শ্লোকঃ ৭
সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম ।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্ ॥ ৭ ॥
সর্বভূতানি—সমগ্র সৃষ্টি; কৌন্তেয় – হে কুন্তীপুত্র; প্রকৃতি — প্রকৃতি; যান্তি—প্রবেশ করে; মার্মিকান্—আমার; কল্পয়ে কল্পের অবসানে; পুনঃ— পুনরায়; তানি- তাদের সকলকে; কল্পাদৌ –কল্পের শুরুতে; বিসৃজামি – সৃষ্টি করি, অহম্ — আমি।
গীতার গান
প্রকৃতির লয় হলে বিশ্রাম আমাতে ।
কল্পারম্ভে হয় সৃষ্টি পুনঃ আমা হতে ৷৷
প্রলয়ের পরে থাকি আমি যে ঈশ্বর ।
সৃষ্টাসৃষ্ট যাহা কিছু আমার কিঙ্কর ।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়। কল্পান্তে সমস্ত জড় সৃষ্টি আমারই প্রকৃতিতে প্রবেশ করে এবং পুনরায় কল্পারম্ভে প্রকৃতির দ্বারা আমি তাদের সৃষ্টি করি।
তাৎপর্যঃ এই জড় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সম্পূর্ণরূপে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। ‘কল্পের অবসানে’ মানে ব্রহ্মার মৃত্যু হলে। ব্রহ্মার আয়ু একশ বছর। তাঁর একদিন পৃথিবীর ৪৩০,০০,০০,০০০ বছরের সমান। তাঁর রাত্রির স্থায়িত্বও সম পরিমাণ। তাঁর এক মাস এই রকম ত্রিশ দিন ও রাত্রির সমন্বয়। এই রকম বারোটি মাসে তাঁর এক বৎসর হয়। এই রকম একশ বছর পরে ব্রহ্মার যখন মৃত্যু হয়, তখন প্রলয় হয়। এর অর্থ হচ্ছে ভগবানের দ্বারা অভিব্যক্ত শক্তি পুনরায় তাঁরই মধ্যে লয় হয়ে যায়। তার পরে আবার যখন জড় জগতের সৃষ্টির প্রয়োজন হয়, তখন তার ইচ্ছানুসারে তা সম্পন্ন হয়। বহু স্যাম্” এক হলেও আমি বহুরূপ ধারণ করব।” এটি হচ্ছে বৈদিক সূত্র (ছান্দোগা উপনিষদ ৬/২/৩)। তিনি নিজেকে এই মায়াশক্তিতে বিস্তার করেন এবং তার ফলে সমস্ত জড় জগৎ পুনরায় প্রকট হয়।
শ্লোকঃ ৮
প্রকৃতিং স্বামনবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ
ভূতাগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ ।। ৮ ।।
প্রকৃতিম্—জড়া প্রকৃতি, স্বাম— আমার নিজের; অবষ্টভ্য—আশ্রয় করে; বিসৃজামি—সৃষ্টি করি; পুনঃ পুনঃ বার বার ভূতগ্রাম — সমগ্র জড় সৃষ্টি; ইমম্— এই; কৃৎস্নম্—সমগ্র; অবশম্—আপনা থেকে: প্রকৃতেঃ– প্রকৃতির; বশাৎ—বশে।
গীতার গান
আমার প্রকৃতি দ্বারা সৃজি পুনঃ পুনঃ।
প্রকৃতির বশে হয় যত ভূতগ্রাম ৷
অনুবাদঃ এই জগৎ আমারই প্রকৃতির অধীন। তা প্রকৃতির বশে অবশ হয়ে আমার ইচ্ছার দ্বারা পুনঃ পুনঃ সৃষ্ট হয় এবং আমারই ইচ্ছায় অন্তকালে বিনষ্ট হয়।
তাৎপর্যঃ এই গড় জগৎ ভগবানেরই অপরা বা নিকৃষ্ট শক্তির অভিব্যক্ত। সেই কথা পূর্বেই কয়েকবার বর্ণনা করা হয়েছে। সৃষ্টির সময় জড়া শক্তি মহৎ-তত্ত্বরূপে পরিণত হয় এবং প্রথম পুরুষাবতার মহাবিষ্ণু তাতে প্রবেশ করেন। তিনি কারণ সমুদ্রে শায়িত থাকেন এবং তাঁর নিঃশ্বাসের ফলে কারণ সমুদ্রে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয় এবং সেই প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডে তিনি আবার গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে প্রবেশ করেন। প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ড এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি নিজেকে আবার ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে প্রকাশিত করেন এবং সেই বিষ্ণু সর্বভূতে প্রবিষ্ট হন—এমন কি অভি ক্ষুদ্র পরমাণুতেও প্রবেশ করেন। সেই তত্ত্ব এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তিনি সব কিছুর মধ্যে প্রবেশ করেন।
