শ্লোকঃ ১০
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্ ।
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ্ বিপরিবর্ততে ॥ ১০॥
ময়া—আমার: অধ্যক্ষেণ — অধ্যক্ষতার দ্বারা, প্রকৃতিঃ – ছড়া প্রকৃতি; সূয়তে- প্রকাশ করে; স—সহ; চরাচরম্ স্থাবর ও জঙ্গম; হেতুনা— কারণে; অনেন—এই কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র, জগৎ – জগৎ, বিপরিবর্ততে—পুনঃ পুনঃ পরিবর্তিত হয়।
গীতার গান
ইঙ্গিত মাত্র সে মোর জড়াকার্য করে ৷
চরাচর যত কিছু প্রসবে সবারে ॥
জগৎ পরিবর্তন হয় সেই সে কারণ ।
পুনঃ পুনঃ হয় যত জনম মরণ ৷৷
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়। আমার অধ্যক্ষতার দ্বারা জড়া প্রকৃতি এই চরাচর বিশ্ব সৃষ্টি করে। প্রকৃতির নিয়মে এই জগৎ পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি হয় এবং ধ্বংস হয়।
তাৎপর্যঃ এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, প্রাকৃত জগতের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ থেকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকলেও ভগবান হচ্ছেন পরম নিয়ন্তা। পরমেশ্বরের পরম ইচ্ছা শক্তির প্রভাবে এই জড় জগতের প্রকাশ হয়, কিন্তু তার পরিচালনা করেন জড়া প্রকৃতি। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতাতে বলেছেন যে, বিভিন্ন যোনি থেকে উদ্ভুত সমস্ত জীব-প্রজাতির তিনিই হচ্ছেন পিতা। মাতার গর্ভে বীজ প্রদান করে পিতা সন্তান উৎপাদন করেন, তেমনই পরমেশ্বর ভগবান তাঁর দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে জড়া প্রকৃতির গর্ভে সমস্ত জীবকে সঞ্চারিত করেন এবং এই সমস্ত জীব তাদের পূর্ব কর্মবাসনা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও যোনি প্রাপ্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত জীবেরা যদিও ভগবানের দৃষ্টিপাতের ফলে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু তাদের পূর্ব কর্মবাসনা অনুসারে তারা ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়। সুতরাং, ভগবান স্বয়ং এই প্রাকৃত সৃষ্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন। শুধুমাত্র তাঁর দৃষ্টিপাতের ফলেই জড়া প্রকৃতি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে এবং তার ফলে তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টির অভিবাক্তি হয়। যেহেতু ভগবান মায়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তখন নিঃসন্দেহে সেটিও তাঁর একটি কার্যকলাপ, কিন্তু জড় জগতের সৃষ্টির অভিব্যক্তির সঙ্গে তাঁর কোন প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ নেই। স্মৃতি শাস্ত্রে এই সম্বন্ধে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা হয়েছে—কারও সামনে যখন একটি সুবাসিত ফুল থাকে, তখন সেই ফুলের সৌরভ ও তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ও সেই ফুলটি পরস্পর থেকে পৃথক। জড় জগৎ এবং ভগবানের মধ্যেও এই রকমেরই সম্বন্ধ রয়েছে। এই জড় জগতে তার কিছু করার নেই, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিপাত ও আদেশের মাধ্যমে তিনি এই জগৎ সৃষ্টি করেন। এর মর্মার্থ হচ্ছে, ভগবানের পরিচালনা ব্যতীত জড়া প্রকৃতি কিছুই করতে পারে না, তবুও সমস্ত জড়-জাগতিক কার্যকলাপ থেকে পরমেশ্বর ভগবান অনাসক্ত।
শ্লোকঃ ১১
অবজানন্তি মাং মঢ়া মানুষীং অনুমতিম্ ।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্ ॥ ১১॥
অবজানন্তি—অবজ্ঞা করে; মাম্——আমাকে; মূঢ়াঃ—মুঢ় ব্যক্তিরা; মানুষীম্ মনুষ্যরূপে; তনুম্—শরীর; আশ্রিতম্—ধারণ করে; পরম্ – পরম; ভাবম্ — তত্ত্ব অজানন্তঃ—না জেনে, মম – আমার, ভূত—সব কিছুর, মহেশ্বরম্ — পরন ঈশ্বর।
গীতার গান
আমার মনুষ্যাকার বিগ্রহ দেখিয়া ৷
মূঢ় লোক নাহি বুঝে অবজ্ঞা করিয়া ৷৷
আমি মহেশ্বর এই জগৎ সংসারে ।
আমার পরম ভাব কে বুঝিতে পারে ॥
