একটা বর্ণময় নাম ‘ওশো’ (রজনীশ) পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন। অত্যন্ত বিতর্কিত ছিলেন ভগবান ‘ওশো’ হ্যাঁ, নামের আগে ‘ভগবান’ শব্দটা জুড়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং ওশো।

‘ওশো মানে-ই অবাধ যৌনতা’—এমন একটা প্রচার আছে। ফলে এই বঙ্গে ওশো ততটা প্রচার পাননি। কিন্তু হিন্দিভাষী অঞ্চলে ওশো’র ‘আর্ট অফ লিভিং’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সত্য সাঁই দক্ষিণ ভারতে ভগবান। আমাদের এখানে এলে-বেলে। এই বঙ্গে দেখতে পাবেন তন্ত্রের রমরমা। ‘তন্ত্র’ মানে-ই অবাধ যৌনতা। বামাক্ষ্যাপা থেকে রামকৃষ্ণ ইত্যাদি তান্ত্রিকদের কথা উঠলে আমরা যতটা ভক্তিগদগদ হই, আদৌ ততটা আদিখ্যেতা দেখান না অন্য প্রদেশবাসীরা। আমরা মধ্যবিত্ত বাঙালি মেধায় দরিদ্র। বড়জোর মধ্যমেধা পর্যন্ত দৌড়। সবজান্তা ভান করাটা মজ্জায় ঢুকে গেছে।

আমরা জানি-ই না—তন্ত্রে পরমব্রহ্ম পাওয়া যায় চূড়ান্ত

দেহ-মিলনে। তন্ত্রে সিদ্ধিলাভের জন্য তান্ত্রিককে যে

কোনও নারীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার বিধান

দেওয়া হয়েছে। মা-বোন-মেয়ে সবার

সঙ্গে-ই দেহ মিলন চলবে

(তন্ত্র নিয়ে বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন, ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ৫ম খণ্ড)।

আমার এই কথা লেখার অর্থ এই নয় সে ওশো’র ‘আর্ট অফ লিভিং’-এ আস্থা রাখছি। সমর্থন বা অসমর্থন না করে খোলা মনে, নিরপেক্ষতার সঙ্গে আলোচনায় ঢুকবো এবার।

 

ওশো রজনীশ

সালটা ১৯৭৭। শরতের শেষ। এখন সকাল। পুণের বুদ্ধ হলে প্রচুর ভক্তের ভিড়। অত্যন্ত ধনী ও বিদেশী ভক্তদের সংখ্যাই বেশি। প্রত্যেকের পরণে কমলা থেকে গোলাপী রঙের আলখাল্লার মত সিল্কের পোশাক। গলায় ঝুলছে রজনীশের লকেট। খালি পা। একদিনের মেডিটেশন ফি ২৫০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। দু’মাসের কোর্স ফি ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।

ভগবান রজনীশ এলেন তাঁর আবাস লাওৎ-সে ভবন থেকে সাদা মার্সিডিজ গাড়িতে। ভবন থেকে বুদ্ধ হল ১০০ গজের বেশি হবে না, রজনীশের পরণে রেশমের দুধ সাদা আলখাল্লা। কাঁধে একটা সাদা তোয়ালে। মাথায় টাক, মুখে দাড়ি-গোঁফ, ঘন কালো ধনুকের মত ভুরু। সুন্দর স্বাস্থ্য, মসৃণ চামড়া। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো চোখ দু’টি, দেখলে যে কেউ প্রথম দর্শনেই আকর্ষিত হবেন।

এখন উনি প্রবচন শোনাবেন। বিশাল হলের মেঝে শ্বেতপাথরের। মেঝেতে বসে ভক্তরা। সামনে ডায়স। ডায়াসে একটা রিভলভিং চেয়ার। ভগবান এলেন । বসলেন। ডায়াসে চেয়ারের পাশে-ই দাঁড়িয়ে মা যোগলক্ষ্মী।

ভগবান প্রবচন শোনাচ্ছেন। তাঁর বাণী ক্যাসেট বন্দি করে রাখা হচ্ছে। প্রবচন শেষে রজনীশ ধ্যানমগ্ন হলেন। একটু পরে একাধিক শিষ্যার কাঁধে ভর করে প্রবচন-গৃহ থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সন্ধ্যায় আবারও আসবেন। দর্শন ও দীক্ষা দেবেন। দীক্ষা দেবার সময় ভক্তের গলায় একটা হার পরিয়ে দেন। হারে ওশোর ছবিওয়ালা লকেট ঝুলছে। নতুন নামও দেন একটা। সঙ্গে উপহার হিসেবে হাতে তুলে দেন একটা বাক্স। বাক্সে থাকে রজনীশের একটা দাড়ির চুল বা পায়ের নখ।

এই ভণ্ডামি সহ্য করতে হয়। অনেক কিছু দেখতে চাইলে, জানতে চাইলে মুখ বন্ধ রাখতেই হবে।

 

চুম্বকে রজনীশ

■ রজনীশের জন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৯৩১ সালে। জন্মস্থান মধ্যপ্রদেশের কুচওয়ারা গ্রামে। এই গ্রামে রজনীশের মামার বাড়ি। বাবার বাড়ি মধ্যপ্রদেশের-ই গরদোয়ারায়।

■ জন্মগত উপাসনা ধৰ্ম–জৈন।

■ রজনীশের দাবি, ২১ মার্চ ১৯৫৩ সালে সত্যের সন্ধান পান।

■ ১৯৫৭ সালে সাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম এ করেন। পরীক্ষায় ১ম হয়েছিলেন।

■ ১৯৫৭ সালে জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হল। পরিচিত হল ‘আচার্য রজনীশ’ নামে।

