রান্নার সঙ্গে সবসময় বান্না যুক্ত হয় কেন?

 খেলাধুলার তাও অর্থ করা যায়। খেলার সময় ধুলা উড়ে এলেই খেলাধুলা। খাবারের সঙ্গে যুক্ত হয় দাবার। খাবারদাবার। দাবার আবার কী? দাবারের একটি অর্থ আমি করেছি। তেমন সুবিধার খাবার যেটা না সেটাই দাবার। কোথাও দাওয়াতে গেলে (সচরাচর যাওয়া হয় না, তারপরও হঠাৎ…) টেবিলে প্রচুল খাবার দেওয়া হয়। আমি সেখান থেকে খাবারগুলি আলাদা করি, দাবারের কাছে যাই না। সাত পদ রান্না হলে পাঁচ পদই যে দাবার হবে, এটা কিন্তু নিপাতনে সিদ্ধ।

যাই হোক, রান্নাবান্নায় ফিরে যাই। চৈত্র মাসের এক দুপুরে খেতে বসেছি। টেবিলে খাবার সাজানো। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রতিটি আইটেম দেখাচ্ছে রোগীর পথ্যের মত। পানি পানি ঝোলে ধবধবে সাদা শিং মাছের টুকরা। সঙ্গের সবজি হলো কাঁচকলা। যে মেয়েটি রান্না করে তাকে ডেকে শাওন বলল, তোমাদের স্যার তরকারিতে লাল রং পছন্দ করেন। তেল-মসলা ছাড়া খান না।

শাওনের বক্তৃতার ফল রাতে ফলল। খেতে বসে দেখি রঙের হোলি উৎসব। করলা ভাজির রঙও টকটকে লাল। দুপুরে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম, রাতে বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমি রান্নার একটা বই লিখব।

অন্যপ্রকাশের মাজহার এই কথা শুনে আল্লাদিত হলো। এবং সিরিয়াস মুখ করে বলল, বইয়ের নামটা বলুন, আমি ধ্রুবকে কভার করতে বলে দেই। কাজ এগিয়ে রাখি।

আজকাল টিভি খুললেই রান্না এবং টকশোর অনুষ্ঠান। দুটো অনুষ্ঠানের মধ্যে মিলও আছে। রান্নার অনুষ্ঠান থেকে কেউ রান্না শিখতে পারছে না, টকশোর অনুষ্ঠান থেকে কেউ কিছু শিখছে না।

সেলিব্রেটি রান্না নামের আরেক বস্তু বের হয়েছে। গায়ক-গায়িকা, চিত্রশিল্পী, নায়ক-নায়িকারা অনুষ্ঠানে নতুন নতুন রান্না শেখাচ্ছেন। (অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকাই সব তৈরি করে রাখছেন। সেলিব্রেটিরা হাসিমুখে চামচ নাড়ছেন।) শাওন গায়িকা এবং অভিনেত্রী হিসেবে এক রান্নার অনুষ্ঠানে গেল। কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তে তাকে চার লাইন গানও করতে হলো।

আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা ভাঙা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে…

খুন্তি কড়াই এবং রঙধনু কোপ্তার (শাওনের রান্না করা খাদ্যদ্রব্যটির এটাই নাম) সঙ্গে অবাক জোছনার সম্পর্ক ঠিক বুঝলাম না।

অনেকক্ষণ হালকা কথা বললাম, এখন মাঝারি টাইপ ভারী কথা বলি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক পার্ল এস বাকের (গুড আর্থ) সীমাহীন আগ্রহ ছিল রান্নাবান্নায়। তিনি রান্নার একটি বইও লিখেছেন। এই বইটির কপি আমার কাছে আছে।

কবি সৈয়দ আলী আহসান সাহেবও রান্নার বই লিখেছেন। তাঁর বইয়ের রেসিপি ব্যবহার করে শুধু রসুন দিয়ে আমার বাসায় মুরগি রান্না হয়েছিল। খেতে অসাধারণ হয়েছিল। যদিও বই দেখে রান্না কখনো ভালো হয় না, এই তথ্য নিউটনের সূত্রের মতো সত্য।

বর্তমানে এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ সাহেব যখন মন্ত্রী ছিলেন না, তখন একরাতে আমার বাসায় আড্ডা দিতে এসেছিলেন। আড্ডায় রান্নার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি মোটামুটি অভিভূত গলায় বললেন, হুমায়ুন ভাই, শেখ হাসিনা যে কত ভালো রাঁধতে পারেন তা কি আপনি জানেন?

