যোগ দর্শনের স্রষ্টা পতঞ্জলি নামের এক জাদু পুরোহিত। তিনি ১৯৪টি সূত্রে যোগধারাকে সংগ্রহ করে তুলে ধরেছিলেন। পতঞ্জলি তাঁর রচনার বহু পরিভাষিক শব্দার্থ বৌদ্ধতন্ত্র থেকে নিয়েছিলেন। যোগ দর্শনের সঙ্গে সাংখ্য দর্শনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যোগদানকে ‘সাংখ্য-পরিশিষ্ট’ বলা হয়। যোগ দর্শনের স্রষ্টা ও টীকাকাররা মনে করেন, যোগ দর্শনই সাংখ্য দর্শনকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে।

যোগীশ্বর যাজ্ঞবান্ধ্য যোগের আটটি অঙ্গের কথা বলেছেন, যা ‘যোগাঙ্গ’ নামে খ্যাত। এগুলো’হল (১) ‘যম’ অর্থাৎ কতকগুলো নিষেধ, (২) ‘নিয়ম’ অর্থাৎ পালনীয় বিধান, (৩) ‘আসন’ অর্থাৎ কিছু দৈহিক ব্যায়াম পদ্ধতি, (৪) ‘প্রাণায়ম’ অর্থাৎ শ্বাস- প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, (৫) ‘প্রত্যাহার’ বিষয় চিন্তা থেকে ইন্দ্রিয়কে তুলে নেওয়া, (৬) ‘ধারণা’ অর্থে একাগ্রতা, (৭) ‘ধ্যান’ বা কোনও একটি বিষয়ে চিন্তাকে গভীরভাবে স্থাপন করা, (৮) ‘সমাধি’ বাহ্যজ্ঞানহীন ধ্যান।

যোগ বিশ্বাস করে, যোগাঙ্গের আসন, প্রাণায়ম, ধ্যান, সমাধি ইত্যাদি দ্বারা বহু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। আর অষ্টাঙ্গ সিদ্ধ হলে তো কথাই নেই। যোগ সিদ্ধ হলে কী কী হয় বলার চেয়ে বলা ভালো, কী না হয়?

‘খেচরী মুদ্রা’ একটি যোগাসন পদ্ধতি। বলা হয়েছে খেচরী সাধনের দ্বারা

ব্যাধি, জরা, নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণাকে জয় করা যায়। মৃত্যুকে জয় করে

অমর হওয়া যায়। ‘যায়’ তো দৃষ্টান্ত কোথায় ?

না, কোথাও নেই।

‘খেচরী মুদ্রা’ শেখানো হয়েছে যোগের আকর গ্রন্থগুলোতে। জিভকে ভিতর দিক দিয়ে ঠেলে দুই ভ্রু’র ভিতরের দিকে দু’দণ্ড রাখতে পারলেই সিদ্ধি লাভ । না, সঙ্গে কোনও মন্ত্র মনে মনেও আওড়াতে হবে না।

মহামুদ্রা সাধনে যক্ষা ও কুঠে রোগের বিনাশ হয়। শীতল কুম্ভক আসন করলে প্লীহা ও উদররোগ, জ্বর, পিত্তবিকার বিনাশ হয়। এই আসনের বাড়তি গুণ ক্ষুধা, তৃষ্ণা থাকে না। বিষাক্ত সাপ শরীরে বিষ ঢাললেও তা কাজ করে না। কোনও যোগী রাজি হবেন নাকি এমন একটা পরীক্ষা দিতে? আসলে এইসব যোগীরা যা বলেন, তাতে নিজেরাই বিশ্বাস করেন না।। তাই পরীক্ষা দেবার মত একজন যোগীও এগিয়ে আসবেন না, জানি। শীতল কুম্ভক অবশ্য খুবই সোজা আসন। জিভকে দু’ঠোটের মাঝে রেখে ঠোঁট ও জিভ পাখির ঠোটের মত করতে হবে। এবার জিভের ফাঁক দিয়ে বায়ু টানতে হবে। বায়ু ছাড়তে হবে নাক দিয়ে ধীরে ধীরে।

কামদেব তুল্য রূপলাবণ্য লাভের উপায়ও আছে যোগের আকরগ্রন্থে। আসনটার নাম ‘সীৎকারী কুম্ভক’। সব কিছুই শীতল কুম্ভকের মতো। শুধু বায়ু টানার সময় ‘সীৎ’ ধরনের শব্দ করতে হবে। সীৎকারী কুম্ভকের বাড়তি গুণ—আলস্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা থাকে না। অষ্টাঙ্গ সিদ্ধ হলে ত্রিলোক ভ্রমণ করা যায়।

মহাদেবের নির্দেশিত দশটি মুদ্রা আয়ত্ত করতে পারলে ইচ্ছে মতো শরীরকে পরমাণুর মতো সূক্ষ্ম আকারে নিয়ে যাওয়া যায়। আকাশে ভ্রমণ করা যায়। ইচ্ছে মতো যে কোনও ক্ষমতা লাভ করা যায়।

শিব বা আদিনাথ অর্থাৎ মহাদেব চুরাশি রকমের আসনের কথা বলেছেন। তার মধ্যে চারটি আসন ‘সারস্বরূপ’ অর্থাৎ প্রধান। আসনগুলো হল—সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, সিংহাসন ও ভদ্রাসন। মুদ্রার মধ্যে খেচরী ও শব্দ উৎপাদনের মধ্যে ‘নাদ বা নাভী থেকে তুলে আনা শব্দকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।

নাসনং সিদ্ধসদৃশ্যং কুম্ভ কেবলোপমঃ ।

না খেচরীসমা মুদ্রা না নাদসদৃশো তনয়ঃ।। ৪০

নাদধ্বনি নিয়ে একটি প্রচলিত ধারণা শিকড় গেড়ে রয়েছে বিশেষ করে নায়ক, অভিনেতা ও হিন্দু উপাসনা-ধর্মের ‘পণ্ডিত’দের মধ্যে। নাদধ্বনি অর্থাৎ নাভি থেকে ধ্বনিকে তুলে আনতে পারলে তা গভীর ও লা-জবাব হয়। ‘ওঁ’ ধ্বনিকে নাভি থেকে তুলে এনে উচ্চারণ করলে ব্রহ্ম লাভ হয়। শব্দ থেকে ব্রহ্ম লাভ হয় বলেই শব্দ পরম ব্রহ্ম’ বলা হয়।

নাদধ্বনি নিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা চালু রয়েছে, সঙ্গে রয়েছে গোড়ার

গলদ। আসলে নাভি বা পেটে যে বায়ু থাকে, তাকে কখনই

স্বর-নালিতে আনা যায় না। পেটের বায়ু শুধু পায়ু

দিয়েই বের হতে পারে, যাকে

আমরা বলি ‘পাদ ।

এটাই শরীর বিজ্ঞানের কথা। আমরা কথা বলার সময় স্বরযন্ত্র দিয়ে যে বায়ু বের হয়, তা আসে ফুসফুস থেকে। উদগার উঠে আসে কণ্ঠনালি দিয়ে। স্বরনালি ও কণ্ঠনালি এক নয়। নাদধ্বনির মিথ্যে কতদিন যে সত্যিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আমাদের মাথায় চেপে থাকবে কে জানে? আমরা কবে যে ‘সবজান্তা’র ভণ্ডামী ছেড়ে সত্যি জানতে আগ্রহী হবো, কে জানে ?

error: Content is protected !!