বাংলা ভাষার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সাপ্তাহিক ‘পরিবর্তন’ –এর ১৬ মে ১৯৭৯-র সংখ্যাটি আর এক ঝড় তুলল। অলৌকিকে ও ঈশ্বর-মাহাত্ম্যে বিশ্বাসীরা পরিবর্তনে প্রকাশিত সংবাদ পাঠে যেমন আপ্লুত হলেন, তেমনি যুক্তিবাদীরা হলেন হতচকিত। সংবাদটির শিরোনাম ছিল, ‘আঙ্গুলের ছোঁয়ায় যে পাথর শূন্যে ভাসে’। প্রতিবেদক শ্রীবিকাশ লিখেছেন, পুণের ২০ কিলোমিটার দূরে এক জাগ্রত পীরের অলৌকিক দরগার কথা। এই দরগার মাজারে রয়েছে দুটি পাথর। একটির ওজন ৬০ কিলোগ্রাম ও অপরটির ওজন ৯০ কিলোগ্রাম। তারপর শ্রীবিকাশ যা লিখেছেন তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। “প্রথমটিতে ৭ জন অপরটিতে ৯ জন মানুষ যদি একত্রে একটি করে আঙ্গুল ছুঁয়ে চিৎকার করে বলে, ‘কামার আলিশা দরবেশ…’ তাহলে পাথর দুটি আপনা থেকেই শূন্যে ভেস ওঠে। পাথর শূন্যে ভেসে থাকে আঙ্গুলগুলি স্পর্শ করে; কিন্তু আঙ্গুলে বিন্দুমাত্র ওজন অনুভব হয় না। যতক্ষণ একটানা একশ্বাসে চিৎকার চলে, ততক্ষণ পাথর শূন্যে ভাসে। যার কন্ঠ আগে বন্ধ হয় পাথর গড়িয়ে পড়ে তারই দিকে। কেউ একজন চিৎকার না করে তাহলে পাথরটি সামান্য একটু ওপরে উঠে নীচে আছড়ে পড়ে।‘
“সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার, কামার আলিশা দরবেশের নাম ছাড়া অন্য কোন নামে বা শব্দে পাথর দুটির একটিও শূন্যে ভাসে না।“
যদিও প্রতিবেদক জানিয়েছেন এমন অলৌকিক ঘটনা, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে সক্ষম হয়নি। তবু বিজ্ঞানেরই সামান্য সাহায্য নিয়ে ও যুক্তি দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা করছি এবং সেই সঙ্গে এও জানিয়ে রাখি, কলকাতার বুকের যক্তিবাদে বিশ্বাসী, বিজ্ঞানমনস্করাই বেশ কয়েকবার কম বেশি ওই ওজনের পাথর একই পদ্ধতিতে আঙ্গুল ঠেকিয়ে শূন্যে ভাসিয়েছেন। না, তাঁরা পাথর ভাসাবার জন্য কোনও পির বা সাধু- সন্ন্যাসীর নাম উচ্চারণ করেননি।
প্রাথমিকভাবে পরিবর্তনের খবর আমাকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল। যদিও বুঝছিলাম ৯০ কেজি পাথর ৯ জনের হাতের ছোঁয়ায় উঠে থাকলে বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম অনুসারে এক একজনকে তুলতে হয়েছিল কম-বেশি ১০ কেজি ওজন। আর দ্রুত একশ্বাসে দরবেশের নাম একসঙ্গে চিৎকার করে উচ্চারণ করার মধ্যে তৈরি হচ্ছিল Impulsive force (ইম্পালসিভ ফোরস)। শ্রমিকেরা ভারি কিছু তোলার সময় ‘আউর থোডা’, ‘হেঁইয়ো’, ‘মারো জওয়ান হেঁইয়ো’ ইত্যাদি বলতে থাকে এ নিশ্চয়ই আপনারা প্রায় সকলেই দেখেছেন। ‘’হেঁইয়ো’ কথাটা সব শ্রমিককে একই সঙ্গে ইম্পালসিভ ফোরস তৈরি করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ সব শ্রমিক একই সময়ে স্থিরভাবে বল (force) প্রয়োগ না করে ‘এক ঝটকায় বল’ (Impulsive force) প্রয়োগ করে। ঝটকা দিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যে ফল পাওয়া যায় যা স্থিরভাবে শক্তি প্রয়োগের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি। ফলে বিজ্ঞানের নিয়মমাফিক বাস্তবক্ষেত্রে এক হ্যাঁচকাটানে ১০ কেজি তুলতে এক একজন ভক্তকে ২ থেকে কেজি ওজন সাধারণভাবে তোলার মতো শক্তি নিয়োগ করতে হয়।
সময় ১৯৮০-র ডিসেম্বর ইলোরা থেকে গোয়া যাওয়ার পথে পুণে নেমেছিলাম প্রধাণত কামার আলিশা দরবেশ –এর দরগা দেখতে। পুনে থেকে ২০ কিলোমিটার মতো দূরে ব্যাঙ্গালোর রোডের ওপর শিবাপুর স্টপেজে নেমে দরগায় যেতে হয়। একটা ছোট পাহাড়ের ওপর দরগা।
পরিচ্ছন্ন দরগা। মাঝখানে মাজার-ঘর, দরবেশের সমাধি। মাজারের সামনে মাটিতে রয়েছে দুটো পাথর, যার ওজন সম্বন্ধে প্রতিবেদক লিখেছিলেন ৬০ কেজি ও ৯০ কেজি। সঠিক ওজন জানার মতো কোনও ব্যবস্থা ওখানে ছিল না। দরগার ফকিরদের বলা ওজনের হিসেব না-ও হতে পারে।
