নিত্য আত্মা ছাড়া জাতিস্মর হয় না

 

চাল ছাড়া ভাত হয় না

আটা ছাড়া রুটি

নিত্য আত্মা ছাড়া জাতিস্মর হয় না

এ’কথাটা খাঁটি।

এই ছড়াটি রামকৃষ্ণ মিশনের এক ছাত্র আমাকে পাঠিয়ে ছড়ার তলায় লিখেছিলেন, “জাতিস্মরের অস্তিত্বই প্রমাণ করে আত্মা নিত্য, শাশ্বত, অমর”।

হ্যাঁ, সত্যি ! খুব প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান কথাটি লিখিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন পত্র-লেখক। জাতিস্মরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে যেমন আত্মার অমরত্ব প্রমাণিত হয়; তেমনই আত্মা অমর নয় প্রমাণিত হলেও জাতিস্মরের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।

আত্মা সম্বন্ধে গীতায় বলা হয়েছেঃ

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ

নায়ং ভুত্বা ভবিতা বা ন ভুয়ঃ

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঃয়েং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।

অর্থাৎ, ইনি (আত্মা) কখনো জন্মান না বা মরেন না, অথবা একবার জন্মগ্রহণ করে আবার জন্মাবেন না, -এমনও নয়; ইনি জন্মহীন, নিত্য, অক্ষয়, অনাদি; শরীর হত হলেও আত্মা হত হয় না।

এই অবস্থায় জাতিস্মরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব নিয়ে  মাথা ঘামানোর আগে আত্মা বলতে বিভিন্ন ধর্মমত কি বলেছে, আত্মাকে কি সংজ্ঞায় বাঁধা হয়েছে, আত্মার একাধিক জন্মের বিশ্বাস প্রসঙ্গে অন্যান্য ধর্মমতগুলোই বা কি বলে, এ’গুলো জেনে নেওয়া খুবই জরুরি। জরুরি ভাবার কারণ কি? সেটা একটু তলিয়ে দেখা যাক।

যে কোনও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালাবার প্রথম পর্যায়ের নাম হাইপোথিসিস (Hypothesis) বা প্রকল্প ; অর্থাৎ প্রমাণার্থে যা সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। এইডস রোগের শারীরিক অস্তিত্বকে সত্য বলে ধরে নিয়ে বৈজ্ঞানিকরা এই রোগের কারণ অনুসন্ধান করে চলেছেন। চরিত্রটা এখনও স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেনি। কারণ খুঁজে পেলে তারপর শুরু হবে কারণটিকে নির্মূল করার জন্য পরবর্তী পর্যায়ের গবেষণা।

এবার মনে করুন, সরলবাবু সরল মনে সুকুমার সাহিত্য সমগ্রের পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে ‘রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা’ লাইনটা পড়েই চমকে উঠলেন। রামগরুড়ের কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন, এবার বইয়ের পাতায়  সুকুমার রায়ের আঁকা রামগরুড়ের প্রায় জীবন্ত ছবি দেখে সংশয়ে দুলে উঠলেন- এমনও হতে পারে, রামগরুড় সত্যিই আছে। সুকুমার রায় হঠাত দেখে ফেলেছিলেন এবং মনে থাকতে থাকতে এঁকে ফেলেছিলেন !

সরলবাবু তাঁর বান্ধবী বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা মুক্তমনা’র কাছে গিয়ে সংশয়ের কথা জানালেন। মুক্তমনাদেবী মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার বিষয়ে অতি সচেতন। এ’কথা জানেন- অতীতে যা প্রমাণিত সত্য ছিল না, সংশয়ের ঊর্ধ্বে ছিল না, বর্তমানে তার অনেক কিছুই প্রমাণিত সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব এক্ষুণি সরলবাবু সংশয় নিয়ে কোনও উত্তর দেওয়া ঠিক হবে না। মুক্তমনাদেবী তাঁর জীবনসঙ্গী বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী সত্যব্রতবাবুকে সবিস্তারে সমস্যাটার কথা জানালেন। এমন অদ্ভুত ও জটিল সমস্যা নিয়ে ইতিপূর্বে কেউ তাঁর কাছে আসেননি। সাত দিন, সাত রাত্তির সত্যব্রতবাবু সমস্যাটিকে নিয়ে খুব সিরিয়াসলি ভাবলেন। তারপর এই বিষয়ে পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক গবেষণা চালাবার প্রয়োজন সম্পর্কে সাতান্ন পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ চিঠি পাঠালেন সাহিত্যে কোথায় কোথায় রামগরুড়ের উপস্থিতি আছে, তার উল্লেখ ও রামগরুড়ের ছবি।

