বিভিন্ন কালের বিভিন্ন যোগীদের যোগ তত্ত্ব বিভিন্ন রকমের। পার্থক্যটা অবশ্য শুধু কালের নয়। প্রাচীনকালেও ‘যোগ’ নিয়ে নানা যোগী ঋষির নানা মত ছিল। একালের যোগীরাও এক একজন এক এক রকমের যোগের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যোগ সাধনার পদ্ধতিতে তাই বিশাল গরমিল—এসবই আমরা আগের আলোচনা দেখেছি।
প্রাচীনকাল থেকে এখনকার কাল পর্যন্ত যোগীরা যোগকেই পরমব্রহ্ম পাওয়ার একমাত্র পথ বলেছেন। এইসব যোগীরা ‘হিন্দু’ হিসেবেই পরিচিত। আবার হিন্দুদের মধ্যেই বহু ধর্মীয় গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী রয়েছেন যাঁরা নানারকম আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে, পূজাপাঠের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর উপাসনা করেন। এবং সেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে অনেকেই দেখেন বলে দাবি করেন। অনেকের উপর ঈশ্বরের ভর হয়। (ঈশ্বর বা ভূত কেউ কেউ নাকি দেখে । দু’য়ের ভরও হয়। আবার ঈশ্বর দেখতে যেসব ঈশ্বর-ভক্ত সত্যিই আগ্রহী, তাদের ঈশ্বর দেখাতে পারেন অনেক মনোবিদ সম্মোহন বিশেষজ্ঞরা। কীভাবে? জানতে পড়তে পারেন ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ‘১ম এবং ২য় খণ্ড। ‘ঈশ্বর’ একটা বিশ্বাস অথচ ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, তাই ঈশ্বর দেখাটা সব সময়ই মানসিক একটা বিকার। কিছু মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ চিকিৎসক, সম্মোহন বিশেষজ্ঞরা কিছু কিছু আবেগ-প্রবণ ব্যক্তির উপর সেই বিকার এনে ঈশ্বর থেকে ভূত সবই দেখাতে পারেন শুধু নয়, আবার ঈশ্বরে ভরগ্রস্তদের, ঈশ্বর দেখতে থাকা মানুষদের ঠিক করেও দিতে পারেন। এ বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।’)
বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষরা নামগানেই ভরগ্রস্ত (মনোবিজ্ঞানের মতে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত) হয়ে পড়েন। সুফি সম্প্রদায়ের ভক্তরাও মাথা দুলিয়ে গান গাইতে গাইতে ভরগ্রস্ত হন। এই অবস্থায় আরাধ্য দেবতাকে দেখতে পান, আল্লাকে অনুভবে পান, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এমন ভক্তও আছেন, যাঁরা অলীক অনুভব করেন যে, দেবতা তাঁর সঙ্গে দৈহিকভাবে মিলিত হচ্ছেন। তন্ত্রে এমন মন্ত্র আছে, যা উচ্চারণে নাকি যে দেবীকে চাওয়া যায়, সেই দেবীকেই ভার্যা হিসেবে পাওয়া যায়। (এ বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ৫ম খণ্ড)।
তা’হলে এ কথা আমরা বলতে পারি—ঈশ্বর দর্শনের জন্য যোগই একমাত্র পথ বলে যা বলা হয়েছে, তা ভুল। নানা উপাসনা ধর্ম পদ্ধতিতে গভীর আস্থাশীল আবেগপ্রবণ মানুষ পুজো করতে করতে ‘ঈশ্বর’ দেখেন—যেমন দেখেছিলেন রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদরা। আবার মনোবিজ্ঞানী এবং সম্মোহনকারীও ঈশ্বর দেখাতে পারেন। এই ঈশ্বর দর্শনগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্য আছে। কিন্তু ঈশ্বরে কোনো পার্থক্য নেই। সবই অলীক দর্শন। যার অস্তিত্ব নেই, তাকে দেখা।
