নবম অধ্যায়

রাজগুহ্য-যোগ

শ্লোকঃ ১

ইদং তু তে গুহ্যতমং প্রবক্ষ্যাম্যনসূয়বে ।

জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং যজ্জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ ৷। ১ ৷।

শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন; ইদম্—এই; তু—কিন্তু, তে— তোমাকে; ওহাতমম্ —অতি গোপনীয়: প্রবক্ষ্যামি বলছি, অনসূয়রে — নির্মৎসর, জ্ঞানম্—জ্ঞান; বিজ্ঞান—উপলব্ধ জ্ঞান; সহিতম্—সহ; যৎ—যা; জ্ঞাত্বা— জেনে মোক্ষ্যসে—মুক্ত হবে; অশুভাৎ দুঃখময় সংসার বন্ধন থেকে

গীতার গান

শ্রীভগবান কহিলেনঃ

এবার হে অর্জুন শুন অসূয়া রহিত ।

এই এক গুহ্যতম কহি তৰ হিত ৷৷

ইহা হয় জ্ঞান আর বিজ্ঞানসম্মত ।

জানিনে সে মুক্ত হয় সর্ব অশুভত ৷।

অনুবাদঃ শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ অনুবাদ পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন! তুমি নির্মৎসর বলে তোমাকে আমি পরম বিজ্ঞান সমন্বিত সবচেয়ে গোপনীয় জ্ঞান উপদেশ করছি। সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে তুমি দুঃখময় সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হও ।

তাৎপর্যঃ ভক্ত যতই ভগবানের কথা শ্রবণ করে, ততই তাঁর অন্তরে দিব্য জ্ঞানের প্রকাশ হয়। এই শ্রবণ পদ্ধতির মহিমা বর্ণনা করে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে— “ভগবানের কথা দিবা শক্তিতে পূর্ণ এবং এই দিব্য শক্তি উপলব্ধি করা যায় যদি ভক্তদের মধ্যে পরমেশ্বর ভগবানের কথা আলোচিত হয়। মনোধর্মী জল্পনাকারী অথবা কেতাবি বিদ্যায় পণ্ডিতদের সঙ্গ করলে এই বিজ্ঞান কখনও লাভ করা যায় না, কেন না এই দিব্য জ্ঞান উপলব্ধি সঞ্জাত।”

ভগবদ্ভক্তেরা সর্বদাই ভগবানের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। ভগবান কৃষ্ণভাবনাময় প্রতিটি জীবের মনোভাব ও আন্তরিকতা জানেন এবং ভক্তসঙ্গে কৃষ্ণ- বিষয়ক বিজ্ঞানতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করার বুদ্ধিমত্তা প্রদান করেন। কৃষ্ণ-বিষয়ক আলোচনা অলৌকিক শক্তিশালী। যদি কোন সৌভাগ্যবান জীব এই সৎসঙ্গ লাভ করেন। এবং জ্ঞান লাভে যত্নশীল হন, তখন তিনি নিশ্চিতভাবে পারমার্থিক উপলব্ধির পথে অবশ্যই উন্নতি সাধন করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সেবায় অর্জুনকে উত্তরোত্তর উন্নত স্তরে উত্তীর্ণ হতে উৎসাহিত করবার উদ্দেশ্যে এই নবম অধ্যায়ে সেই রহস্যের বর্ণনা করেছেন, যা পূর্ববর্ণিত তত্ত্বসমূহ থেকে অনেক বেশি গূঢ় ও গোপনীয় । ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায় হচ্ছে গ্রন্থটির মোটামুটি প্রস্তাবনা-স্বরূপ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের পারমার্থিক জ্ঞানকে গুহ্য বলা হয়েছে। সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ের বিষয় ভক্তিযোগের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত এবং যেহেতু তার প্রভাবে কৃষ্ণভাবনা বিকশিত হয়, তাই তাকে গুহ্যতর বলা হয়েছে। কিন্তু নবম অধ্যায়ে কেবল শুদ্ধ ভক্তির বর্ণনা করা হয়েছে, তাই এই অধ্যায়টি হচ্ছে ওহ্যতম। যিনি শ্রীকৃষ্ণের এই পরম গুহ্যতম তত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত, তিনি স্বাভাবিকভাবে অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত। তাই, জড় জগতে অবস্থানকালেও তাঁর কোন রকম জড়-জাগতিক জ্বালাযন্ত্রণা থাকে না। ভুভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় উৎকণ্ঠিত থাকেন, তিনি সংসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি মুক্ত। তেমনই, ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব যে, যিনি এভাবেই নিয়োজিত, তিনিই হচ্ছেন মুক্ত পুরুষ।

