যুক্তি বারোঃ কোনও বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণের তিনিই শুধু অধিকারী হতে পারেন, যিনি সেই বিষয়ে সুপণ্ডিত। পদার্থবিদ্যার পরীক্ষা নিতে পারেন শুধুমাত্র একজন পদার্থবিদ্যায় পণ্ডিত মানুষ। একজন রসায়নবিদ কী পারেন পদার্থবিদ্যার পরীক্ষা নিতে? না, পারেন না। এই একই যুক্তিতে জ্যোতিষশাস্ত্রের পরীক্ষা তাঁরাই নিতে পারেন, যাঁরা জ্যোতিষ-শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। আজকাল এক নতুন বিপত্তি দেখা দিয়েছে নব্য কিছু যুক্তিবাদীদের নিয়ে। তারা যেখানে-সেখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছে “কয়েকজনের জন্ম সময় বা হাত দেখতে দিচ্ছি, সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করলে স্বীকার করে নেব জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান!” ওইসব যুক্তিবাদীদের স্বীকার বা অস্বীকারের ওপর জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান কী, বিজ্ঞান নয়-তার মীমাংসা নির্ভর করে না। জ্যোতিষশাস্ত্রকে এভাবে পরীক্ষা করতে চাওয়ার কোনও অধিকারই যুক্তিবাদীদের নেই। আবারও বলি অতি যুক্তিসঙ্গতভাবেই জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা পরীক্ষার একমাত্র অধিকারী জ্যোতিষীরাই।
বিরুদ্ধ যুক্তিঃ বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিস্তার লাভ করেছে বিজ্ঞানের বহু শাখা- প্রশাখার । মহাকাশবিজ্ঞানী, রকেটবিজ্ঞানী, কম্পিউটরবিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, প্রত্যেকেই তাঁর শাখার বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী বলে সেই বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণের অধিকারী হলেও, অন্য শাখায় বিশেষ জ্ঞান না রাখলে সেই শাখার পরীক্ষক হিসেবে অচল, এটা অতি সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা যায়।
এই যুক্তির ওপর নির্ভর করে জ্যোতিষীরা দাবি রেখেছেন, জ্যোতিষ শাস্ত্রের পরীক্ষা নেওয়ার একমাত্র অধিকারী জ্যোতিষীরাই; অন্য কেউ নয়। বেশ সুন্দর যুক্তি। এই একই যুক্তির ওপব নির্ভর করে অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারও নিশ্চয়ই দাবি তুলতে পারে, তাদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে কিনা, এ-পরীক্ষা গ্রহণের অধিকার শুধুমাত্র অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীদেরই ।
অলৌকিক ক্ষমতাও আবার নানা ধরনের ; কেউ শূন্যে ভাসে, কেউ শূন্য থেকে বস্তু সৃষ্টি করে, কেউ জলে হাঁটে, কেউ মৃতে প্রাণ দান করে, কেউ রোগমুক্ত করে, কেউ অলৌকিক দৃষ্টিতে সব কিছুই দেখতে পায়-দৃশ্য-অদৃশ্য, ভূত-ভবিষ্যৎ সবই। এমনি নানা অলৌকিক ক্ষমতার কোনও সীমা পরিসীমা নেই। ওরাও নিশ্চয়ই এই একই যুক্তিতে বলতেই পারে—শূন্যে ভাসার ক্ষমতা আছে কিনা, তা আমরা সাধারণ মানুষকে দেখাব না, তারা পরীক্ষা নেবার কে ? আমার শূন্যে ভাসার ক্ষমতার পরীক্ষা নেবার অধিকারী একমাত্র সেই, যে শূন্যে ভাসতে পারে ।” একই ভাবে মৃতকে প্রাণ-দান করার ক্ষমতার অধিকারী দাবি করে বসবে- “বাসি মরাকে যদি আমি বাঁচিয়ে তুলিও, তোমরা কি করে বুঝবে ওকে বাঁচিয়েছি ? তোমরা বলার কে— ‘মরাটাকে বাঁচিয়ে দেখিয়ে দাও তোমার অলৌকিক ক্ষমতা।’ আমার এই ক্ষমতা যে আছে সে শুধু বুঝতে পারবে তারাই, যারা মন্ত্রে মরা বাঁচায়।” তারপর কোন এক বাবা এসে হেঁকে বসবে, “আমি শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারি গোটা একটা জাম্বো জেট প্লেন।” সেই সময় কোনও মানুষ (তার মধ্যে জ্যোতিষীও থাকতে পারে) আহম্মকের মত যদি বলে বসে, “করুন তো, করুন তো।” তখন ওই বাবা মৃদু হেসে যদি বলে বসে, “বস আমি এক্ষুনি এই মাঠটায় একটি বিশাল জাম্বো জেট তৈরি করে হাজির করলেও তোমরা কি করে বুঝবে যে আমি সত্যিই একটা পেল্লাই এরোপ্লেন তৈরি করেছি ? এটা তোমাদের বোঝার কম্মো নয়। বুঝবে শুধু তারাই, যারা আমারই মত মস্তবে প্লেন তৈরি করতে পারে।” শুনে মানুষটি নিশ্চয়ই বলবে, “ব্যাটা হয় পাগল, নয় বুজরুক।” কিন্তু ওই বাবার এই কথা শুনে জোতিষী কী বলবে ? জানার ইচ্ছে রইল ।
আরও এক ধরনের সমস্যা এমন যুক্তি সূত্র ধরে হাজির হতে পারে। সমাধানের উপায় আমার জানা নেই। জ্যোতিষীদের হাতে অবশ্যই আছে ভরসায় এখানে তুলে দিলাম—
গোপালবাবু নরম-সরম, ভোলা- ভালা চেহারার অতি দুষ্ট লোক। পাড়ার জ্যোতিষী গৌতমশ্রীর বাড়িতে গৌতমন্ত্রীর সঙ্গে গোপালবাবুর একদিন বেজায় তর্ক বেধে গেল জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে। গোপালবাবু বললেন, “বেশ তো, আপনাকে কয়েকজনের জন্ম সময় দিচ্ছি, হাত দেখতে দিচ্ছি। আপনি ওদের আগামী এক বছরের কয়েকটা ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করুন। মিলে গেলে নিশ্চয়ই স্বীকার করব, জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান । ”
গৌতমশ্রী বললেন, “আপনাকে কেন বলব মশাই ? আপনার কাছে পরীক্ষাই বা দেব কেন ? ঠিক বলছি কি ভুল বলছি, আপনি কি কিছু বুঝবেন ? পরীক্ষা নেওয়ার অধিকারী সে, যার জ্যোতিষ বিষয়ে জ্ঞান আছে; যে বুঝবে। আপনি মশাই ফালতু পাবলিক; ঘোর নাস্তিক।”
গোপালবাবু জিব কেটে বললেন, “ছি, ছি, কি যে বলেন মশাই ; নাস্তিক হতে যাব কোন দুঃখে ? আমার নিজেরই দস্তুর মত অলৌকিক ক্ষমতা আছে। যে কোনও লোককে মন্ত্র পড়ে পাঁঠা বানিয়ে দিতে পারি।”
“তাই নাকি ? তা দিন না মশাই আমাকেই পাঁঠা বানিয়ে। স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দিচ্ছি, এর জন্য আপনাকে দায়ী করব না।”
গোপালবাবু একগাল হেসে বললেন, “আপনাকে আর পাঁঠা বানাব কী ? আপনি তো মশাই পাঁঠাই; তা না হলে যে ক্ষমতা আপনার নেই সে বিষয়ে পরীক্ষা নিতে চান ? আমার পরীক্ষা নেবে সে, যে মন্ত্রে মানুষকে পাঁঠা বানাতে পারে।”
পাড়ার কয়েকজন ভদ্রলোক বসে গোপালবাবু ও গৌতমত্রীর কলহ শুনে আমোদ পাচ্ছিলেন; তাঁদের একজন হলেন বলরামবাবু। বলরামবাবু উঠে নিপাট গলায় বললেন, “আমারও ওই ক্ষমতাটা আছে। আমি কালই পরীক্ষা নিয়ে জানিয়ে দেব গোপালবাবুর সত্যিই পাঁঠা বানাবার ক্ষমতা আছে কিনা। আজকের মত কলহ মুলতুবি থাক।
পথের দিন বলরামবাবু ও গোপালবাবু ঢুকলেন জ্যোতিষ সম্রাট গৌতমশ্রীর জ্যোতিষ গবেষণালয় অর্থাৎ বাড়িতে। বলরামবাবুর কোলে একটা কুচকুচে কাল নধর পাঁঠা। ওদের দেখে গৌতমশ্রী হেঁকে উঠলেন, “পাঁঠা নিয়ে এলেন কেন ? এবার ওটাকে আবার মানুষ করবেন নাকি ?”
