্রতিটি প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীরই নিজস্ব সাংস্কৃতিক ইতিহাস গড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে এইসব মিথগুলোর অবদান অপরিসীম। তাদের ঈশ্বর ও দেব কল্পনা, ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত আচার-বিধিইত্যাদি বিষয় বিবর্তিত হবার উৎসে এবং প্রবাহে লুকিয়ে থাকে এইসব মিথগুলো তবুও ধর্মীয় বিশ্বাসে বুঁদ হয়ে থাকা, রামকে অবতার জ্ঞানে পূজা আর রামায়ণকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মান্য করা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যুগ যুগ ধরে। বিশ্বাসীরা ‘রামায়ণের প্রতিটি ঘটনা সত্য এবং রাম এ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে রাক্ষস রাবণকে হত্যা করে সীতাকে উদ্ধার করেন এবং রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।’ তাহলে প্রশ্ন আসে সেই সময়কাল কবে? কোন কোন ঐতিহাসিক বা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, রামায়ণে বর্ণিত ঘটনার সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ১২শ-১০মশতাব্দী হতে পারে। আমরা আগেই জেনেছি, বাল্মীকির নামে প্রচলিত রামায়ণ রচনার বেশ কয়েকটি ধাপ ছিল। এবং প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী এবং খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী আর দশরথ জাতক রামায়ণতো আরও অনেক পুরাতন।
বর্তমানে অযোধ্যা নামে পরিচিত ও তদসংলগ্ন এলাকায় এ পর্যন্ত প্রত্ন-খননে যেসব উপাদান সংগৃহীত হয়েছে তা থেকে চূড়ান্তভাবে কোন কিছুই প্রমাণিত হয়নি। মৌর্যযুগের কিছু জৈন ও বৌদ্ধ মূর্তি, মাটির তৈজসপত্র ইত্যাদি পাওয়া গেছে, যা ৪র্থ শতকের আগের নয় বলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের অনুমান। সব চাইতে পুরানো সাক্ষ্য ৮ম শতকের সময়কালের। মোদ্দা কথা হল প্রত্ন সাক্ষ্যে এখনও অযোধ্যার প্রাচীনত্ব বা এখানে যে একটি উচ্চমানের নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা প্রমাণ করা যায়নি ।
প্রত্নসাক্ষ্য বাদ দিলেও পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যেও অযোধ্যার সন্ধান মিলছে না । ‘অঙ্গুত্তর নিকা’য় যেসব প্রাচীন নগরের নাম পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে চম্পা, রাজগৃহ, শ্রাবন্তী, সাকেত, কৌশাম্বী আর বারানসী, অযোধ্যার নাম নেই। অন্যান্য নগরের মধ্যে রয়েছে বৈশালী, তক্ষশীলা, মথুরা, অহিচ্ছত্র, কুশিনারা, ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ, উজ্জয়নী। এখানেও অযোধ্যার খোঁজ নেই। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পরে রচিত (১০.২.৩১-৩৩ শ্লোক) অথর্ববেদে অবশ্য এক অযোধ্যার খোঁজ পাওয়া যায়। তবে সে অযোধ্যা; হল ‘দেব নগর’ বা ‘মিথিক্যাল সিটি’-৮টি বৃত্ত, ৯টি দ্বার ইত্যাদির মাধ্যমে একে মানব দেহের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং এটি ‘রামজন্মভূমি’ অযোধ্যা কি না সংশয় রয়েছে। বৌদ্ধ তত্ত্বগ্রন্থ ‘সমজুত্তনিকায়’তে এক অযোধ্যার উল্লেখ আছে বটে, তবে সেটা স্পষ্টভাবেই গঙ্গাতীরের একটি শহরের কথা বলা হয়েছে। এবং এই অযোধ্যার বয়স খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছর আগের নয়। হিউয়েন সাং তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে এই গাঙ্গেয় অযোধ্যার কথাই লিখেছেন। তাছাড়া খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে রচিত ‘বিষ্ণুস্মৃতি’ গ্রন্থের ৮৫তম অধ্যায়ে ৫২টি মূল তীর্থের তালিকায় অযোধ্যার নাম নেই । দেবতা রামের জন্মভূমি রূপে অযোধ্যার বিশেষ একটি মর্যাদা লাভ কি উচিত ছিল না এই তীর্থ তালিকায়? তাই বোঝা যাচ্ছে, অযোধ্যা কোনওদিন একটি তীর্থরূপে গণ্য হয়নি। স্বয়ং তুলসীদাস পর্যন্ত প্রয়াগকে তীর্থরাজ বলেছেন, কিন্তু ‘অযোধ্যা” তার কাছে নিতান্তই ‘আওধপুরী’। অধ্যাপক পল্লব সেনগুপ্তের মতে, ‘গুপ্তযুগেই রামকে সরযূ নদীর তীরের অযোধ্যা সঙ্গে জোড়া হয়েছে এবং ১৬ শতকের আগে রামকে নিয়ে কোন কাল্ট উত্তর প্রদেশে গড়ে উঠেনি (পৃঃ ১১৪)।’
এখন দেখা যাক রামায়ণের লংকা নিয়ে ঐতিহাসিকদের অভিমত। অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় (পৃষ্ঠা ৩৫, ৩৬) বলেছেন, ‘পণ্ডিতেরা এ বিষয়েও প্রায় ঐকমত্য পোষণ করেন যে রামায়ণের লংকা বর্তমান শ্রীলংকা নয়। কর্নাটক থেকে বেশি দূরে নয় এমন কোন বড় নদীর ধারে কল্পিত অথবা বাস্তব কোন পার্বত্য শহর। দশম-একাদশ শতাব্দীতে চোল সাম্রাজ্যের সঙ্গে শ্রীলংকার বাণিজ্য শুরু হবার পর থেকেই ক্রমশ রামায়ণ-এর লংকাকে শ্রীলংকার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয় । কোন কোন রামায়ণের পরবর্তী রূপায়ণে সেভাবে ভাষা এবং ভাবের রূপান্তর ঘটে’।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, রাম কোন ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। সেটা বুঝেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘রাম জন্মভূমি প্রকৃতপক্ষে মহাকবি বাল্মীকির মনোভূমি ছাড়া আর কিছুই নয় ৷’
সুতরাং রাম যদি অনৈতিহাসিক চরিত্র হন তবে রামায়ণ উপাখ্যান বা মিথ-এর উৎপত্তি স্থল কোথায়? এ ব্যাপারে দীপঙ্কর লাহড়ী তার ‘বিলুপ্ত জনপদঃ প্রচলিত কাহিনী’ গ্রন্থে (সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত, কলকাতা; ১৯৯৪ পৃষ্ঠা-১৯৫, ১৯৬) বলেছেন,
‘রামায়ণ প্রসঙ্গে অত্যন্ত বিস্মিত হতে হয় এই কথা ভেবে যে, সম্রাট অশোকের (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক) যুগে রাম নাম ধারী এমন কোন রাজা জনপদ কিংবা রাজ্য এ দেশে নেই। রামচন্দ্রের প্রাধান্য ভারতের জনমানসে বহুকাল ধরে স্বীকৃত তাতে ব্যাপারটা বিস্ময়কর বটে। অথচ ভূমধ্যসাগরের উত্তর পূর্বাঞ্চলে রাম কিংবা র-যুক্ত শব্দে চিহ্নিত বহু জনপদ ও রাজার নাম রয়েছে যেগুলোর প্রাচীনত্ব খ্রিস্টপূর্ব প্রথম বা দ্বিতীয় সহস্রকের। যেমন মিশরের ফারাও বিভিন্ন রামেসিস (সংখ্যা ১১ জন); ডেভিডের পূর্বপুরুষ, ইব্রাহিমের উত্তর পুরুষ হিষরোনের পুত্র রাম জেরামিলের পুত্র এলিহুর পূর্বপুরুষ (বাইবেল); রামাল্লা (পশ্চিম জর্ডানে জেরুজালেমের উত্তরে শহর), রমণ (তেল আবিবের কাছে শহর), রামাথেইম জোসিফ (স্যামুয়েলের জন্মস্থান-বাইবেল), রামঃ বা রমঃ (Ramah বাইবেলে উক্ত শহর), রামথ লেহি (দক্ষিণ পশ্চিম প্যালেস্টাইনের অঞ্চল বিশেষ— এখানে স্যামসনের হাতে ফিলিস্টাইনরা নিহত হয়), রামথ-নিজপে (জর্ডন নদীর পূর্ব অঞ্চল বিশেষ), র্যামবুয়া (Rambauillet – উত্তর ফ্রান্সের শহর)। এছাড়াও রম কিংবা রুপ উপসর্গযুক্ত শব্দ অনেক আছে যা ইউরোপের মধ্যভাগের ব্যক্তি, নগরী বা দেশ বোঝাতো। ‘রোম নগরের প্রতিষ্ঠাতা রেমুলাস ও রেমাস নামক দুই যমজ ভ্রাতা। রোম বা রুমানিয়া দুটি সুন্দর উদাহরণ। জিপসিরাও নিজস্ব ভাষায় নিজেদের রম নামে পরিচয় দিতো।