■ ১৯৬৬-তে অধ্যাপকের পদ ছাড়লেন। হলেন ধর্মগুরু। নাম নিলেন ‘ওশো’ যার উৎপত্তি ‘ওশনিক’ অর্থাৎ ‘মহাসমুদ্রের মত বিশাল’ শব্দ থেকে।

■ ১৯৭০ সালে মুম্বাইতে চলে আসেন ও থাকতে শুরু করেন। ভক্তদের সামনে প্রথম জানান— ধ্যান-ই জীবনে আনন্দ আনতে পারে। জীবনকে পূর্ণ করতে পারে।

■ ১৯৭০ সালে ‘আচার্য রজনীশ’ থেকে ‘ভগবান শ্রীরজনীশ’ নামে নিজেকে পরিচিত করেন।

■ ১৯৭৪ সালে শিষ্য-শিষ্যাদের নিয়ে পুণে চলে আসেন এবং পুণেতে শ্রী রজনীশ আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিদিন সকালে মানুষের চেতনার পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রবচন দেওয়া শুরু করেন।

■ ভগবান রজনীশ তাঁর আবাস থেকে দিনে দু’বার মাত্র বাইরে আসতেন। সকালে প্রবচন দিতে। সন্ধ্যায় দর্শন ও দীক্ষা দিতে।

■ ১৯৮১ সালে আমেরিকায় যান। সেখানে ওরেগান স্টেটে ৬৪ হাজার একর জমি কিনে ‘রজনিশপুরম’ নামের শহর গড়ে তোলেন।

■ ১৯৮৫-তে আমেরিকা সরকার রজনীশের বিরুদ্ধে ৩৫টি অপরাধের অভিযোগ আনে এবং গ্রেপ্তার করে ।

■ ১৯৮৬-তে আমেরিকান সরকার ওশোকে ‘অবাঞ্ছিত’ হিসেবে দেশ থেকে বহিষ্কার করে এবং ৩ লক্ষ ডলার জরিমানা করে।

■ ভারতে ফিরে ১৯৮৭-তে পুণের আশ্রমে আসেন।

■ ১৯ জানুয়ারি ১৯৯০ সালে মৃত্যু।

 

রজনীশের প্রবচন থেকে কিছু নির্যাস

■ সব ধর্ম-ই মুখে প্রেমের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে প্রেমকে জোর করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখায়।

■ ধর্মগুরুরা-ই মনকে বিষময় করেছে। প্রেমকে স্বতঃস্ফুর্ততার সঙ্গে উৎসারিত হওয়াকে কীভাবে বাঁধ দিয়ে আটকাতে হয়, তা শিখিয়েছে।

■ মানুষ যতই সভ্য, সুসংস্কৃতি-সম্পন্ন হচ্ছে, তত-ই তথাকথিত ধর্মের প্রভাবে মন্দিরে মসজিদে-গীর্জায় প্রার্থনা করে চলেছে, এবং তত-ই মানুষের জীবন প্রেম-শূন্য হয়ে পড়ছে।

■ যে ধর্ম ব্রহ্মচর্য পালনকে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আদর্শ বলে শেখায়, সে ধর্ম প্রেমের শত্রু।

■ প্রেমের সঙ্গে কাম মিলে-মিশে থাকে। কামকে বাদ দিয়ে প্রেম হয় না। আর, প্রেমহীন কাম লাম্পট্য হতে পারে, প্রেম নয়। সব ধর্মগুরু ও মহাত্মারা কাম’কে পাপ, অধর্ম, বিষ বলে ঘোষণা করেছেন।

■ কাম’কে আধ্যাত্মিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার সর্বপ্রথম চেষ্টা তান্ত্রিকরা-ই করেন। তাঁরা-ই প্রথম বলেছিলেন, কাম তৃপ্তিতে যে আনন্দ তা-ই ব্ৰহ্ম, তা-ই ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। তথাকথিত হিন্দু ধর্মগুরুরা কি তন্ত্রের এই সার কথা-কে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেবেন?

■ পরমাত্মা কাম শক্তিকে-ই সৃষ্টির মূল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মানুষের জন্ম-ই কামনা থেকে। পরমাত্মা যাকে ‘পাপ’ বলে মনে করেন না, মহাত্মা, ধর্মগুরুরা তাকে ‘পাপ’ বলে থাকেন। এরপর বলতে-ই হয়, যে ধর্মগুরুরা পরমাত্মার বিধান উল্টে দিতে চায়, তাদের চেয়ে পাপী এ জগতে আর কেউ নেই।

■ মনে রাখা দরকার, ব্রহ্মচর্য পালন করা সংযমীরা খুব বিপজ্জনক লোক। তাদের ভিতরে রয়েছে কামনার আগুন, বাইরে সংযমের মুখোশ। তাই শত-শত বছর ধরে এইসব মুখোশধারী ধর্মগুরুদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা চলে আসছে এবং আসবে।

■ সমাধি বা ধ্যান হলো মনের একাগ্রতা, যাতে অন্য চেতনা রহিত হয় । সম্ভোগে অর্থাৎ নারী-পুরুষের প্রেমের মিলনে-ই মন একাগ্র হয়, চেতনা রহিত হয়। ধ্যানের বা সমাধির প্রথম অনুভব হয়েছে সম্ভোগের মুহূর্তেই । অন্য কোনও সময়ে নয়।

■ সমস্ত ধর্ম-ই মৃত্যুবাদী, জীবনমুখী নয়। ধর্মের দৃষ্টিতে-মৃত্যুর পর যা কিছু তা-ই মহত্বপূর্ণ। জীবিত অবস্থার কোনও কিছুই মহত্বপূর্ণ নয়।

