শ্লোকঃ ৪

ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা।

মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষুবস্থিতঃ ॥ ৪॥

ময়া—আমার দ্বারা; ততস্— ব্যাপ্ত, ইদম্—এই; সর্বন — সমস্ত জগৎ— বিশ্ব; অব্যক্তমূর্তিনা—অব্যক্তরূপে; মৎস্থানি – আমাতে অবস্থিত; সর্বভূতানি — সমস্ত জীব না, চ–, অহম্ — আমি; তেষু – তাতে অবস্থিতঃ — অবস্থিত।

গীতার গান

অব্যক্ত যে নির্বিশেষ আমারই রূপ ।

জগৎ ব্যাপিয়া থাকি অনির্দিষ্ট রূপ ॥

আমাতে জগৎ সব না আমি তাহাতে ।

পরিণাম হয় তাহা আমার শক্তিতে ৷।

অনুবাদঃ অব্যক্তরূপে আমি সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত আছি। সমস্ত জীব আমাতেই অবস্থিত, কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নই।

তাৎপর্যঃ স্থূল ও জড় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করা যায় না। কথিত আছে যে-

অতঃ শ্রীকৃষ্ণনামাদি ন ভবেদ্‌গ্রাহ্যমিন্দ্রিয়ৈঃ ।

সেবোন্মুখে হি জিহ্বাদৌ স্বয়মের স্ফুরতাদঃ ॥

(ভক্তিরসামৃতসিন্ধু পূর্ব ২ / ২৩৪ )

জড় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম, রূপ, লীলা আদি উপলব্ধি করা যায় না। সদগুরুর তত্ত্বাবধানে যিনি শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি সাধন করেন, তাঁর নিকট তিনি প্রকাশিত হন। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৮) বলা হয়েছে, প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তি-বিলোচনেন সম্ভঃ সদৈব হৃদয়ে বিলোকয়ক্তি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীগোবিন্দের প্রতি অপ্রাকৃত প্রেমভক্তি বিকাশ সাধন করার ফলে অন্তরে ও বাইরে তাঁকে সর্বদা দর্শন করা যায়। তাই, তিনি সকলের কাছে প্রকট নন। এখানে বলা হয়েছে, যদিও তিনি সর্বব্যাপ্ত, সর্বত্র দৃশ্য, তবুও তিনি জড় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গোচরীভূত নন। অব্যক্ত মূর্তিনা কথাটির দ্বারা সেই কথাই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, যদিও আমরা তাঁকে দেখতে পাই না, তবুও সব কিছু তাঁকেই আশ্রয় করে আছে। সপ্তম অধ্যায়ে আমরা যে আলোচনা করেছি, সেই অনুসারে সমস্ত মহাজাগতিক সৃষ্টি ভগবানের উৎকৃষ্ট চিন্ময় শক্তি ও নিকৃষ্ট জড় শক্তির সময়ে মাত্র। সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে সূর্যকিরণের বিস্তারের মতো ভগবানের শক্তি সম্পূর্ণ সৃষ্টিতে বিস্তারিত এবং সব কিছুই সেই শক্তির আশ্রয়ে বিদ্যমান।

কিন্তু তা বলে এই সিদ্ধান্ত করা উচিত নয় যে, ভগবান যেহেতু সর্বব্যাপ্ত, তাই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সত্তা হারিয়ে ফেলেছেন। এই যুক্তিকে ভ্রান্ত বলে প্রতিপন্ন করবার জন্য ভগবান বলেছেন, “আমি সর্বব্যাপক এবং সব কিছুই আমাকে আশ্রয় করে আছে, কিন্তু তবুও আমি সব কিছু থেকে স্বতন্ত্র।” উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাজা যেমন তাঁর প্রশাসনের অধীশ্বর বা প্রশাসন তাঁর একটি শক্তির প্রকাশ বিবিধ প্রশাসনিক বিভাগে তাঁর বিভিন্ন শক্তি এবং প্রতিটি বিভাগ তাঁর ক্ষমতার উপর আশ্রিত। কিন্তু তবুও তিনি স্বয়ং প্রতিটি বিভাগে ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান থাকেন না। এটি অবশ্য একটি স্থূল উদাহরণ। সেই রকম, যা কিছু আমরা দেখি এবং জড় জগতে ও চিন্ময় জগতে যত সৃষ্টি আছে, সব কিছুই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শক্তিকে আশ্রয় করে বর্তমান। ভগবানের বিভিন্ন শক্তির প্রসারণের ফলে সৃষ্টির উদ্ভব হয় এবং ভগবদ্গীতাতে সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে, বিষ্টভাহমিদং কৃৎস্নম্—তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধির দ্বারা বা বিভিন্ন শক্তির পরিব্যাপ্তির দ্বারা তিনি সর্বত্রই বিদ্যমান।