এখন, জীবদের সম্পর্কে যা সংঘটিত হতে থাকে তা হচ্ছে, সেগুলিকে জড়া প্রকৃতির গর্ভে সঞ্চারিত করা হয় এবং তাদের অতীতের কর্ম অনুসারে তারা বিভিন্ন অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এভাবেই এই জড় জগতের কার্যকলাপ শুরু হয়। সৃষ্টির একেবারে শুরু থেকেই বিভিন্ন প্রজাতির জীবদের কার্যকলাপ শুরু হয়ে যায়। এমন নয় যে, সব কিছুই বিবর্তিত হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই একই সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ, পশু, পাখি — সমস্তই একই সঙ্গে সৃষ্ট হয়েছে, কারণ পূর্ব কল্পের প্রলয়ের সময় জীবদের যার যেমন বাসনা ছিল, সেভাবেই তারা আবার অভিব্যক্ত হয়েছে। এখানে অবশম্ শব্দটির দ্বারা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই প্রক্রিয়াতে জীবদের কিছুই করার সামর্থ্য থাকে না। পূর্ব সৃষ্টিকালের মধ্যে তাদের পূর্ব জীবনে তাদের সত্তার যে অবস্থা ছিল, ঠিক সেভাবেই তারা আবার অভিব্যক্ত হয় এবং এ সবই সাধিত হয় শুধুমাত্র পরমেশ্বরের ইচ্ছাতেই। এটিই হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের অচিত্ততত্ত শক্তি এবং বিভিন্ন জীব-প্রজাতি সৃষ্টি করার পরে তাদের সঙ্গে তাঁর কোন সংস্পর্শ থাকে না। বিভিন্ন জীবের কর্মবাসনা পূর্ণ করবার জন্যই জড় জগতের সৃষ্টি হয় এবং তাই ভগবান এই জড় জগতের সঙ্গে লিপ্ত হন না।
শ্লোকঃ ৯
ন চ মাং তানি কর্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয় ।
উদাসীনবদাসীনমসক্তং তেষু কৰ্মসু ॥ ৯ ॥
ননা; চ—ও; মাম্—আমাকে, তানি—সেই সমস্ত কর্মাণি – কর্ম; নিবধ্বস্তি— বন্ধন করে; ধনঞ্জয় – হে ধনঞ্জয়; উদাসীনবৎ—উদাসীনের ন্যায়; আসীন — অবস্থিত; অসক্তম্—আসক্তি রহিত; তেষু – সেই সমস্ত; কর্মসু—কর্মে।
গীতার গান
কিন্তু ধনঞ্জয় তুমি বুঝিবে নিশ্চয় ।
প্রকৃতির কার্যে কভু আমি লিপ্ত নয় ॥
উদাসীন আমি সেই প্রকৃতির কার্যে ।
আসক্তি নহে ত মোর প্রকৃতি বিধার্যে ৷৷
অনুবাদঃ হে ধনঞ্জয়। সেই সমস্ত কর্ম আমাকে আবদ্ধ করতে পারে না। আমি সেই সমস্ত কর্মে অনাসক্ত ও উদাসীনের ন্যায় অবস্থিত থাকি ।
তাৎপর্যঃ এই সম্বন্ধে এটি মনে করা উচিত নয় যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান নিষ্ক্রিয়। তাঁর চিন্ময় জগতে তিনি নিত্য সক্রিয় হয়ে রয়েছেন। ব্রহ্মসংহিতাতে (৫/৬) বলা হয়েছে, আত্মারামস্য তস্যাস্তি প্রকৃত্যা ন সমাগমঃ — “তিনি তাঁর শাশ্বত, আনন্দময় ও চিন্ময় রসাত্মক নীলায় নিতা তৎপর, কিন্তু এই জড় জগতের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তাঁর কোন সংসর্গ নেই।” সমস্ত জড়-জাগতিক ক্রিয়াগুলি তাঁর বিভিন্ন শক্তির ভগবান তাঁর সৃষ্ট জগতের সমস্ত জড়-জাগতিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি নিত্য উদাসীন থাকেন। এখানে উদাসীনবৎ কথাটির মাধ্যমে তাঁর উদাসীনতার বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও জাগতিক কার্যকলাপের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনে, তবুও তিনি যেন উদাসীন হয়ে অবস্থান করেন। এই সম্বন্ধে হাইকোর্টের বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত ন্যায়াধীশের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। তাঁর আজ্ঞায় কত ঘটনা ঘটে চলে—কারও প্রাণদও হয়, কারও কারাবাস হয়, কেউ আবার অসীম সম্পদ-সম্পত্তি লাভ করে, কিন্তু তবুও তিনি নিরপেক্ষভাবে উদাসীন হয়ে থাকেন। সেই সমস্ত লাভ-ক্ষতির সঙ্গে তাঁর কোনই সম্পর্ক নেই। ঠিক সেই রকমভাবে, যদিও জড় জগতের প্রতিটি ব্যাপারেই ভগবানের হাত থাকে, তবুও তিনি সব কিছুর থেকেই নিত্য উদাসীন। বেদান্ত সূত্রে (২/১/৩৪) বলা হয়েছে, বৈষম্যনৈর্মূণ্যে ন—তিনি এই জড় জগতের দ্বন্দ্বের মধ্যে অবস্থান করেন। না। তিনি এই সব জড়-জাগতিক দ্বন্দ্বের অতীত। এই জগতের সৃষ্টি এবং বিনাশেও তাঁর কোন আসক্তি নেই। পুর্বকৃত কর্ম অনুসারে জীব ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির দেহ ধারণ করে এবং ভগবান তাতে কোন রকম হস্তক্ষেপ করেন না।