■ ধর্ম হলো মানুষকে বিকশিত করার শিল্পকলা, ‘আর্ট অফ লিভিং আজকালকার ধর্মে মানুষকে বিকশিত করার কোনও প্রচেষ্টাই দেখা যায় না।

■ পৃথিবীতে মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, পূজারী, পুরোহিত, পীর, প্রিস্ট সব-ই বেড়েছে, তারপরও পৃথিবীতে সৎ মানুষের বড় অভাব। কেন না এইসব ধর্মের আধারেই রয়েছে ভুল।

■ পৃথিবীর একশো জন পাগলের মধ্যে আটানব্বই জন হয়েছে কাম দমনের জন্যে। পৃথিবীর এক হাজার হিস্টিরিক রোগী নারীর মধ্যে নিরানব্বই জনের মুর্ছা রোগের কারণ অবদমিত যৌনতা।

■ অন্তর্মুখী চেতনায় পৌঁছবার দুটি মাত্র পথ। একটি সম্ভোগ অর্থাৎ যৌন মিলনের, আর অন্যটি হল ‘মেডিটেশন’ বা ধ্যানের পথ।

■ বালক-বালিকাদের যদি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত নগ্ন থাকতে দেওয়া হয়, তবে একে অপরের শরীরকে জানতে অশোভন কৌতূহল প্রকাশ করবে না।

■ বাচ্চারা যখন দেখে মা-বাবারা যৌনতাকে নোংরা বলছেন মুখে এবং সুযোগ পেলেই সেই যৌনতায় মেতে উঠছেন, তখন তারা মা-বাবাকে প্রতারক, ভণ্ড, নোংরা ইত্যাদি মনে করে। শ্রদ্ধা যায় শেষ হয়ে।

যারা জীবনে প্রেম করার সঙ্গী পায়নি, তারা-ই কামুক। টাকা খরচা করে কাম মেটায় ৷

■ যে স্বামী বা স্ত্রী সবাইকে ভালোবাসতে পারে না, সে স্ত্রী বা স্বামীকে ভালোবাসকে কীভাবে?

■ ভালোবাসা এক স্বভাব, ‘রিলেসনশিপ’ বা সম্পর্ক নয়।

■ প্রেম + ধ্যান = পরমাত্মা।

■ তোমার যদি পূর্বজন্মে যৌন মিলনের অর্থাৎ সম্ভোগের গভীর অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে তুমি এ’জন্মে যৌনতৃষ্ণাহীন ভাবে জন্মাবে। ব্রহ্মচর্য পালনজাতীয় কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে না। স্বতস্ফুর্ততার সঙ্গেই সহজাত যৌনপ্রবৃত্তির উর্ধে থাকবে চেতনা।

■ মনে মনে যৌনক্রিয়া বা স্বমৈথুন বিকৃত মনের লক্ষণ। সম্ভোগ করুন শারীরিকভাবে। এই সম্ভোগ কখন-ই ধর্ষণ হবে না। হবে নারী-পুরুষের মিলিত ইচ্ছায়।

■ যে দেশে প্রেম ছাড়া বিয়ে হয়, সেই দেশে যৌনতা শরীরের স্তরে-ই থেকে যায়। তার বেশি উঠতে পারে না।

■ যে ধরণের ভালোবাসার বিয়েতে পণ্ডিত, জ্যোতিষ, জাত, ধর্ম, অর্থের বিচার প্রাধান্য পায় না, সেখানে ভালোবাসা-ই প্রাধান্য পায় ।

■ বিয়ে কখনই দুটি নারী-পুরুষের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ার ব্যবস্থা হতে পারে না। কেন না, মন চঞ্চল, রুচি পরিবর্তনশীল। তাই পতি-পত্নীর শারীরিক মিলন কখন-ই চিরস্থায়ীভাবে গভীর হতে পারে না।

■ প্রেম ছাড়া সামাজিক যে সব বিয়ে হয়, তাতে পতিনির্ভর পত্নীর অবস্থা বেশ্যার মতো। তফাৎ খুব-ই সামান্য। বেশ্যাকে একদিনের জন্যে কেনেন। পত্নীকে সারা জীবনের জন্যে।

■ স্ত্রী মা না হলে জীবনে পূর্ণতা পায় না। স্ত্রী মা হওয়ার পর তার যৌন চাহিদা কমে যায় ।

■ প্রায় দশ হাজার বছর ধরে অনেক পয়গম্বর, বুদ্ধ, তীর্থঙ্কর, ঈশ্বরপুত্র অবতাররা মানবজাতিকে বুঝিয়েছেন যে, ঝগড়া কোরো না, ঈর্ষা কোরো না। এইসব মহাপুরুষদের প্রচারের ফলে তথাকথিত ধর্মে বিশ্বাসীদের ভিড় বেড়েছে, সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ওরা কেউ-ই উপদেশগুলো মান্য করেনি।

ওশোর এইসব মতামতগুলো বিকৃতি না ঘটিয়ে তুলে দিলাম। ওর এইসব বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিবাদীদের কোনও লেনা-দেনা নেই। ওশোর জন্মান্তরে বিশ্বাস স্পষ্টতই বিজ্ঞান-বিরোধী। ওশো মনে করেন—মা হওয়াতেই নারীজীবন পূর্ণতা পায়। এগিয়ে থাকা মূলবোধের নারীরা, শিক্ষিত-স্বনির্ভর নারীরা এমন বোকা-বোকা ধারণার সঙ্গে কখনই একমত হবেন না। এমনি আরও অনেক ভুল ধারণা, অবাস্তব চিন্তা, অসামাজিক ধারণা তাঁর ‘দর্শনে’ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রগতিশীল চিন্তা-ও।

এবার আবার আমরা দেখবো, ওশো যোগ-ধ্যান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কী বলছেন?