এছাড়া আমরা জানি যে, অসংখ্য দেব দেবী অধ্যুষিত প্রাচীন মিসরের প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্যদেব ‘রা’, তিনি দেবকুলের রাজা। কেউ কেউ মনে করেন তার আদি নাম রাম (Ram)। রা বা রাম নামে সম্ভবত তিনিই ছিলেন মিশরের বদ্বীপ অঞ্চলের অতি প্রাচীন নগর হেলিয়োপলিসের অধীশ্বর এবং মিশরসহ সমগ্র পশ্চিম এশিয়া আর দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বিশেষত গ্রীসের সর্বজনমান্য দেবতা। সেই আমলে সূর্যদেবের পূজায় যে আন্তর্জাতিকতা দেখা গেছে তা নজিরবিহীন। এ থেকে অনেকে ধারণা করে থাকেন রাম ভারতের আগে মধ্যপ্রাচ্যের- অর্থাৎ মিশরের রাম এখন ভারতীয় ভগবান (সূত্রঃ দ্বন্দ্বে ও দ্বৈরথে; পৃষ্ঠা-৮০)। এবং সেই রাম আর্যদের মাধ্যমে ইরানীয় অঞ্চল দিয়ে আস্তে আস্তে উত্তর ভারতে প্রবেশ করেছে।
হোমার রচিত ইলিয়াড মহাকাব্যের সাথে রামায়ণের কাহিনীর মিল দেখে অনেক রামায়ণ বিশেষজ্ঞদের মতে রামায়ণ প্রকৃতপক্ষে ভারতের পরিবেশে ইলিয়াড-এর ছায়া অবলম্বনে রচিত, হয়তো কিছুটা ওডিসির ছায়াও পড়ে থাকতে পারে । জার্মানির বিশিষ্ট রামায়ণ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালব্রেকট ওয়েবার এই মত পোষণ করতেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের আগেই রচিত হয়েছিল। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এই মত প্রকাশ করেছেন যে, হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যই আগে রচিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে রামায়ণে ইলিয়াড থেকে অনেক উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছিল । তবে কেউ কেউ এ ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তাদের অভিমত হচ্ছে, ‘রামায়ণ বা মহাভারত’ কাব্য দু’টি বিশ্বের দু’টি চিরন্তন সত্যকে আশ্রয় করে লিখিত। একটা হচ্ছে নারী অন্যটি হচ্ছে ভূমি। রাম-রাবণের যুদ্ধ হয়েছিল নারীহরণকে কেন্দ্র করে আর মহাভারতের কুরুক্ষেত্র কাহিনী রচিত হয়েছে ভূমিকে কেন্দ্র করে । নারীহরণ ও তার জন্য যুদ্ধ, এই বিষয়বস্তুর জন্য গ্রীক কবি হোমারের কাছে যাবার প্রয়োজন ছিল না। আবার অনেকে এমন মনে করেন যে, রামায়ণ ও ইলিয়াড দুটি মহাকাব্যই আরো প্রাচীন কোন উৎস থেকে এসেছে। অনেক বছর আগে মাল্লাদী ভেঙ্কট রত্নম নামে অন্ধ্র প্রদেশের একজন পণ্ডিত দুই খণ্ডে বই লিখে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, রাম ছিলেন প্রকৃতপক্ষে মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্যারাও দ্বিতীয় র্যামোসিস, সীতা ছিলেন ইখনাতোনের ভগ্নি সীতামন, আর রাবণ ছিলেন একজন হিটাহট রাজা। জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার মহাকাব্য ও মৌলবাদ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৩) নীরদ চৌধুরীর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Contient of Cire’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘রামায়ণ কাহিনী আদতে মধ্যপ্রাচ্যের কোন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে আর্যদের সঙ্গে তা ভারতে প্রবেশ করে এবং উত্তর ভারত থেকে ক্রমশ দক্ষিণ ভারতে বিস্তারের ঐতিহাসিক পটভূমিতে নানাভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে ভারতের রামায়ণের রূপ ধারণ করে।’
এই আলোচনার ভিত্তিতে আমরা কতিপয় সিদ্ধান্ত টানতে পারি। (১) রাম যে ঐতিহাসিক চরিত্র, এখন পর্যন্ত প্রমাণিত নয়। (২) মূল রামায়ণে রামের অবতারত্ব প্রসঙ্গ নেই এবং পল্লবিত রামায়ণে রামের ওপর বিষ্ণুর যে অবতারত্ব তা পরবর্তীকালের প্রক্ষেপণ। (৩) সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস ভিত্তিক রামায়ণের একটি সামাজিক ব্যাখ্যা দেয়া যায়, যাকে রাম-রাবণ-সীতার প্রতীকে মহাকবি বাল্মীকি এই মহাকাব্য উপস্থিত করেছেন।
অথচ রামজন্মভূমি ও রামমন্দির প্রতিষ্ঠার নামে সারা উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারতে কি লংকাকাণ্ডই না ঘটে চলেছে দীর্ঘকাল ধরে। কত সহস্র নিরপরাধী অসহায় মানুষ প্রাণবিসর্জন দিল ধর্মের নামে। ইতিহাস কি আমাদের ক্ষমা করবে?
রামায়ণ মহাকাব্য হিসেবে অতুলনীয় এবং সাহিত্য জগতে এর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এই মহাকাব্যকে ধর্মগ্রন্থ বানিয়ে এবং রামচন্দ্রের মর্যাদা রক্ষার নামে একদল ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ এবং রামভক্ত আধুনিক হনুমানেরা যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং ঘটাচ্ছে তাতে কি এই মহাকাব্যকেই অপমান করা হচ্ছে না? এর অবমূল্যায়ন ঘটছে না? আমাদের মনে হচ্ছে, রাম জন্মভূমি আর বাবরি মসজিদ নিয়ে ঘটনার রেশ আরও দীর্ঘকাল আমাদের বহন করতে হবে, আমরা কেবল আশা করব ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সেক্যুলার শক্তি উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করবে— রক্ষা করবে অসহায় মানবতাকে ।
প্রাসঙ্গিকী ও তথ্যপঞ্জী
১. A L Basham, The wonder that was India, Forntana, Calcutta, 1971, p 301, 304, 306.
২ . জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়, মহাকাব্য ও মৌলবাদ, এলাইড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃ.২১। “…বাল্মীকি রামায়ণে-এর বালকাণ্ডে যেভাবে কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে, তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে রাম নামক একজন নরপতির উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই এই মহাকাব্য রচিত হয়েছে। কোনো অবতারের বাস্তব ইতিহাসকে নয়। রামায়ণের আরম্ভে বাল্মীকি নারদকে বলেছেন : ‘এক্ষণে এই পৃথিবীতে কোন ব্যক্তি গুণবান, বিদ্বান, মহাবল, পরাক্রান্ত, মহাত্মা, ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী, কৃতজ্ঞ, দৃঢ়ব্রত ও সচ্চরিত্র আছেন? কোন ব্যক্তি সকলপ্রকার প্রাণীর হিতসাধন করে থাকেন? কোন ব্যক্তি লোকব্যবহারকুশল, অদ্বিতীয়, সুচতুর ও প্রিয়দর্শন? কোন ব্যক্তিই বা রোষ ও অসুয়ার বশবর্তী নহেন? রণস্থলে জাতক্রোধ হইলে কাহাকে দেখিয়া দেবতারাও ভীত হন? হে তপোবন! এইরূপ গুণসম্পন্ন মনুষ্য কে আছেন, তাহা আপনিই বিলক্ষ্মণ জানেন। এক্ষণে বলুন, ইহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে।’ বাল্মীকি স্পষ্টতই একজন বহুগুণসম্পন্ন আদর্শ মানুষের পরিচয় পেতে চাইছেন। অবতারের কথা জিজ্ঞেস করছেন না। এমনকি কোন রাজার কথা জিজ্ঞেস করছেন না। অবতারত্বের প্রশ্ন জড়িত থাকলে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হতো না। কারণ রামায়ণ-এর অন্যত্র বর্ণনা অনুযায়ী অযোধ্যা নগরী থেকে বাল্মীকির আশ্রয় বেশি দূরে ছিলো না। বাল্মীকির প্রশ্নের উত্তরে নারদও একজন বহুগুণ সম্পন্ন নরপতির নাম করেছেন, একজন অবতারের নাম নয়। নারদ বলেছেন : ‘তাপস, তুমি যে সমস্ত গুণের কথা উল্লেখ করিলে, তৎসমুদয় সামান্য মনুষ্যে নিতান্ত সুলভ নহে। যাহাই হউক, এরূপ গুণবান মনুষ্য এই পৃথিবীতে কে আছেন, এক্ষণে আমি তাহা স্মরণ করিয়া কহিতেছি, শ্রবণ কর।’; এর পর নারদ এই বলে কাহিনী শুরু করেছেন যে, ‘রাম নামে ইক্ষাকু বংশীয় সুবিখ্যাত এক নরপতি আছেন।’ তারপর রামের কিছু গুণ বর্ণনা; করে তার অভিষেকের মুখে কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্র এবং দশরথের কাছে বর প্রার্থনা থেকে আরম্ভ করে সীতাকে উদ্ধার করে লংকা থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত কাহিনী সংক্ষেপে বলে শেষে জানাচ্ছেন যে তখনও ‘অযোধ্যাপতি রাম পিতার ন্যায় প্রজাপালন করিতেছেন।’ অর্থাৎ নারদ কাহিনী বাল্মীকিকে বলবার সময় রাম অযোধ্যায় রাজত্ব করছেন। এরপর নারদ রামরাজত্বের মহত্ত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন এই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, ‘রাম দশ সহস্র ও দশ শত বছর রাজ্য শাসন করিয়া ব্রহ্মলোকে গমন করিবেন।’
৩. হেমচন্দ্র (অনূদিত), বাল্মীকি রামায়ণ, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ ১০৯৭-৯৮, ১১০৩।
- www.solarviews.com/sun.ht;
http://observer.arc.nasa.giv/nasa/exhibits/sun/sun
৫. ভারতের বাইরে এশিয়ার বহুদেশে রামায়ণ কাহিনী ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্ধটিতে – V. Raghavan The Ramayan in Greater India, South Gujrat India University, Surta, 1975.
৬. উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ভারতবর্ষ ও বৃহত্তর ভারতের পুরাবৃত্ত, ১ম খণ্ড, বি. সরকার এন্ড কোং, কলিকাতা, ১৯৫০।
৭. ঈশান চন্দ্ৰ ঘোষ (অনূদিত), জাতক, ৪র্থ খণ্ড, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৩৮৫, পৃ ৮৭-৯১।
১ (ক) লক্ষ্মণ সীতারে লয়ে, অবতরি জলমাঝে, দুইজনে থাক দাঁড়াইয়া ;
(খ) বলিল ভরত আসি, গিয়াছেন স্বর্গপুরে দশরথ জীবন ত্যাজিয়া ।
২ বল রাম, কোন বলে হয়ে বলিয়ান
পিতার বিয়োগ বার্তা করিলে শ্রবণ,
শোককালে শোকাতুর নহে তব প্রাণ?
তথাপি না অভিভূতে দুঃখ তব মন!
রামপণ্ডিত নিজের অশোকের কারণ বুঝাইবার নিমিত্ত নিম্নলিখিত গাথাগুলো বলিলেনঃ
৩. দিবা রাত্র উচ্চৈঃস্বরে করিয়া ক্রন্দন
তার জন্য বৃথা শোকে হয় কি কাতর
যাহারে রক্ষিতে কেহ পার না কখন,
বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, জ্ঞানবান নর?
