শ্লোকঃ ৩১
ক্ষিপং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি ।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি ॥ ৩১ ॥
ক্ষিপ্রম্—অতি শীঘ্র; ভবতি — হন, ধর্মাত্মা – ধার্মিক, শশ্বৎ — নিত্য, শান্তি শান্তি। নিগচ্ছতি—প্রাপ্ত হন; কৌন্তেয়— হে কুন্তীপুত্ৰ, প্ৰতিজানীহি — ঘোষণা কর; ন না; মে— আমার; ভক্তঃ ভক্ত, প্রণশ্যতি বিনাশ প্রাপ্ত হন।
গীতার গান
অতিশীঘ্র যাবে সেই ভাব দুরাচার ।
ধর্মভাব হবে তার ভক্তিতে আমার ॥
হে কৌন্তেয়! প্রতিজ্ঞা এ শুনহ আমার ।
আমার যে ভুক্ত হয় নাশ নাহি তার ॥
অনুবাদঃ তিনি শীঘ্রই ধর্মাত্মায় পরিণত হন এবং নিতা শান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয়া। তুমি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হন না।
তাৎপর্যঃ ভগবানের এই উক্তির ভ্রান্ত অর্থ করা উচিত নয়। সপ্তম অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন যে, অসৎ কর্মে লিপ্ত মানুষেরা কখনই তাঁর ভক্ত হতে পারে না। যে ভগবানের ভক্ত নয়, তার কোনই সদগুণ নেই। তাই এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, তা হলে স্বেচ্ছায় অথবা দুর্ঘটনাক্রমে পাপকর্মে প্রবৃত্ত মানুষ কিভাবে শুদ্ধ ভক্ত হতে পারে? এই ধরনের প্রশ্নের উত্থাপন ন্যায়সঙ্গত। সপ্তম অধ্যায় অনুসারে, যে দুষ্কৃতকারী সর্বদাই ভগবদ্ভক্তি থেকে বিমুখ থাকে, তার কোনই সদগুণ নেই। সেই কথা শ্রীমদ্ভাগবতেও বলা হয়েছে। সাধারণত, নবধা ভক্তি আচরণকারী ভক্ত সমস্ত জাগতিক কলুষ থেকে হৃদয়কে নির্মল করতে প্রবৃত্ত থাকেন। তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে তাঁর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত করেন, তাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর হৃদয় সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়। নিরন্তর ভগবৎ চিন্তা করার প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি শুদ্ধ হন। উন্নত স্তর থেকে ভ্রষ্ট হলে অন্তঃকরণ শুদ্ধ করার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান বেদে আছে। কিন্তু এখানে সে রকম প্রায়শ্চিত্ত করার কোন বিধান দেওয়া হয়নি, কারণ নিরন্তর পরম পুরুষোত্তম ভগবানের চিন্তা করার ফলে ভক্তের হৃদয় আপনা থেকেই নির্মল হয়ে যায়। তাই, নিরন্তর হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে কীর্তন করা উচিত। তার ফলে ভক্ত সব রকম আকস্মিক পতন থেকে রক্ষা পান। এভাবেই তিনি সব রকম জড় কলুষ থেকে সর্বদাই মুক্ত থাকেন।
শ্লোকঃ ৩২
মাং হি পাৰ্থ ব্যপাশ্রিত্য যেঽপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রান্তেঽপি যান্তি পরাং গতিম্ ॥ ৩২ ৷৷
মাম্—আমাকে: হি—অবশ্যই; পার্থ—হে পৃথাপুত্র; ব্যপাশ্রিত্য — বিশেষভাবে আশ্রয় করে; যে—যারা; অপি—ও; সু্যুঃ হয়, পাপযোনয়ঃ — নীচকুলে জাত; স্ক্রিয়:- স্ত্রী: বৈশ্যাঃ—— বৈশ্য; তথা এবং শূদ্রাঃ – শূদ্র: তে অপি – তারাও; যান্তি – লাভ করে; পরাম্—পরম; গতিম্ — গতি।
গীতার গান
আমাকে আশ্রয় করি যেবা পাপযোনি ।
ম্লেচ্ছাদি যখন কিংবা বেশ্যা মধ্যে গণি ।।
কিংবা বৈশ্য শূদ্র যদি আমার আশ্রয় ৷
পাইবে বৈকুণ্ঠপতি জানিহ নিশ্চয়।।
অনুবাদঃ হে পার্থ ! যারা আমাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্র আদি নীচকুলে জাত হলেও অবিলম্বে পরাগতি লাভ করে।