 

ধ্যান কাকে বলে ?

স্ব-বোধে থাকার নাম ধ্যান। যখন তুমি কিছুই করো না, কোনও কাজে নেই, চিন্তা-ভাবনায় নেই, যুক্তি-তর্ক-বিচারে নেই, তখন তুমি স্ব-বোধে আছো।

(স্ব-বোধে থাকা—মানে নিজের বোধে, বিচার-বুদ্ধিতে-যুক্তি-তর্কে থাকা । আর ওশো বলছেন-‘স্ব-বোধ’ মানে বোধহীন, বিচার-বুদ্ধিহীন? এমন অদ্ভুতুড়ে ব্যাখ্যা মানতে গেলে বিচার-বুদ্ধি বিসর্জন দিতে হয়।

ওশো (রজনীশ)-এর লেখা ‘ধ্যান-যোগ’ গ্রন্থের ১ পৃষ্ঠায় আবার বলছেন, “যদি ক্ষণিকের জন্যও তুমি এই সমস্ত থেকে কর্মশূন্য হতে পারো—সেটাই হচ্ছে ধ্যান। নিজের অন্তরে অবস্থিত পরিপূর্ণ বিশ্রমে আসতে পারাটাই হচ্ছে ধ্যান।”

এই গ্রন্থের ৩ পৃষ্ঠায় আবার বলছেন, “মনে রাখবে যে ধ্যান, হচ্ছে সচেতন হওয়া, সজাগ থাকা। তুমি সজাগ হয়ে যা কিছুই করো তাই ধ্যান ।

(বুঝলুম না বাপু। ১ পৃষ্ঠায় ওশো বললেন, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও সমস্ত রকম ভাবে কর্মশূন্য হতে সারা-ই ‘ধ্যান’। ৩ পৃষ্ঠায় বলা হচ্ছে সমস্ত রকম ভাবে সজাগ থাকা-ই ধ্যান।)

ধ্যানের সময়

ধ্যানে বসার আগে টেলিফোনের কানেকশন কাটাতে হবে, নতুবা তুলে রেখে ‘এনগেজড’ করে দিন। কলিংবেলের আলাদা একটা সুইচ রাখবেন, যাতে সুইচের ‘অফ’ ‘অন’-এ বন্ধ করতে ও খুলতে পারেন। কলিংবেল বন্ধ করুন। যে ঘরে ধ্যান করবেন, সে ঘরে ঢোকার আগে জুতো বা চটি খুলে রাখুন। কারণ ধ্যান-কক্ষ অতি পবিত্র স্থান। দরজা বন্ধ করুন। বন্ধ দরজার বাইরে ঝুলিয়ে দিন, “ধ্যান করছি। বিরক্ত করবেন না।” ঘরে ঢোকার সময় জুতোর মতো সমস্ত চিন্তাকে বাইরে ছেড়ে আসুন ।

চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এক ঘন্টা ধ্যানের জন্য আলাদা করে রাখুন। ধ্যানের জন্য একটা ঘর আলাদা করে রাখতে পারলে খুব-ই ভালো হয়।

আলাদা ঘর কেন? কারণ প্রত্যেক কাজ নিজের তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তুমি যখন ধ্যানমগ্ন হও, তখন ধ্যান-কক্ষ তোমার ধ্যানের তরঙ্গকে পান করে নেয়। পরের দিন যখন ধ্যানে বসবে তখন ধ্যান-কক্ষ তোমাকে সেই তরঙ্গকে ফিরিয়ে দেবে । (এমন তরঙ্গ তত্ত্ব উদ্ভট্ এবং বিজ্ঞান-বিরোধী।)

 

ধ্যানে বা যোগে কীভাবে বসবে?

অনেকেই তোমাকে পদ্মাসন থেকে শুরু করে নানা আসনে বসে ধ্যান বা যোগ সাধনা করতে বলবে। ওইসব আসন যদি তোমার কাছে কষ্টকর মনে হয়, তাহলে নিজের মনকে স্ব-বশে আনবে কী করে?

ধ্যানে বা যোগে বসতে প্রথম ও শেষ কথা হলো আরাম করে বসো। চেয়ারে বসবে অথবা মেঝেতে—এটা কোনও প্রশ্ন-ই নয়। আরামে বসলে, শরীরের কষ্ট বা অস্বস্তি নিয়ে মন ব্যস্ত থাকবে না ।

 

মুখোশ ছেড়ে আরম্ভ কর

আমি চাই, তুমি যখন একা, তখন সভ্যতার মুখোশ খুলে রেখে ধ্যান-কক্ষে নিজের ইচ্ছে মত নেচে-পাগলামি করে যোগ বা ধ্যানের কাজটা শুরু করো।

আমি শুরুতে শিষ্য-শিষ্যাদের ইচ্ছে মতো নাচতে, কাঁদতে, পাগলামো করতে দিই। এতে তুমি যখন আনন্দ পেতে শুরু করবে, অফুরন্ত আনন্দ উপভোগের পর মন শাস্ত হবে, মৌন হবে। প্রথমেই সোজা হয়ে বিশেষ মুদ্রায় বসতে বললে, ‘ঠিক বসতে পারছি না, বসতে কিছু শারীরিক অসুবিধে হচ্ছে’—ইত্যাদি ভেবে মন বিক্ষিপ্ত হতো।