বলরামবাবু বললেন, “না মশাই। এটা কাল রাত পর্যন্ত মানুষই ছিল। গোপলবাবু ওকে পাঁঠা বানিয়ে দিয়েছেন।”
গৌতমশ্রী দুই খচ্চরের কারবার দেখে বেজায় চটলেও জুতসই উত্তর দিতে পারেন নি । অন্য কোনও জ্যোতিষীর এর উত্তর জানা থাকলে অনুগ্রহ করে তিনি গৌতমশ্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে উত্তরটা জানিয়ে দিয়ে তাঁকে এই ঘোর সঙ্কট থেকে উদ্ধার করবেন।
জ্যোতিষীরা বিজ্ঞানের কাছে জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা প্রমাণের পরই শুধু দাবি করতে পারেন, “জ্যোতিষশাস্ত্রের পরীক্ষা নেবেন জ্যোতিষীরা।” তখন জ্যোতিষশাস্ত্রের নানা গণনা পদ্ধতি শিক্ষার্থী জ্যোতিষীদের সঠিকভাবে জানা আছে কিনা পরীক্ষা নিয়ে তবেই বিশেষজ্ঞ জ্যোতিষীরা মত প্রকাশ করবেন শিক্ষার্থীটি পাশ কী ফেল । কিন্তু এমন দাবি করার আগে জ্যোতিষীদের অবশ্যই প্রমাণ করত হবে জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে বাস্তবিকই মানুষের জীবনের পল-অণুপলের প্রতিটি ভবিষ্যৎ ঘটনাই বলে দেওয়া সম্ভব। জ্যোতিষীরা সঠিক বলেছেন কিনা, জানার জন্য জ্যোতিষশাস্ত্র জানার সামান্যতম প্রয়োজন তো দেখি না। ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে জাতকের জীবনের ঘটনাগুলো মেলালেই অতি স্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব—ভাগ্য গণনা মিলেছে, কি মেলেনি। জ্যোতিষী যদি বলেন, আজ থেকে পাঁচ দিনের মাথায় আপনার হাত ভাঙবে, এবং বাস্তবিকই যদি আপনার হাতটি ওই পাঁচ দিনের মাথায় ভেঙে যায় তবে অতি সাধারণবুদ্ধির মানুষও মানবে জ্যোতিষীর এই ভবিষ্যদ্বাণীটি ঠিক হয়েছে। ভবিষ্যদ্বাণী মিলেছে কিনা, সেটা জানার জন্য জ্যোতিষশাস্ত্রে পণ্ডিত হওয়ার তো কোনই প্রয়োজন দেখি না, যুক্তির বিচারে। জ্যোতিষীরা এমন কুযুক্তির আমদানী করেছেন অতি সম্প্রতি। আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে নিশ্চিত পরাজয় জেনে চ্যালেঞ্জ এড়াতেই এই দুর্বল অজুহাতের সৃষ্টি।