অনুবাদঃ আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।
তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ের পূর্ববর্তী শ্লোকগুলির ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, নররূপে অবতরণ করলেও পরম পুরুষোত্তম ভগবান সাধারণ মানুষ নন। সমস্ত সৃষ্টির সৃজন, পালন ও সংহারকর্তা পরমেশ্বর ভগবান কখনই একজন মানুষ হতে পারেন না। কিন্তু তবুও অনেক মূঢ় লোক মনে করে যে, শ্রীকৃষ্ণ একজন শক্তিশালী মানুষ মাত্র এবং তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান। ব্রহ্মসংহিতাতে তাঁর বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ—তিনি হচ্ছেন পরম ঈশ্বর।
সৃষ্টিতে একাধিক ঈশ্বর বা নিয়ন্তা রয়েছেন এবং তাদের এক জনের থেকে আর একজনকে শ্রেয় বলে মনে হয়। জড় জগতেও সাধারণত প্রতিটি প্রশাসনে কোনও সচিব, সচিবের উপরে মন্ত্রী এবং সেই মন্ত্রীর উপরে রাষ্ট্রপতি শাসন করেন। এঁরা সকলেই নিয়তা, কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই আবার কারও না কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। ব্রহ্মসংহিতাতে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম নিয়তা। জড় ও চিন্ময় এই উভয় জগতে নিঃসন্দেহে অনেক নিয়ন্তা আছেন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম নিয়ন্ত (ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ) এবং তাঁর শ্রীবিগ্রহ হচ্ছে সচ্চিদানন্দঘন, অর্থাৎ অপ্রাকৃত।
পূর্ব শ্লোকগুলিতে বর্ণিত সমস্ত অদ্ভুত কার্যকলাপ সম্পাদন করা জড়-জাগতিক কলেবর-বিশিষ্ট মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ভগবানের শ্রীবিগ্রহ সচ্চিদানন্দময়। যদিও তিনি একজন সাধারণ মানুষ নন, কিন্তু তবুও মূঢ় লোকেরা তাকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে তাঁকে অবজ্ঞা করে। তাঁর শ্রীবিগ্রহকে এখানে মানুষী বলা হয়েছে, কারণ বুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি একজন রাজনীতিজ্ঞ ও অর্জুনের সখারূপে মানুষের মতো লীলা করেছিলেন। বিভিন্নভাবে তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো লীলা করলেও তাঁর রূপ হচ্ছে সচ্চিদানন্দবিগ্রহ শাশ্বত আনন্দ এবং আনে পরিপূর্ণ। বৈদিক শাস্ত্রেও সেই কথা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণায় – “আমি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে প্রণতি জানাই, যাঁর রূপ সচ্চিদানন্দময়।” (গোপালতাপনী উপনিষদ ১/১) বৈদিক শাস্ত্রে আরও অনেক বিবরণ আছে। তমেকং গোবিন্দম- “তুমি হচ্ছ ইন্দ্রিয়সমূহের ও গাভীদের আনন্দ বর্ধনকারী গোবিন্দ।” সচ্চিদানন্দবিগ্রহম্ — “আর তোমার রূপ হচ্ছে শাশ্বত, জ্ঞানময় ও আনন্দময়।” (গোপালতাপনী উপনিষদ ১/৩৫) শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ জ্ঞানময়, আনন্দময় এই সমস্ত অপ্রাকৃত গুণাবলী সমন্বিত হওয়া সত্ত্বেও ভগবদ্গীতার অনেক তথাকথিত পণ্ডিত ব্যক্তিরা ও ব্যাখ্যাকারেরা শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ মানুষ বলে অবজ্ঞা করে। পূর্ব জন্মের পুণ্যকর্মের ফলে এই ধরনের পণ্ডিত ব্যক্তি অসাধারণ প্রতিভাবান হতে পারে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণা তার জ্ঞানের স্বল্পতারই পরিচায়ক। তাই তাকে মূঢ় বলা হয়েছে, কারণ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ লীলাসমূহ এবং তাঁর শক্তির বৈচিত্রা সম্বন্ধে যারা অজ্ঞ, তারাই তাঁকে সাধারণ মানুষ বলে মনে করে। এই ধরনের মুঢ় লোকেরা জানে না যে, শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ পূর্ণ জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক, তিনিই হচ্ছেন সমস্ত সৃষ্টির অধীশ্বর এবং তিনি যে কোন জীবকে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণের এই সমস্ত অপ্রাকৃত গুণসমূহের কথা না জানার ফলে এই ধরনের মূঢ় লোকেরা তাঁকে উপহাস করে।