ধ্যানের আগের মনকে মুক্ত করো ‘অনিবার্য’ নির্দেশ মেনে ধ্যান করলে হলে তিনটি ‘নির্দেশ’ মানতে-ই হবে। এই তিনটি নির্দেশকে বলে ‘অনিবার্য নির্দেশ’ অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় নির্দেশ। একঃ ধ্যানে মনকে নিয়ে যেতে হবে ‘বিশ্রামপূর্ণ’ অবস্থায়। মন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মনের সঙ্গে লড়াই নয়। একাগ্রতা আনার চেষ্টা নয়। দুইঃ যা চলছে তাতে কোনও হস্তক্ষেপ নয়। শুধু মনকে শান্ত ও সজাগ রাখা। তিনঃ কোনও মূল্যায়নের চেষ্টা নয়। যা করছি, তা কতটা ঠিক করছি, এ’সব মূল্যায়ন করতে নামলে তা ধ্যানের বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

 

সক্রিয় ধ্যান করার নির্দেশ বা বিধি

একঃ দশ মিনিট নাক দিয়ে জোরে প্রশ্বাস ভিতরে নেবে এবং বাইরে ছাড়বে। এই সময় কাঁধ ও গলা শিথিল রাখবে।

দুইঃ সম্পূর্ণ পাগলের মতো হয়ে যাও। হাসো, কাঁদো, নাচো, গান করো, চিৎকার করো, লাফাও, হাত পা ছোড়ো, কোমর পেট-বুক কম্পিত করে। শরীরকে সবদিকে গতিময় হতে দাও ।

তিনঃ কাঁধ ও গলাকে শিথিল করে হাত দুটোকে মাথার উপর তুলে রাখ। কনুই নমনীয় থাকবে। এ’বার সোজা হয়ে লাফাতে শুরু করো। মুখে মন্ত্র উচ্চারণ করবে—হু… হু… হু… এই মন্ত্র জোরে উচ্চারণ করবে। এই তীব্র হু…ধ্বনী প্রতিবার উচ্চারণের সঙ্গে তা কামকেন্দ্র গভীরভাবে আঘাত করবে। মনে রাখতে হবে, এই হু…ধ্বনী সৃষ্টি করতে হবে নাভিকুণ্ড থেকে, একে বলে নাদধ্বনি।

(পেট বা নাভি থেকে কখন-ই কোনও ধ্বনী স্বরনালী দিয়ে উচ্চারিত হতে পারে না। আমাদের ফুসফুসের হাওয়া বের করার সময় স্বরযন্ত্রের সাহায্যে আমরা শব্দ সৃষ্টি করি, পেট থেকে শুধুমাত্র উৎগার বা ঢেকুর হয়ে এবং পাদ হয়ে বায়ু নিঃসরণ ঘটিয়ে শব্দ সৃষ্টি করা সম্ভব।)

চারঃ থামো। যেখানে যেমন আছ, তেমন ভাবে-ই থেমে যাও। তোমার ভিতরে কী হচ্ছে, অনুভব করো, সঙ্গী থেকে যাও !

পাঁচঃ চারটি পর্যায়ের পদক্ষেপে তোমার শরীরে নতুন শক্তি জন্ম নিল। শরীরে শক্তির ‘চার্জ’ হলো। এবার অন্তরের পরমাত্মাকে নিবেদন করো, উৎসব করো। সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে উৎসব পালন করো।

(ওশো রজনীশের এই ধ্যান পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই বিধি পালন করে ধ্যান করেন।

কুণ্ডলিনী ধ্যান

কুণ্ডলিনী জাগ্রত করে পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মকে অনুভব করা যায় না। অনুভব করা যায় শুধুমাত্র সম্ভোগে, শারীরিক মিলনে। একথা প্রাচ্যের মুনি-ঋষিরা আগেই লিখে গেছেন।

এখানে কুণ্ডলিনী ধ্যান শেখান হচ্ছে। কারণ এই ধ্যান সক্রিয় ধ্যানের অতি প্রিয় সহযোগী। কুণ্ডলিনী ধ্যান করতে হয় পনেরো মিনিট করে চারটি পর্যায়ে।

একঃ প্রথম পর্যায়ে শরীরকে শিথিল করে নাও এবং পুরো শরীরকে কাঁপতে দাও। গভীর ভাবে ভাবতে থাকো—পুরো শরীর কাঁপছে। দেখবে কাঁপতে শুরু করেছে। ইচ্ছে করে কাঁপিও না।

দুইঃ নাচো, যেমন ইচ্ছে নাচো। শরীরকে ইচ্ছে মতো গতি আনতে দাও।

তিনঃ চোখ বন্ধ করে নাও। ইচ্ছে মতো বসো অথবা দাঁড়িয়ে থাকো।

চারঃ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। মরার মতো নিশ্চল থাকো। এই কুণ্ডলিনী ধ্যানের মধ্য দিয়ে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়।

নটরাজ ধ্যান

‘নটরাজ ধ্যান’ একটি সম্পূর্ণ ধ্যান। এতে ৬৫ মিনিট তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এই নৃত্য হবে অন্তর থেকে উৎসারিত। এটা কোনও সিরিয়াস কাজ নয়। জীবন-শক্তির সঙ্গে খেলা।

মনে রাখতে হবে—পরমাত্মা গম্ভীরভাবে কোনও সৃষ্টি করেননি। তুমি, আমি, প্রকৃতি—সব-ই তাঁর খেলা, তাঁর লীলা।

(সব সৃষ্টির ক্ষেত্রে-ই প্রকৃতির নিয়মের বদলে কাল্পনিক পরপাত্মাকে টেনে আনা ওশোর অজ্ঞতাই উন্মোচিত করে।)

