বিভিন্ন কালের বিভিন্ন যোগীদের যোগ তত্ত্ব বিভিন্ন রকমের। পার্থক্যটা অবশ্য শুধু কালের নয়। প্রাচীনকালেও ‘যোগ’ নিয়ে নানা যোগী ঋষির নানা মত ছিল। একালের যোগীরাও এক একজন এক এক রকমের যোগের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যোগ সাধনার পদ্ধতিও তাই বিশাল গড়মিল-এসবই আমরা আগের আলোচনায় দেখেছি।
প্রাচীনকাল থেকে এখনকার কাল পর্যন্ত যোগীরা যোগকেই পরমব্রহ্ম পাওয়ার একমাত্র পথ বলেছেন। এইসব যোগীরা ‘হিন্দু’ হিসেবেই পরিচিত। আবার হিন্দুদের মধ্যেই বহু ধর্মীয় গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী রয়েছেন যাঁরা নানারকম আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে, পূজাপাঠের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর উপাসনা করেন। এই সেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে অনেকেই দেখেন বলে দাবি করেন। অনেকের উপর ঈশ্বরের ভর হয়। (ঈশ্বর বা ভূত কেউ কেউ নাকি দেখে। দু’য়ের ভরও হয়। আবার ঈশ্বর দেখতে যে সব ঈশ্বর-ভক্ত সত্যিই আগ্রহী, তাদের ঈশ্বর দেখাতে পারেন অনেক মনোবিদ বা সম্মোহন বিশেষজ্ঞরা। কী ভাবে? জানতে পড়তে পারেন ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ১ম এবং ২য় খণ্ড। ‘ঈশ্বর’ একটা বিশ্বাস, অথচ ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, তাই ঈশ্বর দেখাটা সব সময়ই মানসিক একটা বিকার। কিছু মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ চিকিৎসক, সম্মোহন বিশেষজ্ঞরা কিছু কিছু আবেগ-প্রবণ ব্যক্তির উপর সেই বিকার এনে ঈশ্বর থেকে ভূত সবই দেখাতে পারেন শুধু নয়, আবার ঈশ্বরে ভরগ্রস্তদের, ঈশ্বর দেখতে থাকা মানুষদের ঠিক করেও দিতে পারেন। এ বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।’)
বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষরা নামগানেই ভরগ্রস্ত (মনোবিজ্ঞানের মতে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত) হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় আরাধ্য দেবতাকে দেখতে পান, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এমন ভক্তও আছেন, যাঁরা অলীক অনুভব করেন যে, দেবতা তাঁর সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত হচ্ছেন। তন্ত্রে এমন মন্ত্র আছে, যা উচ্চরণে নাকি যে দেবীকে চাওয়া যায়, সেই দেবীকেই ভার্যা হিসেবে পাওয়া যায়। (এ বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ৫ম খণ্ড)।
তা’হলে এ কথা আমরা বলতে পারি—ঈশ্বর দর্শনের জন্য যোগই একমাত্র পথ বলে যা বলা হয়েছে, তা ভুল। নানা উপাসনা ধর্ম পদ্ধতিতে গভীর আস্তাশীল আবেগপ্রবণ মানুষ পুজো করতে করতে ‘ঈশ্বর’ দেখেন— যেমন দেখেছিলেন রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদরা। আবার মনোবিজ্ঞানী এবং সম্মোহনকারীও ঈশ্বর দেখাতে পারেন। এই ঈশ্বর দর্শনগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্য আছে। কিন্তু ঈশ্বরে কোনও পার্থক্য নেই। সবই অলীক দর্শন। যার অস্তিত্ব নেই, তাকে দেখা।
ধরে নিলাম, কোনও এক স্বামীজী বা মাতাজী পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষকে যোগী করে তুললেন, আশ্রমবাসী করে তুললেন। ভাবুন তো, ফলে ফসল উৎপাদন বন্ধ, পোষাক উৎপাদন বন্ধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের উৎপাদন বন্ধ, বন্ধ বিলাস দ্রব্য, বন্ধ সিনেমা-থিয়েটার-গান-নাচ-যাত্রা-পেইনটিং-ভাস্কর্য, বন্ধ টেলিভিশন, সাহিত্যচর্চা, বাস-গাড়ি-লড়ি-ট্রেন, লোকসভা থেকে বিধানসভা, পুলিশ থেকে কোর্ট, সেলট্যাক্স থেকে ইনট্যাক্স দপ্তর, দোকান-পাট-বাজার-হাট। ভাবুন তো, গভীর ভাবে ভাবুন, সবাই যোগী। না খেয়ে ন্যাংটো হয়ে শুধুই উপাসনা করে যাচ্ছেন। কেমন লাগলো চিত্রটা! আমরা সভ্যতা থেকে আবার অসভ্যতায় ফিরে যাবো? আপনার উত্তর যদি “না” হয়, সেটাকেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলুন। প্রচারের দৌলতে যোগ-ব্যবসায়ীদের সুরে সুর না মিলিয়ে নিজের বিচার শক্তিকে প্রয়োগ করে বলুন।
