বৈদিক যুগের পুরুষরাই ছিল পরিবার ও সমাজের মাথা। তারা কামাসক্ত, বহুপত্নীক, অজাচারী ছিল। এইসব কামুক, অসদাচারী পুরুষদের পায়ের তলায় স্ত্রীদের পড়ে থাকতে বাধ্য করতে চেয়েছিল বৈদিক সমাজ। এই চাওয়াকে বাস্তব রূপ দিতে সে’সময়কার আইনি গ্রন্থ মনুসংহিতায় বিধান দেওয়া হয়েছে—পতি সদাচারহীন, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন-সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতই পুজো করবে। (৫ : ১৫৪ )

বৈদিক যুগের দেবতারা ছিলেন সেই সমাজের-ই সৃষ্টি। ফলে ৩৩ কোটি

দেবতার জন্য ৬০ কোটি বারবণিতা নিয়ে ছিল স্বর্গের সংসার।

দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা,

সুপ্রিয়ার মত ৬০ কোটি কামকলা-পটিয়সী বারবণিতা

ছিল। তারপরও দেবতারা অজাচারি

ও ধর্ষক ছিলেন।

ব্রহ্মা নিজের মেয়ে শতরূপাকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। মনুসংহিতার রচয়িতা মনুর জন্ম ব্রহ্ম ও শতরূপার মিলন থেকে। মৎস্য পুরাণে এমনটাই লেখা হয়েছে।

উষার কথায় আমরা আগেই এসেছি। উষা হলেন প্রজাপতি কন্যা। প্রজাপতি উষার রূপে কামাসক্ত হন এবং মিলিত হতে চান। তখন উষা মৃগীরূপ ধারণ করেন। প্রজাপতি মৃগরূপ ধারণ করে মিলিত হন। (মৈত্রায়নি সংহিতা ৪/২/22)

সম্ভবত উষা ও প্রজাপতি পশুদের মৈথুনের উত্তেজনা উপভোগ করতে পশুর মত মিলিত হয়েছিলেন। এমনটা ভাবার কারণ, তখন পশুর মত করে মিলিত হওয়া এবং স্ত্রী-পশুকে মৈথুন করার উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে আছে। আছে মনুসংহিতাতেও

ইন্দ্র থেকে কৃষ্ণ প্রত্যেকেই ছিলেন কামপ্রিয়। রামায়ণ অনুসারে ইন্দ্র গৌতম ঋষির স্ত্রীকে প্রতারিত করে সঙ্গমে লিপ্ত হন গৌতমের ছদ্মবেশ ধারণ করে। জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা ও শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসীকে প্রতারিত করে বিষ্ণু তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। সপ্তর্ষির সাত স্ত্রীকে দেখে অগ্নি কামার্ত হয়ে পড়েন। সপ্তর্ষিরা হলেন মারীচি, অত্রি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, অঙ্গিরা ও বশিষ্ট। তাঁদের স্ত্রীরা হলেন যথাক্রমে কলা, অনসূয়া, ক্ষমা, হবির্ভূ, সন্নতি, শ্রদ্ধা ও অরুন্ধতি।

চন্দ্র দক্ষের সাতাশটি মেয়েকে বিয়ে করে এবং ৬০ কোটি অপ্সরা নামের বারবণিতাদের নিয়ে ফস্টিনস্টি করেও তাঁর বিকৃত কামের আগুন নেভাতে পারেন না। দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার রূপে এমন-ই কামনাতাড়িত হলেন যে, সমস্ত নীতি ভুলে গুরুপত্নীকে অপহরণ করলেন। একে কী বলবো? ধর্ষণ! এর পরিণতিতে যে সন্তান হয়, তার নাম বুধ।

পদ্মপুরাণ অনুসারে (৫/৩১/১৪) শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী’র সংখ্যা ষোল হাজার একশো। এরা সকলেই গোপবালা ছিলেন না। নানা দেশ থেকে এইসব সুন্দরীদের অপহরণ করে এনে নিজের ‘হারেমে’ পুরেছিলেন। এই প্রতিটি সুন্দরীর যৌবনই তিনি ভোগ করতেন। ভাবা যায় !