সুফি ধ্যান

সুফি দরবেশরা ধ্যানের মধ্য দিয়ে পরমাত্মার সঙ্গে, আল্লার সঙ্গে একান্ত হয়ে যান। তাঁদের এই ধ্যান পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। সুফিরা তাঁদের ধ্যান শুরু করার আগে জুতো খুলে নেন। তারপর গোলকারে ঘুরতে থাকেন। এই ঘোরা হয় ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে, অর্থাৎ ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। ডান হাত ওপরে তুলে করতল আকাশের দিকে মেলে দেওয়া হয়। বাঁ হাত থেকে নীচের দিকে নামানো। করতল থাকে মাটির দিকে মেলা।

প্রথম পনেরো মিনিট ঘোরার গতি থাকবে মাঝারি। পরের তিরিশ মিনিটে ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে যেতে হবে। এমনি ঘুরতে ঘুরতে শরীর নিজেই পড়ে যাবে।

এবার ধ্যানের দ্বিতীয় ধাপ। পড়া মাত্র পেটের দিক মাটি স্পর্শ করে হয়ে থাকতে হবে। নিজের শরীরকে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে দাও ।

হাস্য ধ্যান

হাসি মুখ বুদ্ধ দেখেছো। তাঁর সমস্ত উপদেশের সার হলো হাসি। হাসি যদি আন্তরিক হয় তবে মন আনন্দে বিলীন হয়। সম্ভোগ যেমন মনকে চূড়ান্ত আনন্দের জগতে নিয়ে যায়, হাসি ও তোমাকে আনন্দের মধ্যে নিয়ে যাবে। চূড়ান্ত না হলেও এক অসাধারণ আনন্দের জগতে নিয়ে যাবে।

হাসির ধ্যানের জন্য যা করবে

সকালে ঘুম ভাঙার পর, চোখ খোলার আগে ঘুম থেকে ওঠা বেড়ালের মতো আড়মোড়া ভাঙবে। এর তিন চার মিনিট পরে চোখ বন্ধ রেখে-ই হাসতে আরম্ভ করবে। পাঁচ মিনিট শুধু হাসবে।

প্রথম প্রথম হাসা অভ্যেস করতে হবে। তারপর দেখবে হাসি অন্তর থেকে আপনা-আপনি উৎসারিত হচ্ছে।

বিপাশ্যনা ধ্যান বা যোগ

বিপাশ্যনা ধ্যান বা যোগ পদ্ধতির সাহায্যে সবচেয়ে বেশি লোক বুদ্ধত্ব লাভ করেছে। বিপশ্যনা তিনভাবে করা যেতে পারে। তোমার যেটা পছন্দ সেই একটি পদ্ধতিকে বেছে নিতে পারো।

প্রথম পদ্ধতিঃ নিজের প্রতিটি কাজ করবে অত্যন্ত সজাগ ভাবে। তুমি ঘরে ঢুকেছো, কলিং বেল বাজলো, একই সময়ে ফোনটা বাজলো। হাতের জরুরি কাগজটা নামিয়ে রেখে ফোনটা ধরে বললে, এক মিনিট, কেউ এসেছে। দেখে আসছি। দরজা খুলে আগতকে বসতে বললে। ফোনের কথা সেরে প্রয়োজনীয় কাগজটার কথা মনে পড়লো। ফাইলে রাখতে হবে। আর তখনই খেয়াল হলো, কোথায় রেখেছো মনে পড়ছে না। তন্নতন্ন খুঁজে-ও কাগজটা পাওয়া যাচ্ছে না। কাগজটা সজাগভাবে রাখা হয়নি বলে-ই পাওয়া যাচ্ছে না।

হারাতো না, যদি কাগজটা সচেতন ভাবে রাখা হতো। একসঙ্গে তিনটে কাজ এসে পড়লো, ওমনি কাজে ভুল হলো। বে-খেয়ালে রাখার দরুন জরুরি একটা বিষয় ভুলে গেলে। প্রতিটি কাজ সজাগ ভাবে করাটাও ধ্যান। ছটফট না করে টেনশনে না ভুগে।

দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনকে সজাগ রাখার দুটি বিধি আছে। প্রথম বিধি অনুসারে প্রশ্বাস নিতে হবে পেট ভরে, পেট ফুলিয়ে। শ্বাস ছাড়তে হবে পেট যতটা সম্ভব পিঠের দিকে টেনে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সজাগ ভাবে অর্থাৎ একাগ্রভাবে পেটকে ভিতরে যতটা সম্ভব ঢুকিয়ে নেওয়া ও ফুলিয়ে তোলা-ই ধ্যান ।

তৃতীয় পদ্ধতিঃ সজাগ ভাবে প্রশ্বাস নাও ফুসফুস ভরে, বুক ফুলিয়ে। শ্বাস ছাড় ফুসফুস থেকে বুক নামিয়ে। এটাও ধ্যান।

সজাগ ভাবে যখন-ই তুমি কিছু করছো, তখন তুমি দ্রষ্টা। প্রশ্বাস নেওয়া ও শ্বাস ছাড়ার মাঝখানে সামান্য সময়ের জন্যে হলেও শ্বাস থেমে যায়। তখন তোমার মৃত্যু হয়। নতুন প্রশ্বাস যখন নাও তখন নতুন জন্ম হয়।

(শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ বন্ধ করলেই মৃত্যু হয়—জানা ছিল না। ডাক্তাররা যখন শরীর পরীক্ষা করতে দম বন্ধ করে থাকতে বলেন, তখন আমরা ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে, ডাক্তারের কথা ও বাইরের কথা শুনতে-শুনতে আসলে মরে থাকি—সত্যি বলছি জানতাম না ।)

শান্তি আনতে যোগ

পতঞ্জলি বলেছেন, শ্বাসকে বের করে দেওয়ার বিধির সাহায্যে মনকে শান্ত করা যায়।

যতটা সম্ভব শ্বাসকে বাইরে ছাড়বে। শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মনের অশান্তিও বাইরে চলে যায়। এই শ্বাস ছাড়ার আবার বিশেষ পদ্ধতি আছে। শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পেট ভিতরের দিকে টেনে নাও। তিন সেকেণ্ডের জন্য থামো। এই পদ্ধতিতে শ্বাস ছাড়লে অশান্তি দূর হয়, মনে শান্তি আনে।