এই সমস্ত মূঢ় লোকেরা এটিও জানে না যে, এই জড় জগতে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের অবতরণ হচ্ছে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির একটি প্রকাশ। তিনি হচ্ছেন মায়াশক্তির অধীশ্বর। যে কথা পূর্বে কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে (মম মায়া দুরতায়া), সেই অনুযায়ী তিনি ঘোষণা করছেন যে, অতি প্রবল মায়াশক্তি সর্বতোভাবে তাঁর অধীন, তাই তাঁর চরণারবিন্দের শরণাগত হওয়ার ফলে যে কোনও জীব এই মায়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারে। শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে যদি বদ্ধ জীব মায়াশক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে, তা হলে সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃজন, পালন ও সংহারের পরিচালক স্বয়ং সেই পরমেশ্বর ভগবান কি করে আমাদের মতো জড় দেহধারী হতে পারেন। অতএব শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে এই প্রকার ধারণা সম্পূর্ণ মূঢ়তাপূর্ণ। মূর্খেরা এটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না যে, সাধারণ মানুষের রূপবিশিষ্ট পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু থেকে শুরু করে বিরাট বিশ্বরূপ পর্যন্ত সব কিছুরই নিয়ন্তা হতে পারেন। বৃহত্তম ও ক্ষুদ্রতম তাদের ধারণার অতীত, তাই তারা কল্পনা করতে পারে না যে, তাঁর নরাকার শ্রীবিগ্রহ কিভাবে এক সঙ্গে অসীম ও অতি ক্ষুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। বস্তুতপক্ষে ভগবান এই অসীম ও সসীমকে নিয়ন্ত্রণ করা সত্ত্বেও তিনি এই সৃষ্টির অভিপ্রকাশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে থাকেন। এটিই তাঁর যোগমৈশ্বরম্ অর্থাৎ অচিন্ত৷ দিব্য শক্তি। যদিও মূঢ় লোকেরা কল্পনা করতে পারে না কিভাবে নররূপেই শ্রীকৃষ্ণ অসীম ও সসীমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিন্তু শুদ্ধ ভক্তের সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকে না, কারণ তিনি জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তাই তিনি তাঁর শ্রীচরণারবিন্দে সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণ করে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তি-পরায়ণ হন।
শ্রীকৃষ্ণের নররূপে অবতার সম্বন্ধে সবিশেষবাদী ও নির্বিশেষবাদীদের মধ্যে অনেক মতভেদ আছে। কিন্তু আমরা যদি শ্ৰীকৃষ্ণতত্ত্ব সম্বন্ধীয় প্রামাণ্য শাস্ত্র ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবতের শরণাপন্ন হই, তা হলে আমরা অনায়াসে বুঝতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান। এই ধরাধামে নররূপে অবতরণ করলেও তিনি সামান্য মানুষ নন। শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের প্রথম অধ্যায়ে যখন শৌনক মুনির নেতৃত্বে ঋষিরা শ্রীকৃষ্ণের লীলা সম্বন্ধে প্রশ্নাদি করেছিলেন, তখন তাঁরা বলেছিলেন—
কৃতবান্ কিল কর্মাণি সহ রামেণ কেশবঃ ।
অতিমর্ত্যানি ভগবান্ গূঢ়ঃ কপটমানুষঃ ॥
“পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে মনুষ্যরূপে নীলাবিলাস করেছেন এবং এভাবেই তাঁর স্বরূপ গোপন রেখে তিনি বহু অলৌকিক কার্যকলাপ সম্পাদন করেছেন।” (ভাঃ ১/১/২০ ) পরমেশ্বরের নররূপ অবতার মূঢ়দের কাছে বিড়ম্বনা-স্বরূপ। পৃথিবীতে অবস্থানকালে শ্রীকৃষ্ণ যে সমস্ত অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শন করেন, তা কোন সাধারণ মানুষ করতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁর পিতা ও মাতা বসুদেব ও দেবকীর সমক্ষে সর্বপ্রথম আবির্ভূত হন, তখন তিনি চতুর্ভুজ রূপ নিয়ে একট হয়েছিলেন। কিন্তু মাতা-পিতার বাৎসল্য প্রেমময়ী প্রার্থনায় তিনি একটি সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করেন। ভাগবতে (১০/৩/৪৬) বলা হয়েছে, বছব প্রাকৃতঃ শিশুঃ— তিনি একটি সাধারণ শিশু, একটি সাধারণ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। এখন, আবার এখানে প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, সাধারণ মানুষরূপে প্রকট হওয়া তাঁর চিন্ময় শ্রীবিগ্রহের এক মধুর বিলাস। ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়েও বর্ণনা করা হয়েছে যে, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভুজ রূপ দেখবার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন (তেনৈব রূপেণ চতুর্ভুজেন)। এই চতুর্ভুজ রূপ প্রকাশের পর, অর্জুনের প্রার্থনায় শ্রীকৃষ্ণ পুনরায় তাঁর আদি মনুষ্যরূপ (মানুষং রূপম্ ) ধারণ করেছিলেন। ভগবানের এই বিবিধ রূপ-বৈচিত্র্য সাধারণ মানুষের সাধ্য নয়।
কিছু লোক যারা মায়াবাদের দ্বারা কলুষিত হওয়ার ফলে শ্রীকৃষ্ণকে উপহাস করে, তারা শ্রীকৃষ্ণকে সাধারণ মানুষ বলে প্রতিপন্ন করবার উদ্দেশ্যে শ্রীমদ্ভাগবতের (৩/২৯/২১) এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করে। অহং সর্বেষু ভূতেষু ভূতাত্মাবস্থিতঃ সদা- “আমি সর্বদা সমস্ত জীবের মধ্যে পরমাত্মারূপে অবস্থান করি।” শ্রীকৃষ্ণকে উপহাসকারী অনধিকারী ব্যক্তিদের মনোকল্পিত ব্যাখ্যার অনুসরণ না করে এই শ্লোকের তাৎপর্য শ্রীল জীব গোস্বামী ও শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর আদি বৈষ্ণব আচার্যদের ব্যাখ্যা অনুসারে বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। এই শ্লোকের টীকায় শ্রীল জীব গোস্বামী বলেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মারূপে স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। তাই, যে প্রাকৃত ভক্ত কেবল মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ভগবানের অর্চামূর্তির পরিচর্যায় ব্যস্ত, কিন্তু অন্যান্য জীবদের সম্মান দিতে জানে না, তার অৰ্চাপূজা বার্থ। তিন শ্রেণীর ভগবদ্ভক্তদের মধ্যে প্রাকৃত ভক্তেরা সবচেয়ে কনিষ্ঠ শ্রেণীভুক্ত। সে অন্য ভক্তদের উপেক্ষা করে মন্দিরের অর্চা-বিগ্রহের প্রতি একাগ্র হয়ে থাকে। সুতরাং, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের সাবধান বাণী হচ্ছে যে, এই প্রকার মনোবৃত্তি সংশোধন করা আবশ্যক। ভক্তের দেখা উচিত যে, যেহেতু পরমাত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজমান থাকেন, তাই প্রতিটি জীব হচ্ছে ভগবানের মন্দির। ভগবানের মন্দিরকে যেভাবে অভিবাদন করা হয়, তেমনই পরমাত্মার মন্দিরস্বরূপ প্রতিটি প্রাণীকে যথোচিত সম্মান করা উচিত। প্রত্যেককেই যথোচিত শ্রদ্ধা জানানো উচিত এবং কখনই কাউকে অবহেলা করা উচিত নয়।
অনেক নির্বিশেষবাদী আছে, যারা মন্দিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের অর্চনা করাকে উপহাস করে। তারা তর্ক করে যে, ঈশ্বর সর্বব্যাপক, অতএব মন্দিরে পূজা করে তাকে সীমিত করা হবে কেন? কিন্তু ভগবান যদি সর্বব্যাপক হন, তা হলে কি তিনি মন্দিরে অথবা অর্চা-বিগ্রহে নেই? সবিশেষবাদী এবং নির্বিশেষবাদীরা যদিও এভাবেই আবহমান কাল তর্ক করে থাকে, কিন্তু কৃষ্ণভাবনাময় শুদ্ধ ভক্ত যথার্থই জানেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরম পুরুষোত্তম হলেও তিনি সর্বব্যাপক। ব্রহ্মসংহিতাতেও সেই কথা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। তাঁর পরম ধাম গোলোক বৃন্দাবনে নিত্য বিরাজমান হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর বিবিধ শক্তির প্রভাবে এবং তাঁর অংশ কলার প্রকাশের মাধ্যমে প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজমান ।
শ্লোকঃ ১২
মোঘাশা মোঘকর্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ ।
রাক্ষসীমাসুরীং চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং শ্রিতাঃ ॥ ১২ ৷৷
মোঘাশাঃ—ব্যর্থ আশা; মোকর্মাণঃ নিষ্ফল কর্ম; মোঘজ্ঞানাঃ — বিফল জ্ঞান; বিচেতসঃ—মোহাচ্ছন্ন; রাক্ষসীম্—রাক্ষসী; আসুরী — আসুরী; চ–এবং, এব— অবশ্যই; প্রকৃতি-প্রকৃতি, মোহিনীম্ — মোহকারী; শ্রিতা: — আশ্রয় গ্রহণ করে।
