শ্লোকঃ ১৩

মহাত্মানস্ত মাং পার্থ দৈবীং প্রকৃতিমাশ্রিতাঃ ।

ভজন্ত্যনন্যমনসো জ্ঞাত্বা ভূতাদিমব্যয়ম্ ॥ ১৩॥

মহাত্মানঃ—মহাত্মাগণ; তু—কিন্তু, মাম্ – আমাকে, পার্থ-হে পৃথাপুত্র; দৈবীম্‌ — দৈবী; প্রকৃতিম — প্রকৃতি; আশ্রিতাঃ —আশ্রয় করে; ভজন্তি — ভজনা করেন, অনন্যমনা হয়ে; জ্ঞাত্বা — জেনে; ভূত-সৃষ্টির; আদিম্—আদি; অনন্যমনসঃ অব্যয়ম্—অবায়।

গীতার গান

কিন্তু যেবা মহাত্মা সে আরাধ্য প্রকৃতি ।

আশ্রয় লইয়া করে ভজন সঙ্গতি ।।

অনন্য মনেতে করে বিশুদ্ধ ভজন ।

সমস্ত ভূতের আদি আমাকে তখন ৷।

অনুবাদঃ হে পার্থ ! মোহমুক্ত মহাত্মাগণ আমার দৈবী প্রকৃতিকে আশ্রয় করেন। তারা আমাকে সর্বভূতের আদি ও অব্যয় জেনে অনন্যচিত্তে আমার ভজনা করেন।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে স্পষ্টভাবে যথার্থ মহাত্মার স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। মহাত্মার প্রথম লক্ষণ হচ্ছে যে, তিনি সর্বদাই দিব্য প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত থাকেন। তিনি কখনই জড়া প্রকৃতির অধীনে থাকেন না। আর তা কিভাবে সম্ভব। সপ্তম অধ্যায়ে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে—যিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়েছেন, তিনি অবিলম্বে জড়া প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হন। এটিই হচ্ছে যোগ্যতা। মানুষ যখনই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তৎক্ষণাৎ তিনি মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হন। এটিই হচ্ছে মুক্তি লাভ করার প্রাথমিক সূত্র। যেহেতু জীবসত্তা ভগবানের তটস্থা শক্তি, তাই জড়া প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে চিন্ময় প্রকৃতির আশ্রয় লাভ করে। চিন্ময় প্রকৃতির পথ- নির্দেশকেই বলা হয় দেবী প্রকৃতি। সুতরাং এভাবেই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শরণাগত হওয়ার ফলে কেউ যখন উন্নত হন, তখন তিনি মহাত্মার পর্যায়ে উন্নীত হন।

শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত আর কোন কিছুর দিকেই মহাত্মা তাঁর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করেন • কারণ তিনি খুব ভালভাবেই জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন আদি পরম পুরুষ, তিনিই হচ্ছেন সর্ব কারণের পরম কারণ। এই সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। এই চিত্তবৃত্তির উন্মেষ হয় অন্য মহাত্মাদের বা শুদ্ধ ভক্তদের সঙ্গ লাভ করার ফলে। শুদ্ধ ভক্তেরা শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য রূপের প্রতি, এমন কি চতুর্ভুজ মহাবিষ্ণুর প্রতিও আকৃষ্ট হন না। তাঁরা কেবল শ্রীকৃষ্ণের দ্বিভুজ রূপেই অনুরক্ত থাকেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের অন্য কোনও বৈশিষ্ট্যে আকৃষ্ট হন না, এমন কি অন্য কোন দেবতা বা মানুষের প্রতিও তাদের কোনও রকম আসক্তি থাকে না। এই ধরনের কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন থাকেন। তাঁরা একটানা কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ- সেবায় নিত্য তন্ময় হয়ে থাকেন।

শ্লোকঃ ১৪

সততং কীৰ্ত্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ত্রতাঃ ।

নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে ॥ ১৪॥

সততম্—নিরন্তর, কীর্তয়ন্ত:—কীর্তন করে; মাম্ আমাকে; যতন্তঃ— যত্নশীল; চ- ও;দৃঢ়ব্রতাঃ – দৃঢ়ব্রত, নমস্যন্তঃ নমস্কার করে; চ-৩; মাম্— আমাকে; ভক্ত্যা — ভক্তি সহকারে; নিত্যযুক্তাঃ– নিরন্তর যুক্ত হয়ে, উপাসতে— উপাসনা করে।

