আমরা শৈশব থেকেই শুনে আসছি, আমাদের দেশের মুনি ঋষিরা যোগ সাধনার দ্বারা সমাধিতে যেতেন। নির্বিকল্প সমাধি তাঁদের অধিগত ছিল। নির্বিকল্প সমাধিতে নাড়ির গতি স্তব্ধ হয়ে যেত। অর্থাৎ, দেহ থাকতো, কিন্তু দেহে প্রাণ থাকতো না। এই অবস্থায় জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে বলে হিন্দু উপাসনা ধর্মগ্রন্থে বলা আছে। দেহের বাইরে বেরিয়ে আত্মা যে শুধু পরমাত্মাতেই মিলিত হতো, তেমনটি নয়। নিজের দেহের ভিতরে প্রবেশ করে দেখেছেন, ‘ষঠচক্র’ বা ছবি চক্রকে। এই ছটি চক্র রয়েছে গুহ্যে, লিঙ্গমূলে, নাভিতে, হৃদয়ে, কন্ঠে ও দুই ভ্রুর মাঝখানে। মস্তিষ্কে আছে সহস্র পাপড়ির-পদ্ম-কুঁড়ি। কুঁড়ির ওপর ফণা মেলে রয়েছে একটি সাপ; যার লেজ গেছে গুহ্য পর্যন্ত। এই পদ্মের বীজে আছেন ব্রক্ষ্মস্বরূপ শিব। এ’সব-ই আমরা জেনেছি সেইসব মহান যোগীদের কাছ থেকে, যারা যোগ বলে নিজেদের নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করতে পারতেন। তারপর মুক্ত আত্মা যেখানে খুশি যেতে পারতেন। ব্রক্ষ্মলোক থেকে গ্রহ-নক্ষত্র সর্বত্র বিচরণ করতেন।
আজকাল দু-পাতা বিজ্ঞান পড়ে কেউ কেউ মুনি-ঋষি-যোগীদের যোগ ক্ষমতাকেও অস্বীকার করতে চান।
গত দশকের সাতের দশকে মহর্ষি মহেশ যোগী ভারতীয় যোগকে আবার বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করেন। পাশ্চাত্যের শিক্ষিত হাজার হাজার মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন মুনি-ঋষিদের যোগশক্তি আদৌ গল্প-কথা ছিল না।
ওপরের এই কথাগুলো আমরা বলি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক অনুষ্ঠানে’। তারপর বলিঃ-
“আপনাদের সামনে এবার হাজির করছি মহর্ষি মহেশ যোগীর শিষ্য যোগীরাজ…কে। তিনি আপনাদের সামনে একইভাবে নাড়ি বন্ধ করে দেখাবেন। আপনাদের কাছে অনুরোধ, একদম চুপ করে থাকুন, যাতে উনি মনঃসংযোগ করে যোগ সমাধিতে যেতে পারেন।
“একটিও কথা নয়। আপনারা নিজের চোখে দেখুন এই মহান ঘটনা। আপনাদেরও শেখাবো, কি করে নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করবেন।
“আপনাদের মধ্যে কোনও ডাক্তার থাকলে উঠে আসুন মঞ্চে। অথবা এমন কেউ উঠে আসুন, যিনি নাড়ি দেখতে পারেন। নাড়ি দেখা খুব সোজা। বুড়ো আঙ্গুলের তলায় কব্জির উপর তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুল দুটি হালকা করে চেপে ধরুন। আঙ্গুল দুটিতে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে পারবেন। মিনিটে যতবার হার্ট ধক-ধক করবে, ততবারই নাড়িও একই ছন্দে ধক ধক করবে। আগেকার দিনের ডাক্তার বা কবিরাজরা আগেই রোগীর নাড়ি টিপতেন। নাড়ির গতি মিনিটে তিরিশ বা তার নীচে হলে বলতেন – আমার আর কিছু করার নেই। ভগবানকে ডাকুন।
“হ্যাঁ দেখুন। নাড়ি চলছে তো? মিনিটে ষাটের বেশি গতিতে চলছে তো?
বাঃ, বহুত খুব। এবার নাড়ি থেকে আঙ্গুল সরান। হ্যাঁ ঠিক আছে। পাশে-ই দাঁড়ান।
“এ’বার আপনার সব্বাই যোগীরাজের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। একদম চু-প।
“দেখুন আস্তে আস্তে যোগীরাজ চেয়ারে বসেই যোগ-সমাধিতে চলে যাচ্ছেন। যোগীরাজ চোখ বুজে, গভীর সমাধিতে চলে যাচ্ছেন।
“চার মিনিট হয়ে গেছে। দেখি, এখন নাড়ির গতি কেমন? বন্ধ হয়ে গেছে। নাড়ির স্পন্দন পাচ্ছি না। আপনি এগিয়ে আসুন তো। আগে তো দেখেছিলেন পালস বিট নরমাল। এ’বার দেখুন তো?