গীতার গান
আমাকে অবজ্ঞা তাই ব্যর্থ সব আশা ৷
বিফল করম তার জ্ঞানের জিজ্ঞাসা ।।
যাহার আসুরী ভাব রাক্ষস স্বভাব ।
ছাড়ে মোরে মানে শুধু প্রকৃতি বৈভব ।।
প্রকৃতি মোহিনীমূর্তি তারে জারি মারে ।
মায়াময় মূর্তি বলে তাহারা আমারে ।।
অনুবাদঃ এভাবেই যারা মোহাচ্ছন্ন হয়েছে, তারা রাক্ষসী ও আসুরী ডাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় তাদের মুক্তি লাভের আশা, তাদের সকাম কর্ম এবং জ্ঞানের প্রয়াস সমস্তই ব্যর্থ হয়।
তাৎপর্যঃ অনেক ভক্ত আছে, যারা নিজেদের কৃষ্ণভাবনাময় ও ভক্তিযোগে যুক্ত বলে মনে করে, কিন্তু তারা অন্তরে পরম পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণকে পরমতত্ত্ব বলে স্বীকার করে না। তারা কোন দিনই ভক্তিযোগের ফলস্বরূপ ভগবৎ-ধাম প্রাপ্ত হতে পারে না। তেমনই, যারা সকাম পুণ্যকর্মে নিয়োজিত এবং যারা পরিশেষে এই জড় বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের আশা করছে, তারা কোনটিতেই সফল হবে না, কারণ তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উপহাস করে। পক্ষান্তরে, যে সমস্ত মানুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উপেক্ষা করে, তারা আসুরিক ভাবাপন্ন কিংবা নাস্তিক। ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ে তাই বলা হয়েছে যে, এই ধরনের আসুরিক ভাবাপন্ন দুষ্ট লোকেরা কখনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয় না। তাই, পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য তারা মনোধর্ম-প্রসূত জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, সাধারণ জীব ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা মনে করে যে, তাদের মনুষ্যদেহ এখন মায়ার দ্বারা আবৃত হয়ে আছে, কিন্তু যখন কেউ তার দেহ থেকে মুক্ত হবে, তখন তার ও ঈশ্বরের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। মোহগ্রস্ত চিন্তাধারার ফলে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে এক হওয়ার এই যে প্রচেষ্টা তা কোন দিনই সফল হবে না। পারমার্থিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই ধরনের নাস্তিক্য ও আসুরিক অনুশীলন সর্বদাই নিষ্ফল হয়। এটিই হচ্ছে এই শ্লোকের নির্দেশ। এই ধরনের লোকদের দ্বারা বেদান্ত-সূত্র ও উপনিষদ আদি বৈদিক শাস্ত্র থেকে জ্ঞান অনুশীলন চিরকালই নিষ্ফল ও ব্যর্থ হয়।
সুতরাং, পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করা মহা অপরাধ। যারা তা করে তারা অবশ্যই বিভ্রান্ত, কারণ তারা শ্রীকৃষ্ণের শাশ্বত রূপ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। বৃহদ্বিষ্ণুস্মৃতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—
যো বেত্তি ভৌতিকং দেহং কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ ।
স সর্বস্মাদ বহিষ্কার্যঃ শ্রোতস্মার্তবিধানতঃ ॥
মুখং তস্যাবলোক্যাপি সচেলং মানমাচরেৎ।
“যে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহকে প্রাকৃত দেহ বলে মনে করে, তাকে শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্রের সমস্ত বিধান থেকে বহিষ্কৃত করা উচিত এবং ঘটনাক্রমে যদি কখনও তার মুখদর্শন ঘটে, তা হলে সেই পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ গঙ্গাস্নান করা উচিত।” পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তারাই উপহাস করে, যারা তাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। তাদের নিয়তি হচ্ছে জন্ম-জন্মান্তর ধরে নিশ্চিতভাবে বারবার আসুরিক ও নিরীশ্বরবাদী যোনিতে জন্মগ্রহণ করা। তাদের প্রকৃত জ্ঞান চিরকালই মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে, যার ফলে তারা উত্তরোত্তর সৃষ্টিরাজ্যের সবচেয়ে তমসাময় অধম যোনিতেই পতিত হবে।