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে পরমেশ্বর ভগবান স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন যে, ভক্তিযোে সকলেরই সমান অধিকার, এতে কোন জাতি-কুল আদির ভেদাভেদ নেই। জড়- জাগতিক জীবন ধারায় এই প্রকার ভেদাভেদ আছে, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি অপ্রাকৃত সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তির কাছে তা নেই। পরম লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। শ্রীমদ্ভাগবতে (২/৪/১৮) বলা হয়েছে যে, এমন কি অত্যন্ত অধম যোনিজাত কুকুরভোজী চণ্ডাল পর্যন্ত শুদ্ধ ভক্তের সংসর্গে শুদ্ধ হতে পারে। সুতরাং, ভগবস্তুতি ও শুদ্ধ ভক্তের পথনির্দেশ এতই শক্তিসম্পন্ন যে, তাতে উচ্চ-নীচ জাতিভেদ নেই; যে কেউ তা গ্রহণ করতে পারে। সবচেয়ে নগণ্য মানুষও যদি শুদ্ধ ভক্তের আশ্রয় গ্রহণ করে, তা হলে যথাযথ পথনির্দেশের মাধ্যমে সেও অচিরে শুদ্ধ হতে পারে। প্রকৃতির বিভিন্ন গুণ অনুসারে মানুষকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে— সত্ত্বগুণ-বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ, রজোগুণ বিশিষ্ট ক্ষত্রিয় (শাসক), রজ ও তমোগুণ-বিশিষ্ট বৈশ্য (বণিক) এবং তমোগুণ বিশিষ্ট শূদ্র (শ্রমিক)। তাদের থেকে অধম মানুষকে পাপযোনিভূক্ত চণ্ডাল বলা হয়। সাধারণত, উচ্চকুলোদ্ভূত মানুষেরা এই সমস্ত পাপযোনিভূক্ত জীবকে অস্পৃশ্য বলে দূরে ঠেলে দেন। কিন্তু ভগবদ্ভক্তির পন্থা এতই ক্ষমতাসম্পন্ন যে, ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত নীচবর্ণের মানুষদেরও মানব-জীবনের পরম সিদ্ধি প্রদান করতে সক্ষম। এটি সম্ভব হয় কেবল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে। ব্যপাশিতা শব্দটির দ্বারা এখানে তা নির্দেশিত হয়েছে, তাই সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়া উচিত। যিনি তা করেন, তিনি মহাজ্ঞানী এবং যোগীদের চেয়েও অধিক গৌরবান্বিত হন।
শ্লোকঃ ৩৩
কিং পুনব্রাহ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা ।
অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্ ॥ ৩৩ ॥
কিম্—কি; পুনঃ—পুনরায়; ব্রাহ্মণাঃ – ব্রাহ্মণেরা, পুণ্যাঃ—পুণ্যবান, ভক্তাঃ- ভক্তেরা রাজাঃ—রাজর্ষিরা, তথা — ও অনিত্যম্ – অনিতা : অসুখম— দুঃখময়; লোকম্— লোক; ইমম্—এই; প্রাপ্য – লাভ করে; ভজস্ব — ভজনা কর; মাম্—আমাকে।
গীতার গান
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় যারা তাদের কি কথা।
পুণ্যবান হয় তারা জানিবে সর্বথা ।।
অতএব এ অনিত্য সংসারে আসিয়া ।
ভজন করহ মোর নিশ্চিন্তে বসিয়া ।।
অনুবাদঃ পুণ্যবান ব্রাহ্মণ, ভক্ত ও রাজর্ষিদের আর কি কথা? তাঁরা আমাকে আশ্রয় করলে নিশ্চয়ই পরাগতি লাভ করবেন। অতএব, তুমি এই অনিত্য দুঃখময় মর্ত্যলোক লাভ করে আমাকে ভজনা কর ।
তাৎপর্যঃ এই ভাগতে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই জগৎ কারও জন্যই সুখদায়ক নয়। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অনিত্যমসুখং লোকম্—এই জগৎ অনিতা ও দুঃখময় এবং কোন সুস্থ মস্তিষ্ক-সম্পন্ন ভদ্রলোকের বসবাসের উপযুক্ত জায়গা এটি নয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবান এই জগৎকে অনিতা ও দুঃখময় বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কিছু কিছু দার্শনিকেরা, বিশেষ করে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মায়াবাদী দার্শনিকেরা বলে যে, এই জগৎ মিথ্যা। কিন্তু ভগবদ্গীতা থেকে আমরা জানতে পারি যে, এই জগৎ মিথ্যা নয়; তবে এই জগৎ হচ্ছে অনিত্য। অনিত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই জগৎ অনিত্য, কিন্তু আর একটি জ আছে, যা নিত্য শাশ্বত। এই জগৎ দুঃখময়, কিন্তু আর একটি জগৎ আছে যা নিত্য ও আনন্দময়।
অর্জুন রাজর্ষিকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁকেও ভগবান বলেছেন, “আমাকে ভক্তি কর এবং শীঘ্রই ভগবৎ-ধামে ফিরে এস।” এই দুঃখময় অনিত্য জগতে কারওই পড়ে থাকা উচিত নয়। সকলেরই কর্তবা হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁর কাছে ফিরে গিয়ে শাশ্বত সুখ লাভ করা। ভগবদ্ভক্তিই হচ্ছে সকল শ্রেণীর মানুষের সব রকম দুঃখ দূর করার একমাত্র উপায়। তাই, প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে তার জীবন সার্থক করে তোলা।