শ্লোকঃ ১৬

অহং ক্রতুবহং যজ্ঞঃ স্বধাহমহমৌষধম্ ।

মন্ত্রোঽহমহমেবাজ্যমহমগ্নিৱহং হুতম্ ॥ ১৬ ॥

অহম—আমি; ক্রতুঃ—অগ্নিষ্টোম, আদি শ্রৌত যজ্ঞ, অহম্ — আমি; যজ্ঞঃ – স্মার্ত G: স্বধা—শ্রাদ্ধ আদি কর্ম; অহম্—আমি, অহম্—আমি; ঔষধম্ — রোগ নিবারক ভা; মন্ত্রঃ-মন্ত্র; অহম্ — আমি; অহম্ — আমি; এব— অবশ্যই; আজ্যম্ – ত অহম—আমি; অগ্নিঃ—অগ্নি: অহম্—আমি; হুতম্― হোমক্রিয়া।

গীতার গান

আমিই সে স্মাতযজ্ঞে শ্রৌত বৈশ্যদেব ।

আমিই সে স্বধা মন্ত্র ঔষধ বিভেদ ৷৷

আমিই সে অগ্নি হোম ঘৃতাদি সামগ্রী ।

আমি পিতা আমি মাতা অথবা বিধাতৃ ॥

অনুবাদঃ আমি অগ্নিষ্টোম আদি শ্রৌত যজ্ঞ, আমি বৈশ্বদেব আদি স্মার্ত যজ্ঞ, আমি ‘পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধাদি কর্ম, আমি রোগ নিবারক ভেষজ, আমি মন্ত্র, আমি হোমের ঘৃত, আমি অগ্নি এবং আমিই হোমক্রিয়া।

তাৎপর্যঃ ‘জ্যোতিষ্টোম’ নামক যজ্ঞ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ এবং স্মৃতিশাস্ত্র অনুসারে তিনি ‘মহাযজ্ঞ’। পিতৃলোককে অর্পণ করা হয় যে স্বধা বা ঘৃতরূপী ঔষধ, তাও শ্রীকৃষ্ণেরই একটি রূপ। এই ক্রিয়াতে উচ্চারিত মন্ত্রও হচ্ছে কৃষ্ণ। যজ্ঞে যে সমস্ত দুগ্ধজাত পদার্থ আঞ্চতি দেওয়া হয়, তাও শ্রীকৃষ্ণ। অগ্নিকেও শ্রীকৃষ্ণ বলা হয়েছে, কারণ পঞ্চমহাভূতের একটি তত্ত্ব হওয়ার ফলে তাও শ্রীকৃষ্ণেরই ভিন্ন শক্তি। অর্থাৎ, বৈদিক কর্মকাণ্ডে প্রতিপাদিত বিবিধ যজ্ঞের সমষ্টিও হচ্ছে কৃষ্ণ। প্রকারান্তরে এটি জানা উচিত যে, যে মানুষ কৃষ্ণভক্তিতে নিষ্ঠাবান, তিনি ইতিমধ্যেই সমস্ত বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন।

শ্লোকঃ ১৭

পিতাহমস্য জগতো মাতা ধাতা পিতামহঃ ।

বেদ্যং পবিত্রম্ ওঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ ৷৷ ১৭ ৷৷

পিতা-পিতা; অহম্ — আমি; অস্য – এই জগতঃ– জগতের; মাতা- মাতা; ধাতা — বিধাতা: পিতামহঃ – পিতামহ; বেদ্যম্ জ্ঞেয় বস্তু; পবিত্রম্ শোধনকারী; ওঙ্কারঃ—ওঙ্কার; ঋক্—ঋগ্বেদ, সাম— সামবেদ; যজুঃ — যজুর্বেদ এর – অবশ্যই; চ—এবং ।

গীতার গান

আমি পিতামহ বেদ্য পবিত্র ওঙ্কার ।

আমি ঋক্ আমি সাম যজু কিংবা আর ॥

অনুবাদঃ আমিই এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা ও পিতামহ। আমি জ্ঞেয় বস্তু, শোধনকারী ও ওঙ্কার। আমিই ঋক্, সাম ও যজুর্বেদ।

তাৎপর্যঃ শ্রীকৃষ্ণের শক্তির বিবিধ ক্রিয়ার ফলেই চরাচরের সমস্ত সৃষ্টির অভিব্যক্তি হয়। সংসারে আমরা বিভিন্ন জীবের সঙ্গে নানা রকম আত্মীয়তার সম্বন্ধ স্থাপন করি; এই সমস্ত জীব বস্তুতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণের তটস্থা শক্তি। কিন্তু প্রকৃতির সৃষ্টির অধীনে, তাদের কেউ কেউ আমাদের পিতা, মাতা, পিতামহ, সৃষ্টিকর্তা আদিরূপে প্রতিভাত হন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সকলেই শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অংশ ব্যতীত আর কিছুই নন। এভাবেই আমাদের মাতা, পিতারূপে প্রতিভাত হয় যে সমস্ত জীবসত্তা, তাঁরাও শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই নন। এই শ্লোকে ধাতা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সৃষ্টিকর্তা’। আমাদের পিতা-মাতা যে কেবল শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অংশ তাই নন, পরন্তু সৃষ্টিকর্তা, পিতামহী ও পিতামহ প্রমুখ সকলেই শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের অপরিহার্য অংশ হবার ফলে বস্তুতপক্ষে প্রতিটি জীবই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। তাই, সম্পূর্ণ বেদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। বেদের মাধ্যমে আমরা যা কিছু জানতে চাই, তা ক্রমশ শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ-তত্ত্বের দিকেই আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলে। যে তত্ত্বজ্ঞান আমাদের অন্তরকে। কলুষমুক্ত করতে সাহায্য করে, তা বিশেষরূপে শ্রীকৃষ্ণ। তেমনই, যে মানুষ সম্পূর্ণরূপে বৈদিক তত্ত্বজ্ঞান জানবার প্রয়াসী, সেও শ্রীকৃষ্ণেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সেই কারণে শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন। সমস্ত বৈদিক মন্ত্রগুলির মধ্যে ওঁ শব্দটিকে বলা হয় ‘প্রণব’ এবং সেটি হচ্ছে অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গ, তাই সেটিও শ্রীকৃষ্ণ। আর যেহেতু ঋক্‌, সাম, যজুঃ ও অথর্ব—এই চার বেদের সমস্ত মন্ত্রের মধ্যে ‘প্রণব’ বা ওঙ্কার হচ্ছে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, তাই বুঝতে হবে সেটিও শ্রীকৃষ্ণ।

