কিছু সন্ধিক্ষণ আসে যখন মানুষ যুক্তির চেয়ে আবেগকে মূল্য দেয় বেশি সেই সময় একটি মানুষ কোন্ যুক্তিকে গ্রহণ করবে এবং কোন্ যুক্তিকে বর্জন করবে- এই বিচারের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে ধর্ম, জাত-পাত, প্রাদেশিকতা, গোষ্ঠীস্বার্থ ইত্যাদি। এই আবেগকে কাজে লাগিয়েই শোষিত মানুষদের মধ্যে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা, অবিশ্বাস ও ঘৃণার বীজ বপনে পরিকল্পিতভাবে সচেষ্ট থাকে শাসক ও শোষক শ্রেণি। এই পরিকল্পনা শোষিতদের উন্মাদনার নেশায় ভুলিয়ে রাখার স্বার্থে, শোষকদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। আর তাইতেই জন্ম নেয় রামজন্মভূমি বাবরি মসজিদ সমস্যা, চাকরি ক্ষেত্রের সংরক্ষণ সমস্যার মতো সমস্যাগুলো। শোষক নিজ স্বার্থেই চায় সাধারণ মানুষ যুক্তির দ্বারা নয়, আবেগের দ্বারাই পরিচালিত হোক।
শোষক শ্রেণি কখনওই চাইতে পারে না সাধারণ মানুষের
চেতনাকে যুক্তিনিষ্ঠ করতে, বেশি দূর-পর্যন্ত
এগিয়ে নিয়ে যেতে।
এর বাইরেও আমরা ব্যক্তিস্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে অনেক সময় হৃদয়াবেগে আপ্লুত হয়ে যুক্তিছাড়া যুক্তিকে অর্থাৎ কুযুক্তিকে সমর্থন করি। যখন আমি একজন বাসকর্মী, তখন অপর কোনও বাসকর্মীর প্রতি যে কোনও কারণে আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই— তা সেই আইন ভাঙার জন্যে পুলিশ আইন সম্মত ব্যবস্থা নিলেও। যখন আমি ছাত্র, তখন আমারই সহপাঠী বিনা টিকিটে, ট্রেনে কলেজে আসার সময় গ্রেপ্তার হলেও রেলকর্মীদের হাত থেকে বন্ধুকে মুক্ত করতে স্টেশনে হামলা চালাই। আমি কখনও প্রতিবেশীর মৃত্যুতে ডাক্তারের দায়িত্বহীনতার দাবি তুলে ক্ষোভে ফেটে পড়ি। আমিই আবার হাসপাতাল-কর্মী হিসেবে ওই আক্রমণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার দাবিতে হাসপাতালের কাজকর্মকে অচল করে দিই। এই ব্যক্তিস্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত হয়ে কখনও আমরা বাঙালি, কখনও বিহারি, কখনও আসামি, কখনও অন্য কিছু। কখনও হিন্দু, কখনও মুসলমান, কখনও বা অনধর্মী। কখনও শুধুমাত্র ভিন্ন ভাষাভাষী হওয়ার অপরাধে, ভিন্ন ধর্মী হওয়ার অপরাধে, ভিন্ন রাজনৈতিকি বিশ্বাস পোষণ করায় একে অপরের জীবনধারণের অধিকার কেড়ে নিতেও দ্বিধা করি না। যুক্তিহীন আবেগই আমাকে হত্যাকারী, অত্যাচারী করে তোলে। কুযুক্তির দাস করে তোলে।
ব্যক্তি-শ্রদ্ধা থেকে বা অন্ধ-শ্রদ্ধা থেকে আমরা অনেকেই প্রশ্ন তুলি, “আমার মা নিজের চোখে অমুক অলৌকিক ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। তিনি কি তবে মিথ্যে বলেছেন?” কখনও এই প্রশ্নটাই আমরা তুলি মা-এর পরিবর্তে বাবা বা অন্য কোনও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির নাম প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে খাড়া করে। সেই সময় প্রশ্ন কর্তা আমরা মা-বাবার মতো আবেগ-আপ্লুত সম্পর্ককে টেনে এনে যে প্রশ্ন হাজির করি, প্রকারান্তরে সেগুলো অলৌকিকতাকে প্রতিষ্ঠা করারই চেষ্টা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, উত্তরদাতা যে আমাদের মা-বাবার মতো আবেগ-আপ্লুত সম্পর্ককে আঘাত হানবার জন্য একশো বার ভাববেন, এ ব্যাপারটা আমরা বেশ ভালো রকমই বুঝি। কিন্তু আমরা যেটা বুঝি না সেটা হল, মিথ্যাচারী, অসৎ, মানুষগুলোও কারো না কারো মা-বাবা-ভাই- বোন-কাকা-জেঠা ইত্যাদি। আসলে মা-বাবা হলেই শ্রদ্ধা করতে হবে— এমন আরোপিত মূল্যবোধের পিছনে বাস্তবিকই কোনও যুক্তি দেখি না। মা বা বাবা যদি দুর্নীতিপরায়ণ, ভেজালদার, শোষক, লম্পট, সমাজ-বিরোধী-রাজনীতিক ইত্যাদি হন, তবে আদর্শবান যে কোনও সন্তানই এমন মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়, বরং এমন মা-বাবার বিরোধিতা করাটাই সুস্থ চেতনাসম্পন্ন সন্তানের কাছে প্রত্যাশিত। আমরা আদর্শের পক্ষে। ব্যক্তি সম্পর্কের চেয়ে আদর্শ আমাদের কাছে অনেক বড়।
মানুষ যে ধর্ম, জাত-পাত, প্রাদেশিকতা, গোষ্ঠীস্বার্থ ইত্যাদি দ্বারাই প্রধানত পরিচালিত হয়, তার কারণ খুঁজতে যুক্তি হাতড়ালে দেখতে পাব মানুষের সামাজিক পরিবেশই তাকে এমনভাবে পরিচালিত হতে শিখিয়েছে। সমাজ আমাদের পরিচালিত করে, প্রভাবিত করে, আবার আমরা সমাজকে পরিচালিত করি, প্রভাবিত করি।
মানবজীবনে দোষ-গুণ প্রকাশে পরিবেশের প্রভাব
উন্নততর দেশগুলির মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মানবজীবনের ওপর দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বর্তমান এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন— মানুষের বংশগত সূত্রে প্রাপ্ত অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত।
আমরা যে দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াই, হাঁটি, পানীয় পশুর মতো জিভ দিয়ে গ্রহণ না করে পান করি, কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করি— এসবের কোনওটাই জন্মগত নয়। এইসব অতি সাধারণ মানব-ধর্মগুলো আমরা শিখেছি, অনুশীলন দ্বারা অর্জন করেছি। শিখিয়েছে আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোই, অর্থাৎ আমাদের সামাজিক পরিবেশ।
