শ্লোকঃ ১৯

তপাম্যহমহং বর্ষং নিগৃহ্লামুৎসৃজামি চ ।

অমৃতং চৈব মৃত্যুশ্চ সদসচ্চাহমর্জুন ॥ ১৯ ॥

তপামি ——তাপ প্রদান করি; অহম্ — আমি; অহম্ — আমি; বর্ষ — বৃষ্টি; নিগৃহ্লামি – আকর্ষণ করি; উৎসৃজামি—বর্ষণ করি; চ–এবং অমৃতম্ — অমৃত; চ–এবং; এব— অবশ্যই; মৃত্যুঃ—মৃত্যু; চ এবং সং–চেতন, অসৎ— জড় বস্তু; চ—এবং; অহম্—আমি, অর্জুন—হে অর্জুন।

গীতার গান

আমি সে উৎপত্তি স্থিতি বীজ অব্যয় ।

আমি বৃষ্টি আমি মেঘ আমি মৃত্যুময় ৷।

আমি সে অমৃততত্ত্ব শুন হে অর্জুন ।

সদসদ যাহা কিছু আমি বিশ্বরূপ ৷।

অনুবাদঃ হে অর্জুন ! আমি তাপ প্রদান করি এবং আমি বৃষ্টি বর্ষণ করি ও আকর্ষণ করি। আমি অমৃত এবং আমি মৃত্যু। জড় ও চেতন বস্তু উভয়ই আমার মধ্যে ।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিবিধ শক্তি বিদ্যুৎ ও সূর্যের মাধ্যমে তাপ ও আলোক বিবিরণ করেন। গ্রীষ্ম ঋতুতে তিনি বৃষ্টিকে আকাশ থেকে পড়তে দেন না, আবার বর্ষা ঋতুতে তিনি অবিরাম প্রচণ্ড বৃষ্টি বর্ষণ করেন। যে শক্তি আমাদের আয়ুকে পরিবর্ধিত করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে তাও শ্রীকৃষ্ণেরই শক্তি। জীবনের অন্তেও মৃত্যুরূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হন। শ্রীকৃষ্ণের এই বিভিন্ন শক্তির বিশ্লেষণ করার ফলে আমরা প্রতিপন্ন করতে পারি যে, তাঁর দৃষ্টিতে জড় ও চেতনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, অথবা পক্ষান্তরে, জড় ও চেতন উভয়ই তার প্রকাশ। তাই, কৃষ্ণভাবনার অতি উন্নত স্তরে এই রকম পার্থক্য সৃষ্টি করা উচিত নয়। এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত যিনি উত্তম অধিকারী, তিনি সর্বত্র সব কিছুতেই শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পান। যেহেতু জড় ও চেতন উভয় শ্রীকৃষ্ণ, তাই সমস্ত জড় উপাদানে সংঘটিত বিশাল বিশ্বরূপও হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। মুরলীধর শ্যামসুন্দর রূপে তাঁর যে বৃন্দাবন, সেটি তাঁর পরম মাধুর্যময় ভগবৎ-লীলা।

শ্লোকঃ ২০

ত্রৈবিদ্যা মাং সোমপাঃ পূতপাপা

যজ্ঞৈরিষ্টা স্বর্গতিং প্রার্থয়ন্তে ।

তে পুণ্যমাসাদ্য সুরেন্দ্রলোকম

অশ্নন্তি দিব্যান্ দিবি দেবভোগান ।। ২০ ।।

ত্রৈবিদ্যাঃ— ত্রিবেদজ্ঞগণ; মাম্― আমাকে; সোমপাঃ- সোমরস পানকারী, – পবিত্র, পাপাঃ—পাপ; যজ্ঞেঃ— যজ্ঞের দ্বারা ইচ্ছা— পূজা করে, স্বগতিম দামন প্রার্থয়ন্তে— প্রার্থনা করেন; তে—তাঁরা; পুণ্যম্পুণ্য; আসাদা সুরেন্দ্র—ইন্দ্র, লোকম্—লোক, অশ্বস্তি— ভোগ করেন; দিব্যান্—দিব্য, বি- : দেবভোগান্― দেবতাদের ভোগসমূহ।

গীতার গান

কর্মকান্ড বেদত্রয়     সাধনে যে পূর্ণ হয়,

সোমরস পানে পাপ ক্ষয় ৷৷

যজ্ঞ মোর উপাসনা,     যেবা করে সে সাধনা,

স্বর্গসুখ প্রার্থনা সে করে ৷

পুণ্যের ফলেতে সেই,     সুরেন্দ্র লোকেতে যায়,

দিব্যসুখ ভোগ সেথা করে ।

অনুবাদঃ ত্রিবেদজ্ঞগণ যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা আমাকে আরাধনা করে যজ্ঞাবশিষ্ট সোমরস পান করে পাপমুক্ত হন এবং স্বর্গে গমন প্রার্থনা করেন। তাঁরা গুণাকর্মের ফলস্বরূপ ইন্দ্রলোক লাভ করে দেবভোগ্য দিব্য স্বর্গসুখ উপভোগ করেন।