মাজারে মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই, সুতরাং স্ত্রীকে বাইরে রেখেই আমি আর ছেলে পিংকি মাজারে গিয়েছিলাম। ওখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম। তারই মধ্যে কয়েকবার কিছু ভক্ত আঙ্গুল ছুঁইয়ে ছোট আর বড় দুটো পাথরই তুলবেন। ছোট পাথর তুলতে ৯ জন এবং বড় পাথর তুলতে ১১ জনের প্রয়োজন হচ্ছিল। আমি দরগার ফকিরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “শুনেছি, ছোট আর বড় পাথরটা তুলতে ৭ জন ও ৯ জনের প্রয়োজন হয়।“
ফকির বললেন, “না, ভুল শুনেছেন, ৯ জন আর ১১ জনের আঙ্গুল ছোঁয়াতে হয় পাথরের তলায়। সবাই একসঙ্গে ‘কামার আলিশা দরবেশ’ বলে যত জোরে সম্ভব একবার উচ্চারণ করুন, দেখবেন দরবেশের কৃপায় পাথর শূন্যে উঠে যাচ্ছে।“
দেখলামও বেশ কয়েকবার। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, প্রতিবার পাথরে আঙ্গুল, ছোঁয়ার সময় ভক্ত দর্শকদের চেয়ে দরগার ফকিরের সংখ্যা থাকছে বেশি।
আমি কিছুক্ষণের অপেক্ষায় আমাকে নিয়ে ৮ জন দর্শক যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ৯ জন পূর্ণ করতে আমাদের একজন ফকিরের সাহায্য নিতে হয়েছিল। আমরা ফকিরেরই সঙ্গে সুর মিলিয়ে একসঙ্গে চিৎকার করলাম ‘কামার আলিশা দরবেশ’। কথাটা উচ্ছারণ করতে আমাদের সময় লেগেছিল ১ সেকেন্ডের মতো। আমরা প্রতিটি দর্শক আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম পাথর উঠল না। অমনি আমাদের কাছে ছুটে এলো আর কয়েকজন ফকির। তারা বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কয়েকজন খারাপ লোক আছে, তাই পাথর ওঠেনি। বুঝেছিলাম, ক্ষিপ্রতা আসলে অভিনয়। পাথর না ওঠার কারণ যাতে দর্শকদের যাতে গ্রহণযোগ্য মনে হয়, তাই তাদের এই ছেঁদো যুক্তি সহযোগে অভিনয়। আসলে পাথর দরবেশের নামের জোরে ওঠে না। ওঠে দরগার ফকিরদের অভিজ্ঞ হাতের আঙ্গুলের ছোঁয়ায়। ফকিরদের হাতের হ্যাঁচকায় পাথর ওঠে পাথর উঠতে থাকার স্থায়িত্বকাল দরবেশের নাম উচ্চারিত হওয়া পর্যন্ত এবং সেটা দেড় সেকেন্ডের মতো, Impulsive force প্রয়োগ করার সময় পর্যন্ত। অন্ধ-ভক্তেরা ধরে নেন পাথর উঠল তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় ও দরবেশের নামের জোরে।
প্রতিবেদক লিখেছেন, “আঙ্গুলে বিন্দুমাত্র ওজন অনুভব হয় না।“ আমি পরীক্ষা করে ও যারা তুলেছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি, স্বল্প হলেও প্রত্যেকেই ওজন অনুভব করেছেন। বুঝেছি মস্তিষ্কের কোষগুলো স্বাভাবিক থাকলে প্রত্যেকেই ওজন অনুভব করবেন।
প্রতিবেদক লিখেছেন, “সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার; কামার আলিশা দরবেশের নাম ছাড়া অন্য কোন নামে বা শব্দে পাথর দুটির একটিও শূন্যে ভাসে না।“
তাহলে শ্রীবিকাশের পক্ষে আরও আশ্চর্য হওয়ার মতো একটি খবর দিই, কলকাতার যুক্তিবাদীরা একাধিকবার এই ধরনের পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, ৯ জনের আঙ্গুলের ছোঁয়ায় Impulsive force ব্যবহার করে ৫০ কেজি পাথর তোলা যায়, যাকে প্রতিবেদকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় –‘পাথর ভাসানো’ যায়। আরও একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখি। যক্তিবাদীরা পাথর তোলার সময় চেঁচিয়েছিলেন ঠিকই, তবে ভুলেও কোন অবতারের নাম নিয়ে নয়।
আমি মাজারে দুটি পাথর তোলার ক্ষেত্রেই একাধিকবার আঙ্গুল ছুঁইয়েছি। ‘কামার আলিশা দরবেশ’ উচ্চারণ করার বদলে একই সুরে অন্য কথা উচ্চারণ করে পরীক্ষা চালিয়েছি। কিন্তু আমার দিকে পাথর গড়িয়ে পড়েনি। প্রতিবেদক নিজেই অথবা যে কেউ আমার কথার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।