শ্লোকঃ ৫

ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্ ।

ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ ।। ৫ ।।

ন না; চও; মৎস্থানি —আমাতে স্থিত; ভূতানি — সমগ্র সৃষ্টি; পশ্য—দেখ; মে—আমার; যোগমৈশ্বরম্ — অচিন্ত্য যোগশক্তি; ভূতভৃৎ— সমস্ত জীবের ধারক, ন—না; চ–ও; ভূতস্থঃ — জড় সৃষ্টির মধ্যে; মম— আমার; আত্মা -স্বরূপ; ভূতভাবনঃ—সমগ্র জগতের উৎস।

গীতার গান

আমার শক্তিতে থাকে ভিন্ন আমা হতে।

যোগেশ্বর্য সেই মোর বুঝ ভাল মতে ॥

ভর্তা সকল ভূতের নহি সে ভূত ৷

ভূতভৃৎ নাম মোর ভূতাদি তটস্থ ৷৷

অনুবাদঃ যদিও সব কিছুই আমারই সৃষ্ট, তবুও তারা আমাতে অবস্থিত নয়। আমার যোগেশ্বর্য দর্শন কর। যদিও আমি সমস্ত জীবের ধারক এবং যদিও আমি সর্বব্যাপ্ত, তবুও আমি এই জড় সৃষ্টির অন্তর্গত নই, কেন না আমি নিজেই সমস্ত সৃষ্টির উৎস।

তাৎপর্যঃ ভগবান এখানে বলেছেন যে, সব কিছু তাকে আশ্রয় করে আছে (মংস্থানি সর্বভূতানি)। ভগবানের এই উক্তির ভ্রান্ত অর্থ করা উচিত নয়। এই জড় সৃষ্টির পালন-পোষণের ব্যাপারে ভগবানের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কখনও কখনও ছবিতে দেখি যে, গ্রীক পুরাণের অ্যাটলাস নামে এক অতিকায় পুরুষ তার কাঁধে পৃথিবী ধারণ করে আছে। তাকে দেখে মনে হয় এই বিশাল পৃথিবী গ্রহটির ভার বহন করে সে অত্যন্ত ক্লান্ত। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেভাবে ব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করেন না। তিনি বলেছেন, যদিও সব কিছু তাঁকে আশ্রয় করে আছে, তবুও তিনি তাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। গ্রহমণ্ডলী মহাকাশে ভাসছে এবং এই মহাকাশ হচ্ছে ভগবানের শক্তি। কিন্তু তিনি মহাকাশ থেকে ভিন্ন। তিনি স্বতন্ত্রভাবে অধিষ্ঠিত থাকেন। তাই ভগবান বলেছেন, “তারা যদিও আমার অচিন্ত্য শক্তিতে অবস্থান করে, কিন্তু তবুও পরমেশ্বর ভগবানরূপে আমি তাদের থেকে স্বতন্ত্র।” এটিই হচ্ছে ভগবানের অচিন্ত্য ঐশ্বর্য।

নিরুক্তি নামে বৈদিক অভিধানে বলা হয়েছে যে, যুজ্যতেহনেন দুর্ঘটেঘু কার্যেষু—“ভগবান তাঁর বিচিত্র শক্তির প্রভাবে অদ্ভুত, অচিন্ত লীলা পরিবেশন করেন।” তিনি বিভিন্ন শক্তিসম্পন্ন পুরুষ এবং তাঁর সংকল্পই হচ্ছে বাস্তব সত্য।

এভাবেই পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করা উচিত। আমরা অনেক কিছুই করার ইচ্ছা করতে পারি, কিন্তু তাদের বাস্তবে রূপদান করতে গেলে আমাদের নানা রকমের প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন হতে হয় এবং অনেক সময় আমাদের ইচ্ছানুসারে তা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন কোন কিছু করতে চান, তখন তার সংকল্প মাত্রই সমস্ত কিছু এত সুষ্ঠুভাবে সাধিত হয় যে, তা কল্পনাও করা যায় না। ভগবান এই সত্যের ব্যাখ্যা করে বলেছেন— যদিও তিনি সম্পূর্ণ সৃষ্টির ধারক ও প্রতিপালক, কিন্তু তবুও তিনি তা স্পর্শও করেন না। কেবলমাত্র তাঁর পরম বলবর্তী ইচ্ছা শক্তির দ্বারাই সম্পূর্ণ সৃষ্টির সৃজন, ধারণ, পালন ও সংহার সাধিত হয়। আমাদের জড় মন ও স্বয়ং আমি, এর মধ্যে ভেদ আছে, কিন্তু ভগবানের মন ও স্বয়ং তিনি সর্বদাই অভিন্ন, কারণ তিনি হচ্ছেন পরম চৈতন্য। যুগপৎভাবে ভগবান সব কিছুর মধ্যে বিদ্যমান; তবুও সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না কিভাবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সব কিছুর মধ্যে বিদ্যমান। ভগবান এই সৃষ্টির থেকে ভিন্ন, তবুও সব কিছুই তাঁকে আশ্রয় করে আছে। এই অচিন্ত সত্যকে এখানে যোগমৈশ্বরম অর্থাৎ ভগবানের যোগশক্তি বলা হয়েছে।

