শ্লোকঃ ৩৪

মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু ৷

মামেবৈয্যসি যুক্তৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ ॥ ৩৪ ॥

মন্মনাঃ—মদ্‌গত চিত্ত; ভব—হও; মৎ- আমার; ভক্তঃ–ভক্ত; মৎ-আমার; যাজী—পূজাপরায়ণ; মাম্ আমাকে, নমস্কুরু–নমস্কার কর; মাম্ আমাকে; এব—সম্পূর্ণরূপে: এ্যসি — প্রাপ্ত হবে, যুক্তৈকম্—এভাবে অভিনিবিষ্ট হয়ে; আত্মানম্—তোমার আত্মা; মৎপরায়ণঃ- সৎপরায়ণ হয়ে।

গীতার গান

মন্মনা মঞ্জুক্ত মোর ভজন পূজন ৷

আমাকে প্রণাম তুমি কর সর্বক্ষণ ।।

মৎপর হয়ে তুমি নিজ কার্য কর ৷

অবশ্য পাইবে মোরে জান ইহা কর ৷।

অনুবাদঃ তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত কর, আমার ভক্ত হও, আমাকে প্রণাম কর এবং আমার পূজা কর। এভাবেই মৎপরায়ণ হয়ে সম্পূর্ণরূপে আমাতে অভিনিবিষ্ট হলে, নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকটিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কৃষ্ণভাবনার অমৃতই হচ্ছে এই দূষিত জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করার একমাত্র উপায়। যদিও এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, সমস্ত ভক্তিযোগের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অসাধু ব্যাখ্যাকারেরা এই অতি স্পষ্ট তথ্যকে বিকৃত করে পাঠকের চিত্ত কৃষ্ণবিমুখ করে তোলে এবং তাকে কুপথে চালিত করে। এই ধরনের ব্যাখ্যাকারেরা জানে না যে, শ্রীকৃষ্ণের মন এবং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কোন ভেদ নেই। শ্রীকৃষ্ণ সাধারণ মানুষ নন, তিনি হচ্ছেন পরমতত্ত্ব। তাঁর দেহ, তাঁর মন ও তিনি স্বয়ং অন্বয় পরমতত্ত্ব। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতের আদিলীলা, পঞ্চম অধ্যায়, ৪১-৪৮ সংখ্যক শ্লোকের অনুভাষ্যে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর কুম পুরাণ থেকে একটি শ্লোকের উল্লেখ করে বলেছেন, দেহদেহিবিভেদোহাং নেশ্বরে বিদ্যতে কচিৎ। অর্থাৎ, পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর দেহে কোন ভেদ নেই। কিন্তু যেহেতু তথাকথিত ব্যাখ্যাকারেরা কৃষ্ণতত্ত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তাই তারা তাদের ব্যাখ্যা ও বাক্‌চাতুর্যের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে আড়াল করে রেখে বলে যে, শ্রীকৃষ্ণের যথার্থ স্বরূপ তাঁর দেহ ও মন থেকে ভিন্ন। যদিও এই ধরনের মন্তব্য কৃষ্ণতত্ত্ব- বিজ্ঞান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার পরিচায়ক, কিন্তু কিছু মানুষ জনসাধারণকে এভাবেই বিপথগামী করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে।