নবম অধ্যায়ের এই প্রথম শ্লোকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইদং জ্ঞানম্ (‘এই জ্ঞান ) কথাটির অর্থ শুদ্ধ ভক্তিযোগ, যা হচ্ছে নববিধা ভক্তি শ্রবণ, কীৰ্ত্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্জন, বন্দন, দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদন। ভক্তিযোগের এই নয়টি অঙ্গের অনুশীলনের ফলে চিন্ময় চেতনায় বা কৃষ্ণভাবনায় উন্নীত হওয়া যায়। এভাবেই জড়-জাগতিক কনুষ থেকে হৃদয় শুদ্ধ হলে এই কৃষ্ণ-তত্ত্ববিজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করতে পারা যায়। জীবাত্মা যে জড় সত্তা নয়, শুধু এই উপলব্ধিটুকুই যথেষ্ট নয়। এর মাধ্যমে কেবল পারমার্থিক উপলব্ধির সূচনাই হতে পারে। কিন্তু জীবের দৈহিক ক্রিয়াকলাপ এবং যিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, তিনি দেহটি নন, তাঁর ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যে কি ভেদ, সেটি জানা আবশাক।

সপ্তম অধ্যায়ে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ঐশর্যপূর্ণ শক্তিমত্তা, তাঁর বিবিধ শক্তি, পরা ও অপরা প্রকৃতি এবং এই সমস্ত জড়-জাগতিক সৃষ্টির বর্ণনা করা হয়েছে। এখন এই নবম অধ্যায়ে ভগবানের মহিমা বর্ণিত হচ্ছে।

এই শ্লোকে অনসূয়রে সংস্কৃত কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত গীতার ব্যাখ্যাকারেরা উচ্চ শিক্ষিত হলেও তাঁরা সকলেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। এমন কি বড় বড় পণ্ডিতেরাও ভগবদ্গীতার অত্যন্ত অশুদ্ধ ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের ভাষ্য অর্থহীন, কারণ তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। ভগবদ্গীতার যথার্থ ব্যাখ্যা কেবলমাত্র ভগবদ্ভক্তই করতে পারেন। ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তি কখনই ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যা করতে পারে না অথবা কৃষ্ণতত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে পারে না। কৃষ্ণতত্ত্ব না জেনে যারা তাঁর চরিত্রের সমালোচনা করে, তারা বাস্তবিকই মূঢ়। তাই, অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে সেই সমস্ত ভাষ্য বর্জন করাই কল্যাণকর। যে ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণকে শুদ্ধ, দিবা পুরুষোত্তম স্বয়ং ভগবান বলে জানেন, তাঁর পক্ষে এই অধ্যায়গুলি হবে পরম কল্যাণকর।

শ্লোকঃ ২

রাজবিদ্যা রাজগুহ্যং পবিত্রমিদমুত্তমম্ ।

প্রত্যক্ষাবগমং ধর্ম্যং সুসুখং কর্তুমব্যয়ম্ ॥ ২॥

রাজবিদ্যা — সমস্ত বিদ্যার রাজা, রাজগুহাম্—গোপনীয় জ্ঞানসমূহের রাজা; পবিত্রম্ – পবিত্র, ইদম্—এই, উত্তমম্ — উত্তম; প্রত্যক্ষ— প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা অবগমম্ — উপলব্ধ হয়; ধর্মাম—ধর্ম, সুসুখম্ — অত্যন্ত সুখদায়ক; কতুম — অনুষ্ঠান করতে; অব্যয়ম —অব্যয়।

গীতার গান

রাজবিদ্যা এই জ্ঞান রাজগুহ্য কহে ।

পৰিত্ৰ উত্তম তাহা সাধারণ নহে ॥

যাহার সাধনে হয় প্রত্যক্ষানুভব ।

সুসুখ সে ধর্ম হয় অব্যয় বৈভব ৷।

অনুবাদঃ এই জ্ঞান সমস্ত বিদ্যার রাজা, সমস্ত গুহ্যতত্ত্ব থেকেও গুহ্যতর, অতি পবিত্র এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা আত্ম-উপলব্ধি প্রদান করে বলে প্রকৃত ধর্ম। এই জ্ঞান অব্যয় এবং সুখসাধ্য ।