মানবশিশু প্রজাতিসুলভ জিনের প্রভাবে মানবধর্ম বিকশিত হওয়ার পরিপূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে অবশ্যই জন্মায়। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দেয় মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-বন্ধু, সহপাঠী, খেলার সঙ্গী, শিক্ষক, অধ্যাপক, প্রতিবেশী, পরিচিত ও আশেপাশের মানুষরা, অর্থাৎ আমাদের সামাজিক পরিবেশ।
আপনার আমার পরিবারের কোনও শিশু সভ্যতার আলো না
দেখা আন্দামানের আদিবাসী জারোয়াদের মধ্যে বেড়ে
উঠলে তার আচার-আচরণে, মেধায়
জারোয়াদেরই গড় প্রতিফলন
দেখতে পাব।
আবার একটি জারোয়া শিশুকে শিশুকাল থেকে আমাদের সামাজিক পরিবেশে মানুষ করলে দেখতে পাব শিশুটি বড় হয়ে আমাদের সমাজের আর দশটা ছেলে-মেয়ের গড় বিদ্যেবুদ্ধি ও মেধার পরিচয় দিচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন, বিগত বহু বছরের মধ্যে মানুষের শারীরবৃত্তির কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। এই কম্পিউটার যুগের আধুনিক সমাজের মানব শিশুর সঙ্গে বিশ হাজার বছর আগের ভাষাহীন, কাঁচামাংসভোজী সমাজের মানব শিশুর মধ্যে জিনগত বিশেষ কোনও পার্থক্য ছিল না। সেই আদিম যুগের শিশুকে এ-যুগের অতি উন্নততর বিজ্ঞানে অগ্রবর্তী কোনও সমাজের পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে পারলে ওই আদিম যুগের শিশুটি আধুনিকতম উন্নত সমাজের গড় মানুষদের মতোই বিদ্যে-বুদ্ধির অধিকারী হত।
একই সঙ্গে বিজ্ঞান একথাও অবশ্যই স্বীকার করে, কোনও অনুকূল পরিবেশে শিশুকাল থেকে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকানদের নিরন্ন, হতদরিদ্র মূর্খ মানুষগুলোও হতে পারত ইউরোপ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার মধ্যে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর সমকক্ষ অবশ্য ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের জন্য স্বাতন্ত্র্য নিশ্চয়ই থাকত যেমনটি এখনও আছে একই দেশের একই পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষদের মধ্যে।
কিন্তু এই কথার অর্থ এই নয় যে—বংশগতি সূত্রে প্রাপ্ত সমস্ত বৈশিষ্ট্যই পরিবেশ প্রভাবিত। আর তাই মানুষের পরিবর্তে একটি বনমানুষ বা শিম্পাঞ্জিকে শিশুকাল থেকে আমাদের সামাজিক পরিবেশে মানুষ করলেও এবং আমাদের পরিবারের শিশুর মতোই তাকেও লেখাপড়া শেখাবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালালেও তাকে আমাদের সমাজের স্বাভাবিক শিশুদের বিদ্যে, বুদ্ধি, মেধার অধিকারী করতে পারব না। কারণ, ওই বনমানুষ বা শিম্পাঞ্জির ভেতর বংশগতির ধারায় বংশানুক্রমিক গুণ না থাকায় তা অনুকূল পরিবেশ পেলেও বিকশিত হওয়া কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার সূত্র থেকে আমরা দু’টি সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম, এক : মানবগুণ-বিকাশে জিনের প্রভাব বিদ্যমান। দুই: মানুষের জিনের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত
পরিবেশকে আমরা অবশ্যই দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। একঃ প্রাকৃতিক পরিবেশ। দুইঃ সামাজিক পরিবেশ।
সামাজিক পরিবেশকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একঃ আর্থ-সামাজিক (Socio-economic) এবং দুইঃ সমাজ-সাংস্কৃতিক (Socio-cultural)।
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব আমাদের বিভিন্ন শারীরিক বিশিষ্টতা দিয়েছে। আমরা যে অঞ্চলে বাস করি তার উচ্চতা, তাপাঙ্ক, বৃষ্টিপাত, নদী, সমুদ্র, পাহাড় বা মরুভূমি ইত্যাদির প্রভাব কম-বেশি পড়েই থাকে।
সমুদ্রকূলের মানুষরা নৌ-চালনা, মাছ ধরা, মুক্তোর চাষ, সমুদ্র থেকে আহরণ করা নানা জিনিস ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এইসব সমুদ্দুর ছেঁকে তুলে আনতে যে শ্রম ও ঝুঁকির মুখোমুখি হয় তাই মানুষগুলোকে সাহসী করে তোলে। পলিতে গড়া জমির কৃষকদের চেয়ে রুখো জমির কৃষকরা অনেক বেশি পরিশ্রমী। গ্রীষ্মপ্রধান আর্দ্র অঞ্চলের মানুষদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষদের তুলনায় কম। বেঁচে থাকার সংগ্রাম মরু এবং মেরু অঞ্চলের মানুষদের করেছে কঠোর সংগ্রামী। চরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মানুষদের বেঁচে থাকার সংগ্রামেই দিন-রাতের প্রায় পুরোটা সময়ই ব্যয়িত হয়। ফলে তাদের পক্ষে বুদ্ধি ও মেধাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগ করার মতো সময়টুকু থাকে না।
আবার যে অঞ্চল পেট্রলের ওপর ভাসছে, সে অঞ্চলের মানুষদের পায়ের তলাতেই গলানো সোনা। আয়াসহীনভাবে কিছু মানুষ এত প্রাচুর্যের অধিকারী যে, ফেলে ছড়িয়েও শেষ করতে পারে না তাদের সুবিশাল আয়ের ভগ্নাংশটুকুও। ওরা শ্রম কেনে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। ফলে এই অঞ্চলের মানুষগুলো প্রকৃতির অপার দাক্ষিণ্যে ধনকুবের বনে গিয়ে ভোগসর্বস্ব হয়ে পড়ে। ফলে মানসিক প্রগতি এই অঞ্চলের মানুষদের অধরাই থেকে যায়।
প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষদের যে কোনও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। আবার খরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দীর্ঘস্থায়ী হলে বিপন্ন মানুষদের অনেকেই কষ্টকর এই চাপের মুখে মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়েন। অথবা মানসিক কারণেই রক্তচাপ বৃদ্ধি, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, আন্ত্রিক ক্ষত ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হন।