সত্যবাবুর সত্যানুসন্ধানে সাহায্য করতে ‘বাংলা সাহিত্যে রামগরুড়’ নিয়ে গবেষণার জন্য একগাদা ছাত্র-ছাত্রীকে এক মাস ধরে কাজে লাগিয়েছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক রামবাবু।

রামগরুড়ের অস্তিত্ব নিয়ে এক বছর ধরে জীব-বিজ্ঞানীদের বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধান চালানোর পর নিউইয়র্কে ডাকা আন্তর্জাতিক জীব-বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে সভাপতি ল্যাদোস্কি একশ পচানব্বই পৃষ্ঠার এক অন্তর্বর্তী রিপোর্ট পড়লেন। যার মোদ্দা কথা – পৃথিবীর একশো আঠাশটি দেশের দশ হাজার দু’শ চুরানব্বই জন জীব-বিজ্ঞানীর এক বছর ধরে সংগৃহীত তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে এমন কথা বলা যাচ্ছে না, রামগরুড়ের অস্তিত্ব অসম্ভব। এই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে আমাদের আরও ব্যাপকভাবে দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান চালাতে হবে। পৃথিবীর বহু দেশ আমাদের এই গবেষণায় যুক্ত হয়নি। তাদের প্রত্যেককে আমাদের কাজে যুক্ত করতে হবে। এবং শুধু জীব-বিজ্ঞানীদের নিয়েই এই অনুসন্ধান না চালিয়ে এই অনুসন্ধানে যুক্ত করতে হবে তামাম জিন বিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ, পুরাতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের। আমরা আমাদের সমস্যার কথা জানিয়ে পরিপূর্ণ সহযোগিতা চেয়ে উল্লিখিত চারটি বিভাগের আন্তর্জাতিক সংগঠনের সভাপতির কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। এই বিষয়ে গবেষণার জন্য ইউ.এন.ও’র কাছে আমরা তিন হাজার কোটি ডলারের সাহায্য প্রার্থনা করেছি।

বাস্তবে এমন গবেষণা নিয়ে এমন একটা বিশাল কান্ড ঘটলে স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন যে কেউ বলতেন, “যত্তো সব পাগলের কান্ড। এরপর তো তবে ঘোড়ার ডিম, ট্যাঁশ গরু, হাঁসজারু বা বকচ্ছপ নিয়েও এমন ওঁচা গবেষণার নামে সময়, প্রচেষ্টা ও অর্থের বিপুল অপচয় হতে পারে।“

কিন্তু দেখুন, রামগরুড়ের অস্তিত্বের সমস্যা নিয়ে যারা গবেষণা করছিলেন, তাঁরা প্রত্যকেই জ্ঞানী-গুণী-পরিশ্রমী। গবেষণা বা অনুসন্ধানের প্রথম পর্যায়েই, যাকে বলে হাইপোথিসিস। এমন কোনও কারণ ঘটেনি যার জন্য মনে হতে পারে, “রামগরুড় থাকলেও থাকতে পারে।“ বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে হুরী-পরীর কথাও লেখা থাকে, পরী-টরীরা যে ধরনের কান্ড ঘটায় সেই ধরনের কান্ড-টান্ডগুলো ঘটতে থাকলেও না হয় সন্দেহ করা যেতে পারে। কিন্তু এমন-ধরনের কিছুই না ঠিকঠাকভাবে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তের দিকে এগুনো সত্ত্বেও সিদ্ধান্তটা হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে- ভিত্তিহীন একটি হাইপোথিসিসকে গ্রহণ করার জন্য।

এখন প্রিয় পাঠকরা নিশ্চয় মানবেন,

আত্মার অবিনশ্বরতার স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ

না পাওয়া গেলেও জাতিস্মর নিয়ে গবেষণা চালানো,

আর ‘কাকে কান নিয়ে গেল’ শুনেই কানে হাত না দিয়ে

কাকের পিছনে ছোটা একই ব্যাপার।

এবার আসুন, আমরা দেখি আত্মার অমরত্বের স্বপক্ষে কি কি যুক্তি আছে।

error: Content is protected !!