শ্লোকঃ ২২
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ॥ ২২ ॥
অনন্যাঃ—অনন্য: চিন্তয়ন্ত:- চিন্তা করতে করতে; মাম্ — আমাকে যে – যে; জনাঃ—ব্যক্তিগণ; পর্যুপাসতে— যথাযথভাবে আরাধনা করেন; তেষাম্—তাঁদের; নিত্য — সর্বদা, অভিযুক্তানাম্ — ভগবদ্ভক্তিতে যুক্ত, যোগক্ষেমম্—অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি এবং প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ, বহামি বহন করি, অহম্ — আমি।
গীতার গান
কিন্তু যে অনন্যভাবে মোরে চিন্তা করে ।
একান্ত হইয়া শুধু আমাকে যে স্মরে ॥
সেই নিত্যযুক্ত ভক্ত আমার সে প্রিয় ।
যে সুখ চাহয়ে সেই হয় মোর দেয় ॥
আমি তার যোগক্ষেম বহি লই যাই ৷
আমা বিনা অন্য তার কোন চিন্তা নাই ॥
অনুবাদঃ অনন্যচিত্তে আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে, পরিপূর্ণ ভক্তি সহকারে যাঁরা সর্বদাই আমার উপাসনা করেন, তাঁদের সমস্ত অপ্রাপ্ত বস্তু আমি বহন করি এবং তাঁদের প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ করি।
তাৎপর্যঃ যিনি কৃষ্ণভাবনা ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না, তিনি শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, বন্দন, অর্চন, পাদসেবন, দাস্য, সখা ও আত্মনিবেদনের দ্বারা নবধা ভক্তিপরায়ণ হয়ে চব্বিশ ঘণ্টা শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ ছাড়া অন্য কিছু করেন না। ভক্তির এই সমস্ত ক্রিয়া পরম মঙ্গলময় এবং পারমার্থিক শক্তিসম্পন্ন, যার ফলে ভক্ত আত্ম-উপলব্ধিতে পূর্ণতা লাভ করতে পারেন। তখন তাঁর একমাত্র অভিলাষ হয় ভগবানের সঙ্গ লাভ করা। এই প্রকার ভক্ত অনায়াসে নিঃসন্দেহে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করেন। একে বলা হয় যোগ। ভগবানের কৃপার ফলে এই ধরনের ভক্তদের আর কখনও এই জড়-জাগতিক বদ্ধ জীবনে ফিরে আসতে হয় না। ক্ষেম কথাটির অর্থ হচ্ছে ভগবানের কৃপাময় সংরক্ষণ। যোগের দ্বারা কৃষ্ণভাকা লাভ করতে ভগবান ভক্তকে সহায়তা করেন এবং তিনি পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হলে ভগবান তাঁকে দুঃখময় বদ্ধ জীবনে পতিত হবার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করেন।
শ্লোকঃ ২৩
যেহপানাদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্ ॥ ২৩ ॥
যে—যারা; অপি—ও; অন্য অন্য দেবতা— দেবতা; ভক্তাঃ— ভক্তেরা; যজন্তে— পূজা করে, শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ- :-শ্রদ্ধা সহকারে, তে— তারা; অপি–ও, মাম্ এব আমাকেই, কৌন্তেয় হে কুন্তীপুত্র; যজন্তি পূজা করে; অবিধিপূর্বকম— অবিধিপূর্বক।
গীতার গান
ইতর দেবতা যেবা পূজে শ্রদ্ধা করি ৷
সেও আমাকে পূজে বিধি ধৰ্ম ছাড়ি ॥
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! যারা অন্য দেবতাদের ভক্ত এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাঁদের পূজা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা অবিধিপূর্বক আমারই পূজা করে।
তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “যারা দেবতাদের উপাসনা করে, তারা অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন, যদিও এই ধরনের উপাসনা পরোক্ষভাবে আমারই উপাসনা।” উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, গাছের গোড়ায় জল দেওয়ার পরিবর্তে কেউ যদি তার ডালপালায় জল দিতে থাকে, তবে সেটি সে করে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাবে অথবা সাধারণ নিয়মনীতি পালন না করার ফলে। তেমনই, দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সেবা করার উপায় হচ্ছে উদরে খাদ্য প্রদান করা। সুতরাং বলা যেতে পারে, দেবতারা হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের সার্বভৌম প্রশাসনের অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন পদাধিকারী শাসক ও সঞ্চালক। প্রজার কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন পালন করা, কর্মচারীর অথবা সঞ্চালকদের কল্পিত বিধান পালন করা কখনই তার কর্তব্য নয়। তেমনই, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে কেবল পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করা। ভগবানের আরাধনা করার ফলে তাঁর কর্মচারী-স্বরূপ বিভিন্ন দেবতারাও আপনা থেকেই তুষ্ট হন। শাসক ও সঞ্চালকেরা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরূপে নিয়োজিত থাকেন এবং তাঁদের উৎকোচ দেওয়া অবৈধ। সেটিই এখানে অবিধিপূর্বকম্ বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে, শ্রীকৃষ্ণ অনাবশ্যক দেবোপাসনা কখনই অনুমোদন করেন না।
শ্লোকঃ ২৪
অহং হি সর্বযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ ।
ন তু মামভিজানন্তি তত্ত্বেনাতশ্চ্যবন্তি তে ৷। ২৪ ।।
অহম্ — আমি; হি—নিশ্চয়ই; সর্ব— সমস্ত; যজ্ঞানান্ যজ্ঞের, ভোক্তা — ভোক্তা; চ—এবং; প্রভুঃ—প্রভু; এব—ও; চ–এবং ননা, তু—কিন্তু; মাম্—আমাকে; অভিজানন্তি—জানে; তত্ত্বেন — স্বরূপত; অতঃ – অতএব; চাবন্তি — অধঃপতিত হয়; তে—তারা।
গীতার গান
সর্ব যজ্ঞেশ্বর আমি প্রভু আর ভোক্তা ৷
সে কথা বুঝে না যারা নহে তত্ত্ববেত্তা ।।
অতএব তত্ত্বজ্ঞান হইতে বিচ্যুত।
প্রতীকোপাসনা সেই তাত্ত্বিক বিস্তৃত ।।
অনুবাদঃ আমিই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু। কিন্তু যারা আমার চিন্ময় স্বরূপ জানে না, তারা আবার সংসার সমুদ্রে অধঃপতিত হয়।
তাৎপর্যঃ এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বেদে নানা রকম যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার বিধান দেওয়া আছে, কিন্তু সেই সমস্ত যজ্ঞের যথার্থ উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধান করা। যজ্ঞ শব্দের অর্থ হচ্ছে বিষ্ণু। ভগবদ্গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যজ্ঞ বা বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কেবল কর্ম করা উচিত। বর্ণাশ্রম-ধর্ম নামক মানব-সভ্যতার পূর্ণতা প্রাপ্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিষ্ণুকে তুষ্ট করা। তাই, শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকে বলেছেন, “সমস্ত যজ্ঞের একমাত্র ভোক্তা হচ্ছি আমি, কারণ আমি হচ্ছি পরম প্রভু।” তবু অন্ন-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এই সত্যকে উপলব্ধি করতে না পেরে সাময়িক লাভের জন্য বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করে। তাই, তারা সংসার সমুদ্রে পতিত হয় এবং জীবনের যথার্থ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। কিন্তু যদি কারও জাগতিক বাসনা পূর্ণ করার অভিলাষ থাকে, তার বরং ভগবানের কাছে তা প্রার্থনা করা অধিক শ্রেয়স্কর (যদিও তা শুদ্ধ ভক্তি নয়) এবং এভাবেই সে তার বাঞ্ছিত ফল লাভ করবে।