ধরে নিলাম, কোনো এক স্বামীজী বা মাতাজি পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষকে যোগী করে তুললেন, আশ্রমবাসী করে তুললেন। ভাবুন তো, ফলে ফসল উৎপাদন বন্ধ, পোশাক উৎপাদন বন্ধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের উৎপাদন বন্ধ, বন্ধ বিলাস দ্রব্য, বন্ধ সিনেমা-থিয়েটার-গান-নাচ-যাত্রা- পেইনটিং ভাস্কর্য, বন্ধ টেলিভিশন, সাহিত্যচর্চা, বাস- গাড়ি-লরি-ট্রেন, লোকসভা থেকে বিধানসভা, পুলিশ থেকে কোর্ট, সেলট্যাক্স থেকে ইনকামট্যাক্স দপ্তর, দোকান-পাট-বাজার-হাট সব বন্ধ। ভাবুন তো, গভীরভাবে ভাবুন, সবাই যোগী। না খেয়ে ন্যাংটো হয়ে শুধুই উপাসনা করে যাচ্ছেন। কেমন লাগল চিত্রটা ! আমরা সভ্যতা থেকে আবার অসভ্যতায় ফিরে যাবো? আপনার উত্তর যদি ‘না’ হয়, সেটাকেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলুন। প্রচারের দৌলতে যোগ-ব্যবসায়ীদের সুরে সুর না মিলিয়ে নিজের বিচার শক্তিকে প্রয়োগ করে বলুন ।
যোগ আমাদের স্বাভাবিক মস্তিষ্কচর্চার বিরোধী চিন্তাচর্চার বিরোধী, প্রশ্ন, তোলার বিরোধী কোনো সৃষ্টিশীল কাজেই এইসব যোগ-চিন্তায় বিভোররা অচল। বিজ্ঞানে-শিল্পে-সাহিত্যে এমনকি প্রত্যেকটি সৃষ্টিশীল কাজে যারা নিজেদের চিন্তা- চেতনাকে উজাড় করে দিয়েছিলেন, তাঁরা কেউ-ই ‘আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন’কে জীবনের লক্ষ্য করে নেননি। আর, নেননি বলেই নিজেরা এগিয়ে ছিলেন, সমাজকে এগিয়ে দিয়েছেন।
আজো সমাজের অগ্রগতি এইসব চিন্তাশীল মানুষদের উপর
নির্ভরশীল। এঁরা সমাজবিজ্ঞানী, পুরাতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক,
ভূতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ
ইত্যাদি যাই হোক না কেন কেউ-ই ‘
যোগী’ নন ৷
এঁরা অনেকেই মন ও শরীরকে ‘রিলাকস্’ করার জন্য, মস্তিষ্ক কোষকে বিশ্রাম দিয়ে আবার সতেজ করার জন্য স্ব-সম্মোহন বা ‘মেডিটেশন’ করেন। কিন্তু সেই স্বসম্মোহন বা ‘মেডিটেশন’ যোগীদের ‘মেডিটেশন’ থেকে পৃথক কিছু। এখানে মনোবিজ্ঞান আছে, ঈশ্বর নেই ৷
মস্তিষ্ক চর্চার কারণে অতি সক্রিয় মস্তিষ্ক কোষকে বিশ্রাম দিতে এবং সঙ্গে শরীরের কোষগুলোকে সাময়িক বিশ্রাম দিতে স্বসম্মোহন বা মেডিটেশন করা হয়। বিশ্রামের পর সতেজ মস্তিষ্ক কোষ আবার মস্তিষ্কচর্চার জন্য সতেজ হয়ে ওঠে। যোগীদের মেডিটেশনে চিন্তার চর্চাকে বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে মস্তিষ্ককোষগুলো নানারকম অস্বাভাবিক আচরণ করে। ফলে তাঁরা অনেকেই ঈশ্বর দেখেন, ঈশ্বরের বাণী শোনেন, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলেন ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে (observation) ওঁরা মানসিক রোগী। ঠিকমতো মানসিক চিকিৎসা হলে এই ধরনের মানসিক রোগ সেরে যওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মনোবিজ্ঞান এবং মনোরোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এইসব ঈশ্বর দেখার মতো ভ্রান্ত অনুভূতিকে বলা হয় ‘ইলিউশন’ (illusion), ‘হ্যালিউসিনেশন’ (hallucination), ‘ডেলিউশন’ (delusion) এবং প্যারানয়া (paranoia ) ।