কিছু আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষও শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করে। কিন্তু তাদের চিন্তা শ্রীকৃষ্ণের মাতুল কংসের মতোই বিদ্বেষপূর্ণ। সে-ও শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় সদাসর্বদা তন্ময় থাকত, কিন্তু সে শ্রীকৃষ্ণকে শত্রুরূপে চিন্তা করত। তার সব সময় উদ্বেগ হত যে, কখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে হত্যা করতে আসবেন। এই ধরনের চিন্তার ফলে কোন লাভ হয় না। শ্রীকৃষ্ণের চিত্র করা উচিত প্রেমভক্তি সহকারে। তাকেই বলা হয় ভক্তিযোগ। প্রত্যেকের নিরন্তর কৃষ্ণবিজ্ঞান অনুশীলন করার চেষ্টা করা উচিত। সেই অনুকূল অনুশীলন কি? সদগুরুর আশ্রয়ে শিক্ষা গ্রহণ করাই হচ্ছে কৃষ্ণতত্ত্বের অনুকূল অনুশীলন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং আমরা ইতিপূর্বে কয়েকবার বিশ্লেষণ করেছি যে, তাঁর শ্রীবিগ্রহ জড় নয়, কিন্তু তা সচ্চিদানন্দময়। এই ধরনের কৃষ্ণকথা মানুষকে ভক্ত হতে সহায়তা করে। তা না করে যদি কোন অবাঞ্ছিত ব্যক্তির কাছে কৃষ্ণতত্ত্ব জানবার চেষ্টা করা হয়, তা হলে সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য, আদ্যরূপে চিত্ত অভিনিবিষ্ট করে, হৃদয়ে সুদৃঢ় বিশ্বাস সহকারে তাঁকে পরমেশ্বর ভগবান বলে জেনে তাঁর পূজায় তৎপর হওয়া উচিত। ভারতবর্ষে শ্রীকৃষ্ণকে পূজা করার জন্য হাজার হাজার মন্দির আছে এবং সেখানে ভক্তিযোগ অনুশীলন করা হয়। এই ভক্তিযোগের একটি অঙ্গ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করা। ভগবানের শ্রীবিগ্রহের সামনে দণ্ডবৎ প্রণাম করা উচিত এবং কায়মনোবাক্যে সর্বতোভাবে কৃষ্ণোন্মুখ হতে হয়। তার ফলে শ্রীকৃষ্ণে অবিচলিত নিষ্ঠার উদয় হয় এবং কৃষ্ণলোক প্রাপ্ত হওয়া যায়। বাক্‌চাতুর্যে কারও পথভ্রষ্ট হওয়া উচিত নয়। শ্রীকৃষ্ণের কথা নবধা ভক্তির অনুশীলনে প্রত্যেকের নিষ্ঠাপরায়ণ হওয়া উচিত। শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তিই হচ্ছে মানব সমাজের পরম প্রাপ্তি।

ভগবদ্গীতার সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে মনোধর্মী জ্ঞান, অষ্টাঙ্গযোগ ও সকাম কর্ম থেকে মুক্ত শুদ্ধ ভক্তিযোগের বর্ণনা করা হয়েছে। যারা পূর্ণরূপে শুদ্ধ হতে পারেনি, তারা নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি, সর্বভুতে স্থিত পরমাত্মা আদি ভগবানের অন্যান্য রূপের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, কিন্তু শুদ্ধ ভক্ত কেবল ভগবানের সেবাকেই অঙ্গীকার করেন।

কৃষ্ণ-বিষয়ক একটি অতি মধুর কবিতাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত অন্যান্য দেব-দেবীর পূজায় নিয়োজিত ব্যক্তিগণ মূঢ় এবং তারা কখনই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম কৃপা লাভ করতে পারে না। ভক্ত প্রামাণিক পর্যায়ে কখনও কখনও তাঁর প্রকৃত অবস্থা থেকে সাময়িকভাবে অধঃপতিত হতে পারে, তবুও তাঁকে সকল দার্শনিক ও যোগীদের থেকে অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা উচিত। যে ব্যক্তি কৃষ্ণচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সতত কৃষ্ণসেবায় নিয়োজিত আছেন, তিনিই প্রকৃত সাধু ব্যক্তি। তাঁর দৈবক্রমে অনুষ্ঠিত অভক্তোচিত কার্যকলাপ অচিরেই বিনষ্ট হবে এবং তিনি শীঘ্রই নিঃসন্দেহে পরম সিদ্ধি লাভ করবেন। পরমেশ্বর ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের কখনও পতনের সম্ভাবনা থাকে না। কারণ, পরম পুরুষোত্তম ভগবান স্বয়ং তাঁর শুদ্ধ ভক্তের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সুতরাং বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রেরই কৃষ্ণভক্তির এই সরল পন্থাটি অবলম্বন করে, এই জড় জগতেই পরম সুখে জীবন যাপন করা উচিত। অবশেষে তিনিই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম কৃপা লাভ করবেন।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ৷

শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ৷৷

ইতি—গূঢ়তম জ্ঞান বিষয়ক ‘রাজগুহ্য-যোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নবম অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

error: Content is protected !!