আর্থ-সামাজিক পরিবেশ
আমাদের মতো দরিদ্র ও উন্নতশীল দেশে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের প্রতিটি পদক্ষেপে যেখানে রয়েছে অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা, শোষণ, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও অত্যাচার, সেখানে মানুষের জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাব যথেষ্ট শক্তিশালী, এটা সমাজবিজ্ঞানী মাত্রই স্বীকার করেন। এখানে স্রেফ বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে নানা অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজে নামতে হয়। মেয়েদের নিজেকে বাঁচাতে, সংসারকে বাঁচাতে ইজ্জত বেচতে হয়। এদেশের বহু মানুষের কাছে বিশুদ্ধ জল পান চরম বিলাসিতা। এ-দেশে এখনও অচ্ছুতরা বর্ণহিন্দুদের কুয়ো ছোঁয়ার দুঃসাহস দেখালে ধড় থেকে মাথা যায় কাটা। হরিজন নারীকে জীবনসঙ্গিনী করার অপরাধে বর্ণহিন্দুর চাকরি যায়, বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়। রাজনীতিকের জাদুকাঠির ছোঁয়া না পেলে ঋণ-মেলায় ঋণ মেলে না। সরকারি চাকরি অধরাই থেকে যায়। চাকরির সুযোগ সীমিত, বেকার অসীম। ফলে কাজ পেতে খুঁটি ধরাই সেরা যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়। এরপরও চাকরি পাওয়া ছেলেটি ও তাদের পরিবারের সকলেই মনে করে— কাজ পাওয়াটাই বিশাল ভাগ্য, মানতের ফল, অবতারের আশীর্বাদের কেরামতি, গ্রহরত্নের ভেল্কি।
যে দেশের পঙ্গু অর্থনীতি গ্রামে গ্রামে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধে পৌঁছে দিতে পারে না, সে দেশের গ্রামবাসীরা রোগ ও মৃত্যুকে অদৃষ্টের লিখন বলে মেনে নিক— এটাই চাইবে রাষ্ট্রক্ষমতা, সরকার। আর তেমনটাই মেনে নিচ্ছে অসহায় গ্রামের মানুষরা। গরিব ঘরের মানুষদের বিনে মাইনের স্কুলে সন্তান পড়াবার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না। ঘরের ছেলে কাজে না গিয়ে স্কুলে গেলে রোজগার করবে কে? শিশু-শ্রমের ওপরও প্রায় সমস্ত দরিদ্র পরিবারকেই কিছুটা নির্ভর করতে হয়। আবার পাশাপাশি এও সত্য— আব্রু রক্ষা করে স্কুলে যাওয়ার মতো সাধারণ পোশাকটুকুও অনেকের জোটে না। পড়াশুনো ও বাইরের খবরাখবর রাখতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ যেহেতু দরিদ্রদের ক্ষেত্রে খুবই কম, তাই শুধুমাত্র এই আর্থ-সামাজিক কারণেই দরিদ্র গ্রামবাসী ও শহরের বস্তিবাসীদের মধ্যে মেধা, বুদ্ধি, মননশীলতা খুবই কম। গ্রামের কিশোরীদের চেয়ে শহরের গরিব কিশোরীদের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। এখানে একটা ঘর নামক নরকে বহু মানুষকে গাদাগাদি হয়ে ভোরের সূর্যের প্রতীক্ষা করতে হয়। ফলে অনেক সময় এরা নারী-পুরুষের গোপন ক্রিয়াকলাপ দেখে কৈশোরেই যৌন আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। আবার অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও আর্থিক নিরাপত্তা, জীবন ধারণের নিরাপত্তার জন্য পাড়ার মস্তান, কাজে নিয়োগকারী বা আত্মীয়দের লালসার শিকার হতে হয়। কৈশোরে পা দিয়েই অনেককে বেঁচে থাকার জন্য যোগ দিতে হয় নানা অবৈধ কাজে। এইসব পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো এমনতর জীবনযাত্রা ইচ্ছে করে বেছে নেয়নি, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই তাদের এমনতর জীবনযাত্রা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে।
আর্থ-সামাজিক পরিবেশ যে সাধারণ মানুষকে কী বিপুলভাবে
প্রভাবিত করে, সে বিষয়ে সাধারণত মনোবিজ্ঞানীরা মুখ
খুলতে চাননি। যখন খুলেছেন, তখন মানবজীবনে
আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাবকে লঘু
করে দেখাতে প্রয়াসী হয়েছেন।
রাষ্ট্র ও শোষকশ্রেণির দ্বারা সম্মানিত এইসব মনোবিজ্ঞানীরা তাঁদের শ্রেণি স্বার্থেই চান না, অথবা সরকার ও শোষকশ্রেণিকে তুষ্ট করার স্বার্থেই চান না, বঞ্চিত মানুষগুলো তাদের বঞ্চনার কারণ হিসেবে আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, রাষ্ট্র কাঠামোকেই দায়ী করুক।
সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ
প্রতিটি সমাজ ও তার সংস্কৃতি জন্ম থেকেই শিশুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাবেই মানবিক আচার-আচরণ, মানবিক হৃদয়বৃত্তি বিকশিত হতে থাকে। শিশুকে হাঁটতে শেখানো হয়, শিশু হাঁটতে দেখে, তাই হাঁটে। শিশু কী ভাবে হাতকে ব্যবহার করে খাদ্য গ্রহণ করবে, কী ভাষায় কথা বলবে, সবই নির্ভর করে মা-বাবা ও তার আশেপাশের আপনজনদের ওপর। শিশু যদি কোনও কারণে মানবসমাজে প্রতিপালিত না হয়ে পশু সমাজে বেড়ে ওঠে, তাহলে দেখা যাবে সে পশুর মতোই হামা দিয়ে হাঁটবে। হাতকে ব্যবহার না করে পাত্র থেকে সরাসরি মুখ দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করবে। জলপানের জন্য জিভকে কাজে লাগাবে।