আমি বললাম, জানি না। জানার কোনো সুযোগ নেই।

সৈয়দ আশরাফ বললেন, তাঁর রান্না শুধু যে অসাধারণ তা-না, অসাধারণের অসাধারণ।

বঙ্গবন্ধু কন্যার এই গুণটির কথা কেউই মনে হয় জানেন না। সুযোগ পেয়ে জানিয়ে দিলাম।

প্রধানমন্ত্রীর কেবিনেটে কিছু নারীমুখ দেখছি। টিভি পর্দায় তাদের যখন দেখি তখন প্রথমেই মনে হয়, আচ্ছা এই অতি ব্যস্ত মহিলা বি এখন রাঁধেন? বা রান্নাবান্না নামক ব্যাপারটা জানেন? তাঁদের প্রিয়জনরা কি তাঁদের হাতের রান্না খেয়ে কখনো বলেছেন, বাহ অসাধারণ!

আমার নিজের ধারণা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন রান্না জানেন না। রাঁধার মতো সুযোগই পান নি। রাজনীতি করে এবং বক্তৃতা দিতে দিতেই তাঁর জীবন কেটে গেছে। টিভিতে তাকে মাঝে মধ্যে দেখি। যাই বলেন বিকট চিৎকার দিয়ে বলেন।

মনে হয় পলটন ময়দানে ভাষণ দিচ্ছেন, মাইক কাজ করছে না বলে চেঁচিয়ে বলতে হচ্ছে।

উনি চিৎকার করতে থাকুন, আমি রান্নাবান্নায় ফিরে আসি। প্রথমেই কুইজ—স্বাদ কত রকমের?

তিক্ত
লবণ
মিষ্টি
ঝাল
টক

 পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মতো পঞ্চ স্বাদ। সবাই কুইজে ফেল করেছেন। স্বাদ ছয় রকমের। ষষ্ঠ স্বাদের নাম Umami, সব খাবারেই কিছু Umami স্বাদ থাকে। মাংসে আছে, টমেটোতে আছে। সয়াসসে আছে প্রচুর পরিমাণে। Umami স্বাদটা এসে একধরনের লবণ থেকে। লবণের নাম Monosodium glutamate.

প্রকৃতি মানুষের মুখে পাঁচ রকমের স্বাদ কেন দিয়েছেন? দিয়েছেন আমাদের সর্তক করার জন্যে। পৃথিবীর যাবতীয় বিষাক্ত জিনিসের স্বাদ তিতা। আমরা যেন তিতা না খাই। নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবারের স্বাদ হবে টক। আমাদের নষ্ট খাবার বিষয়ে সতর্ক করার জন্যেই টক স্বাদ বুঝার টেস্ট বাড জিভে দেয়া আছে।

এখন আমরা বুঝে শুনে খেতে শিখেছি। আদি মানুষের সেই বোধ ছিল না। তাদেরকে নির্ভর করতে হতো জিভের ওপর।

পশ্চিমে রান্নাবান্নার পুরোটাই পুরুষদের দখলে। বাংলাদেশে ঘটনা সেরকম না। তার প্রধান কারণ আমাদের কালচারে পুরুষদের রান্নাঘরে ঢোকাকে মেয়েলি ভাব বলে মনে করা হয়। স্বামীদের রান্নাঘরে ঢুকতে দেখলে বিরক্ত হন না এমন স্ত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। বাংলাদেশে বাবুর্চি শব্দটাও বুদ্ধিজীবীর মতো তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হয়। বিখ্যাত শেফ টমি মিয়াকে বাবুর্চি টমি মিয়া বললে তিনি নিশ্চয়ই রাগ করবেন।