শ্লোকঃ ৬

যথাকাশস্থিতো নিত্যং বায়ুঃ সর্বত্রগো মহান্ ।

তথা সর্বাণি ভূতানি মৎস্থানীত্যুপধারয় ।। ৬ ।।

যথা— যেমন; আকাশস্থিতঃ – আকাশে অবস্থিত, নিত্যম্—সর্বদা, বায়ুঃ বায়ু; সর্বভগঃ—সর্বত্র বিচরণশীল; মহান—মহান, তথা — তেমনই; সর্বাণি — সমস্ত; ভূতানি—জীবসমূহ: মৎস্থানি – আমাতে অবস্থিত; ইতি—এভাবে; উপধারয়- উপলব্ধি করতে চেষ্টা কর।

গীতার গান

আকাশ আর যে বায়ু সেরূপ তুলনা ।

আকাশ পৃথক হতে বায়ুর চালনা ॥

আকাশ সর্বত্র ব্যাপ্ত বায়ু যথা থাকে ।

তথা সর্বভূত স্থিত থাকে যে আমাতে ॥

অনুবাদঃ অবগত হও যে, মহান বায়ু যেমন সর্বত্র বিচরণশীল হওয়া সত্ত্বেও সর্বদা আকাশে অবস্থান করে, তেমনই সমস্ত সৃষ্ট জীব আমাতে অবস্থান করে।

তাৎপর্যঃ এই বিশাল জড় জগৎ কিভাবে ভগবানকে আশ্রয় করে আছে, এই সত্য সাধারণ মানুষের কাছে অচিস্তানীয়। তাই, আমাদের বোঝাবার জন্য ভগবান এখানে এই উদাহরণের অবতারণা করেছেন। এই সৃষ্টিতে, আমাদের কল্পনায় আকাশ হচ্ছে সবচেয়ে বড়। আর সেই আকাশের মধ্যে বাতাস হচ্ছে মহাজগতের সবচেয়ে বিশাল এক অভিপ্রকাশ। সেই বাতাসের চলাচল থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় অন্য সব কিছুর চলাচল। কিন্তু এই মহান বায়ু অত বিশাল হলেও আকাশের মধ্যেই তার অবস্থান, বাতাস তো আকাশের বাইরে নয়। তেমনই, চমকপ্রদ সমস্ত সৃষ্টি ভগবানেরই ইচ্ছার প্রভাবে বিদ্যমান এবং সেই সমস্ত পূর্ণরূপে তাঁরই ইচ্ছার অধীন। যেমন আমরা সাধারণত বলে থাকি, পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ইচ্ছা ছাড়া একটি পাতাও নড়ে না। এভাবেই সব কিছুই তাঁরই ইচ্ছা অনুসারে সাধিত হয় — তাঁরই ইচ্ছায় সব কিছুর সৃষ্টি হচ্ছে, সব কিছুর পালন হচ্ছে এবং সব কিছুর বিনাশ হচ্ছে। কিন্তু তবুও তিনি সব কিছুর থেকে পৃথক, যেমন আকাশ সব সময়ই বায়ুমণ্ডলের ক্রিয়াকলাপ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে বিরাজ করে।

উপনিষদে বলা হয়েছে, যভীষা বাতঃ পরতে— “ভগবানের ভয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়।” ( তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২/৮/১)। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩/৮/৯) বলা হয়েছে—এতসা বা অক্ষরসা প্রশাসনে গার্গি সূর্যচন্দ্রমসৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠত এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি দ্যাবাপৃথিবৌ বিহুতৌ তিষ্ঠতঃ । “পরমেশ্বর ভগবানের পরম আজ্ঞার ফলে চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য বৃহৎ গ্রহমণ্ডলী তাদের কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে।” ব্রহ্মসংহিতাতেও (৫/৫২) বলা হয়েছে—

যচক্ষুরেষ সবিতা সকল গ্রহাণাং

রাজা সমস্তসুরমূর্তিরশেষতেজাঃ ।

যস্যাক্রয়া ভ্রমতি সংভূতকালচক্রো

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।

এখানে সূর্যের ভ্রমণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, তাপ ও আলো বিকিরণকারী অনন্ত শক্তিসম্পন্ন সূর্য ভগবানের একটি চক্ষুবিশেষ। শ্রীগোবিন্দের আজ্ঞা ও ইচ্ছা অনুসারে তিনি তাঁর কক্ষপথে পরিভ্রমণ করেন। সুতরাং, বৈদিক শাস্ত্র থেকে প্রমাণিত হয় যে, অতি অদ্ভুত ও মহানরূপে প্রতিভাত হয় যে জড় সৃষ্টি, তা পূর্ণরূপে পরমেশ্বর ভগবানেরই নিয়ন্ত্রণাধীন। এই অধ্যায়ে পরবর্তী শ্লোকগুলিতে নাই তথ্যের বিশদ বর্ণনা করা হবে।

error: Content is protected !!