শিশু বয়সে বা কৈশোরে মানুষ তার মা-বাবার ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়। মা-বাবার ধর্মীয় বিশ্বাস আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীপ্রীতি, শ্রেণি-চেতনা, প্রাদেশিকতা, যুক্তিবাদী চেতনা, মূল্যবোধ, নীতিবোধ, সাহিত্য-প্রীতি, সংগীত-প্রীতি, অঙ্কন-প্রীতি, অভিনয়-প্রীতি, দয়া, নিষ্ঠুরতা, ঘরকুনো মানসিকতা, সমাজসেবায় আগ্রহ, নেশা-প্রীতি, অসামাজিক কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ, ভীরুতা, সাহসিকতা, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ সচেতনতা, মিথ্যে বলার প্রবণতা ইত্যাদি সন্তানকে প্রভাবিত করে।
শিশু বড় হতে থাকে। পাঠাভ্যাস গড়ে উঠলে বিদ্যালয়ের শিক্ষকই সহপাঠীদের চিন্তাভাবনা, আচার-ব্যবহার, ভাললাগা না লাগা প্রভাবিত করতে থাকে। বেড়ে ওঠা শিশুটির ওপর অনবরত প্রভাব ফেলতে থাকে পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু, পাঠ্য-বই, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার, ক্লাব, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদি। কিশোর বয়সে সে তার ঘনিষ্ঠ মানুষজনের চোখ ও কান দিয়ে দেখে ও শোনে। তার পরিচিত গোষ্ঠীর মূল্যবোধের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের সংঘাত হলে সে নিজের গোষ্ঠীস্বার্থে জাতীয় স্বার্থের বিরোধিতা করতে পারে। ধর্মীয় উন্মত্ততা, জাত-পাতের সঙ্কীর্ণতা, অতীন্দ্রিয়তার প্রতি বিশ্বাস, ঈশ্বরজাতীয় কোনও কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস, জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস, মন্ত্র-তন্ত্রের ক্ষমতায় বিশ্বাস ও ভূত নামক কোনও কিছুর অদ্ভুত সব কাজকর্মের প্রতি বিশ্বাস, তাবিজ-কবজে বিশ্বাস ইত্যাদি প্রধানত গড়ে ওঠে আশেপাশের সামাজিক পরিবেশ থেকে, পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোর বিশ্বাসের পরিমণ্ডল থেকে।
শিশুকাল থেকে আমরণ আমাদের প্রভাবিত করে আমাদের সমাজ, আমাদের সংস্কৃতি; ফলে আমরা সাধারণভাবেই সেই সমাজ ও সংস্কৃতির অংশীদার হয়ে পড়ি ।
আমাদের খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস, শিক্ষা-চেতনার স্ফুরণ,
রাজনৈতিক মতবাদ— কোনও কিছুই শূন্য থেকে
আসে না। এর প্রত্যেকটি গড়ে ওঠে
সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলেই।
এ-যুগের অনেকেই প্রথাগত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এঁদের অনেকে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা ইত্যাদি করেছেন, ডক্টরেট নামক ডিগ্রি পেয়ে বিজ্ঞানী হয়েছেন, চিকিৎসক পেশায় সফল হয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানী নামে প্রচারিত হচ্ছেন, সফল বিভিন্ন শাখার ইঞ্জিনিয়াররা, প্রযুক্তিবিদরাও বিজ্ঞানী বলে পরিচিত হচ্ছেন। এরা অনেকেই বিজ্ঞানের কোনও বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও মনে-প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেননি, পারেননি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে—পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পরই কোনও মতকে গ্রহণ বা বর্জন করতে। এঁরা আমাদের সমাজের আপনার আমরাই বাড়ির ছেলে। শিশুকালে হাতেখড়ি হয়েছে সরস্বতীকে আরাধনা করে। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের দেখেছে ঈশ্বরজাতীয় কারো কাছে পরম ভক্তিতে আভূমি নত হতে। পড়ার বইয়ে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে নানা পুরাণের গল্পের মধ্যে কাল্পনিক অলৌকিক কাহিনি। দেখেছে জ্যোতিষ-কোষ্ঠী-হাতের রেখার প্রতি পরিচিত মানুষদের পরম বিশ্বাস। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে ঈশ্বর, আল্লা ও পরম পিতার প্রতি প্রার্থনা। এমনি আরও বহুতর অন্ধ-বিশ্বাস ও সংস্কারের মধ্যে বেড়ে ওঠার সূত্রে বিশ্বাস করেছে বহু অলীকে। কিন্তু লেখাপড়ায় ভালো হওয়ার সুবাদে আপনি আমি ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ছেলের পেশাগত সুবিধার কথা ভেবে তাকে বিজ্ঞান শাখায় পড়তে উৎসাহিত করেছি। সন্তান আমাদের বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনা করেছে। পড়াশুনায় সফল হয়ে বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে গ্রহণও করেছে; যেমনভাবে পেশা হিসাবে কেউ গ্ৰহণ করে আলু-পটলের ব্যবসাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা কখনওই নিজেদের জীবনে গ্রহণ করেনি। আর্থ-সামাজিক পরিবেশই এমন সব অনেক বড় বড় বিজ্ঞান পেশার কিন্তু বিজ্ঞানে অবিশ্বাসী মানুষ বা অমানুষ তৈরি করেছে।
‘অমানুষ’ কথাটা একটু কড়া হলেও সুচিন্তিতভাবেই লিখতে হল। যে নিজেকে বিজ্ঞানের পূজারি বলে জাহির করে এবং একই সঙ্গে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পথ পরিত্যাগ করে অন্ধ-বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, তাকে ‘অমানুষ’নিশ্চয়ই বলা চলে । কারণ তার গায়ে ‘বিজ্ঞানী’ তমা আঁটা থাকার তার ব্যক্তি-বিশ্বাস সাধারণ মানুষের ব্যক্তি-বিশ্বাসের চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নেয়, মানুষের প্রগতির পক্ষে, বিকাশের পক্ষে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জনগণ স্বভাবতই যা ভাবে তা হল—এত বড় বিজ্ঞানী কি আর ভুল কথা বলছেন?