তাৎপর্যঃ ভগবদ্‌গীতার এই অধ্যায়টিকে রাজবিদ্যা বলা হয়েছে, কারণ পূর্ববর্ণিত সমস্ত মত ও দর্শনের সারমর্ম এই অধ্যায়ে প্রতিপাদন করা হয়েছে। ভারতবর্ষের প্রধান দার্শনিকদের মধ্যে রয়েছেন গৌতম, কণাদ, কপিল, যাজ্ঞবল্ক্য, শাণ্ডিল্য, বৈশ্বানর এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বেদান্ত-সূত্রের রচয়িতা ব্যাসদেব। সুতরাং দর্শন অথবা দিব্য জ্ঞানে ভারত অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে ভগবান বলেছেন যে, নবম অধ্যায়ে বর্ণিত তত্ত্বজ্ঞান সমস্ত বিদ্যার রাজা এবং বেদ অধ্যয়ন ও বিভিন্ন দর্শনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্ত তত্ত্বজ্ঞানের সারতত্ত্ব। এই তত্ত্বজ্ঞান পরম গুহ্য, কারণ এই জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মা ও দেহের পার্থক্য উপলব্ধি করা যায় এবং এই রাজবিদ্যার চরম পরিণতি হচ্ছে ভগবদ্ভক্তি।

সাধারণত, মানুষ এই রাজবিদ্যা শিক্ষা লাভ করে না; তাদের শিক্ষা কেবল বাহ্যিক জ্ঞানের মধ্যেই সীমিত। জাগতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে, মানুষ রাজনীতি, সমাজনীতি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র, জ্যোতিষ শাস্ত্র, যন্ত্র-বিজ্ঞান আদি বিভিন্ন বিভাগে সাধারণত শিক্ষা লাভ করে। সমগ্র বিশ্বে এই জ্ঞান অর্জনের বিভিন্ন বিভাগ ও বহু বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এমন কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে চিন্ময় আত্মার তত্ত্ববিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়। অথচ এই দেহে আত্মার মাহাত্মাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আত্মাবিহীন দেহ মৃত। কিন্তু তবুও প্রাণের আধার এই আত্মাকে উপেক্ষা করে কেবল জড় দেহটির আবশ্যকতাগুলির উপরেই মানুষ গুরুত্ব আরোপ করে চলেছে।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়, বিশেষ করে দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে আত্মতত্ত্বের মাহাত্ম্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই অধ্যায়ের শুরুতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, এই জড় দেহটি নম্বর কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর (অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোতাঃ শরীরিণঃ ) । দেহের থেকে আত্মা ভিন্ন এবং আত্মা অপরিবর্তনীয়, অবিনশ্বর ও সনাতন—এই মৌলিক উপলব্ধি হচ্ছে জ্ঞানের গুহা তত্ত্ব। কিন্তু এর মাধ্যমে আত্মার সম্বন্ধে কোন ইতিবাচক সংবাদ প্রদান করে না। কখনও কখনও মানুষ মনে করে যে, দেহ থেকে আত্মা ভিন্ন এবং দেহান্তর হলে অথবা দেহ থেকে মুক্তি লাভ হলে, আত্মা শুনো লীন হয়ে গিয়ে তার সত্তা হারিয়ে ফেলে এবং নির্বিশেষ হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। এটি কিভাবে সম্ভব যে, দেহে অবস্থিত অত্যন্ত সক্রিয় যে আত্মা, তা দেহ থেকে মুক্ত হওয়ার পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়? আত্মা নিত্য সক্রিয় থাকে। আত্মা যদি নিত্য হয়, তা হলে তার সক্রিয়তাও নিত্য এবং ভগবৎ-ধামে তার ক্রিয়াকলাপ হচ্ছে পারমার্থিক জ্ঞানরাজ্যের গুহ্যতম অংশ। আত্মার এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপকে এখানে রাজবিদ্যা অর্থাৎ সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে পরম গুহ্যতম বলা হয়েছে।

এই জ্ঞান হচ্ছে সমস্ত কার্যকলাপের পরম বিশুদ্ধ রূপ। সেই কথা বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। পদ্ম পুরাণে মানুষের পাপকর্মের বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং পাপের পর পাপকর্মের পরিণাম দেখানো হয়েছে। যারা সকাম কর্মে নিয়োজিত, তারা পাপ কর্মফলের বিভিন্ন স্তরে আবদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যখন কোন বৃক্ষের বীজ রোপণ করা হয়, সেটি তৎক্ষণাৎ একটি বৃক্ষে পরিণত হয় না; তার জন্য কিছু সময় লাগে। সর্বপ্রথমে তা একটি চারা গাছে অঙ্কুরিত হয়, তারপর একটি গাছের রূপ ধারণ করে পল্লবিত হয় এবং ফুলে-ফলে শোভিত হয়। এভাবেই তা যখন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, তখন তাকে যে রোপণ করেছিল, সে তার ফল ও ফুল উপভোগ করে। সেই রকম, মানুষের পাপকর্মের বীজেরও ফল প্রাপ্ত হতে সময় লাগে। কর্মফলের বিভিন্ন স্তর আছে। পাপকর্ম থেকে নিবৃত্ত হওয়ার পরেও তার কর্তাকে সেই পাপকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। অনেক পাপকর্ম এখনও বীজরাপে রয়েছে, অনেক পাপের ফল দুঃখ-দুর্দশারূপে ফল প্রাপ্ত হয়েছে, যা আমরা এখনও ভোগ করছি।

