ভারতের অতীত ও বর্তমানে গাদা-গাদা অবতারদের সম্বন্ধে শোনা যায় যে, তাঁরা নাকি একই সঙ্গে একাধিক স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শুধু রামঠাকুর বা শ্যামাপদ লাহিড়ীই নন এ যুগের অনেকের সম্বন্ধেই এই ধরনের কথা শুনেছি। আদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা অন্নদাঠাকুরের শ্যালক পরেশ চক্রবর্তীর তান্ত্রিক হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি ছিল। তিনি নিজেই আমাকে বলেছেন, একবার তাঁর এক ভক্তের জীবনের অন্তিম লগ্নে উপস্থিত থাকার জন্য ট্যাক্সিতে যাচ্ছিলেন। ট্যাক্সিতে সঙ্গী ছিলেন অসুস্থ ভক্তেরই আত্মীয়। কলকাতার বিখ্যাত যানজটে তাঁর ট্যাক্সি যায় আটকে। পরেশ চক্রবর্তী এই সময় আর একটি ধারণ করে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে তাঁর কাছে হাজির হয়ে দেখা দেন। পরে ট্যাক্সি যখন ভক্তের বাড়িতে পৌঁছায়, তখন সব শেষ। পরেশ চক্রবর্তীকে সেই মুহূর্তে আবার ঘরে ঢুকতে দেখে ভক্তের বাড়ির সকলেই অবাক হয়ে যান। আর বিস্মিত হন, যখন জানতে পারেন যে, যেই সময় তাঁরা রোগীর শিয়রে পরেশ চক্রবর্তীকে দেখেছেন সেই সময় বাস্তবিকপক্ষে তিনি ছিলেন ট্যাক্সিতে। জমাটি গল্প, সন্দেহ নেই!
আমার ভায়রা পুলিন রায় চৌধুরী ছিলেন পেশায় শিক্ষক। তাঁর বড়দা তান্ত্রিক বলে পরিচিত। তাঁর কাছে শুনেছি, তিনি একবার বিশেষ কাজে ট্রেনে যেতে যেতে মনে পড়ে আজ তাঁর বাড়িতে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাইরে থেকে আসবেন। তিনি বাস্তবে ট্রেনে ভ্রমণ করতে থাকেন এবং আরও একটি দেহ ধারণ করে বন্ধুকে সঙ্গ দেন।
আমি বলেছিলাম, “আপনি আমার সামনেই দু-জন হয়ে দেখান তো।“ তান্ত্রিক বাবাজি তারপর থেকে আমাকে এড়িয়ে চলেন।
একই লোকের দু’জায়গায় হাজির হওয়া নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন যাদুকর আলেকজান্ডার হারম্যান –এর একটি সত্যি-গল্প শোনাই। হারম্যান দিন-গ্রেট ছিলেন খেয়ালি প্রকৃতির লোক। তিনি যখন যে শহরে যাদুর খেলা দেখিয়েছেন তখন সেই শহরের লোকেরা দেখেছেন তাঁর দুটো অস্তিত্ব। কখনো শহরের থিয়েটার হলে যে’সময় যাদুর খেলা দেখিয়ে কয়েকশো লোককে অবাক করে দিয়েছেন, সেই একই সময়ে শহরের বাজারে কয়েকশো লোক তাঁকে বাজার করতে দেখেছেন। আবার কখনো একই সঙ্গে তাঁকে দেখা যাচ্ছে হলে যাদুর খেলা দেখাতে এবং ঘোড়দৌড়ের মাঠে ঘোড়ার দৌড় দেখতে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক শো বা কয়েক হাজার লোক। এসব ক্ষেত্রে শেখানো-পড়ানো মিছে কথা সুযোগ নেই। অতএব সে কালের বহু লোকই বিশ্বাস করতেন, হারম্যানের অলৌকিক ক্ষমতা আছে।
হারম্যানের কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল না। ছিল তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও উপযুক্ত সহকারী উইলিয়াম রবিনসন। পরবর্তীকালে এই রবিনসনই চ্যাং লিং সু ছদ্মনামে যাদুর জগতে এসে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যাদুকর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
অসাধারণ প্রতিভাধর দুই হারম্যান ও রবিনসনের কাঠামোয় সাদৃশ্যের সুযোগ নিয়ে তাঁরা স্টেজের বাইরেও আর এক খেলায় মেতে ছিলেন। রবিনসন নিখুঁত ছদ্মবেশে হারম্যান সেজে যখন খেলা দেখাতেন তখন হারম্যান হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। ফলে, অলৌকিক যাদুকর হিসেবে প্রচার ও পয়সা লুটেছিলেন হারম্যান ও তাঁর দল।
একই মানুষের দু’জায়গায় উপস্থিতি সম্বন্ধে যেমন স্বেচ্ছাকৃতভাবে ভুল বোঝানো সম্ভব, তেমনি আবার অনেক সময় প্রত্যক্ষদর্শীর দেখার ভুলেও এই ধরনের গুজবের সৃষ্টি হয়। কেউ সেই গুজবকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে পরিচিত হতে অসুবিধে কোথায়?