ঠিক এই সময় ভ্রান্ত চিন্তার পরিমণ্ডল থেকে সাধারণ মানুষদের বের করে আনতেই প্রয়োজন নতুন বলিষ্ঠ যুক্তিযুক্ত চিন্তার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা। এই সময়ই প্রয়োজন বিভ্রান্তিকর কুযুক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে সুযুক্তির সঙ্গে সাধারণ মানুষদের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া। মানুষ সাধারণভাবে যুক্তির দিকেই ধাবিত হয়। সুযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হলে কুযুক্তি তারা বর্জন করেই। দীর্ঘদিনের প্রচলিত বহু ভ্রান্ত চিন্তা ও ধারণাকেই বর্তমান শোষক ও শাসকশ্রেণি বজায় রাখতে সচেতন ।
যে ভ্রান্ত চিন্তা প্রতিটি বঞ্চনার জন্য অদৃষ্টকে দোষারোপ
করে, সে ভ্রান্ত চিন্তা মানুষের মধ্যে থাকলে
লাভ তো বঞ্চনাকারীদেরই।
তাই তো বঞ্চনাকারী শোষক ও তাদের তল্পিবাহক রাষ্ট্রক্ষমতা মুখে যত লক্ষবারই সাধারণ মানুষদের কুসংস্কার মুক্ত করার আহ্বান জানাক না কেন, কাজে বঞ্চিত মানুষদের কুসংস্কারে আবদ্ধ রাখতেই চাইবে। তাদের সমস্ত ক্ষমতা ও প্রচারের সাহায্যে সব সময়ই জনসাধারণের মগজ ধোলাই করে ভ্রান্ত চিত্তার পরিমণ্ডল গড়ে তোলার চেষ্টা করে চলেছে, চলবেও।
কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের চরম সাফল্য কখনওই সরকারি সহযোগিতায় আসবে না। আসবে শোষক-শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের তীব্র প্রতিরোধ ও বিরোধিতাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে। আর এরই জন্য চাই যুক্তিবাদী পরিমণ্ডলকে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত করা। সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা।
পারিপার্শ্বিক মানুষজনের প্রভাবে আমাদের দেশের শিশু যখন যুবক ও প্রৌঢ়ত্বে পা রাখে তাদের মধ্যে ধর্মীয় ধারণা ও অন্ধবিশ্বাসগুলো একইভাবে অনড় থাকে, যদিও এঁদের কেউ কেউ ব্যবহারিক জীবনে বা পেশাগতভাবে ‘বিজ্ঞানী’, ‘বুদ্ধিজীবী’, ইত্যাদি বিশেষণে পরিচিত হতে থাকেন। তাই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও বিজ্ঞান পেশার মানুষদের মধ্যেও দেখা যায় যুক্তির শিথিলতা অথবা যুক্তিহীনতা। এঁদের মধ্যে একই সঙ্গে অবস্থান করে পড়ার বইয়ের কিছু কিছু জ্ঞান ও আশৈশব গড়ে ওঠা অন্ধবিশ্বাস। এঁদের অনেকেরই আঙুলে, গলায়, বাজুতে, শোভা পায় গ্রহরত্ন, ধাতুর বালা বা আংটি, শিকড় বা তাবিজ কবচ। ধারণ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে এঁদের অনেকেই লজ্জায় স্বীকার করতে চান না— ভাগ্য ফেরাতে পেরেছেন। জেল্লা বজায় রাখতে সকলেই হাত বাড়ায় অজুহাতের ‘ব্রাসো’র দিকে। এঁরা নিজেদের ‘প্রেজেন্ট’ কররেন বিদ্যাসাগরের সুবোধ বালক হিসেবে‘যাহা দেয়, তাহাই পরে’। এ-সব হাবি-জাবি জিনিস পরতে এঁদের নাকি অনুরোধ জানিয়েছিলেন মাতা, মাতামহী, পিতা, পিতামহ, আত্মীয়, বন্ধু, প্রেমিক, পত্নী ইত্যাদিরা। আর স্রেফ ওদের দুঃখ দিতে না চাওয়ার জন্যই পরা। এঁরা এতই কোমলহৃদয় প্রাণী যে ভয় হয়, কেউ জুতোর মালা পরাতে চাইলে প্রার্থীর হৃদয় রাখতে টপ করে না জুতোর মালাই গলায় গলিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ আবার এই যুক্তিই দেন— “বলল, তাই পরে ফেললাম। দেখিই না, যদি কাজ হয় ভাল, না হলেও ক্ষতি তো নেই।” এই স্বচ্ছতাহীন দ্বিধাগ্রস্ত মানুষগুলো এটা বোঝে না যে, এতেও ক্ষতি হয়। প্রথমেই অর্থ ক্ষতি তো অবশ্যই। তারপর যে ক্ষতি তা সমাজের ক্ষতি। মানুষ হেহেতু সামাজিক জীব তাই এই দ্বিধাগ্রস্ততা, অস্বচ্ছতা যা অদৃষ্টবাদকে সমর্থনেরই নামান্তর, তা প্রভাবিত করবে তাঁরই পরিবারের শিশুটিকে, আশেপাশের মানুষজনকে।
স্কুল-কলেজে যে ইতিহাস পড়েছি সে সবই সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকদের লেখা। তাদের লেখা ও শিক্ষকদের শিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা একটু একটু করে নিজেদের সাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তুলেছি। ভারতবর্ষে বর্তমানে যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তীব্র হানাহানির ফলে বারবার বহু রক্ত ঝরেছে, বহু বাড়ি দোকান পুড়েছে, বহু ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে, সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ হঠাৎ করে একদিন এ দেশের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়েনি। ছড়ানো হয়েছে। বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষগুলোকে এককাট্টা হতে না দেওয়ার জন্যেই বিভেদ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা বারবার অনুভব করেছে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী থেকে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী পর্যন্ত। এই প্রয়োজন মেটাতে তারা ঐতিহাসিকদের কাজে লাগিয়েছে বারবার। শাসককুলের কৃপা লাভের আশায় ঐতিহাসিকরা দেশের মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চিন্তার বীজ বুনতে আসরে নেমে পড়েছেন। ইতিহাসের মধ্যে বিভিন্ন সময়কার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভাষাগত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত, ধর্মগত ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে সেই সময়কার সমাজের একটা পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়, যেটার মধ্য দিয়ে আমরা মানব অগ্রগতির নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে জানতে পারব, বুঝতে পারব। কিন্তু পরিবর্তে আমরা স্কুল কলেজে ইতিহাস বই পড়ে জেনেছি সাধারণভাবে বিভিন্ন শাসকদের জয়-পরাজয় ও ব্যক্তিজীবনের কিছু কথা।
‘হিন্দু’ ঐতিহাসিকরা ‘হিন্দু’ রাজাদের রাজ্যাংশ ফিরে পাওয়ার যুদ্ধকে স্বদেশ প্রেমের নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ভুলে থাকতে চেয়েছি-দেশ শুধুমাত্র একটা ভূ-খণ্ড নিয়ে নয়, ভূ-খণ্ডের মানুষদের নিয়ে। কোনও দেশের উন্নতির অর্থ সেই দেশের অধিবাসীদের উন্নতি। স্বদেশ প্রেম বলতে, দেশের বৃহত্তম জনসমষ্টির প্রতি প্রেম। এই অর্থে রাজাদের দেশপ্রেমের সামান্যতম হদিশ মেলে কি? সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকরা আকবরের বিরুদ্ধে রাণা প্রতাপের যুদ্ধকে মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুদের যুদ্ধ বলে প্রচার করতে চাইলেও বাস্তব সত্য কিন্তু আদৌ তা নয়। আকবরের পক্ষে হিন্দু রাজপুত সেনার সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার। সেনাপতি মান সিংহও ছিলেন রাজপুত। অপরপক্ষে রাণা প্রতাপের বাহিনীতে ছিল বিশাল সংখ্যায় পাঠান সৈন্য। সেনাপতি ছিলেন হাকিম খাঁ। এ-ছাড়া তাজ খাঁর নেতৃত্বেও ছিল আর এক পাঠান বাহিনী। অতএব দুই রাজার এই লড়াই কোনও সময়ই মুসলমান ও হিন্দুদের যুদ্ধ ছিল না। ছিল দুই রাজার মধ্যকার স্বার্থের লড়াই।
রানা প্রতাপের রাজ্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টাকে স্বদেশ-প্রেম
বলার যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণই থাকতে পারে না।
নিজ স্বার্থে লড়াই স্বদেশ-প্রেমের নিদর্শন হলে,
আকবর কেন স্বদেশ-প্রেমিক হবেন না?
