ছোটবেলায় একটা খেলা খেলতাম। এই খেলায় অতি দ্রুত একটি ছড়া আবৃত্তি করতে হতো–
রস
কষ
সিঙ্গাড়া
বুলবুলি
মস্তক
একটি শব্দের সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। ননসেন্স রাইম যেরকম হবার কথা সেরকম। শুধু প্রথম দুটি শব্দ সবসময় একসঙ্গে ব্যবহার করার রীতি আছে। যেমন, লোকটির রসকষ নেই। ব্যাপারটা এরকম যার রস থাকবে তার কষও থাকতে হবে। রসবোধের সঙ্গে কষবোধ।
আমরা রসিক মানুষ পছন্দ করি। শৈশবে দেখেছি গ্রাম্য মজলিশে ভাড়া করে রসিক মানুষ নিয়ে আসা হতো। তাদের কাজ হাসিতামাশা করে আসর জমিয়ে দেয়া। নেত্রকোনা অঞ্চলে এদের নাম আলাপি অর্থাৎ যিনি আলাপ করেন। শৈশবে আলাপিলের আলাপ শুনেছি। তাদের আলাপের বড় অংশ জুড়েই আদি রস। কাজেই শিশুদের জন্যে নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশের মেয়েরাও মনে হয় স্বামী হিসেবে রসিক পুরুষ পছন্দ করে। কী ধরনের স্বামী পছন্দ? প্রশ্নের জবাবে দেখি একটা সাধারণ উত্তর হলো, তাকে রসিক হতে হবে। রসবোধ থাকতে হবে।
আমার আড্ডার আড্ডাধারিরা সবাই রসিক। রসিকতা করেন এবং বুঝতেও পারেন। বাসায় আড্ডা চলছে আর কিছুক্ষণ পর পর হো হো হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে না তা কখনো হয় না। যারা নিয়মিত আড্ডায় আসেন না তারাও ভালো কোনো রসিকতা পেলে sms করে আমাকে পাঠিয়ে দেন।
সম্প্রতি এরকম একটি sms পেয়েছি। যিনি পাঠিয়েছেন তিনি গুরুগম্ভীর মানুষ। পরিচয় প্রকাশ করে তার গাম্ভীর্যে কালো স্পট ফেলার অর্থ হয় না বলেই নাম অপ্রকাশিত। রসিকতাটা বলা যাক।
ইন্ডিয়াতে গে সমাজ (সমকামী সমাজ) স্বীকৃতি পেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দরজিদের ওপর। কেউ ট্রাউজার বানাতে গেলে দরজি বলছে, স্যার জিপার কি শুধু সামনে হবে? নাকি পেছনেও হবে?
রসিকতার উৎপত্তি কোথায় হয় এই বিষয়টি কিন্তু রহস্যাবৃত। একই ধরনের রসিকতা পৃথিবীর সব দেশে, সব কালচারে প্রচলিত। কে প্রথম শুরু করেছে তা কেউ জানে না।
সায়েন্স ফিকশনের গ্র্যান্ডমাস্টার আইজাক অ্যাসিমভের এই বিষয়ে একটি থিওরি আছে। তিনি বলেন, রসিকতার জন্ম পৃথিবীর বাইরে। এলিয়েনরা এগুলি তৈরি করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। মানুষ রসিকতাগুলি কীভাবে গ্রহণ করে তা দেখে তারা মানব সমাজ সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে চায়। তবে তাৎক্ষণিক রসিকতা মানুষই তৈরি করে।
এখন একটি তাৎক্ষণিক রসিকতার গল্প বলি। আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথিবীর নানান দেশের লেখকরা উপস্থিত হয়েছেন। আমিও সেই দলে আছি। ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর ওপর একটা সেমিনার হচ্ছে। বক্তা চমৎকার বলছেন। হঠাৎ লেখকদের একজন (ইন্দোনেশীয় ঔপন্যাসিক) হাত তুললেন।
বক্তা হঠাৎ বক্তৃতা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, কী জানতে চাচ্ছেন?