সে’কথা আমরা ‘শামান’ বা জাদুপুরোহিতদের মুনি, ঋষি ইত্যাদি বলা হত আগেই আলোচনা করেছি। এইসব জাদু-পুরোহিতরা কাম-ক্রোধ ইত্যাদির ঊর্ধ্বে ছিলেন না।

পান থেকে চুন খসলে মুনি, ঋষিরা রাগে কাঁপতে কাঁপতে শাপ দিতেন।

বিয়ে করতেন। তারপরও রাজাদের আমন্ত্রণে হাজির হতেন

রানিদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে। সুন্দরী অপ্সরা

বা বারবনিতা দেখলে এতই উত্তেজিত

হতেন যে রেতঃপাত

হয়ে যেতো।

এইসব জাদু পুরোহিতরা বিয়ে করতেন প্রচুর সম্পদ যৌতুক নিয়ে। অর্থাৎ কামনা বাসনা ত্যাগ করার কোনও লক্ষ্মণ তাঁদের জীবনচর্চায় দেখা যেত না। তবে তাঁরা ভোগজীবনের ঊর্ধ্বে—এমন একটা মুখোশ পরে থাকতেন। যেটাকে সোজা কথায় বলে ভণ্ডামী। সেই ভণ্ডামীর ট্রাডিশন-ই কী আমরা আজও বহন করে চলেছি? রাজা থেকে সাধারণ মানুষ, দেবতা থেকে ঋষি সব্বাই বেদের যুগে যৌন- উচ্ছৃঙ্খলায় মত্ত ছিলেন। বৈদিক সাহিত্য এ কথাই বলে।

এ’সবই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় বৈদিক সমাজের দুটি বৈশিষ্ট্যকে। এক : যৌন-শক্তিধর হওয়াটা প্রধান একটি গুণ হিসেবে গণ্য হত। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুরের কথায়, “মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল।” (দেবলোকের যৌনজীবন, ডঃ অতুল সুর, প্রথম সংস্করণ পৃষ্ঠা ৬২) দুই : বৈদিক জাদু পুরোহিতরা প্রাক-বৈদিক যুগের মাতৃপ্রাধান্যের শিকড় সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। মেয়েদের মৈথুন-যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাই ব্রহ্মার বাণী বলে প্রচার করা হয়েছে—নারীরা পুরুষদের মৈথুনের জন্যই সৃষ্ট। তোমরা মৈথুন কর্ম চালিয়ে যাও। প্রজা উৎপাদন কর। তাতেই আমি তুষ্ট।

পুরুষদের বহুবিবাহ, বউয়ের থেকে বরের বয়স অনেক বেশি হবার প্রথা, সতীদাহ, বৈধব্যজীবনকে সব সুখ থেকে সরিয়ে রেখে ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে শেষ করার প্রথা, দেবতাজ্ঞানে পতি সেবার নীতি—এ’সবই বৈদিক সমাজ চাপিয়ে দিল। কিন্তু এত কিছুর পরও মাতৃপ্রধান্যের সমস্ত স্মারক ধুয়ে মুছে সাফ করতে পারেনি বৈদিক সমাজপতিরা ।

বৈদিক যুগে সমাজে যৌন-উশৃঙ্খলা ছিল। প্রবলভাবেই ছিল। সুতরাং বৈদিক সমাজ যে নারী পুরুষের মিলনের মধ্যে ব্রহ্মকে খুঁজে পাবার নামে নারীদেহ খুঁজে বেড়াবে—এমনটাই ছিল অনিবার্য। হরপ্পা যুগের উর্বরতামূলক জাদু বিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। জাদু বিশ্বাসকে তন্ত্রের রূপ দিয়েছিল বৈদিক জাদু-পুরোহিতরাই।

হরপ্পা যুগের জাদু বিশ্বাস ছিল সামাজিক, প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হত।

বৈদিক যুগে তা হল গুহ্য বা গোপন সাধনার বিষয়। সহজ-

সরল নারী-পুরুষের মিলনে যুক্ত হল ভণ্ডামী।

ধর্মের নামে বিকৃতকামীদের ভণ্ডামী।

error: Content is protected !!