প্রকৃতপক্ষে রানাপ্রতাপ সমগ্র ভারতবর্ষ তো নয়ই, এমনকী, গোটা রাজপুতানার জন্যেও যুদ্ধ করেননি। তিনি যুদ্ধ করেছিলেন নিজের রাজ্য শাসনের দখল পাওয়ার জন্য।
একই ভাবে ঔরঙ্গজেব ও শিবাজির লড়াইও ছিল এক বাদশা এবং এক রাজার স্বার্থের দ্বন্দ্ব মাত্র।
ইতিহাসের নিরিখে ভারতের মধ্যযুগের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক । তুর্কি সেনার বিরুদ্ধে রাজপুত প্রভুদের লড়াই শুধুই দু-দলের সেনাবাহিনীরই লড়াই ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে। কোথাও তুর্কি সেনাদের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। ভোগসর্বস্ব হিন্দু রাজাদের জন্য লড়াই করার কোনও প্রেরণাই প্রজারা অনুভব করেনি। এই কঠিন সত্যকে হিন্দু ইতিহাস রচয়িতারা ‘হিন্দু’ স্বার্থেই দেখতে চাননি। তাঁরা দেখাতে চাননি—মুঘল যুগে মুঘল বা মুসলমান প্রজারাও ছিল চূড়ান্ত ভাবে শোষিত, দারিদ্রে জর্জরিত।
‘হিন্দু’ ঐতিহাসিকরা যেভাবে তুর্কিদের বহিরাগত বলে বর্ণনা করেছেন, আগ্রাসকের ভূমিকায় বসিয়েছেন সেভাবে তো তাঁরা বর্বর আর্য উপজাতিদের চিত্রিত করেননি। তুর্কিদের চেয়ে তো আর্যরা কোনও অংশেই কম বহিরাগত বা কম বিধর্মী ছিল না। কয়েক সহস্র বছর আগে তারাও তো তুর্কি ভূখণ্ড থেকেই ভাবতে প্রবেশ করেছিল। আর্যরা ভারতীয় হতে পারলে তুর্কিরা কেন ভারতীয় বলে পরিচিত হবে না? প্রাক্-আর্য জাতি পরাজিত হয়েছিল বলেই তাদেরকে ‘অনার্য’ রূপে এমনভাবে ঐতিহাসিকরা চিত্রিত করেছেন যে বর্তমানে ‘অনার্য’ শব্দটি ‘অসভ্য’-র প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মহেঞ্জোদড়ো, হরপ্পা ও নর্মদা উপত্যকার প্রাক্ আর্য যুগের যে নিদর্শন পেয়েছি তা ঐতিহাসিকদের মিথ্যাচারিতারই প্রমাণ। তাদের গৃহনির্মাণ প্রণালী, নগরবিন্যাস, বয়ন, অঙ্কন, লিখন, ভাস্কর্য প্রতিটিই ছিল অতি উন্নত পর্যায়ের। আর্যরা প্রাক্ আর্য মানুষের কাছ থেকে এইসব বহু বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল এ কথা চূড়ান্তভাবেই সত্য। আর্য সভ্যতার কোনও নিদর্শন না পাওয়ায় অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, আর্য সভ্যতা ছিল গ্রামীণ। তাই প্রাত্নিক উপকরণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
আর্যরাই ভারতে প্রথম সভ্যতার আলো এনেছে, এ কথা
যেমন মিথ্যা, একইভাবে মিথ্যা, ভারতের বর্তমান
সভ্য জাতিগোষ্ঠীগুলো সবই আর্যদের থেকেই
সৃষ্ট। এই চিন্তাই আমাদের আর্যজাতির
বংশধর হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে
প্রাক-আর্য জাতিকে অনার্য, অসভ্য
হিসেবে চিত্রিত করতে।
আমাদের দেশের ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবোধ পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা সুলতান মামুদ এবং ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসকে ‘হিন্দু’ বিদ্বেষের এবং হিন্দুত্বের অপমানের প্রমাণ হিসেবে হাজির করেছে। একই সঙ্গে ষষ্ঠ শতকে হর্ষের একের পর এক হিন্দু মন্দির লুণ্ঠনের ঘটনা বিষয়ে নীরব থেকেছে। হর্ষ তো মন্দির লুণ্ঠনের জন্য ‘দেবোৎপাটননায়ক’ নামে এক শ্রেণির রাজকর্মচারীই নিয়োগ করেছিল। মন্দির লুণ্ঠনের জন্য যদি মামুদ ও ঔরঙ্গজেব হিন্দুবিদ্বেষী হিসেবে চিত্রিত হন, তবে হর্ষ একই কাজের জন্য কেন হিন্দু বিদ্বেষী হিসেবে চিত্রিত হবেন না?
হর্ষের মন্দির লুণ্ঠন প্রসঙ্গে আমার এক ইতিহাসের অধ্যাপক বন্ধু জানিয়েছিলেন, “আমাদের আলোচনা করা উচিত শুধুমাত্র যুক্তির উপর নির্ভর করে নয়, বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ করে। সে যুগে মন্দির শুধু দেবোপাসনার স্থল ছিল না, মন্দিরের গুপ্তকক্ষে সঞ্চিত থাকত ভক্তদের দান শ্রেষ্ঠীদের রত্নরাশি। অর্থ ও রত্ন রাজ্য শাসনে অপরিহার্য। রাজ্য শাসনের স্বার্থেই রত্ন আহরণের জন্য হর্ষ মন্দিরে হাত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।”
এই যুক্তিই মামুদ বা ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে কেন প্রযোজ্য হবে না? গোটা হিন্দু যুগব্যাপী বীর-শৈব ও লিঙ্গায়েৎ সম্প্রদায়গুলো যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন মন্দির মঠ পুঁথি ধ্বংস করে গেছেন, আমাদের দেশের ইতিহাসের বইগুলো সে বিষয়ে নীরব কেন? হিন্দুত্বে কালি ছিটবে বলে?
হিন্দুদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য মুঘল যুগের শাসকদের ‘হিন্দু’ ঐতিহাসিকরা যতই তাঁদের লেখনিতে অভিযুক্ত করুন, বাস্তবক্ষেত্রে কোনও মুঘল সম্রাটই কিন্তু গণ-ধর্মান্তরের চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করেননি। এমনকী, ঔরঙ্গজেবও নন।
সমগ্র প্রজাপুঞ্জকে রাজধর্মে দীক্ষিত করা নিন্দনীয়ই
যদি হয়, তবে নিন্দার প্লাবনে ভাসিয়ে দেওয়া
উচিত সম্রাট অশোককে। নিজ ধর্মে
দীক্ষিত করতে তিনি
কী না করেছেন?