যোগ আমাদের স্বাভাবিক মস্তিষ্কচর্চার বিরোধী, চিন্তাচর্চার বিরোধী, প্রশ্ন তোলার বিরোধী। কোনও সৃষ্টিশীল কাজেই এইসব যোগ-চিন্তায় বিভোররা অচল। বিজ্ঞানে-শিল্পে-সাহিত্যে এমনকি প্রত্যেকটি সৃষ্টিশীল কাজে যারা নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে উজার করে দিয়েছিলেন, তাঁরা কেউ-ই ‘আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন’কে জীবনের লক্ষ্য করে নেননি। আর, নেননি বলেই নিজেরা এগিয়ে ছিলেন, সমাজকে এগিয়ে দিয়েছেন।
আজও সমাজের অগ্রগতি এইসব চিন্তশীল মানুষদের উপর
নির্ভরশীল। এঁরা সমাজবিজ্ঞানী, পুরাতত্ববিদ, ঐতিহাসিক,
ভূতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ
ইত্যাদি যাই হোন না কেন কেউ-ই ‘যোগী’ নন।
এঁরা অনেকেই মন ও শরীরকে ‘রিল্যাক্স’ করার জন্য, মস্তিষ্ক কোষকে বিশ্রাম দিয়ে আবার সতেজ করার জন্য স্ব-সম্মোহন বা ‘মেডিটেশন’ করেন। কিন্তু সেই স্বসম্মোহন বা ‘মেডিটেশন’ যোগীদের ‘মেডিটেশন’ থেকে পৃথক কিছু। এখানে মনোবিজ্ঞান আছে, ঈশ্বর নেই।
মস্তিষ্ক চর্চার কারণে অতি সক্রিয় মস্তিষ্ক কোষকে বিশ্রাম দিতে এবং সঙ্গে শরীরের কোষগুলোকে সাময়িক বিশ্রাম দিতে স্বসম্মোহন বা মেডিটেশন করা হয়। বিশ্রামের পর সতেজ মস্তিষ্ক কোষ আবার মস্তিষ্কচর্চার জন্য সতেজ হয়ে ওঠে। যোগীদের মেডিটেশনে চিন্তার চর্চাকে বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে মস্তিষ্ককোষগুলো নানারকম অস্বাভাবিক আচরণ করে। ফলে তাঁরা অনেকেই ঈশ্বর দেখেন, ঈশ্বরের বানী শোনেন, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলেন ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে (observation) ওরা মানসিক রোগী। ঠিকমতো মানসিক চিকিৎসা হলে এই ধরনের মানসিক রোগ সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মনোবিজ্ঞান এবং মনোরোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এইসব ঈশ্বর দেখার মতো ভ্রান্ত অনুভূতিকে বলা হয় ইলিউশন’ (illusion), ‘হ্যালিউসিনেশন’ (hallucination), ‘ডেলিউশন’ (delusion) এবং প্যারানয়রা (paranoia)।
ইলিউশন হচ্ছে—প্রকৃতপক্ষে যা, তাকে সেইভাবে উপলব্ধি না করা। দেখছি কালীঠাকুরের মূর্তি, কৃষ্ণের ছবি বা কোনও মাতাজীর ছবি। একমনে দিনের পর দিন দেখছি। এবং আমার আবেগ ভাবছে, মূর্তি বা ছবি নড়ে-চড়ে জীবন্ত হয়ে উঠবে। একসময় আমি যেমনটা গভীরভাবে ভাবছি, তেমনটাই দেখলাম। মাতাজী বা মাকালী নড়ে-চড়ে উঠলেন, অথবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এই ভ্রান্ত অনুভূতিকেই বলে ইলিউশন। আসলে মাতাজীর ছবি বা কালীমূর্তিকে হয়তো নাড়িয়েছে টিকটিকি বা ইঁদুর। নাড়লে ছবি নড়েছে। ছবির ঠোঁট নড়েছে। ঠোঁট নড়াই হাসি বলে অনুভব করেছি।
‘হ্যালিউসিনেশন’ কথার মানে ‘অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস থেকে অলীক ইন্দ্রিয়ানুভূতি। ধরা গেল রামবাবু মাতাজী নির্মলাদেবীর সহজযোগে গভীর বিশ্বাসী। তিনি মাতাজীর ছবির সামনে যোগে বসলেন এবং মাথায় ঠাণ্ডায় হাওয়া বয়ে যাচ্ছে এটা অনুভব করলেন। এটা অবশ্যই হ্যালিউসিনেশন। মাতাজীর ছবির সামনে সহজযোগে বসলে এমনটা হয়, এই গভীর বিশ্বাস থেকেই এই অলীক ইন্দ্রিয়ানুভূতি এসেছে ।
‘ডেলিউশন’ রোগীর মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা থাকে। যেমন, একজন ‘ডেলিউশন’ রোগী ভাবলো তার সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে হয়ে গেছে। কৃষ্ণ তার স্বামী। মীরাবাঈ থেকে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, নারী থেকে পুরুষ ভেবেছিলেন কৃষ্ণ তাঁদের স্বামী। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে তাঁদের আচরণে নানা মানসিক অসঙ্গতি দেখা দিয়েছিল।