ঔপন্যাসিক বললেন, সেমিনার কক্ষে কয়েকটা মশা উড়তে দেখেছি। আমি জানতে চাচ্ছি, মশা কামড়ালে কি AIDS হয়?
বক্তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এই প্রশ্নের জবাবে বললেন, মশা কামড়ালে AIDS হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে তুমি যদি মশার সঙ্গে যৌনসঙ্গম কর তাহলে হতে পারে।
আমি বক্তার তাৎক্ষণিক রসিকতায় মুগ্ধ। ইন্দোনেশীয় ঔপন্যাসিকের ভোতামুখের ছবি এখনো চোখে ভাসে।
শুরুতে বলেছি আমরা রসিক মানুষ পছন্দ করি। কিন্তু বাংলাদেশে রসিক মানুষদের কিছু সমস্যা আছে। তারা সমাজে হালকা মানুষ বলে বিবেচিত হন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এদের আলাদা নাম আছে, কিচক। কিচক হলো ভাঁড়।
ক্রিয়েটিভ মানুষরা নিপাতনে সিদ্ধর মতো সবসময় রসিক হন। তাঁরা তাদের রসবোধ বন্ধুবান্ধবের বাইরেও (তাদের সৃষ্টিতে) ছড়িয়ে দেন। জননী মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রথমদিকে একটি উপন্যাস। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের মদ্যপানের অভ্যাস। তার একটি ছেলে হয়েছে খবর পেয়ে সে বাড়িতে ছেলে দেখতে এল। ছেলে কোলে নিয়ে বলল, যমজ হয়েছে না কি গো? দুটা কেন?
রবীন্দ্রনাথের তাৎক্ষণিক রসিকতা নিয়ে কয়েকটি বই আছে। পাঠকরা পড়লে মজা পাবেন। আমাদের কবি নির্মলেন্দু গুণের রসবোধ তুলনাবিহীন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে নিজের অজান্তেই আমি হো হো করে হাসার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি।
বিজ্ঞানীরা এক অর্থে ক্রিয়েটিভ মানুষ। তারা কি রসিকতা করেন? বিজ্ঞানীরা সিঙ্গেল ট্র্যাক মানুষ। সিঙ্গেল ট্র্যাক মানুষরা রসিকতা করেন না, বুঝেনও না। তাদের মধ্যে ধর্ম প্রচারকের আলাদা গাম্ভীর্য থাকে। তারা মনে করেন বিজ্ঞান নামক ধর্ম তাঁরা প্রচার করছেন। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম পদার্থবিদ George Gamow, ইনি ১৯৪৮ সনে বিগ ব্যাং-এর প্রমাণ হিসেবে মহাকাশে Background Radiation পাওয়া যাবে বলে ভবিষৎবাণী করেছিলেন। দুজন বিজ্ঞানী Background Radiation আবিষ্কার করেন। তাদের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
যে কথা বলছিলাম, পদার্থবিদদের সমাজে জর্জ গ্যামোকে জোকার হিসেবে ধরা হতো। কারণ তিনি সারাক্ষণই নাকি জোকারি করতেন। তার জোকারির একটা নমুনা হচ্ছে, তিনি পদার্থবিদ্যার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা তাঁর এক বন্ধুর নাম দিয়ে জার্নালে প্রকাশ করে দেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো, এই কাজটি কেন করলেন? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, বন্ধুকে চমকে দেবার জন্যে। সে মাথা চুলকাবে আর ভাববে এই কাজটি কখন করলাম?