সপ্তম অধ্যায়ের অষ্টবিংশতি শ্লোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যে ব্যক্তি সমস্ত পাপকর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে নিবৃত্ত হয়েছেন এবং জড়-জাগতিক সংসারের দু থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে সৎকর্মপরায়ণ হয়েছেন, তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হন। পক্ষান্তরে বলা যায়, যিনি ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করছেন, তিনি ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণরূপে পাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন। এই কথা পদ্ম পুরাণে প্রতিপন্ন হয়েছে—

অপ্রারব্ধফলং পাপং কূটং বীজং ফলোন্মুখম্ ।

ক্রমেণৈব প্রলীয়েত বিষ্ণুভক্তিরতাত্মনাম্ ॥

ভক্তি সহকারে যাঁরা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সেবা করছেন, তাঁদের প্রারব্ধ, সঞ্চিত ও বীজত্ব সমস্ত পাপকর্মের ফলই ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং ভগবদ্ভক্তিতে অত্যন্ত প্রবল পাপ নাশকারী শক্তি আছে। এই কারণে তাকে পবিত্রম্ উত্তমম্ অর্থাৎ পরম পবিত্র বলা হয়। উত্তমম্ শব্দটির অর্থ হচ্ছে অপ্রাকৃত । তমস্ শব্দটির অর্থ হচ্ছে এই জড় জগৎ অথবা অন্ধকার এবং উত্তম শব্দের অর্থ হচ্ছে জড় কার্যকলাপের অতীত। ভক্তিমূলক কার্যকলাপকে কখনই জড়-জাগতিক বলে মনে করা উচিত নয়। যদিও আপাত দৃষ্টিতে কখনও কখনও মনে হতে পারে যে, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত সাধারণ মানুষের মতোই কর্তব্যকর্ম করে চলেছে। ভক্তিযোগ সম্বন্ধে অবগত তত্ত্বদ্রষ্টা পুরুষ জানেন যে, ভক্তের কাজকর্ম কখনই জড়-জাগতিক কাজকর্ম নয়। তাঁর সমস্ত কাজকর্মই জড়া প্রকৃতির গুণের অতীত চিন্ময় এবং ভক্তিভাবময়।

এমন কথাও বলা হয়ে থাকে যে, ভগবদ্ভক্তির সাধন এতই উৎকৃষ্ট যে, তার পরিণাম সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে, শ্রীকৃষ্ণের নাম সমন্বিত মহামন্ত্র হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে অপরাধমুক্ত হয়ে কীর্তন করার ফলে সকলেরই যথাসময়ে অপ্রাকৃত আনন্দানুভূতি হয়, যার ফলে মানুষ অতি শীঘ্রই জড়-জাগতিক সমস্ত কলুষ থেকে পূর্ণরূপে পবিত্র হয়। এটি বাস্তবিকই দেখা গেছে। অধিকন্তু, কেবলমাত্র শ্রবণ করাই নয়, সেই সঙ্গে যদি কেউ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগের কথা প্রচার করে অথবা কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রচারের কাজকর্মে সহযোগিতা করে, তবে সেও উত্তরোত্তর পারমার্থিক উন্নতি অনুভব করে। পারমার্থিক জীবনের এই উন্নতি কোন প্রকার পূর্বাভিত শিক্ষা বা যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না। এই পথ স্বরূপত এতই পবিত্র যে, তার অনুগামী হওয়া মাত্রই মানুষ আপনা থেকেই পবিত্র হয়ে ওঠে।

বেদান্ত-সুত্রে (৩/২/২৬) এই সিদ্ধান্তের নিরূপণ করা হয়েছে— প্রকাশশ্চ কর্মণ্যভ্যাসাৎ। “ভক্তিযোগ এত শক্তিশালী যে, তার অনুশীলন করার ফলে নিঃসন্দেহে দিব্য জ্ঞান লাভ করা যায়।” এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখা যায় নারদ মুনির পূর্বজীবনে। ত্রিভুবনখ্যাত ভগবদ্ভক্ত দেবর্ষি নারদ পূর্বজন্মে এক দাসীর পুত্র ছিলেন। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না অথবা কৌলীন্যও ছিল না। কিন্তু তাঁর মা যখন মহাভাগবতদের সেবা করেছিলেন, তখন তিনিও তাঁদের সেবাপরায়ণ হতেন এবং কখনও কখনও তাঁর মায়ের অনুপস্থিতিতে তিনি নিজেই সেই মহাভাগবতদের সেবা করতেন। নারদ মুনি নিজেই বলেছেন–