(গরিব, বেকার, অসুস্থ, অপুষ্টিতে ভোগা, মাথা গোঁজার ঠাঁইহীন অশান্ত মানুষদের মনে শান্তি আনতে সরকার ওশো’র এই পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন।)

নাদব্রহ্ম ধ্যান বা নাদব্রহ্ম যোগ

এই ধ্যান বা যোগ সকালে খালি পেটে করতে হয়। এই ধ্যান বা যোগ বিধি এক ঘন্টায় তিনটি ধাপে করতে হবে।

প্রথম ধাপঃ তিরিশ মিনিট। বিশ্রাম নেবার মত করে ইচ্ছে মতো বসো। মুখ দিয়ে ভ্রমরের মত গুঞ্জনধ্বনি করো। গুঞ্জনধ্বনির কম্পন গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।

দ্বিতীয় ধাপঃ পনেরো মিনিট। প্রথম সাড়ে সাত মিনিট দুটি হাতের তালুকে আকাশের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে চক্রাকারে ঘোরাতে থাক। গতি হবে অতি মন্থর। সাড়ে সাত মিনিট শেষে হাতের তালু দুটো নাভির সামনে নিয়ে আসবে।

এবার হাত দুটোর তালু মেঝেতে ঠেকাও। তারপর উল্টো ভাবে চক্রাকারে হাত দুটি ঘোরাও। গতি হবে এক-ই রকম মন্থর। সাড়ে সাত মিনিট শেষে হাত দুটো নাভির সামনে আনবে।

তৃতীয় ধাপঃ পনের মিনিট। শান্ত ও স্থির হয়ে বসে থাক বা শুয়ে পড়ে।

নারী-পুরুষ একসঙ্গে নাদব্রহ্ম ধ্যান করতে পারলে খুব-ই ভাল ফল পাওয়া যায়। নারী-পুরুষের পরনে কোনও কাপড় না থাকলে সবচেয়ে ভালো। ঘরের আলো হবে ছোট-ছোট চারটে মোমবাতির আলোর সমান ।

চোখ বন্ধ করে তিরিশ মিনিট দু’জনে দুজনকে ধরে গুঞ্জনধ্বনি করো এবং নিজেদের শরীরকে কল্পনা করতে থাক । এই বিশেষ ধ্যানের জন্যে বিশেষ যন্ত্রধ্বনির ক্যাসেট আছে। দুজনের শক্তি মিলিত হতে থাকবে, একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতে থাকবে, দু’জনে এক হয়ে যাবে।

সম্ভোগ ধ্যান

শিব যোগের স্রষ্টা। এবং তিনি লিঙ্গেশ্বর। শিবের উপদেশ, নারী-পুরুষের মিলন বা সম্ভোগ-ই ধ্যান। সম্ভোগের সময় তোমার প্রতিটি দেহকোষ উত্তেজনায় কম্পিত হতে থাকে। নাড়ির গতি দ্রুত হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়। প্রতিটি কোষ অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। চোখে বিস্ফারিত হয়। যৌনাঙ্গ রসসিক্ত হয়। সম্ভোগে দুটি শরীর শুধু মিলিত হয় না। চূড়ান্ত উত্তেজনার মুহূর্তে পরম আনন্দ, পরমেশ্বরকে অনুভব করা যায় ।

যখন তুমি জন্মগ্রহণ করেছিলে, তখন দুটি যৌন কোষের মিলন হয়েছিল। ওই দুটি কাম কোষই বিভক্ত হতে হতে, সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে তোমার শরীর তৈরি হয়েছে। শুধুমাত্র সম্ভোগের সময়-ই তোমার শরীর প্রতিটি কোষ কাঁপতে থাকে। মনে রাখবে—তোমার শরীরের প্রতিটি কোষ বিপরীত কোষের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। এই কম্পন যদি পাশবিক মনে হয়, তাতেও এটায় কোনও দোষ নেই। কারণ মানুষ এক হিসেবে পশু।

আমরা বিশেষতঃ মেয়েদের বেলায় মিলনের সময় গতি ও কম্পনাকে নিষেধ করি। তারা মরদেহের মত পরে থাকে। নিষ্ক্রিয় অংশীদার। এটা কেন হচ্ছে? কারণ পুরুষরা মেয়েদের অধীনে রাখতে চায়। পুরুষরা জানে, মেয়েরা পরপর তিন তিনবার চূড়ান্ত উত্তেজনার শিখরে উঠতে পারে। আর পুরুষ পারে কেবলমাত্র একবার। পুরুষ যখন সম্ভোগে চূড়ান্ত উত্তেজনায় বিস্ফোরিত হয়। নারী তখন আরও একাধিকবার চূড়ান্ত উত্তেজনায় বিস্ফোরিত হতে চায়। পুরুষ ভয় পায় সামলাবে কী করে?