শ্লোকঃ ১৮

গতির্ভর্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ ।

প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানং বীজমব্যয়ম্ ॥ ১৮ ॥

মতিঃ—গতি; ভর্তা—পতি; প্রভুঃ – নিয়ন্তা; সাক্ষী সাক্ষী; নিবাসঃ – নিবাস; শরণন—রক্ষাকর্তা; সুহাৎ- সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু; প্রভবঃ – সৃষ্টি, প্রলয়ঃ প্রলয়; স্থানম্—স্থিতি। নিধানম্—আশ্রয়; বীজম্ — বীজ: অব্যয়ম্—অবিনাশী।

গীতার গান

আমি গতি আমি ভর্তা মোরে সাক্ষী কর ।

আমি সে শরণ্যধাম প্রভব প্রলয় ॥

অনুবাদঃ আমি সকলের গতি, ভর্তা, প্রভু, সাক্ষী, নিবাস, শরণ ও সুহৃৎ । আমিই উৎপত্তি, নাশ, স্থিতি, আশ্রয় ও অব্যয় বীজ।

তাৎপর্যঃ গতি শব্দে এখানে গন্তব্যস্থানকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে আমরা যেতে চাই। কিন্তু সকলেরই পরম গতি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। যদিও সাধারণ মানুষ এই কথা জানে না। যারা শ্রীকৃষ্ণকে জানে না, তারা নিশ্চিতরূপে পথভ্রষ্ট। তাদের তথাকথিত উন্নতির পথে প্রগতি প্রকৃতপক্ষে অসম্পূর্ণ অথবা ভ্রমাত্মক। অনেক মানুষ আছে, যারা বিভিন্ন দেব-দেবীকে তাদের পরম লক্ষ্য বলে মনে করে এবং ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের পূজা করার ফলে তারা চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, ইন্দ্রলোক, মহলোক আদি উচ্চতর গ্রহলোক প্রাপ্ত হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা রচিত এই সমস্ত গ্রহলোকগুলি যুগপৎভাবে কৃষ্ণ আবার কৃষ্ণ নয়। শ্রীকৃষ্ণেরই শক্তির প্রকাশ হওয়ায়, এই সমস্ত গ্রহলোকও শ্রীকৃষ্ণ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেগুলি কৃষ্ণতত্ত্ব উপলব্ধির পথে এক পদক্ষেপ অগ্রসর হতে সাহায্য করে মাত্র। শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন শক্তির সমীপবর্তী হওয়া শ্রীকৃষ্ণের প্রতি পরোক্ষভাবে অগ্রসর হওয়ার মতো। তাই, সময় ও সামর্থ্যের বার্থ অপব্যয় না করে প্রত্যক্ষরূপে শ্রীকৃষ্ণের দিকে অগ্রসর হওয়া বিধেয়, তার ফলে সময় ও শক্তি বাঁচানো যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যদি কোন বাড়িতে উঠবার জন্য লিফ্ট থাকে, তা হলে অনর্থক সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠবে কেন? সব কিছুই শ্রীকৃষ্ণের শক্তিকে আশ্রয় করে আছে সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয় ব্যতীত কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম নিয়ন্তা কারণ সব কিছু তাঁরই অধীন এবং তাঁরই শক্তিকে আশ্রয় করে সব কিছু বিদ্যমান । সমস্ত জীবের অন্তর্যামীরূপে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম সাক্ষী। আমাদের নিবাস, দেশ, গ্রহলোক আদি যেখানে আমরা বসবাস করি তাও শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম আশ্রয় ও গতি। তাই আমাদের সুরক্ষার জন্য অথবা দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণের জন্য তাঁরই শরণাগত হওয়া উচিত। যখনই আমরা সুরক্ষার প্রয়োজন বোধ করব, আমাদের জানতে হবে যে, কোনও জীবশক্তিকেই আশ্রয় বলে মানতে হয়। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম জীবসত্তা। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সৃষ্টির উৎস অথবা পরম পিতা, তাই শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা অন্য কেউ সুহৃদ হতে পারে না, অন্য কেউ হিতৈষী হতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সৃষ্টির আদি কারণ এবং প্রলয়ান্তে পরম আশ্রয়। তাই, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ।

error: Content is protected !!