আমাদের সমাজে ভাঁড় মানে, জোট জাত। তাদের কথাবার্তায় মজা পওয়া যাবে, তবে তাদেরকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। কারণ তারা এক অর্থে বেয়াদব। মুরব্বিদের সামনে শব্দ করে হেসে ফেলাকে বেয়াদবি ধরা হতো। নববধু স্বামীর ঘর করতে যাবার আগে তাকে যেসব উপদেশ দেয়া হতো তার মধ্যে একটি হচ্ছে–শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে কখনো শব্দ করে হাসবে না। যদি হেসে ফেল লক্ষ্য রাখবে দাঁত যেন দেখা না যায়। শ্বশুর-শাশুড়িকে দাঁত দেখানো বিরাট বেয়াদবি।
চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে যখন পড়তাম তখন আমাদের এক অংক শিক্ষকের কাছে ক্লাসে হেসে ফেলার জন্য কঠিন শাস্তি পেয়েছি। আমি একা না, অনেকেই। এই স্যার আবার তাৎক্ষণিক রসিকতায় অসম্ভব পারদর্শী। ছাত্রদের এমন সব কথা বলতেন যে হেসে না ফেলে উপায় ছিল না। হাসলেই বিপদ। স্যারের হুঙ্কার, এটা কি রঙ্গশালা? হাসল কে? কান ধরে উঠে দাঁড়াও। বকের মতো দাঁড়াও এক ঠ্যাং-এ! তোমার নাম কালাম। আজ থেকে নামের আগে বগা টাইটেল। সবাই একে কবে বগা কালাম।
স্যারের কথায় হাসি আসছে, কিন্তু হাসতে পারছি না। এ এক কঠিন অবস্থা। কঠিন বড় বাথরুম চেপেছে, বাথরুমে যেতে পারছি না টাইপ।
স্যারের অন্য ধরনের একটা গল্প বলি। তখন মার্বেল খেলায় আমার খুব ঝোঁক ছিল। একটা স্কয়ার এঁকে স্কয়ারের এক কোনায় মার্বেল রাখা হতো। সেই মার্বেলকে সই করে মারতে হতো। খেলায় স্কয়ারের একটা ভূমিকা ছিল। কী ভূমিকা তা মনে নেই। মগ্ন হয়ে খেলছি, হঠাৎ দেখি অংক স্যার। আমি আতঙ্কে জমে গেলাম। স্যার বললেন, এখানে কী করছিস?
মার্বেল খেলছি স্যার।
মার্বেল খেলছিস? থাপড়ায়ে তোর দাঁত সবগুলো ফেলে দেব। বত্রিশটা দাঁত পকেটে নিয়ে বাসায় যাবি। আয় আমার সঙ্গে।
আমি ভয়ে অস্থির হয়ে স্যারের সঙ্গে গেলাম। স্যার একটা টিনের হাফ বিল্ডিং-এ ঢুকলেন এবং ডাকলেন জমিলা বা এই ধরনের কিছু। স্যারের নাম এবং তার স্ত্রীর নাম মনে পড়ছে না। অল্পবয়েসী এক তরুণী বের হয়ে এলেন। স্যার বললেন, এ আমার ছাত্র। এদের আমি সবসময় বকাঝকা করি। তুমি একে কোলে নিয়ে আদর করে দাও। এতে সমান সমান হবে। ঘরে কোনো খাবার থাকলে খেতে দাও।
ক্লাস ফাইভে যে ছেলে পড়ে সে অনেক বড়। স্যারের বালিকা বধূ তারপরেও টেনে আমাকে কোলে তুললেন। লজ্জিত গলায় বললেন, ঘরে তো কিছু নাই। স্যার বললেন, কোলে নিয়ে বসে থাক। আমি গরম জিলাপি নিয়ে আসি। গরম জিলাপি পুলাপানের পছন্দ। এই বলেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, গাধা গরম জিলাপি খাবি?
আমি বললাম, খাব।
ঝিম ধরে কোলে বসে থাক, আমি জিলাপি নিয়ে আসছি।
পৃথিবীর অনেক প্রাণী extinct হয়ে যাচ্ছে। তাদের রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা শৈশবে যেসব শিক্ষক পেয়েছি তাঁরাও Extinct হয়ে যাচ্ছেন। তাদের রক্ষার কোনো চেষ্টা নেই।
“কাঠপেন্সিল” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