ইলিউশন হচ্ছে—প্রকৃতপক্ষে যা, তাকে সেইভাবে উপলব্ধি না করা। দেখছি কালীঠাকুরের মূর্তি, কৃষ্ণের ছবি বা কোনো মাতাজির ছবি। একমনে দিনের পর দিন দেখছি। এবং আমার আবেগ ভাবছে, মূর্তি বা ছবি নড়ে-চড়ে জীবন্ত হয়ে উঠবে। একসময় আমি যেমনটা গভীরভাবে ভাবছি, তেমনটাই দেখলাম। মাতাজি বা মাকালী নড়ে-চড়ে উঠলেন অথবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এই ভ্রান্ত অনুভূতিকেই বলে ইলিউশন। আসলে মাতাজির ছবি বা কালীমূর্তিকে হয়তো নাড়িয়েছে টিকটিকি বা ইঁদুর। নাড়লে ছবি নড়েছে। ছবির ঠোঁট নড়েছে। ঠোঁট নড়াই হাসি বলে অনুভব করেছি।
‘হ্যালিউসিনেশন’ কথার মানে অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস থেকে অলীক ইন্দ্রিয়ানুভূতি। ধরা গেল রামবাবু মাতাজি নির্মলাদেবীর সহজযোগে গভীর বিশ্বাসী। তিনি মাতাজির ছবির সামনে যোগে বসলেন এবং মাথায় ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে এটা অনুভব করলেন। এটা অবশ্যই হ্যালিউসিনেশন। মাতাজির ছবির সামনে সহজযোগে বসলে এমনটা হয়, এই গভীর বিশ্বাস থেকেই এই অলীক ইন্দ্ৰিয়ানুভূতি এসেছে।
‘ডেলিউশন’ রোগীর মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা থাকে। যেমন, একজন ‘ডেলিউশন’ রোগী ভাবলো তার সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে হয়ে গেছে। কৃষ্ণ তাঁর স্বামী। মীরাবাঈ থেকে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, নারী থেকে পুরুষ অনেকেই ভেবেছিলেন কৃষ্ণ তাঁদের স্বামী। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে তাঁদের আচরণে নানা মানসিক অসঙ্গতি দেখা দিয়েছিল।
‘প্যারানয়া’ রোগের অর্থ—বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি। কিন্তু তারা বিশ্বাসের পিছনে সুন্দর যুক্তি সাজাতে খুব ভালোই পারেন ।
ধরুন শ্যামবাবুর কথা। তিনি যোগ নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। অনেক যোগীদের কাছে গিয়েছেন যোগ শিখতে। এখন তাঁর ধ্যান-জ্ঞান যোগ সাধনা। তিনি একটা যোগ- কক্ষ তৈরি করেছেন। যোগে বসলে একসময় বুঝতে পারেন অর্থাৎ অনুভব করতে পারেন, তাঁর বীর্য ছটি চক্র অতিক্রম করে মস্তিষ্কের সহস্রদল পদ্মের কুঁড়িতে উঠেছে। ফণা মেলে থাকা সাপ ফণা গুটালো। হাজার পাপড়ি মেলে ফুটে উঠলো পদ্মা-কুঁড়ি। প্রতিটি পাপড়ির ভিন্ন ভিন্ন রঙ। পদ্মের উপর আছেন শিব-শক্তি। ঈশ্বর দর্শনের অপার আনন্দে চেতনা রহিত হয়ে গেছে। গোটা চেতনা জুড়েই শুধু আনন্দ
শ্যামবাবু প্যারানইয়া রোগী। ধর্ম ব্যবসায়ী নন, প্রতারক নন। এই রোগী যখন ভক্তদের মাঝে যোগের নানা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর উপলব্ধির কথা বলবেন, তখন তাঁর অনেক শিষ্য জুটে যাবেই। কারণ এখনো আমাদের সমাজের প্রথাগত শিক্ষা পাওয়া মানুষদের জ্ঞান (wisdom)-এর লেভেল অত্যন্ত কম। মস্তিষ্ক-চর্চার অভাবেই কম ।
শ্যামবাবুর মতো কিছু কিছু প্যারানইয়া রোগী সাধারণের চোখে ‘অবতার’ বা ‘মহাপুরুষ’ বলে পূজিত হচ্ছে।
(ইলিউশন, হ্যালিউসিনেশন, ডেলিউশন এবং প্যারানয়া বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন, ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ১ম খণ্ড)।
আমাদের আলোচনাকে এবার গুটিয়ে নিলে দেখতে পাচ্ছি,
যোগ সাধনা শুধুমাত্র স্থবির এক তত্ত্ব নয়, মস্তিষ্ক-চিন্তা
বিরোধী তত্ত্ব নয়, মানসিক রোগী তৈরি
করার এক শক্তিশালী তত্ত্ব-ও৷
তা হলে ‘যোগ’ এর এত জনপ্রিয়তার কারণ কী?