আমার ধারণা সব পুরুষের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় রান্নার শখ আছে। আমার নিজের তো আছেই। শখ মেটাই রান্নার বই পড়ে। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির একটা বড় অংশে আছে রান্নার বই। আমার গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররাও ভালো খাবার পছন্দ করে। হিমু তো করেই। সে মাজেদা খালার বাড়িতে যায় ভালো ভালো খাবারের লোভে।

মিসির আলির মতো নিরাসক্ত লোকও খাবার খেয়ে তৃপ্তির বিরাট বর্ণনা দেন।

আমার বইয়ে অনেক রেসিপিও দেয়া থাকে। অনেকে আবার সেই রেসিপি দেখে রাঁধতে গিয়ে ধরা খান। যাই হোক, একটি অতি সহজ রেসিপি দিচ্ছি। আমি এর নাম দিলাম ডিজিটাল জাউভাত।

আতপ চাল লাগবে। পাটপাতা লাগবে। পেঁয়াজ-লবণ নিশ্চয়ই ঘরে আছে।

পরিমাণ?

মেপে পরিমাণ দিতে পারছি না।

হাঁড়িতে আতপ চাল সেদ্ধ করুন। সঙ্গে সামনি পেঁয়াজ এবং লবণ। চাল সেদ্ধ হয়ে জাউ জাউ হয়ে যাবার পর কিছু পাটপাতা (তেতোটা) দিয়ে দিন ঘোঁটা। তৈরি হয়ে গেল ডিজিটাল জাউ।

গরম গরম পরিবেশন করুন।

চেহারা দেখে কেউ খেতে চাইবে না। তবে রাঁধুনীর প্রতি মমতাবশত কিংবা ভদ্রতাবশত কেউ যদি এক চামচ মুখে দেয়, সে দ্বিতীয়বারও নেবে।

এই রেসিপি আমি পেয়েছি নিউইয়র্ক প্রবাসী এক মহিলা কবির কাছ থেকে। তাঁর নাম নার্গিস আলমগীর।

অতি সাদামাটা রেসিপি দেখে যারা নাসিকা কুঞ্চন করছেন তাদের জন্যে মিশরের ফারাওদের খাবারের একটি রেসিপি। সম্রাটদের খানা বলে কথা।

চাল, ঘি, ভেড়ার মাংস হাঁড়িতে নিন। হাঁড়ির ঢাকনা আটা দিয়ে আটকে দিল। অল্প আঁচে সাত আট ঘণ্টা রাখুন। রেসিপিতে মসলাপাতির উল্লেখ নেই বলে দিতে পারছি না। মসলা এবং লবণ দিতে ভুলবেন না।

(সুত্র : বিরিয়ানির নেপথ্য কাহিনী, শাহরিয়ার ইকবাল।)

রান্নার ওপর কোনো বই না লিখলেও একটা রান্নার বইয়ের ভূমিকা আমার লেখা। বইটি হলো অবসর প্রকাশনীর ইলিশ রান্না।

পাঠকদের জন্য ইলিশ রান্না বইটির ভূমিকাটা দিয়ে দিলাম।

 

ভূমিকা

তখন আমেরিকার কার্গো শহরে থাকি। জানুয়ারি মাস, হাড়কাঁপানো শীত। থার্মোমিটারে পারদ নেমে গেছে শূন্যেরও কুড়ি ডিগ্রি নিচে। সকাল থেকেই তুষারপাত হচ্ছে। দৃশ্য খুবই সুন্দর, তবে বাইরে বের হয়ে দেখার দৃশ্য না। ঘরে বসে জানালা দিয়ে দেখার দৃশ্য।

এমন দুর্যোগের দিনেও বিকেল থেকেই আমার বাসায় অতিথিরা আসতে শুরু করল। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং মুরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী ছাত্র। কারণ আজ আমার বাসায় ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে। ইলিশ মাছ এসেছে বাংলাদেশ থেকে। সিল করা টিনে ইলিশ। যতদূর মনে পড়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরির পাইলট প্রকল্পের জিনিস। যে প্রকল্পটি শেষ পর্যন্তু কাজ করে নি।