‘প্যারানয়রা’ রোগের অর্থ—বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি। কিন্তু তারা বিশ্বাসের পিছনে সুন্দর যুক্তি সাজাতে খুব ভালোই পারেন।
ধরুন শ্যামবাবুর কথা। তিনি যোগ নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। অনেক যোগীদের কাছে গিয়েছেন যোগ শিখতে। এখন তাঁর ধ্যান-জ্ঞান যোগ সাধনা । তিনি একটা যোগ-কক্ষ তৈরি করেছেন। যোগে বসলে একসময় বুঝতে পারেন অর্থাৎ অনুভব করতে পারেন, তাঁর বীর্য ছটি চক্র অতিক্রম করে মস্তিষ্কের সহস্রদল পদ্মের কুঁড়িতে উঠেছে। ফণা মেলে থাকা সাপ ফণা গুটালো। হাজার পাঁপড়ি মেলে ফুটে উঠলো পদ্ম-কুঁড়ি। প্রতিটি পাঁপড়ির ভিন্ন ভিন্ন রঙ। পদ্মের উপর আছেন শিব-শক্তি । ঈশ্বর দর্শনের অপার আনন্দে চেতনা রহিত হয়ে গেছে। গোটা চেতনা জুড়েই শুধু আনন্দ ।
শ্যামবাবু প্যারানইয়া রোগী। ধর্ম ব্যবসায়ী নন, প্রতারক নন। এই রোগী যখন ভক্তদের মাঝে যোগের নানা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর উপলব্ধির কথা বলবেন, তখন তাঁর অনেক শিষ্য জুটে যাবেই। কারণ এখনও আমাদের সমাজের প্রথাগত শিক্ষা পাওয়া মানুষদের জ্ঞান ( wisdom)-এর লেভেল অত্যন্ত কম। মস্তিষ্ক-চর্চার অভাবেই কম।
শ্যামবাবুর মতো কিছু কিছু প্যারানইয়া রোগী সাধারণের চোখে ‘অবতার’ বা | ‘মহাপুরুষ’ বলে পূজিত হচ্ছে।
(ইলিউশন, হ্যালিউসিনেশন, ডেলিউশন এবং প্যারানয়য়া বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন, ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ১ম খণ্ড ) ।
আমাদের আলোচনাকে এবার গুটিয়ে নিলে দেখতে পাচ্ছি,
যোগ সাধনা শুধুমাত্র স্থবির এক তত্ত্ব নয়, মস্তিষ্ক-চিন্তা
বিরোধী তত্ত্ব নয়, মানসিক রোগী তৈরি করার
এক শক্তিশালী তত্ত্ব-ও।
প্রথম পর্বঃ মনের নিয়ন্ত্রণ
অধ্যায়ঃ এক
♦ বুদ্ধি, স্মৃতি, প্রতিভা নিয়ে বিভ্রান্তি বেচে খাচ্ছে অনেকে
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রচুর পড়েন মানে-ই মস্তিষ্কচর্চা করেন?
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্মৃতি-শক্তি ও প্রতিভা এক নয়
অধ্যায়ঃ চার
♦ জ্ঞান (wisdom) ও শিক্ষা (education) এক নয়
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ মস্তিষ্ক ও তার কিছু বৈশিষ্ট্য
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ পাভলভ-তত্ত্বে মস্তিষ্কের ‘ছক’ বা type
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছু পাল্টে যায়
অধ্যায়ঃ নয়
♦ অলজাইমারস সৃষ্টিশীল মেধায় ভয়ঙ্কর অসুখ
অধ্যায়ঃ দশ
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জিন বা বংশগতি-ই ঠিক করে মেধা-বুদ্ধি?
অধ্যায়ঃ বারো
♦ বংশগতি গবেষণা ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অগ্রগতি
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ মগজধোলাই-এর প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলেছে
দ্বিতীয় পর্বঃ ধ্যাণ-যোগ-সমাধি মেডিটেশন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘রজনীশ’ এক শিক্ষিত যোগী, বিতর্কিত নাম
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ সাত
♦ শ্রীমাতাজী নির্মলা দেবীর সহজযোগ
অধ্যায়ঃ আট
♦ রিল্যাক্সেশন, মেডিটেশন নিয়ে বাংলাদেশের যোগী মহাজাতক
অধ্যায়ঃ নয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
অধ্যায়ঃ দশ
♦ ‘মেডিটেশন’, ‘রিলাক্সেশন’, বা ‘স্বসম্মোহন’
অধ্যায়ঃ এগারো
“মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ-মেডিটেশন” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