গীতার গান

লক্ষণ সে মহাত্মার হয় বিলক্ষণ ।

মহিমা আমার করে সতত কীর্তন ॥

আমার মহিমা জন্য সর্ব কর্মে রত ।

সকল বিষয়ে যত হও দৃঢ়ব্রত ৷৷

ভক্তির যাজন আর প্রণাম বিজ্ঞপ্তি ।

নিত্যসেবা উপাসনা আমাকেই প্রাপ্তি ॥

অনুবাদঃ দৃঢ়ব্রত ও যত্নশীল হয়ে, সর্বদা আমার মহিমা কীর্তন করে এবং আমাকে প্রণাম করে, এই সমস্ত মহাত্মারা নিরন্তর যুক্ত হয়ে ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে।

তাৎপর্যঃ কোন সাধারণ মানুষকে একটি ছাপ মেরে মহাত্মা বানানো যায় না। মহাত্মার স্বরূপ এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাত্মা সর্বদাই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তনে মগ্ন থাকেন। তাঁর আর অন্য কোন কাজই থাকে না। তিনি নিরন্তর পরমেশ্বরের মহিমা প্রচারে নিয়োজিত থাকেন। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, মহাত্মা কখনই নির্বিশেষবাদী হন না। মহিমা কীর্তনের অর্থ হচ্ছে, ভগবানের ধাম, ভগবানের নাম, ভগবানের রূপ, ভগবানের গুণ ও ভগবানের অদ্ভুত চরিত্রের লীলাসমূহ কীৰ্ত্তন করা। এই সমস্ত বিষয় সর্বদাই কীর্তনীয়; তাই যথার্থ মহাত্মা সর্বদাই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি অনুরক্ত থাকেন।

ভগবানের নির্বিশেষ রূপ ব্রহ্মাজ্যোতির প্রতি যে আসক্ত, তাকে ভগবদ্‌গীতায় মহাত্মা বলে বর্ণনা করা হয়নি। এই ধরনের মানুষকে পরবর্তী শ্লোকে অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, মহাত্মা সর্বদাই ভগবদ্ভক্তির নানা রকম কার্যকলাপে মগ্ন থাকেন, তিনি বিষ্ণুতত্ত্বের শ্রবণ ও কীর্তন করেন এবং কখনই দেব-দেবী বা কোন মানুষের মহিমা কীর্তন করেন না। সেটিই হচ্ছে ভক্তি—শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ এবং স্মরণম্ অর্থাৎ তাকে সর্বদা স্মরণ করা। এই প্রকার মহাত্মা পাঁচটি দিবা রসের যে কোন একটির দ্বারা ভগবানের সঙ্গে অন্তিমকালে নিত্যযুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে বদ্ধপরিকর। সেই উদ্দেশ্য সফল করবার জন্য তিনি মনোবাক্যে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় সর্বতোভাবে যুক্ত থাকেন। যেটিকে বলা হয় পূর্ণ কৃষ্ণভাবনামৃত ।

ভক্তিযোগের কতগুলি ক্রিয়া অবশ্য পালনীয়, যেমন একাদশী, জন্মাষ্টমী আদি গুণাতিথিতে উপবাস করা। এই সমস্ত বিধি-বিধান মহান আচার্যদের দ্বারা তাঁদের আন। নির্দেশিত হয়েছে, যাঁরা চিন্ময় জগতে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করার প্রকৃত প্রয়াসী। মহাত্মারা এই সমস্ত বিধি-বিধান কঠোরভাবে পালন করেন। তাই, তাঁরা অবধারিতভাবে তাঁদের বাঞ্ছিত ফল লাভ করেন।

এই অধ্যায়ের দ্বিতীয় শোকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এই ভক্তিযোগ কেবল সহজসাধ্যই নয়, তা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সম্পাদন করা যায়। এর জন্য কোন কঠোর তপস্যা বা কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজন হয় না। সদগুরুর তত্ত্বাবধানে গৃহস্থ, সী অথবা ব্রহ্মচারীরূপে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় যে কোনও অবস্থায় পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ভক্তি সাধন করার মাধ্যমে যথার্থ মহাত্মায় পরিণত ওয়া যায়।

শ্লোকঃ ১৫

জ্ঞানযজ্ঞেন চাপানো যজন্তো মামুপাসতে ।

একত্বেন পৃথতেন বহুধা বিশ্বতোমুখম্ ॥ ১৫ ॥

জ্ঞানযজ্ঞেন—জ্ঞানরূপ যজ্ঞের দ্বারা; চ—ও; অপি – অবশ্যই; অন্যে – অন্যেরা; জন্তঃ— যজন করে; মাস্—আমাকে, উপাসতে—উপাসনা করেন; একত্বেন- অভেদ চিন্তার দ্বারা; পৃথত্বেন—পৃথক চিন্তার দ্বারা; বহুধা — বহু প্রকারে; বিশ্বতোমুখম্—বিশ্বরূপের।

গীতার গান

যারা শুদ্ধ ভক্ত নহে কিন্তু মোরে ভজে ।

জ্ঞান যজ্ঞ করি তারা তিনভাবে মজে ।।

অহংগ্রহ উপাসনা একত্ব সে নাম ৷

পৃথকত্বে উপাসনা প্রতীকোপাসন ।।

বিশ্বরূপ উপাসনা অনির্দিষ্ট রূপ ।

নিরাকার ভাব কিংবা ভাবে বহুরূপ ৷।

অনুবাদঃ অন্য কেউ কেউ জ্ঞান যজ্ঞের দ্বারা অভেদ চিত্তাপূর্বক, কেউ কেউ বহুরূপে প্রকাশিত ভেদ চিন্তাপূর্বক এবং অন্য কেউ আমার বিশ্বরূপের উপাসনা করেন।-

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে পূর্ববর্তী শ্লোকসমূহের সারমর্ম ব্যক্ত হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, কৃষ্ণভাবনায় ভাতি যে অনন্য ভক্ত শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই জানেন না, তিনি হচ্ছেন মহাত্মা। কিন্তু এমনও কিছু মানুষ আছেন, যারা যথার্থ মহাত্মা না হলেও বিভিন্নভাবে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন। সেই রকম কিছু ভক্তের মধ্যে আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানীর কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এদের থেকে আরও নিম্নস্তরের উপাসক আছে এবং এরা তিন ভাগে বিভক্ত ( ১) অহংগ্রহ উপাসক — যে নিজেকে ভগবানের অভেদ মনে করে নিজের উপাসনা করে, (২) প্রতীকোপাসক — যে কল্পনাপ্রসূত কোন একরূপে ভগবানের উপাসনা করে এবং (৩) বিশ্বরূপোপাসক – যে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের বিশ্বরূপকে স্বীকার করে তার উপাসনা করে। এই তিন শ্রেণীর মধ্যে যারা নিজেদেরকে ভগবান বলে মনে করে নিজেদের উপাসনা করে, তাদের বলা হয় অদ্বৈতবাদী। এরাই হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্তরের ভগবৎ উপাসক এবং এদেরই প্রাধান্য বেশি। এই প্রকার লোকেরা নিজেদের পরমেশ্বর বলে মনে করে নিজেদেরই উপাসনা করে। এটিও এক রকমের ঈশ্বর উপাসনা, কারণ এর মাধ্যমে তারা জানতে পারে যে, তাদের জড় দেহটি তাদের স্বরূপ নয়, তাদের স্বরূপ হচ্ছে চিন্ময় আত্মা। এদের মধ্যে অন্ততপক্ষে এই বিবেকের উন্মেষ হয়। সাধারণত নির্বিশেষবাদীরা এভাবেই ভগবানের উপাসনা করে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীভূক্ত মানুষেরা হচ্ছে দেবোপাসক। তারা তাদের কল্পনাপ্রসূত যে কোন একটি রূপকে ভগবানের রূপ বলে মনে করে। আর তৃতীয় শ্রেণীতে যারা রয়েছে, তারা এই জড় ব্রহ্মাণ্ডের অভিব্যক্তি বিশ্বরূপের অতীত আর কোনও কিছুকে চিন্তা করতে পারে না। তাই, তারা ভগবানের বিশ্বরূপকে পরমতত্ত্ব বলে মনে করে সেটির আরাধনায় তৎপর হয়। এই বিশ্ব- ব্রহ্মাণ্ডটি ভগবানেরই একটি রূপ।

error: Content is protected !!