৪. বাল, বুদ্ধ, ধনবান, অতি দীন হীন,
মূর্খ, বিজ্ঞ সকলেই মৃত্যুর অধীন।
৫. তরুশাখে ফল যবে পরিপক্ক হয়,
অনুক্ষণ থাকে তার পতনের ভয়।
জীবগণ, সেইরূপ জন্ম লাভ করি
মৃত্যুভয়ে দিবানিশি কাঁপে থরথরি ।
৬. ঊষাকালে যাহাদের পাই দশরথ
ইহাদের (ও) বহুজন ঊষা না ফিরিতে
না হেরি সায়াহ্নকালে তার বহুজন;
অদৃশ্য হইয়া যায় যমের কুক্ষিতে।
৭. বৃথশোকে অভিভূত হয়ে মূঢ় জন
লভিতে ইহাতে যদি সুফল তাহারা,
আত্মার অশেষ ক্লেশ করে উৎপাদন;
পণ্ডিতেও শোকবেগে হ’ত আত্মহারা।
৮. শোকেতে শরীর ক্ষয়, লাভ নাহি আর;
বিবর্ণ, বিশুষ্ক দেহ, অস্থিচর্মসার।
শোক কি করিতে পারে মৃতুঞ্জীবন?
কি ফল পাইব তবে করিয়া ক্রন্দন?
৯. বারির সাহায্যে যথা গৃহ দহ্যমান
সযতনে গৃহিগণ করলে নির্বান
ধীর শাস্ত্রজ্ঞানী, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ
তেমতি শোকের সদা করেন দমন।
বায়ুবেগে তুলারাশি উড়ি যথা যায়,
প্রজ্ঞাবলে শোক তথা শীঘ্ৰ লয় পায়।
১০. কৰ্ম্মবশে যাতায়াত করে জীবগণ;
কেহ মরে, কেহ করে জনম-গ্রহণ।
এই মাতা, পিতা, এই সোদর আমার,
হেনজ্ঞানে সুখে মগ্ন নিখিল সংসার ।
১১. গিয়াছেন স্বর্গে পিতা,
কি কাজ ক্রন্দনে?
লইব পিতার স্থান,
দীনেরে কবির দান
রাখিব মানীর মান,
ভাবিয়াছি মনে।
জ্ঞাতিজনে সাবধানে
করিব পালন,
পুষিব যতনে আর
যত পরিজন।
১২ সুধীর, শাস্ত্রজ্ঞ লোকে করেন দর্শন
ইহলোকে, পরলোকে প্রভেদ কেমন।
যত বড় শোক কেনো উপস্থিত হয়,
দহিতে পারে না কভু তাদের হৃদয়।
৯. উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, পূর্বোক্ত, পৃ ৮৬-৯০
১০. পল্লব সেনগুপ্ত, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা, উৎসের সন্ধানে, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা, পৃ ৯৪-৯৫।
১১. ঐ, পৃ ১১৩ ।
১২. গৌতম নিয়োগী, রাম জন্মভূমি বনাম বাবরি মসজিদ, মাসিক অনিক, জুআই ১৯৯০, কলকাতা, পৃ ৩২।
১৩. J I Brockington, Righteous Rama : The Evolution of an Epic, Oxford University Press, Delhi.
১৪. অতুল সুর, হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য, সাহিত্যালোক, কলকাতা, পৃ ৩৩-৪২ ।
১৫. Malladi Venkat Ratnam, The greatest Pharao of Egypt, 2 vols., Rajahmudnry, 1934.
১৬. বেনজীন খান, দ্বন্দ্বে ও দ্বৈরথে, চারুলিপি প্রকাশন, ঢাকা।
১৭. আর এম দেবনাথ, সিন্ধু থেকে হিন্দু, রিডার্স ওয়েজ, বাংলাবাজার, ঢাকা ।
১৮. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৷
১৯. নন্দগোপাল, সেনগুপ্ত, বস্তুবাদীর ভারত জিজ্ঞাসা, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা ।
http://www.time.com.asia.features/India_ayodhya/timeline/;
http://www.vepachedu.org/ Babri-history.html;
http://en.wikipedia.org/wiki/Babri_mosque; http://news.bbc.co.uk/2/hi/south_asia/1844930.stm
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