উচ্ছিষ্টলে পাননুমোদিতো দ্বিজঃ

সকৃৎশ ভুঞ্জে তদপাতকিন্তিয়ঃ ।

এবং প্রবৃত্তসা বিশুদ্ধচেস-

ঔষ্কর্ম এবাত্মরুচিঃ প্রজায়তে ।।

শ্রীমদ্ভাগবতের (১/৫/২৫) এই শ্লোকটিতে নারদ মুনি তাঁর শিষ্য শ্রীব্যাসদেবকে তাঁর পূর্বজন্মের কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, পূর্বজন্মে বাল্যকালে চাতুর্নাসোর সময় তিনি কয়েকজন মহাভাগবতের সেবা করেছিলেন। যার ফলে তিনি তাঁদের অন্তরঙ্গ সঙ্গ লাভ করেন। তাদের অনুগ্রহক্রমে তিনি তাদের ভিক্ষাপাত্র সংলগ্ন উচ্ছিষ্ট অম্ল একবার মাত্র ভোজন করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁর পাপ দূর হয় এবং চিত্ত মার্জিত হয়। তখন তাঁর হৃদয় সেই মহাভাগবতদের মতো নির্মল হয় এবং তাতে পরমেশ্বরের আরাধনায় রুচি জাগ্রত হয়। সেই মহাভাগবতেরা শ্রবণ ও কীর্তনের মাধ্যমে নিরন্তর ভগবদ্ভক্তির রসাস্বাদন করতেন। সেই রুচির উন্মেষ হওয়ার ফলে নারদও শ্রবণ ও কীর্তনে অত্যন্ত উৎসাহিত হন। নারদ মুনি তাই আরও বলেছেন—

তাহহং কৃষ্ণকথাঃ প্রগায়তা-

মনুগ্রহেণাশণবং মনোহরাঃ ।

তাঃ শ্রদ্ধয়া মেহনুপদং বিশৃণ্বতঃ

প্রিয়এবস্যস মমাভবচিঃ।।

সাধুসঙ্গের প্রভাবে নারদ ভগবানের মহিমা শ্রবণ ও কীর্তনে রুচি লাভ করেন। এবং তাঁর হৃদয়ে ভগবদ্ভক্তির প্রতি তীব্র আসক্তি জন্মায়। তাই, বেদান্ত-সুত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকাশ্য কর্মণাভ্যাসাৎ— ভগবদ্ভক্তিতে অনন্য নিষ্ঠা হলে ভক্তের হৃদয়ে পূর্ণরূপে সকল প্রকার ভগবৎ-তত্ত্বের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ হয় এবং তখন তিনি সব কিছু হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। একেই বলা হয় ‘প্রত্যক্ষ’ অনুভূতি। এই শ্লোকে ধর্মাম্ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ধর্মের পথ। নারদ মুনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে এক দাসীপুত্র, তাই তিনি বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ পাননি। তিনি কেবল তাঁর মাঝে সাহায্য করতেন এবং সৌভাগ্যক্রমে তার মা ভগবদ্ভক্তের সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। শিশু নারদও সেই সুযোগ পেয়েছিলেন এবং কেবল সাধুসঙ্গের প্রভাবেই তিনি সমস্ত ধর্মের পরম লক্ষ্য প্রাপ্ত হন। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, সমস্ত ধর্ম আচরণের পরম লক্ষ্য হচ্ছে ভক্তিযোগ (স বৈ পুংসাং পরো ধর্মো যতো ভক্তিরবোজে)। ধর্মপরায়ণ লোকেরা সাধারণত জানে না যে, ধর্মাচরণের চরম সার্থকতা হচ্ছে ভগবভুক্তি লাভ করা। অষ্টম অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটিতে (বেদেষু যজ্ঞেষু তপঃসু চৈব) আমরা ইতিমধ্যেই সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। সাধারণত আত্ম-উপলব্ধি করতে হলে বৈদিক জ্ঞানের আবশ্যকতা আছে। কিন্তু এখানে, যদিও নারদ কখনও কোন গুরুদেবের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যাননি এবং বৈদিক সিদ্ধান্তে শিক্ষিত হতে পারেননি, তবুও তিনি বৈদিক জ্ঞান অনুশীলনে পরম সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এই ভক্তিপথ এতই শক্তিশালী যে, নিয়মিতভাবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান না করেও পরম সিদ্ধি লাভ করা যায়। এটি কি করে সম্ভব? বৈদিক সাহিত্যে সেই সম্বন্ধে প্রতিপন্ন হয়েছে— আচার্যবান পুরুষো বেদ। মহান আচার্যদের সঙ্গ লাভ করার ফলে অশিক্ষিত ও বৈদিক জ্ঞানে সম্পূর্ণ অজ্ঞ মানুষও আত্ম-উপলব্ধির উপযোগী জ্ঞান সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন।