পিয়ের ম্যুর ইংলন্ড থেকে এসেছেন। বছর খানেক হল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন। কেরলে “আম্মা’, কর্ণাটকে জ্যান্ত মাছ খাইয়ে হাঁপানি সারানো, সাঁইবাবার হাতসাফাই—এসবই জানেন বা প্রত্যক্ষ করেছেন। বই লিখেছেন, বিষয় ‘মিরা’ বা অলৌকিক ঘটনা। বললেন, ওদেশে ব্রিটিশ সাহেবদের মধ্যে কেউ কেউ—সাঁইবাবার ভক্ত । ওঁর পরিচিত এক সাহেব, সাঁই এর পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করেন না। সাঁইবাবা নাকি মনে মনে অলৌকিক উপায়ে ওঁকে গাইড করেন। পিয়ের বললেন, “আমার মনে হচ্ছে ভারতে গিয়ে, সাঁইবাবাকে দেখার পর থেকে সাহেবটি পাগলই হয়ে গেছে।” আরো বলল— ‘আমি জানতে চাইছিলাম, ভারতের আধ্যাত্মিকতার মূল রহস্যটা কী? কিসের জন্য পাশ্চাত্যের সচ্ছল পরিবারের মানুষজনও ভারতে এসে এত আনন্দ পায়?”
পিয়ের ম্যুরের মতে তিনি যত ঘুরছেন, যত দেখছেন—ততই বুঝছেন যে, ভারতের আধ্যাত্মিকতা মনগড়া একটা ব্যাপার । এখনো পর্যন্ত কোনো মিরা-এর দেখা পাননি। এই অল্পবয়সি যুবকটি ইন্টারনেট থেকে আমার নাম ও ফোন নম্বর জোগাড় করে সামনাসামনি সাক্ষাৎকার নিলেন। বললেন, যোগ পাশ্চাত্যে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। টেনশন থেকে মুক্তি পেতে পাশ্চাত্যের মানুষ যোগ শিখতে চাইছে। যোগ কতটা কার্যকর কে জানে? এসব জানতেই আপনার কাছে আসা।
গত পনেরো বছরে টেলিভিশন ইন্টারনেট বিপ্লব সারা পৃথিবীর মানুষকে অনেক কাছাকাছি এনে দিয়েছে। যেমন এদেশের মানুষ বিশেষত তরুণ প্রজন্ম তাদের পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চা, ফ্যাশন, জীবনযাপন-পদ্ধতি, প্রেম-বিবাহ বিষয়ক ধারণা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি সব ব্যাপারেই পাশ্চাত্যের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন (এটাকে খারাপ, ভালো যাই বলুন)। তেমনি পশ্চিমে অনেক অল্পশিক্ষিত, গ্রামের মানুষ আছেন যাঁদের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতি একটা নতুন, অজানা কিছু। তাঁরা অল্প খরচে ভারতে বেড়াতে আসতে পারেন। এখানকার স্থাপত্য, তাজমহল, আটশ বছরের পুরনো কোনারকের মন্দির তাঁদের কাছে পরম বিস্ময়কর । তাঁরা সাঁইবাবার কোটির উপর ভক্তসংখ্যা দেখে হতচকিত। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, ভারতের সাধুরা ভয়ঙ্কর রকম ক্ষমতাশীল (রাজনীতিকদের কল্যাণে প্রভাবশালীও বটে) অসাধারণ অলৌকিক শক্তিধর। আবার আমাদের এখানকার আমজনতা তাদের সাহেবপ্রীতির কারণে, সাদা চামড়ার ভক্ত দেখে ততোধিক উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এই ভাবেই চলতে থাকে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন এবং তার সঙ্গে হুজুগ, বিভ্রান্তি, ঠকানো, বোকা বানানো এবং সচেতন শোষণ প্রক্রিয়া।