তবু তিনি মহান ! তিনি ধর্মাশোক ! তিনি শান্তি ও অহিংসার প্রতীক ! সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিকরা এমন ইতিহাসই রচনা করেছেন, যা পড়ে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক ভারতের সমস্ত কিছু গৌরবের কৃতিত্ব হিন্দুদের। যা কিছু অগৌরবের তার সমস্ত কিছুর দায়ই মুসলমানদের। দেশের এই শিক্ষা পরিবেশের মধ্যে মানুষ হয়ে সাধারণভাবে মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষই পোষণ করেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৈষম্যমূলক আচরণ পেয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতি সন্দেহই পোষণ করছে। ফলে একই দেশে বাস করেও সংখ্যাগুরুদের অবিশ্বাস ও পক্ষপাত সংখ্যালঘুদের ভারতকে আপন দেশ ভাবার সুযোগ দিচ্ছে না। বরং ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে মৌলবাদী পরিবেশই আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসছে।
ঐতিহাসিকরা গোষ্ঠী রক্ষার্থে যে ইতিহাস রচনা করেছেন তা
হিন্দু জাতীয়তাবাদকেই পুষ্ট করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের
বিষবৃক্ষের বীজ কৈশোরেই ইতিহাস পাঠকদের
মাথায় বপন করা হয়েছে, তারই ফলশ্রুতিতে
সাম্প্রদায়িক রেষারেষি, রক্তপাত, লুণ্ঠন,
হত্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি
লাভ করেই চলেছে।
মগজ ধোলাইয়ের সেকাল-একালঃ সমস্তই এক বয়ে চলা স্রোত
এ-কালের শাসক-শোষক ও তাদের অধীনস্থ বুদ্ধিজীবীদের মতো প্রাচীন ভারতের শাসকরা ও তাদের বুদ্ধিদাতা ধর্ম-পণ্ডিতরা স্পষ্টতই বুঝে ছিলেন, যুক্তিবাদী দর্শন, যুক্তি-নির্ভর চিন্তাধারা ব্যাপকতা পেলে, সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেলে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিতই টলে যেতে পারে—যে সমাজব্যবস্থায় একদল শুধুই খাটবে আর একদল ভোগ করবে সেই খাটুনির ফল ।
শোষক ও শোষিত—এই দুই শ্রেণিবিন্যাসকে বজায় রাখতেই তৈরি হয়েছিল প্রাচীন আইন গ্রন্থ ‘স্মৃতি’ বা ধর্মশাস্ত্র । আর বেদ, উপনিষদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শ্ৰুতি’। এই ‘শ্রুতি’ ও ‘স্মৃতি’ নিয়ে গড়ে উঠেছিল ভাববাদী দর্শন, যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত বিশ্বাসবাদ, শাস্ত্র-বিশ্বাস, গুরু-বিশ্বাস, অধ্যাত্মবাদ।
যুক্তিবাদী দর্শনে এমন অন্ধ-বিশ্বাসের কোনও স্থান নেই। যুক্তিবাদ সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যুক্তির পথ ধরে, পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের পথ ধরে।
দর্শনের ইতিহাসে মূল দ্বন্দ্ব ভাববাদ বা বিশ্বাসবাদ বনাম
বস্তুবাদী যুক্তিবাদ। ভাববাদের সঙ্গে যুক্তিবাদের এই
দ্বন্দ্বই অন্ধ-বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির দ্বন্দ্ব, অসাম্যের
সমাজ-ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টার
বিরুদ্ধে সাম্যের সমাজ-ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা করার দ্বন্দ্ব।
এই দুই দর্শনের গুরুত্ব ও দ্বন্দ্বের গুরুত্ব সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেও সাম্যের সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ভাববাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে লাগাতার যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রক্রিয়াগুলোকে চালু না রাখতে পারলে ভাববাদী দর্শনের চিন্তা আবার অসাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেই।
আসুন, আমরা ফিরেই তাকাই প্রাচীন ভারতের দিকে। সেখানেও দেখতে পাচ্ছি সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’-এর মতো মহাকাব্যগুলোতেও ঢুকে পড়েছে অনেক কাহিনি, অনেক নীতি কথা। রামায়ণের অযোধ্যা-কাণ্ডের দিকে তাকান। রামচন্দ্র তখন চিত্রকূটে। ভরত এলেন। রামচন্দ্র রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন :
ক্বচিন্ন লোকায়তিকান্ ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।
অনর্থকুশলা হোতে বালাঃ পন্ডিতমানিনঃ।।
অর্থাৎ, “আশা করি তুমি লোকায়তিক (যুক্তিবাদী) ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।”
মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্ৰাহ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমানের জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সংকেত দেখতে পেয়ে শিয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণকে পশুজীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানবজীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পুণ্যের ফল সঞ্চয় করে এই মানবজন্ম পাওয়া। এমন মহার্ঘতম মানবজীবন, বিশেষত শ্ৰেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মলাভের পরেও কেউ কি পারে সে-জীবন ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শিয়াল, সে নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মেছিল। কিন্তু সে-জন্মে চূড়ান্ত মূর্খের মতো এক মহাপাতকের কাজ করেছিল বলেই আজ এই শিয়াল জন্ম।
চূড়ান্ত মূর্খের মতো মহাপাতকের কাজটা কী? এ-বারই বেরিয়ে এল নীতিকথা—
অহমাসং পণ্ডিতকো হৈতুকো দেবনিন্দকঃ।
আন্বীক্ষিকীং তর্কবিদ্যম্ অনুরক্তো নিরার্থিকাম।।
হেতুবাদান্ প্রবদিতা বক্তা সুংসৎসু হেতুমৎ।
আক্রোষ্ট চ- অভিবক্ত চ ব্রাহ্মবাকেষু চ দ্বিজান।।
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ ।
ভাস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃশৃগালত্বং মম দ্বিজ ।
(শান্তিপর্ব ১৮০-/৪৭-৪৯)
অর্থাৎ, আমি ছিলাম এক বেদ-সমালোচক যুক্তিবাদী পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচার সভায় ছিলাম যুক্তিবাদের প্রবক্তা। যুক্তি বলে দ্বিজদের ব্রাহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক, অর্থাৎ কি না পণ্ডিত্যাভিমানী মূর্খ। হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্ম।
ভারতবর্ষে ভাববাদী দর্শনের সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাই আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকে ‘উপনষদ’ সাহিত্যে। চার্বাক বা লোকায়ত দৰ্শন বা বস্তুবাদী যুক্তিবাদের সূচনা সঠিক কবে হয়েছিল বলা সম্ভব নয়। আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত বৌদ্ধ দার্শনিক কমল শীলের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘পঞ্জিকা’তে বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাই ।
কমল শীলের গুরু শান্ত রক্ষিত নিজের মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ নামে একটি দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচনায় দেখতে পাই বস্তুবাদী যুক্তিবাদী দর্শনকে তিনি ‘চার্বাক’ না বলে ‘লোকায়ত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
