যুক্তি উনিশঃ এই যে বেশ কিছু লক্ষ মানুষের মধ্যে একজন লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পাচ্ছেন, ঠিক তিনিই কি করে পাচ্ছেন? এটা কী ভাগ্য নয়? বিমান দুর্ঘটনা হচ্ছে, নৌকেডুবি হচ্ছে, আরো নানা বড় আকারের দুর্ঘটনায় এই যে অনেকে মরছে, অথচ তার মধ্যেই কেউ কেউ কি করে বাঁচছে? এটা কী ভাগ্য নয়? যুক্তিবাদীরা এই বিষয়ে কোনও যুক্তি হাজির করতে পারবেন কী ? (এই প্রশ্নটি আজ অনেক জ্যোতিষীদের কাছেই যুক্তিবাদীদের আঘাত হানার প্রশ্ন-বাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেক সাধারণ মানুষও এমন প্রশ্নে বিভ্রান্ত হন।)

বিরুদ্ধ যুক্তিঃ এমন লটারি জেতা ‘ভাগ্য’ বা দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া ‘ভাগ্য’-র সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য’-র স্পষ্ট একটা পার্থক্য আছে। লটারি (তা সে পাড়ার ক্লাবের লটারিই হোক বা কোটি কোটি টাকা বাজেটের লটারিই হোক) হলেই তাতে একটা নম্বর প্রথম পুরষ্কার দেবার জন্য তোলা হবেই। বহুর মধ্যে থেকে কয়েকটি নম্বর তুলে সেইসব নম্বরের টিকিক মালিকদের পুরষ্কৃত করার ওপরই লটারি ব্যবসা দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্ৰথম পুরষ্কার এমনিই একটি তোলা নম্বর। এই তোলা টিকিটের একজন ক্রেতা থাকবেই । তাকেই দেওয়া হবে প্রথম পুরষ্কারটি। এটি একটি পদ্ধতির মাধ্যমে বেড়িয়ে আসা ঘটনা মাত্র । অর্থাৎ, মোদ্দা কথায় স্রেফ, একটি ঘটনা মাত্র। এর বেশি কিছুই নয়। যত বেশি বেশি কবে নতুন নতুন লটারি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠবে ততই বেশি বেশি করে মানুষ এই সব লটারির পুরষ্কারও পেতে থাকবে। জ্যোতিষীদের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়- ততই বেশি বেশি করে মানুষ এমন লটারি বিজেতার ‘ভাগ্য’ অর্জন করবে। লটারি ব্যবসা, ঘোড়- দৌড় ইত্যাদি জুয়া যত দিন থাকবে, ততদিন বিজেতাও থাকবেই। আইনের খোঁচায় লটারি ব্যবসা বন্ধ হলেই লটারি পাওয়া ভাগ্যবান সৃষ্টির ক্ষমতাও গ্রহ-নক্ষত্র বা ঈশ্বরদের লুপ্ত হয়ে যাবে। আইনের কাছে ওইসব ‘ভাগ্য নিযন্ত্রা’দের ক্ষমতা এতই সীমাবদ্ধ ।

বিমান অ্যাকসিডেন্ট বা যে কোনও অ্যাকসিডেন্টের পেছনেই থাকে অবশ্যই কিছু কারণ । বিমান তৈরির কারিগরিগত ত্রুটি বা ওই মডেলের বিমান চালনার বিষয়ে চালকের ট্রেনিংগত ত্রুটি, অথবা অন্তর্ঘাত, কিংবা দুর্যোগ, অথবা বিমান আকাশে ওড়ার আগে পরীক্ষাগত ত্রুটি ইত্যাদি এক বা একাধিক কারণ দূর্ঘটনার জন্য দায়ি হতেই পারে। দূর্ঘটনা হলে সকলেই মারা যাবে, এমনটা সবক্ষেত্রেই ঘটবে ভাবার মত কোনও কারণ নেই। এ-ক্ষেত্রে দূর্ঘটনার ব্যাপকতার অবশ্যই একটি ভূমিকা রয়েছে। বিমান বিস্ফোরণে আকাশেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লে একটি যাত্রীকেও বাঁচাবার ক্ষমতা কোনও গ্রহ-নক্ষত্রের হবে না । দূর্ঘটনায় বিমানের কোনও একটি বিশেষ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে অংশের যাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার এমন কি মৃত্যু হবার সম্ভাবনাও বাড়বে। বিমানের কোনও অংশ কম ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা অক্ষত থাকলে, সেই অঞ্চলের যাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনাও কম থাকবে। এরই পাশাপাশি দূর্ঘটনার মুহূর্তে যাত্রীর কোমরে বেল্ট বাঁধা ছিল কি না, যাত্রীর থেকে বাইরে বেরোবার দরজা কতটা দূরে ছিল, যাত্রী সেই সময় কোথায় কি ভাবে অবস্থান করছিল, এবং আরও বহুতর কারণই যাত্রীর মৃত্যু হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এবং এগুলোও নেহাৎই ঘটনা বই কিছুই নয়।

নৌকোডুবি হচ্ছে; মানুষ মরছে। নৌকাডুবির পেছনে ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস যেমন বহুক্ষেত্রেই একটি কারণ, তেমনই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহনই প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্তত আমাদের দেশে। প্রশাসনের গাফিলতি, অপ্রতুল পরিবহণ ব্যবস্থা জন্য যাত্রীরা প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়েই নৌকোয় উঠতে বাধ্য হন। অনেক সময়ই নির্ধারিত যাত্রীর দেড়-দু’গুণ যাত্রী ওই সব নৌকো বহন করে। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটে। কেউ বাঁচেন, অনেকেই মারা যান। কিন্তু এই পরিবহণগত সমস্যা মেটাবার ব্যবস্থা যদি প্রসাশন করে এবং শক্ত হাতে যাত্রী বহনের ক্ষেত্রে নৌকোগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করে, তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেশি যাত্রীবহনের জন্য নৌকোডুবিতে মারা যাওয়া ও বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ‘ভাগ্য’ পাল্টে যেতে বাধ্য। তখন ওই গ্রহ-নক্ষত্রদের কেন, তাদের বাপ-ঠাকুরদাদেরও সাধ্য হবে না, নৌকাডুবিজনিত বাঁচা-মরা নিয়ন্ত্রণ করা— কারণ নৌকেই তো তখন ডুববে না।

কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য’ অবশ্যই অন্য কিছু। সে ভাগ্য হঠাৎ লটারি পাওয়া বা দূর্ঘটনায় পড়ে বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার একটি ঘটনা মাত্র নয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের ‘ভাগ্য’—মানুষের পূর্বনির্ধারিত জীবন।

জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে প্রধান যুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম। এর বাইরেও কিছু কিছু থেকে গেছে, যেগুলো গুরুত্বহীন ও অত্যন্ত জোলো অথবা এখনও আমি সেইসব যুক্তিগুলো শুনিনি, তাই আলোচনায় আসেনি। এই আক্রমণের পর জ্যোতিষীরা নিশ্চয়ই নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে না। চেষ্টা করবে আবারও নতুন কোনও প্রতারণামূলক যুক্তি খুঁজে বের করতে। তেমন কোনও যুক্তি হাজির হলে বিরুদ্ধ যুক্তি অবশ্যই হাজির করব, অঙ্গীকারবদ্ধ রইলাম । এই লেখার বাইরে জ্যোতিষীদের হাজির করা কোনও বিরুদ্ধ-যুক্তি আপনারা জানতে চাইলে নিশ্চয়ই দেব। শুধু অনুরোধ, চিঠি জবাবী খাম সহ পাঠাবেন।

error: Content is protected !!