ভক্তিযোগের পথ অত্যন্ত সুখসাধ্য (সুসুখম্)। কেন? ভক্তিযোগের অঙ্গ হচ্ছে শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ, সুতরাং ভগবানের নাম মাহাত্ম্য শ্রবণ, কীর্তন অথবা প্রামাণিক আচার্যদের দিব্যজ্ঞান সমন্বিত দার্শনিক প্রবচন শোনার মাধ্যমে ভক্তিযোগ সাধিত হয়। শুধু বসে বসেই শিক্ষা লাভ করা যায় এবং তারপর ভগবানের সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করা যায়। যে-কোন অবস্থায় ভক্তিযোগ অত্যন্ত আনন্দদায়ক। পরম দারিদ্র্যের মধ্যেও ভক্তিযোগ সাধন করা যায়। ভগবান বলেছেন, পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ম্—তিনি ভক্তের নিবেদিত সব কিছুই গ্রহণ করতে প্রস্তুত এবং তা যা-ই হোক না কেন তাতে কিছু মনে করেন না। পত্র, পুষ্প, ফল, জল আদি পৃথিবীর সর্বত্রই পাওয়া যায় এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ ভগবানকে তা প্রেমভক্তি সহকারে নিবেদন করতে পারে। ভক্তি সহকারে ভগবনকে যা কিছু অর্পণ করা হয়, তা-ই তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে। ভগবানের চরণে অর্পিত তুলসীর সৌরভ শুধুমাত্র ঘ্রাণ করে সনৎকুমার আদি মহর্ষিরা মহাভাগবতে পরিণত হন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, ভক্তির পন্থা অতি উত্তম এবং অত্যন্ত সুখসাধ্য। ভগবানকে আমরা যা কিছুই নিবেদন করি না কেন, তিনি কেবল আমাদের ভালবাসাটাই গ্রহণ করেন।

এখানে ভক্তিযোগকে শাশ্বত নিত্য বলা হয়েছে। এই ভক্তি মায়াবাদীদের মতবাদকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করে। মায়াবাদীরা কখনও কখনও নামমাত্র ভক্তি অনুশীলন করে এবং মুক্তি লাভ না করা পর্যন্ত তার আচরণ করতে থাকে, কিন্তু সব শেষে যখন তারা মুক্ত হয়, তখন ভক্তি ত্যাগ করে ‘ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যায়। অত্যন্ত স্বার্থপরায়ণ এই ভক্তিকে শুদ্ধ ভক্তি বলা যায় না। যথার্থ ভক্তিযোগের অনুশীলন এমন কি মুক্তির পরেও পূর্ববং চলতে থাকে। ভক্ত যখন ভগবৎ-ধামে ফিরে যান, তখন তিনি সেখানেও ভগবৎ-সেবায় মগ্ন থাকেন। ভক্ত কখনই ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন না।

ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, যথার্থ ভক্তিযোগের শুরু হয় মুক্তি লাভের পরে। মুক্তির পরে কেউ যখন ব্রহ্মভূত করে অধিষ্ঠিত হন, তখনই তাঁর ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন শুরু হয় (সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্‌ভক্তিং লভতে পরাম্)। স্বাধীনভাবে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, অষ্টাঙ্গযোগ অথবা অন্য যে কোন যোগ অনুষ্ঠান করলেও পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করা যায় না। এই সব যৌগিক পদ্ধতির সাহায্যে ভক্তিযোগের পথে মানুষ কিছুটা অগ্রসর হতে পারে, কিন্তু ভগবন্তুক্তির স্তরে উপনীত না হলে পুরুষোত্তম ভগবান যে কি, কেউ তা বুঝতে পারে না। শ্রীমদ্ভাগবতে এই কথা প্রতিপন্ন করাও হয়েছে যে, ভক্তিযোগ সাধন করার ফলে, বিশেষত মহাভাগবতদের মুখারবিন্দ থেকে শ্রীমদ্ভাগবত অথবা ভগবদ্গীতা শ্রবণ করলে কৃষ্ণতত্ত্ব বা ভগবৎ-তত্ত্ব জানা যায়। এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ। হৃদয় যখন সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্তি ও অনর্থ থেকে মুক্ত হয়, তখন মানুষ বুঝতে পারে ভগবান কি। এভাবেই ভগবদ্ভক্তি বা কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থা হচ্ছে সমস্ত বিদ্যার রাজা এবং সমস্ত গুহাতত্বের রাজা। এটি হচ্ছে পরম বিশুদ্ধ ধর্ম এবং আনন্দের সঙ্গে অনায়াসে এর অনুশীলন করা চলে। তাই, এই পন্থা গ্রহণ করা মানুষের অবশ্যই কর্তব্য।