আপনি কোনো লোককে আপনার পরিচিত লোক বলে কখনো ভুল করেছেন কি? আমার চেহারার সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে এমন ব্যক্তি বৃহত্তর কলকাতাতেই থাকেন। আমরা কলেজ জীবন থেকেই শুনে আসছি, আমাকে নাকি অমুক দিন দমদম স্টেশনে দেখা গেছে। যদিও সেদিন আমি সেখানে যাইনি। এই ধরনের ভুলের স্বীকার হয়েছি গত পচিশ বছরে বোধহয় বার তিরিশেক। দিলীপ সেন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক, থাকেন দমদমের চেতনা ছিনেমা হলের পাশে। কর্মস্থল কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এককালে আনন্দবাজারে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দিলীপবাবুর ভাইয়ের বউ ও দিলীপবাবুর স্ত্রী একদিন আমার স্ত্রীকে বললেন, “প্রবীরবাবুকে কাল বিকেলে আর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে রিকশা করে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখলাম। সিনেমায় যাচ্ছিলেন নাকি?”
সেদিন সেই সময় আমি ও আমার স্ত্রী বাড়িতেই ছিলাম।
আমার এক ভায়রা সুশোভন রায় চৌধুরী একদিন আমাদের বাড়ির কাছেই আমার স্ত্রীকে বলল, “প্রবীর অত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় দৌড়ল?”
আমার স্ত্রী সীমা বলল, “ও তো বাড়িতেই রয়েছে।“
সুযোভন যথেষ্ট জোরের সঙ্গে বলল, “আমি এক্ষুনি দেখেছি ওকে ট্যাক্সি ধরতে।“
সীমাও বলল, আমি এক্ষুনি বাড়ি থেকে আসছি।“
দু’জনেই এসে হাজির হল আমি আছি কিনা দেখতে। আমি অবশ্য বাড়িতেই ছিলাম।
এই ধরনের আরও অনেক ঘটনাই আমার জীবনে ঘটেছে। শুধু আমার জীবনেই বা বলি কেন? আমাদের এক সহকর্মী বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য একদিন অফিসে এসে আমাকে বললেন, “তোমার বউকে দেখলাম মিনিবাসে। এক মিনিবাসেই এলাম।“
আমি জানালাম, “সীমা এখন জমশেদপুরে। অন্য কাউকে দেখেছেন।“
বিশ্বনাথদা বেশ কয়েকবার সীমাকে দেখেছেন, অতএব ভুল হওয়া উচিৎ নয়। বিশ্বনাথদা বললেন, “বিশ্বাস করো, যাকে দেখেছি সাএ অবিকল সীমার মতো দেখতে।“
এই ধরনের ভুল আরও অনেকের জীবনেই হয়েছে। হয়তো আপনার জীবনেও যেসব সাধুদের একাধিক জায়গায় একই সময়ে দেখা গেছে, সেগুলো যে এই ধরনের ভুল অথবা মিথ্যে প্রচার বা কৌশলমাত্র, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আমার সামনে কোন অলৌকিক ক্ষমতাধর যদি নিজেকে দু’জন হিসেবে উপস্থিত করতে পারে তবে আমার যুক্তিবাদী সব ধারনাই একান্ত মিথ্যে বলে স্বীকার করে নেব।
এটা সত্যিই দুঃখের যে, লেখাপড়া জানা বেশীরভাগই অনেক অলৌকিক গাল-গল্পকেই যাচাই না করে অথবা যুক্তি দিয়ে বিচার না করেই বিশ্বাস করে ফেলেন।
১. অধ্যায়ঃ এক
১.৩ যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার সেইসব মানুষ
২. অধ্যায়ঃ দুই
২.১ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান
২.২ শাসক শ্রেণির স্বার্থে কুসংস্কার পুষ্ট হচ্ছে
৩. অধ্যায়ঃ তিন
৩.২ বিখ্যাত মহারাজের শূন্যে ভাসা
৩.৩ ব্ল্যাক আর্ট ছাড়া সাধিকার শূন্যে ভাসা
৩.৪ লাঠিতে হাতকে বিশ্রাম দিয়ে শূন্যে ভাসা
৩.৫ বেদে-বেদেনীদের শূন্যে ভাসা
৩.৭ সাঁই বাবাঃ সাঁইবাবার অলৌকিক ঘড়ি-রহস্য
৩.১১ শূন্য থেকে হার আনলেন ও হার মানলেন সাঁই
৩.১২ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর!
