আত্মার সংজ্ঞা নিয়ে নানা মুনির নানা মত
যে আত্মার অমরত্বেই অধ্যাত্মবাদের প্রাণ-ভ্রমরা বন্দি, সেই ‘আত্মা’ বস্তুটি কি? অথবা আদৌ সেটা বস্তু কি না ! এ’বিষয়ে অধ্যাত্মবাদের স্রষ্টা ধর্ম গুরু ও ধর্মমতগুলো কি বলছে? আসুন, সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করি।
ভারতে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসুন হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসে ‘আত্মা’ প্রসঙ্গে কি বলছে, তাই নিয়েই আলোচনা শুরু করি।
হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘উপনিষদ’ তেরটি। বিভিন্ন সময়ে এগুলো রচিত হয়েছিল। খ্রিষ্টাব্দের জন্মের ৫০০ থেকে ৪০০ বছর আগে রচিত হয়েছিল কঠ-উপনিষদ। ভগবদগীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে যে সব উপদেশ দিয়েছিলেন তার অনেক কিছুই কঠ-উপনিষদ থেকেই গ্রহণ করা হয়েছিল। এই কঠ-উপনিষদেই আছে যম ও নচিকেতা’র বিখ্যাত কাহিনী। নচিকেতা যমের কাছে গিয়েছেন। যম তখন অন্যত্র। যমের পরিবার নচিকেতাকে বিশ্রাম ও খাদ্যগ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন। যমের সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত নচিকেতা খাদ্য গ্রহণে রাজি হলেন না। তৃতীয় দিনে যম বাড়ি ফিরে অতিথি নচিকেতাকে অভুক্ত দেখে খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বর দিতে চাইলেন। নচিকেতা প্রার্থনা করলেন, “মৃত ব্যক্তির বিষয়ে মানুষের সন্দেহ থাকে। কেউ মনে করেন আত্মা আছে। কেউ মনে করেন নেই। আপনি আত্মার বিষয়ে আমাকে জ্ঞান দান করুন।” যম বললেন, “এ বিষয়ে দেবগণও সন্দিগ্ধ। একে জানা সম্ভব নয়। অতএব এ বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ না করে অন্য বর প্রার্থনা কর।”
নচিকেতা যখন বার বারই যমের অনুরোধ ঠেলে জানালেন, “এই বর ছাড়া অন্যকিছু প্রার্থনা নেই।” তখন যম নচিকেতাকে উপদেশদানে স্বীকৃত হলেন।
কঠ-উপনিষদে রথের দৃষ্টান্ত এনে আত্মার অবিনশ্বরতাকে প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছে। এবং একই সঙ্গে আত্মাকে ইন্দ্রিয়গণের চালক, অর্থাৎ মন বা চৈতন্যের চালক বলা হয়েছেঃ “আল্লা রথী, শরীর রথ স্বরূপ, ইন্দ্রিয়গণ অশ্ব, মন রশি, বুদ্ধি তার সারথি।”
এই সুর গীতাতেও লক্ষ্য করা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, সেই জ্ঞানীর জন্ম-মৃত্যু নেই, তিনি কোথা হতেও আসেননি, কোথাও হননি। ইনি জন্মাননি, শাশ্বত, প্রাচীন। শরীরের বিনাশ হলেও এর বিনাশ হয় না।”
এ’যুগের হিন্দু দার্শনিকরা যেমন নিজেদের বিচারকে নির্ভুল প্রমাণ করতে উপনিষদের দোহাই যেন, তেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদও বেদের জয়যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। এই প্রাচীন বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, “মনো বৈ ব্রহ্মোতি অমনসো হি কি স্যাৎ?” (৪/১/৬) অর্থাৎ “মনই ব্রহ্মা ; মন-হীনের কি সিদ্ধ হতে পারে?”