শ্লোকঃ ৩

অশ্রদ্দধানাঃ পুরুষা ধর্মস্যাস্য পরন্তপ ৷

অপ্রাপ্য মাং নিবর্তন্তে মৃত্যুসংসারবর্তনি ॥ ৩ ॥

অশ্রদধানাঃ—শ্রদ্ধাহীন; পুরুষাঃ ব্যক্তিরা; ধর্মস্যধর্মের, অস্যা — এই; পরন্তপ — হে পরন্তপ; অপ্রাপ্য না পেয়ে মা – আমাকে; নিবর্তন্তে — ফিরে আসে; মৃত্যু— মৃত্যুর সংসার—সংসার; বন্ধনি—পথে।

গীতার গান

যাহার সে শ্রদ্ধা নাই, ওহে পরন্তপ ৷

এই ধর্ম বিজ্ঞানেতে বৃথা জপতপ ॥

সে আমাকে নাহি পায় জানিহ নিশ্চয় ৷

মৃত্যু সংসারের পথে নিরন্তর রয় ।।

অনুবাদঃ হে পরন্তপ। এই ভগবদ্ভক্তিতে যাদের শ্রদ্ধা উদিত হয়নি, তারা আমাকে লাভ করতে পারে না। তাই, তারা এই জড় জগতে জন্ম-মৃত্যুর পথে ফিরে আসে।

তাৎপর্যঃ শ্রদ্ধাহীন মানুষের পক্ষে ভক্তিযোগ সাধন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব; এটি হচ্ছে এই শ্লোকের তাৎপর্য। সাধুসঙ্গে শ্রদ্ধার উদয় হয়। কিন্তু কিছু মানুষ এতই হতভাগ্য যে, মহাপুরুষদের মুখারবিন্দ থেকে বেদের সমস্ত প্রমাণ শ্রবণ করার পরেও তাদের হৃদয়ে ভগবানের প্রতি বিশ্বাসের উদয় হয় না। সন্দেহান্বিত হওয়ার ফলে তারা ভক্তিযোগে স্থির থাকতে পারে না। তাই কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধন করবার জন্য শ্রদ্ধাই হচ্ছে সবচেয়ে মহত্বপূর্ণ অঙ্গ। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে যে, শ্রদ্ধা হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে দৃঢ় বিশ্বাস, অর্থাৎ শুধুমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার দ্বারা মানুষ সব রকমের সার্থকতা অর্জন করতে পারে। একেই বলা হয় প্রকৃত বিশ্বাস। শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/৩১/১৪) বলা হয়েছে—

যথা তরোমূলনিষেচনেন

তুপান্তি তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ।

প্রাণোপহারাচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং

তথৈব সর্বার্থণমচ্যুতেজ্যা ॥

“গাছের গোড়ায় জল দিলে যেমন তার শাখা-প্রশাখা ও পল্লবাদি আপনা থেকেই। পুষ্ট হয়, উদরকে খাদ্য দিলে যেমন সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রসন্ন হয়, তেমনই চিন্ময় ভগবৎ- সেবা করার ফলে সমস্ত দেবতা ও জীব আপনা থেকেই সন্তুষ্ট হয়।” সুতরাং, ভগবদ্‌গীতা অধ্যয়ন করে অবিলম্বে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত যে, অন্য সমস্ত কর্তব্যকর্ম আগ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাই হচ্ছে কর্তব্য। জীবনের এই দর্শনের প্রতি বিশ্বাসই হচ্ছে যথার্থ শ্রদ্ধা। আর এই শ্রদ্ধাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত ।