এই উপরোক্ত কারণেই গত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি হিন্দু তন্ত্র, মন্ত্র, যোগের জনপ্রিয়তা। প্রোমোট করছেন ব্যবসায়ীরা, কাজে লাগাচ্ছেন এবং টিকিয়ে রাখছেন রাজনীতিকরা। মিডিয়ার প্রচার ও বিজ্ঞাপনের দৌলতে একবার একটু জনপ্রিয়তার আভাস এলেই হুড়মুড় করে প্রচার তুঙ্গে। প্রথমে তাই শুরু হয় খুব সাধারণ, মোলায়েম, হাসিখুশি চেহারার মানুষদের নিয়ে। এদের চেহারা সাধাসিধে, আচরণ হাসিখুশি, কথাবার্তা জনমুখী । লক্ষ্য করুন আম্মা, মা নির্মলা, রামদেবদের চেহারা। অত্যন্ত সাধারণ। টিভি মিডিয়া গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ায় এই পরিবর্তন। আর আগে হোমড়া-চোমড়া গুরু হতেন। রজনীশ বা মোহনানন্দের মতো হাই-ফাই গুরু এই গরিব দেশে সাধারণের মধ্যে ততটা ছাপ ফেলেননি। এইসব গুরুরা সত্যজিৎ রায়ের মহাপুরুষ ছবির বিরিঞ্চিবাবার মতো ভক্তদের মনস্তত্ত্ব বুঝে ধীরে ধীরে লাটাইয়ের সুতো ছাড়তে থাকেন। তাই এদের কথায় কিছু কিছু ভালো কথা, সত্যি তথ্যও থাকে।
আমার আগের অধ্যায়গুলো লক্ষ্য করুন। রজনীশের প্রবচনগুলোর মধ্যে প্রথম আটটি— পয়েন্ট একেবারে সত্যি এবং সেযুগে বৈপ্লবিক সত্যভাষণ। পরের পাতায়ও প্রেম-কাম- মানসিক রোগ সম্পর্কিত বক্তব্য বেশ বিজ্ঞানসম্মত। মা নির্মলার সহজযোগও বেশ সহজ। ওঁর রিল্যাকসেশানের পদ্ধতিও বেশ আরামদায়ক। কোনো কর্মব্যস্ত মানুষ বা সারা দিন সংসারের ঝক্কি সামলানো গৃহিণী যদি অন্তত আধঘণ্টা নিজের আরামের জন্য রাখেন (সে গরমজলে পা ডুবিয়েই হোক), তা হলে শরীর মন ঝরঝরে তো লাগবেই। আবার রামদেবের—বয়স হলে হালকা খাওয়া ও ঘুমের সময় ঠিক রাখা, মহাজাতকের শিথিলায়তন প্রক্রিয়া—এ সবের মধ্যেই তো কিছু সত্য ও বিজ্ঞানসম্মত ধারণা লুকিয়ে আছে। তাই এরা প্রাথমিকভাবে বেশকিছু মানুষকে প্রভাবিত করে। তারপর শুরু হয় টিভি’র কল্যাণে টাকার খেলা। শুরু হয় বিজ্ঞাপনে- বিজ্ঞাপনে মানুষকে বোকা বানানোর খেলা। যে কোনো অসুখ সারানোর প্রতিশ্রুতি। সদস্য চাঁদা ছয় অঙ্ক ছাড়ায়। আশ্রম তৈরি হয় একরের পর একর জমি নিয়ে। অতবড় মানুষ। বাব্বা। রাজনীতিকদের পোয়াবারো। সাঁইবাবা ভক্তি পড়তির দিকে, এবার রামদেবের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে আমজনতাকে গাধা-গরু বানিয়ে নিজেদের সুবিধে করে নেওয়া
সবকিছুর মূলে রয়েছে টেকনোলজির উন্নতি এবং মানুষের মনে সুপ্ত বা ব্যক্ত অলৌকিকের প্রতি আকর্ষণ। এযুগে পাশ্চাত্যেও এখনো মিরাকলে বিশ্বাস করা মানুষ কম নেই। (মনে করুন মাদার টেরেসার ঘটনা)। বুদ্ধিমান, শিক্ষিতরাও অলৌকিককে বিশ্বাস করেন এবং ‘ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন’ নামক সৃষ্টি রহস্যের কচ্ছপ-মার্কা থিয়োরি নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। তার মধ্যে স্বয়ং জর্জ বুশও আছেন ।
তাই বিজ্ঞাপনে না ভুলে, সঠিক বিজ্ঞানকে জেনে, ঠিক ভুল বেছে নেওয়ার ক্ষমতাকে বাড়াতে হবে। আমাদের ম্যাজিক-প্রীতি ও ভক্তিগদগদ হওয়ার অভ্যাস ছাড়তে হবে। এসবের মূল ভিত্তি যে ধর্মবিশ্বাস (প্রতিষ্ঠানিক উপাসনা ধর্মের প্রতি অন্ধবিশ্বাস) তাকেই আঘাত করতে হবে।
পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?
পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ
অধ্যায়ঃ এক
♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ Hysterical neurosis – Conversion type
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)
পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