“কি বলছেন? নেই? কর্ডলেসটা আপনার কাছে ধরছি। পাবলিককে বলুন যা দেখলেন।
“বাঃ সুন্দর। আবার আপনাকে একটু কষ্ট দেবো। আবার একটু সরে আসুন। যোগীরাজের পাশে চুপটি করে দাঁড়ান। হ্যাঁ, একদম ঠিকঠাক।
“যোগীরাজ, আবার আপনি সমাধি ভেঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে আমাদের মধ্যে চলে আসুন। প্লিজ, একটুও গোলমাল নয়। আপনার একটু অসহযোগিতার জন্য যোগীরাজ নির্বিকল্প সমাধি থেকে ফিরতে না পারার মানে জানেন? মৃত্যু। হ্যাঁ, মৃত্যু।
“হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি, নাড়ি ধীরে-ধীরে চলতে শুরু করেছে। এবার আর একবার কষ্ট করে পরীক্ষা করুন। দেখুন। কি, নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে পারছেন? উনি পারছেন। ওঁর কাছ থেকেই আপনারা বরং শুনুন।“
হ্যাঁ, মোটামুটি এ’ভাবেই বলি আমাদের সমিতির অনুষ্ঠানে পালস বিট বন্ধ করে দেখাবার সময়।
কিভাবে বন্ধ করি? দুটি মাঝারি আলু অথবা দুটি রুমাল শক্ত করে পুঁটলি করে দু’বগলের তলায় রাখুন। এবার হাত দুটো বুকের পাশে চেপে রাখুন। এই চাপে বগলের তলার অ্যাক্সিলারি ধমনীতে রক্ত চলাচল স্বভাবতই বন্ধ হবে। অর্থাৎ নাড়ির স্পন্দন বন্ধ হবে।
এই হল যোগ সমাধিতে নাড়ি বন্ধ করার মোদ্দা কৌশল।
স্বাস্থ্যবান কোনও মানুষ বগলের পেশি ফুলিয়ে হাত দুটি চেপে অ্যাক্সিলারি ধমনীর রক্ত চলাচল বন্ধ করতে পারেন।
দুটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময়ের জন্য নাড়ি বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। দু’হাতের রক্ত চলাচল দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ রাখলে তা হাতের বিপদ ঘটাবে।
যুক্তিবাদী আন্দোলনের শুরুতে নাড়ির গতি স্তব্ধ করে দেখাতাম আমি। আজ দেখান আমাদের সমিতির কয়েক’শ সদস্য-সদস্যা। দেখান আরও অনেক বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মী। শুরু থেকে লক্ষ্য করেছি, আমি যখন নাড়ি বন্ধ করতাম, তখন সাধারণ মানুষরা তেমন অবাক হতেন না। অবাক হতেন বড় বড় চিকিৎসকরা। কারণ সাধারণ মানুষরা ভাবন যোগ যারা জানেন, তাড়া নাড়ি বন্ধ করতে-ই পারেন। এর মধ্যে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। নতুন কিছুও নয়।
চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের কাছে যখন দেখিয়েছি, তখন তাঁদের বিস্ময়ের ঘোর লেগে যেত। কারণ, নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করে একজন মানুষের স্বাভাবিক ভাবে
বেঁচে থাকা মানুষের শারীরবৃত্তিতে অসম্ভব ব্যাপার। যখন কৌশলে নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করেছি তখন তা দেখে ভয়ঙ্কর রকম অবাক হয়েছেন ডাঃ আবিরলাল মুখার্জি, ডাঃ প্রসেনজিৎ কোনার, ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ, ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল প্রমুখ বহু বিশিষ্ট চিকিৎসক।
সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটা ধাক্কা দিতে-ই একসময় থেকে নাড়ি বন্ধ করার আগে মুনি-ঋষিদের যোগে নাড়ি বন্ধের গল্প বলা শুরু করি। দেখলাম মানুষ হতবাক হয়ে দেখেছে নাড়ি বন্ধের ঘটনা।
আমরা একদিকে অলৌকিকত্বের বিরুদ্ধে প্রচার করেছি, আর একদিকে মুনি-ঋষিদের যোগ বিষয়ে ‘মিথ’ ভেঙ্গেছি।