এখন, সেই বিশ্বাসের উন্নতি সাধন করাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার পন্থা। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত মানুষকে তিন প্রকারে ভাগ করা যায়। সর্বনিম্ন তৃতীয় স্তরে যারা আছে, তাদের কোনই বিশ্বাস নেই। এমন কি যদিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনে নিযুক্ত থাকে, তবুও তারা পরম সার্থকতার স্তর অর্জন করতে পারে না। এদের অধিকাংশই কিছুকাল পরে হয়ত ভক্তিমার্গ থেকে স্থলিত হয়। তারা কিছু কালের জন্য ভগবৎ-সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারে, কিন্তু পূর্ণ শ্রদ্ধা না থাকার ফলে তাদের পক্ষে অধিককাল কৃষ্ণভাবনায় নিযুক্ত থাকা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের প্রচারকার্যে আমরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছি যে, কিছু লোক গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন শুরু করে এবং তাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভাল হলে তারা এই পন্থা পরিত্যাগ করে আবার পুরানো জীবনধারা গ্রহণ করে। কেবলমাত্র শ্রদ্ধার দ্বারাই মানুষ কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধন করতে পারে। শ্রদ্ধার উন্নতি সাধন সম্বন্ধে বলা যায়, ভক্তি সম্বন্ধীয় শাস্ত্রগ্রন্থে যিনি পারদর্শী এবং যিনি দৃঢ় শ্রদ্ধার স্তর লাভ করেছেন, তাঁকে কৃষ্ণভাবনায় প্রথম শ্রেণীর মানুষ বা উত্তম অধিকারী বলা হয়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যন অধিকারী হচ্ছেন তিনি, যিনি শাস্ত্রজ্ঞানে ততটা পারদর্শী নন, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, কৃষ্ণভক্তিই হচ্ছে সর্বোত্তম মার্গ এবং তাই দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে তিনি এই মার্গ অনুসরণ করেন। এভাবেই মধ্যম অধিকারী কনিষ্ঠ অধিকারীর থেকে উত্তম। কনিষ্ঠ অধিকারীর যথার্থ শাস্ত্রজ্ঞান ও দৃঢ় শ্রদ্ধা এই দুইয়েরই অভাব। কিন্তু তাঁরা সাধুসঙ্গ ও নিষ্কপট সহকারে ভক্তিমার্গ অবলম্বন করেন। কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনে কনিষ্ঠ অধিকারীর পতন হতে পারে, কিন্তু কেউ যখন মধ্যম অধিকারীতে স্থিত হন, তিনি তখন পতিত হন না এবং কৃষ্ণভাবনায় উত্তম অধিকারীর পতনের কখনও সম্ভাবনাই থাকে না। উত্তম অধিকারী নিশ্চিতভাবে উত্তরোত্তর উন্নতি সাধন করে অবশেষে সুফল প্রাপ্ত হন। কনিষ্ঠ অধিকারীর যদিও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনের উপযোগিতা সম্পর্কে বিশ্বাস জেগেছে, কিন্তু সে শ্রীমদ্ভাগবত ও ভগবদ্‌গীতা আদি শাস্ত্রের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে এখনও যথেষ্ট জ্ঞান আহরণ করেনি। কখনও কখনও কৃষ্ণভাবনামৃতের এই কনিষ্ঠ অধিকারীদের কর্মযোগ অথবা জ্ঞানযোগের প্রতি কিছুটা প্রবণতা থাকে এবং কখনও কখনও তার ভক্তিমার্গ থেকে বিচলিত হয়ে পড়ে, কিন্তু কর্মযোগ, জানযোগ আদির সংক্রমণ থেকে মুক্ত হওয়ার পর তারা কৃষ্ণভাবনায় মধ্যম অথবা উত্তম অধিকারীতে পরিণত হতে পারে। শ্রীমদ্ভাগবতে কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধার তিনটি স্তরের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে একাদশ স্কন্ধে প্রথম শ্রেণীর আসক্তি, দ্বিতীয় শ্রেণীর আসক্তি ও তৃতীয় শ্রেণীর আসক্তির কথাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণকথা তথা ভক্তিযোগের শ্রেষ্ঠত্বের কথা শ্রবণ করা সত্ত্বেও যাদের শ্রদ্ধার উদয় হয় না এবং যারা কেবল সেগুলিকে স্তুতিমাত্র বলে মনে করে, তাদের কাছে এই পথ অত্যন্ত দুর্গম বলে প্রতিভাত হয়, এমন কি যদিও তারা তথাকথিতভাবে ভক্তিযোগে তৎপর আছে বলে মনে হয়। তাদের পক্ষে সিদ্ধি লাভ করার কোনই আশা নেই। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, ভক্তিযোগ সাধনে শ্রদ্ধা অত্যন্ত দরকারি।

error: Content is protected !!