৩.১৬ যে সাধকরা একই সময়ে একাধিক স্থানে হাজির ছিলেন
৩.১৭ অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার তান্ত্রিক ও সন্ন্যাসীরা
৩.২০ অবতারদের নিজদেহে রোগ গ্রহণ
৩.২৬ বকনা গরুর অলৌকিক দুধ ও মেহবেব আলি
৩.২৭ বাবা তারক ভোলার মন্দির ও শ্রীশ্রীবাসুদেব
৩.২৮ যোগে বৃষ্টি আনলেন শিববাল যোগী
৩.২৯ চন্দননগরে সাধুর মৃতকে প্রাণ-দান
৩.৩০ ভগবান শ্রীসদানন্দ দেবঠাকুর
৪. অধ্যায়ঃ চার
৫. অধ্যায় পাঁচ
৬. অধ্যায়ঃ ছয়
৬.১ হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মোহন, নির্দেশ
৭. অধ্যায়ঃ সাত
৭.২ সম্মোহনে আত্মা এলো ‘সানন্দা’য়
৭.৩ সম্মোহন নিয়ে নানা ভুল ধারণা
৮. অধ্যায়ঃ আট
৮.১ Illusion (ভ্রান্ত অনুভূতি)
৮.২ Hallucination (অলীক বিশ্বাস)
৮.৩ Delusion মোহ, অন্ধ ভ্রান্ত ধারণা
৯. অধ্যায়ঃ নয়
৯.২ ধর্মের নামে লোক ঠকাবার উপদেশ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে
৯.৩ সোমনাথ মন্দিরের অলৌকিক রহস্য
৯.৪ প্রাচীন মিশরের ধর্মস্থান রহস্য
৯.৫ কলকাতায় জীবন্ত শীতলাদেবী ও মা দুর্গা
৯.৭ খেজুরতলার মাটি সারায় যত রোগ
৯.১৩ বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্য
১০. অধ্যায়ঃ দশ
১১. অধ্যায়ঃ এগারো
১১.২ ডুবোজাহাজে টেলিপ্যাথির পরীক্ষা
১১.৩ টেলিপ্যাথির সাহায্যে নোটের নম্বর বলা
১১.৪ টেলিফোনে টেলিপ্যাথিঃ আয়োজক লন্ডনের ‘সানডে মিরর’
১১.৭ টেলিফোন টেলিপ্যাথির আর এক আকর্ষণীয় ঘটনা
১১.৮ এমিল উদ্যা ও রবেয়ার উদ্যা’র টেলিপ্যাথি
১১.৯ অতীন্দ্রিয় ইউরি গেলারকে নিয়ে ‘নেচার’ (Nature)-এর রিপোর্ট
১১.১০ আই আই টি-তে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও
১১.১১ তবু প্রমাণ করা যায় তেলিপ্যাথি আছে
১২. অধ্যায়ঃ বার
১২.২ নায়াগ্রা জলপ্রপাত ভেঙ্গে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী
১৩. অধ্যায়ঃ তের
১৩.২ সাধু-সন্ন্যাসীদের অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি
১৩.৩ ইউরি গেলারের অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি
১৪. অধ্যায়ঃ চোদ্দ
১৪.২ মানসিক শক্তিতে রেলগাড়ি থামানো
১৪.৪ স্টীমার বন্ধ করেছিলেন পি.সি. সরকার
১৪.৬ লিফট ও কেবল-কার দাঁড় করিয়েছিলেন ইউরি গেলার
১৪.৭ মানসিক শক্তি দিয়ে গেলারের চামচ বাঁকানো
১৪.৯ ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ –এর পরীক্ষায় ইউরি এলেন না
১৫. অধ্যায়ঃ পনের
১৬. অধ্যায়ঃ ষোল
১৬.১ অধ্যায়ঃ ভাববাদ বনাম যুক্তিবাদ বা বস্তুবাদ
১৬.২ মুক্ত চিন্তার বিরোধী ‘মনু সংহিতা’
১৬.৩ আধ্যাত্মবাদ ও যুক্তিবাদের চোখের আত্মা
১৬.৪ আত্মা, পরলোক ও জন্মান্তর বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দ
১৬.৫ স্বামী বিবেকানন্দের চোখে আত্মা
১৬.৬ আত্মা নিয়ে আরও কিছু বিশিষ্ট ভাববাদীর মত
১৬.৭ আত্মা প্রসঙ্গে চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন
১৭. অধ্যায়ঃ সতের
১৭.১ জাতিস্মররা হয় মানসিক রোগী, নয় প্রতারক
১৮. অধ্যায়ঃ আঠারো
১৮.১ জাতিস্মর তদন্ত-১: দোলনচাঁপা
১৮.২ জাতিস্মর তদন্ত ২: জ্ঞানতিলক
১৮.৩ জাতিস্মর তদন্ত ৩: ফ্রান্সিস পুনর্জন্ম
১৮.৪ জাতিস্মর তদন্ত ৪: সুনীল দত্ত সাক্সেনা
১৮.৬ জাতিস্মর তদন্ত ৬: কলকাতায় জাতিস্মর
১৯. অধ্যায়ঃ ঊনিশ
১৯.২ উনিশ শতকের দুই সেরা মিডিয়া ও দুই জাদুকর
১৯.৩ প্ল্যানচেটের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
১৯.৪ স্বামী অভেদানন্দ ও প্রেত-বৈঠক
১৯.৫ বন্ধনমুক্তির খেলায় ভারতীয় জাদুকর
১৯.৬ রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা
২০. অধ্যায়ঃ বিশ
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ১ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