উপনিষদগুলির অন্যতম মৈত্রী-উপনিষদে আত্মা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “যিনি শুদ্ধ… শান্ত… শাশ্বত, অজাত… তাঁর দ্বারাই এই শরীর চেতন-রূপে থাকে।” অর্থাৎ আত্মা শুধু শাশ্বতই নয়, আত্মাত দ্বারাই চেতনার উৎপত্তি।
ঋকবেদের দশম মণ্ডলের আটান্ন সুক্তে আছেঃ
যত্তে যমং বৈবস্বতং মনো জগাম দূরকম।
তত্ত আ বর্তমায়সী ক্ষয়ায় জীবসে ।। ১
যত্তে দিবং যৎ পৃথিবীং মনো জগাম দূরকম।
তত্ত আ বর্তয়ামসী-হ ক্ষয়ায় জীবসে ।। ২
অনুবাদ করলে দাঁড়ায়ঃ
১। তোমার যে মন অতিদূরে বিবস্বনের পুত্র যমের নিকট তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি, জীবিত হয়ে ইহলোকে বাস কর।
২। তোমার যে মন অতিদূরে স্বর্গে অথবা পৃথিবীতে চলে গিয়েছে, তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি, তুমি জীবিত হয়ে ইহলোকে এসে বাস কর।
এখানে ‘মন’ও ‘আত্মা’ সমার্থক।
সাংখ্যমতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপ [সাংখ্যসূত্র ৫/৬৯] ও [সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য- ২/৪২/৪৭]
আচার্য শঙ্কর তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলেছেন, “মন হল আত্মার উপাধিস্বরূপ।”
জৈনদর্শনে বলা হয়েছে, “চৈতন্যই জীবের লক্ষণ বা আত্মার ধর্ম” [ষড়দর্শনসমুচ্চয়- পৃষ্ঠা ৫০ (চৌখাম্বা সং)]
ভাট্টমীমাংসকগণ মতে “মন সর্বত্রগামী হলেও মন হল কর্ম, কর্তা হল আত্মা।” [মণিমেয়োদয়- পৃষ্ঠা ১০২, (ত্রিবান্দ্রম সং)]
শ্রীভাষ্যকার রামানুজের মতো “আত্মা চৈতন্যস্বরূপ।” [যতীন্দ্রমতদীপিকা, পৃষ্ঠা ৯৮ (আনন্দ আশ্রম সং)]
বৌদ্ধমতে আত্মা দেহ অতিরিক্ত নয়, দেহেরই গুণ বা ধর্ম। বৌদ্ধ মতে ‘মন’ বিজ্ঞানেরই একটি রূপ। বিজ্ঞান যেমন ক্ষণিক, তেমনই ‘আত্মা’ এবং ‘মন’ও ক্ষণিক। [লঙ্গবতারসূত্র, পৃষ্ঠা ২১ (কিয়োটা সং)] এবং [সবদর্শনসংগ্রহ- বৌদ্ধ]
বুদ্ধদেব ‘আত্মা’ প্রসঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের বলেছেন, “ভিক্ষুগণ ! -আমার আত্মা যা অনুভব করছে তা আমার একান্ত নিজস্ব ভালো মন্দ অনুভূতির বিষয় ; সেখানে আমার আত্মা নিত্য=ধ্রুব=শাশ্বত=অপরিবর্তনীয়=চিরকাল ধরে তা এ’রকমই থাকবে’ -এই চিন্তা বালসুলভ মূর্খ-বিশ্বাসে পরিপূর্ণ।” [মহামালুঙ্ক্যসূত্ত, মজঝিমনিকায়, ১/১/২]
ব্রাহ্মধর্ম আত্মা প্রসঙ্গে বলেছে, “এই আমি শরীর নই, রক্ত মাংস নই, চক্ষু কর্ণ বা কোন ইদ্রিয় নই। কিন্তু আমিই চক্ষুর দ্বারা দেখি, কর্ণের দ্বারা শ্রবণ করি, শরীরের দ্বারা সমুদয় অভিপ্রেত কার্য্য সম্পন্ন করি। যে আমি এইরূপ দর্শন করি, শ্রবণ করি, চিন্তা করি, যে-আমি হিতাহিত বুঝিতেছি, যে-আমি সৌন্দর্য অনুভব করিতেছি, যে-আমি পূর্ণের দিকে যাইবার জন্য লালায়িত, সেই আমিই আত্মা।” [ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মসমাজ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, পৃষ্ঠা ৪]
অর্থাৎ ব্রাহ্মধর্ম ইদ্রিয়সমূহের চালিকা শক্তিকে আত্মা বলে চিহ্নিত করেছে।
শাক্তদর্শনে বলা হয়েছে, “মন অন্য নয়, আত্মাই মন” [ত্রিপুরারহস্যন্ত্র- ১৮/১১৭,৪৭]
যোগবাশিষ্ঠরামায়ণে বলা হয়েছে “স্বপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মাই যখন মননশক্তি ধারণ করে, তখন মন বলে অভিহিত হয়। অর্থাৎ চৈতন্য বা মনই আত্মা। [যোগবাশিষ্ঠরামায়ণ, উৎপত্তিপ্রকরণ- ১০০/১৪]
স্বামী বিবেকানন্দের মতে চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা। [বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখন্ড সং- প্রকাশক, নবপত্র, পৃষ্ঠা-১৬২]
স্বামী অভেদানন্দ তাঁর বিপু জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘মরণের পারে’তে মন বা চিন্তা অথবা চৈতন্যকেই ‘আত্মা’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আত্মা বা মন মস্তিষ্কের বহির্ভূত পদার্থ, মস্তিষ্কজাত নয়” [মরণের পারে, প্রিষ্ঠা-৯৮] তিনি এও বলেছেন – মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে ‘মন’ বা ‘আত্মা’ নামের কোনও জিনিস খুঁজে না পেলেই তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তুমি যখন বলবে, “আত্মা বলে কোন জিনিস নেই, আর এটি বলা মানেই তুমি আর একটা মন বা আত্মার অস্তিত্বকে মেনে নিলে ; কেননা তুমি যা জানছো ‘মনের বা আত্মার সত্তা নেই’ -তাও জানছ মন দিয়ে”… “যদি বলো যে, মনের বা আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই, তবে সেটা হবে কেমন- যেমন এখুনি যদি বলো যে তোমার জিহ্বা নেই। আমি কথা কইছি জিহ্বা ব্যবহার করে অথচ যদি বলো যে জিহ্বা নেই, তাহলে সেটাতে অজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া হবে।” [মরণের পারে, পৃষ্ঠা- ১০১]