 কৌটা খুলে দেখা গেল হলুদ রঙের আলুভর্তা জাতীয় পদার্থ। সেই জিনিস তেলে ভাজা হলো। সবাই চায়ের চামচের ছ’চামচ করে পেল। সবার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। যেন অমৃত চাখা হচ্ছে।

খাওয়াদাওয়ার পর রাতভর শুধুই ইলিশের গল্প। পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি, না যমুনার ইলিশের? সুরমা নদীতে যে ইলিশ ধরা পড়ে তার স্বাদ গভীর সমুদ্রের ইলিশের মতো। তার কী কারণ? এই নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা। একজন আর শুনালেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানে ধাক্কা খাওয়া ইলিশের গল্প। স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে ইলিশ মাছের নাক থেঁতো হয়ে যায়। সেইসব নাকভাক্তা ইলিশই আসল পদ্মার ইলিশ।

এরপর শুরু হলো ইলিশ রান্নার গল্প। দেখা গেল সবাই ইলিশ রান্নার কোনো-না-কোনো পদ্ধতি জানে। ভাপে ইলিশ, চটকানো ইলিশ, শুধু লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে সেদ্ধ ইলিশ। গভীর রাত পর্যন্ত গল্প চলতেই থাকল।

পঁচিশ বছর আগের আমেরিকার এক দুর্যোগের রাতের সঙ্গে এখনকার অবস্থা মিলানো যাবে না। এখন আমি ঢাকা শহরে বাস করি। ইলিশ মাছ কোনো ব্যাপার না। প্রায় রোজই রান্না হয়। নতুন নতুন পদও হয়। এই তো সেদিন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শেফ টমি মিয়া নিজে রান্না করে ইলিশ মাছের একটা পদ খাওয়ালেন–স্মোকবিহীন ‘স্মোকড হিলসা’। সাহেবদের পছন্দের খাবার।

স্মোকড হিলসা খেতে খেতেই শুনলাম অবসর প্রকাশনা সংস্থার আলমগীর রহমান শতাধিক পদের ইলিশ রান্নার একটি বই কম্পোজ করে রেখেছেন। কাউকে দিয়ে ভূমিকা লেখানো যাচ্ছে না বলে বইটি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ভূমিকা আমি লিখে দেব।

সাধারণত দেখা যায় লেখকদের লেখার ক্ষমতা পুল্লাপুরি শেষ হবার পর তারা ভূমিকা এবং সমালোচনা জাতীয় রচনা লেখা শুরু করেন। যে আগ্রহে ভুমিকা লিখতে রাজি হয়েছি তাতে মনে হয় আমার ঘণ্টা বেজে গেছে। আচ্ছা বাজুক বণ্টা, আমি ভূমিকাতেই থাকি।

গুরুগম্ভীর ভূমিকা লেখার বিশেষ কায়দা আছে। প্রথমেই নামের উৎপত্তিতে যেতে হয়। ইলিশ নামটা কীভাবে এল, কেন এল। এই প্রজাতির মাছ পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে পাওয়া যায়। যেসব মাছ সমুদ্রে থাকে এবং ডিম পাড়ার জন্যে মিঠা পানিতে আসে তাদের শ্রেণীবিন্যাস। সেই বিন্যাসে ইলিশের স্থান কোথায় সে বিষয়ে আলোচনা। এরপর আসবে ইলিশের ইতিহাস। বাংলা আদি সাহিত্যে (চর্যাপদে) ইলিশ মাছের উল্লেখ কেন নেই সে বিষয়ে গবেষণামুলক সুচিন্তিত মতামত। মোগল রসুইখানায় ইলিশের অনুপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা।… আমি এইসব কিছুই জানি না। আমি শুধু জানি বাংলা বর্ণমালার শিশুশিক্ষা বইয়ে অ-তে হয় অজগর, আ তে আম, ই-তে ইলিশ.. এই তথ্যই কি ইলিশ রান্না বিষয়ক একটি বইয়ের ভূমিকার জন্য যথেষ্ট নয়?

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x