তাৎপর্যঃ ত্রৈবিদ্যাঃ বলতে সাম, যজুঃ ও ঋক্ নামক তিনটি বেদকে বুঝায়। যে ব্ৰাহ্মণ এই তিনটি বেদ অধ্যয়ন করেছেন, তাঁকে বলা হয় ত্রিবেদী। যাঁরা এই তিনটি বেদ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত, তাঁরা মনুষ্য সমাজে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। দুর্ভাগ্যবশত, বেদের অনেক বড় বড় পণ্ডিতেরা বৈদিক জ্ঞানের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন না। তাই, শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকে ঘোষণা করেছেন যে, তিনিই হচ্ছেন ত্রিবেদীদের পরম লক্ষ্য। যথার্থ ত্রিবেদী শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের শরণাগত হন এবং তাঁর প্রীতি উৎপাদনের জন্য বিশুদ্ধ ভক্তিযোগে নিয়োজিত থাকেন। এই ভক্তিযোগ শুরু হয় হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন ও সেই সঙ্গে কৃষ্ণতত্ত্ব জানবার প্রচেষ্টা করার মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যবশত যে সমস্ত মানুষ কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে বেদ অধ্যয়ন করে, তারা ইন্দ্র, চন্দ্র আদি দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করার প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়। এই প্রকার প্রচেষ্টার দ্বারা এই ধরনের দেবোপাসকেরা নিঃসন্দেহে প্রকৃতির নিকৃষ্ট গুণের দোষ থেকে শুদ্ধ হয়ে স্বৰ্গলোক মহলোক, জনলোক, তপলোক আদি উচ্চলোক প্রাপ্ত হয়। এই সমস্ত স্বৰ্গলোকে একবার অধিষ্ঠিত হলে এই জগতের থেকে লক্ষ লক্ষ গুণ বেশি ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধন করা সম্ভব হয়।

শ্লোকঃ ২১

তে তং ভুত্ত্বা স্বৰ্গলোকং বিশালং

ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি ।

এবং ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না

গতাগতং কামকামা লভন্তে ৷৷ ২১ ॥

তে—তাঁরা; তম্—সেই; ভুত্ত্বা – ভোগ করে; স্বর্গলোকস্ — স্বৰ্গলোক; বিশালম্— বিশাল: ক্ষীণে—ক্ষীণ হলে; পুণ্যে — পুণ্যফল; মর্ত্যলোকম্ — মর্ত্যলোকে; বিশন্তি— অধঃপতিত হন; এবন্—এভাবে; ত্রয়ী — তিন বেদের; ধর্মম্—ধর্ম; অনুপ্রপন্না অনুষ্ঠান-পরায়ণ, গভাগতম্—জন্ম ও মৃত্যু; কামকামাঃ— ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষী: লভন্তে লাভ করেন।

গীতার গান

বিশাল সে স্বর্গসুখ,     ভুলে যায় জড় দুঃখ,

ক্রমে ক্রমে তার পুণ্য হরে ॥

ত্রয়ী ধর্ম কর্মকাণ্ড,     পয়োমুখ বিষভাণ্ড,

অমৃত ভাবিয়া যেবা খায় ।

গতাগতি কামলাভ,     জন্মে জন্মে মহাতাপ,

তার জন্ম অধঃপাতে যায় ৷।

অনুবাদঃ তারা সেই বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করে পুণ্য ক্ষয় হলে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। এভাবেই ত্রিবেদোক্ত ধর্মের অনুষ্ঠান করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষী মানুষেরা সংসারে কেবলমাত্র বারংবার জন্ম-মৃত্যু লাভ করে থাকেন।

তাৎপর্যঃ স্বর্গলোকে উন্নীত হবার ফলে জীব তথাকথিত দীর্ঘ জীবন ও ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির শ্রেষ্ঠ সুযোগ-সুবিধা লাভ করে, কিন্তু তারা চিরকাল সেখানে থাকতে পারে না। পুণা- কর্মফল শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাকে আবার এই মর্ত্যলোকে ফিরে আসতে হয়। বেদান্ত-সূত্রে নির্দেশিত পূর্ণজ্ঞান (জন্মাদাস্য যতঃ) যে প্রাপ্ত হয়নি, অথবা যে সর্ব কারণের পরম কারণ শ্রীকৃষ্ণকে তত্ত্বগতভাবে জানতে পারেনি, সে মানব জীবনের পরম লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সে কখনও স্বর্গলোকে উত্তীর্ণ হয় এবং তার পরে আবার এই মর্ত্যলোকে নেমে আসে, যেন সে নাগরদোলায় বসে কখনও উপরের দিকে কখনও নীচের দিকে পাক খেতে থাকে। এর তাৎপর্য হচ্ছে যে, যেখানে একবার ফিরে গেলে আর নীচে নেমে আসতে হয় না, সেই চিন্তায় জগতে উন্নীত না হয়ে, সে কেবলমাত্র উচ্চ ও নিম্নলোকে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তন করতে থাকে। তাই, মানুষের উচিত চিন্ময় জগৎ প্রাপ্ত হওয়ার চেষ্টা করা, যার ফলে সচ্চিদানন্দময় নিত্য জীবন লাভ করা যায় এবং আর কখনও এই দুঃখময় জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।

error: Content is protected !!