আমি বলি, দু’জনেই কম্পিত হও। দু’জনেই সক্রিয় হও। দু’জনেই দু’জনের উপর নাচো। দু’জনের চূড়ান্ত আনন্দ আসে দুজনে সক্রিয় মিলনে। নারী মৃতের মত পড়ে থাকলে তার চূড়ান্ত উত্তেজক বিস্ফোরণ হবে কোথা থেকে? সে অতৃপ্ত থাকলে অন্যকে কামনা করবে, এটাই স্বাভাবিক

অতএব বলি, দু’জনেই দু’জনের শরীরে প্রবেশ করো।

এই মিলন বৌদ্ধিক নয়। এই মিলন জৈবিক।

এটাই অদ্বৈত। এই অদ্বৈতকে অনুভব

করতে না পারলে সমস্ত

দর্শনশাস্ত্র ব্যর্থ।

 

রজনীশকে যেমন দেখেছি

রজনীশ ভালো সংগঠক ছিলেন। পৃথিবী ব্যাপী ৩০০ ‘রজনীশ মেডিটেশন সেন্টার’ (Rajneesh Meditation Centre) তৈরি করেছিলেন। প্রতিটি সেন্টার পরিচালনার ভার দিয়েছিলেন একজন করে সুঠাম চেহারার সুন্দরীকে।

রজনীশকে ঘিরে সব সময়-ই থাকতেন সুন্দরী দেশী-বিদেশী রমনীরা। রজনীশের সম্ভোগ সেশনে নর-নারীরা পোশাক-টোশাক ছিঁড়ে মৈথুনে মত্ত হতো। তবে মৈথুনের আগে পুরুষদের কণ্ডোম ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। সম্ভোগ সেশনে পার্টনার পাল্টান নিত্যকার ঘটনা। সোজা কথায় উৎশৃঙ্খল যৌনাচার ছিল রজনীশ মেডিটেশন সেন্টারগুলোর মূল কাজকর্ম। নানা ধরনের গ্রুপ ধ্যান চলতো পুণে আশ্রমে। সবই আসলে আবাধ যৌনাচার। সম্ভোগ, প্রবচন, ধ্যান ও যোগ নিয়ে যে সব কথা রজনীশ বলতেন, তা সব-ই শেষপর্যন্ত ছিল কথার কথা। আসল কথাটা ছিল তন্ত্রের যথেচ্ছ যৌনাচারের-ই রকম ফের।

শেষপর্যন্ত যা দেখেছি, রজনীশ তন্ত্রের-ই প্রচার করেছেন। এক অতি আধুনিক স্টাইলে ভণ্ডামী বাদ দিয়ে যথেচ্ছ সম্ভোগের প্রচার-ই সম্ভবতঃ পাশ্চাত্যে ‘সম্ভোগ ধ্যান’ ও ‘তন্ত্র’কে জনপ্রিয় করেছে। আর তাতেই কি ‘পাবলিক নুইসেন্সে’-এর দায়ে আমেরিকা ওকে বিতাড়িত করল? ‘প্রেম’ বা ‘কাম’ যা-ই হোক—ব্যাপারটা যে ব্যক্তিগত এবং একান্ত, তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। খোলা-মেলা নগ্ন নাচ-গান-মিলন অবশ্যই এক যৌন-পাগলামি। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।

রজনীশ নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে অনেক ভালো-ভালো কথা বলেছেন। আর কাজের বেলায় সেই সম্পর্কগুলোকে নিয়ে অত্যন্ত নোংরা খেলায় মেতেছেন। এইসব নোংরা খেলার ক্রীড়াভূমি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তিনশো ‘রজনীশ মেডিটেশন সেন্টার’। এরপর কেউ যদি রজনীশকে একজন বিকৃত মনের প্রতারক বলে ধরে নেন, তাতে আদৌ আপত্তি করার মত কিছু থাকে কি?

প্রথম পর্বঃ মনের নিয়ন্ত্রণ

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ বুদ্ধি, স্মৃতি, প্রতিভা নিয়ে বিভ্রান্তি বেচে খাচ্ছে অনেকে

অধ্যায়ঃ দুই

♦ প্রচুর পড়েন মানে-ই মস্তিষ্কচর্চা করেন?

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্মৃতি-শক্তি ও প্রতিভা এক নয়

অধ্যায়ঃ চার

♦ জ্ঞান (wisdom) ও শিক্ষা (education) এক নয়

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ মস্তিষ্ক ও তার কিছু বৈশিষ্ট্য

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ পাভলভ-তত্ত্বে মস্তিষ্কের ‘ছক’ বা type

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আচরণগত সমস্যা

অধ্যায়ঃ আট

♦ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছু পাল্টে যায়

অধ্যায়ঃ নয়

♦ অলজাইমারস সৃষ্টিশীল মেধায় ভয়ঙ্কর অসুখ

অধ্যায়ঃ দশ

♦ ‘আই কিউ’ কি বাড়ানো যায়?

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জিন বা বংশগতি-ই ঠিক করে মেধা-বুদ্ধি?

অধ্যায়ঃ বারো

♦ বংশগতি গবেষণা ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অগ্রগতি

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ মগজ কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ মগজধোলাই-এর প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলেছে

দ্বিতীয় পর্বঃ ধ্যাণ-যোগ-সমাধি মেডিটেশন

অধ্যায়ঃ এক

♦ যোগ নিয়ে যোগ বিয়োগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগ কি? যোগ নিয়ে গুলগপ্পো

অধ্যায়ঃ তিন

♦ যোগ

অধ্যায়ঃ চার

♦ যোগের সে’কাল এ’কাল

অধ্যায়ঃ পাঁচ

‘রজনীশ’ এক শিক্ষিত যোগী, বিতর্কিত নাম

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ সাত

♦ শ্রীমাতাজী নির্মলা দেবীর সহজযোগ

অধ্যায়ঃ আট

♦ রিল্যাক্সেশন, মেডিটেশন নিয়ে বাংলাদেশের যোগী মহাজাতক

অধ্যায়ঃ নয়

♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব

অধ্যায়ঃ দশ

♦ ‘মেডিটেশন’, ‘রিলাক্সেশন’, বা ‘স্বসম্মোহন’

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ বিশ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ

“মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ-মেডিটেশন” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!