আর এক অধ্যাত্মবাদী নেতা, রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী প্রজ্ঞানন্দ ‘মরণের পারে’ বইটির ভূমিকায় মনকেই আত্মা বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর ধারণায় “ইহলোক- স্থূল ইন্দ্রিয়ের রাজ্য, আর পরলোক- সূক্ষ্ম-মনের ও মানসিক সংস্কারের রাজ্য।” [পৃষ্ঠা- এগারো]
স্বামী প্রজ্ঞানন্দ আরও বলেছেন, “‘মরণের পারে’ এক রহস্যময় দেশ- যে দেশে সূর্য নাই, চন্দ্র নাই, নক্ষত্র নাই, যে দেশে স্থূল নাই, কেবলই সূক্ষ্ম-ভাবনা ও সূক্ষ্ম-চিন্তার রাজ্য। এই চিন্তার রাজ্যকেই মনোরাজ্য বা স্বপ্নরাজ্য বলে” … “মনের সেখানে বিলাস-চলা, বসা, খাওয়া, দেওয়া-নেওয়া, এই সমস্ত পরলোকবাসী জীবাত্মা ভোগ করে মনে তাই মনেরই সেটা রাজ্য, মনেরই সেটা লোক।” [ঐ বইয়েরই পৃষ্ঠা- এগার]
বহু মতের থেকে নির্যাস হিসেবে
বেরিয়ে এল প্রধাণ দু’টি মত।
একঃ চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মনই আত্মা।
দুইঃ চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন
আত্মারই কাজ-কর্মের ফল।
আসুন, পরের পর্যায়ে আমরা দেখি ‘আত্মা’কে কেমন দেখতে? এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন ধর্মগুরু ও ধর্মীয় বিশ্বাস কি বলে?
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৪র্থ খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ আত্মার রূপ নিয়ে বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি
অধ্যায়ঃ চার
♦ এ’দেশের কিছু আদিবাসী ও বিদেশের কিছু অধিবাসীদের আত্মা-চিন্তা
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘সানন্দা’র দপ্তরে প্ল্যানচেটের আসর
♦ ঘাড়ে চাপল প্ল্যানচেটের আত্মা
♦ রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা
♦ স্বামী অভেদানন্দের সামনে আত্মা লিখল শ্লেটে
♦ ভূতের ভরে পটকা মেয়েও পেয়ে যায় হাজার হাতির বল
♦ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ভূতে পাওয়া কি
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ভিড় করে আসা প্রশ্নমালার উৎপত্তি
♦ থিওজফিক্যাল সোসাইটির প্রেতচর্চা
♦ উনিশ শতকের সেরা মিডিয়ামদ্বয় ও দুই শৌখিন জাদুকর
♦ থিওজফস্টদের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
♦ থিওজফিস্টদের প্রতি লেখা বিজ্ঞানী হাক্সলের মজার চিঠি
অধ্যায়ঃ সাত
♦ যুক্তির নিরিখে ‘আত্মা’ কি অমর?
অধ্যায়ঃ আট
♦ অসাম্যের বিষবৃক্ষের মূল শিকড় অধ্যাত্মবাদ অধ্যাত্মবাদের মূল শিকড় আত্মা
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সিস্টেম’কে পুষ্ট করতেই টিনের তলোয়ার ঝন-ঝন বাজে “আত্মা থাক, কুসংস্কার দূর হোক”
♦ সমাজ কাঠামোর সিংহাসনের চারটি পায়া কারা
অধ্যায়ঃ দশ
♦ হিন্দু ছাড়া কেউ জন্মান্তর মানে না
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ আত্মার অস্তিত্বে বিশাল আঘাত হেনেছিল চার্বাক দর্শন
অধ্যায়ঃ বারো
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ তবু জাতিস্মর বার বার ঘুরে ফিরে আসে
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ জাতিস্মর কাহিনীর প্রথম পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ২ : চাকদার অগ্নিশিখা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৩ : সুনীল সাক্সেনা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৪ : যমজ জাতিস্মর রামু ও রাজু
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৫ : পুঁটি পাত্র
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৬ : গুজরাটের রাজুল
অধ্যায়ঃ পনের- জাতিস্মর কাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৭ : জ্ঞানতিলক
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৯ : ত্রিশের দশকে কলকাতায় জাতিস্মর
অধ্যায়ঃ ষোল- অবতারদের পুনর্জন্ম
♦ জাতিস্মর তদন্ত-১০ : সত্য সাঁইবাবা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ১১ : দলাই লামা
অধ্যায়ঃ সতের
♦ জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদারদের প্রতি ১৫০,০০০ টাকার চ্যালেঞ্জ