শান্ত রক্ষিত থেকে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ভাববাদী দার্শনিকের রচনায় ‘লোকায়ত’ বা ‘চার্বাক’ নামের যুক্তিবাদী দর্শনটির উল্লেখ দেখতে পাই। সে-সময় ভারতীয় দর্শনের প্রথামত পরমত খণ্ডন করে নিজের মত স্থাপন করা হত। পরমত হিসেবেই এইসব ভাববাদী দার্শনিকেরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক দর্শন বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে পারি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দর্শন যা ছড়া হিসেবে প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে। অলিখিত এই ছড়াই লোকগাথার রূপ পেয়েছিল।
আত্মা অবিনশ্বর হলে তবেই মৃত্যুর পর আসে স্বর্গ বা নরক ভোগের প্রশ্ন, জন্মান্তর পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদির প্রশ্ন। আত্মা নশ্বর হলে এইসব প্রশ্নই অর্থহীন হয়ে যায়।
আসুন আমরা এক ঝলকে চার্বাক দর্শনের পরিচয়টা একটু জেনে নিই ৷
প্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনটির নামটা নিয়ে একটু আলোচনা স্বল্প পরিসরে সেরে নিলে বোধহয় অনেকের কিছুটা কৌতূহলও মেটানো যাবে এবং আত্মা প্ৰসঙ্গে যে দর্শনের মতামতের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে চাইছি, তার বিষয়েও কিছু বলা হবে।
‘চার্বাক’ কথাটা কোথা থেকে এল? অনেক দার্শনিকের মতে ‘চারু + বাক’ থেকে চার্বাক কথাটা এসেছে। মানুষের স্বাভাবিক ভোগ প্রবৃত্তির কথা মাথায় রেখে যে দর্শন ‘চারু’ বা সুন্দর কথার জাল বুনে ‘হই জগতেই সব কিছুর শেষ, মৃত্যুর পরে অন্য কোনও জগৎ বলে কিছু নেই, অতএব ভোগ করো’ বলে মানুষদের চিত্ত আকর্ষণ করেছে, সেই দর্শনই চারু + বাক্ বা চার্বাক দর্শন।
অন্য মতে ‘চব’ (অর্থাৎ চর্বণ) করে যে -এই অর্থে চার্বাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরনের ব্যাখ্যাতারা বলতে চান-চর্ব-চোষ্য-খানা-পিনার মধ্যেই জীবনের চরমতম সার্থকতা যে দর্শন খুঁজে পায় সে দর্শনই চার্বাক দর্শন।
ব্যাকরণ মানতে গেলে দুটো মতকেই বাতিল করতে হয়। ‘চারু + বাক’ থেকে ‘চারু-বাক’ অথবা ‘চারবাক্’ বা ‘চার্বাক্’ কোন অবস্থাতেই ‘চার্বাক’ নয় ৷ অথচ প্রাচীন প্রতিটি লেখাতেই আমরা দেখতে পাই ‘চার্বাক-এর ‘ক’-এর হসন্ত বাদ দেওয়া হয়েছে।
আবার ‘চর্বণ করে যে’ সে ‘চার্বাক নয় চার্বক, অর্থাৎ ‘ব’-এ আ-কার হবে না।
পালি সাহিত্য বিষয়ে সুপণ্ডিত রিস ডেভিল্ডস্ (Rhys Debinds) -এর ধারণায়—মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাক-এর নাম থেকেই পরবর্তী সময়ে ভাববাদীরা বস্তুবাদী দর্শনটির নাম রাখেন চার্বাক দর্শন। মহাভারতে আছে— চার্বাক ছিল দুরাত্মা দুর্যোধনের বন্ধু আর এক দুরাত্মা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ-বিজয়ী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশধারী চার্বাক জ্ঞাতিঘাতী হিসেবে ধিক্কার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাহ্মণগণ তাঁদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাক-এর আসল পরিচয় জেনে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন।
প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী দর্শনটির প্রতি সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্যই এমন এক ঘৃণ্য রাক্ষস চরিত্রের নামে দর্শনটির নাম রেখেছিলেন।
সে যুগের কিছু ভাববাদীরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনকে দেবগুরু বৃহস্পতি প্রণীত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাণে আছে-অসুরদের পরাক্রমে বিধ্বস্ত দেবকুলের রক্ষা করতে এক কৌশল অবলম্বন করলেন বৃহস্পতি। অসুরদের ধ্বংসের জন্য, অধঃপাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ভ্রান্ত দর্শন রচনা করলেন, তারপর অসুরের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনটি প্রচার করলেন। ফলে নীতিভ্রষ্ট, ভ্রান্ত অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হল।
এখানেও দেখতে পাই-বস্তুবাদী দর্শনই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল, প্রচারের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আতঙ্ক এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির স্পষ্ট চেষ্টা।
শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা বস্তুবাদী দর্শনটিকে ‘লোকায়ত’ নামে অবহিত করার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন— দর্শনটি ইতর লোকের দর্শন, তাই ‘লোকায়ত’ দর্শন।
এখানে ভাববাদী দার্শনিকদের লোকায়ত দর্শনের প্রতি অশ্রদ্ধা স্পষ্ট। অনেক পাঠক-পাঠিকাদের মনেই এ-চিন্তা নিশ্চয়ই উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে, চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনে কী এমন কথা বলা হয়েছে, যা অবহেলায় পাশে সরিয়ে দেওয়ার সাধ্য সে যুগের রথী-মহারথী দার্শনিকদের ছিল না, তার ফলে ভাববাদী রথী-মহারথীরা বস্তুবাদী দর্শনটিকে লক্ষ করে তীক্ষ্ণ আক্রমণ হেনেছেন এবং সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষদের দর্শনটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন ।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনে আত্মার বিষয়ে এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল যেগুলো ইতরজন বা সাধারণের কাছেও গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল। যুক্তিবাদী এই দর্শনে আত্মা বা চেতনাকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা ‘অমর’ কি ‘মরণশীল’–এই নিয়ে।
লোকায়ত দর্শন মতে–কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অনুমানের সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অনুমান-নির্ভর, একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অমর আত্মা, ইহলোক, পরলোক ইত্যাদি ধারণাগুলো লোক ঠকানোর জন্য একদল ধূর্ত লোকের সৃষ্টি। প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণই শ্রেষ্ঠ বলে চার্বাক দর্শন মনে করলেও তাঁরা প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানকেও মর্যাদা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি অনুমানের মূল শর্ত অবশ্যই হবে ‘পূর্ব প্রত্যক্ষ’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি। অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান কখনওই হতে পারে না ।
ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব
ছিল সামান্য অথবা অবান্তর। তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব
দিতেন ‘ঋষি’ নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে,
ধর্মগুরুদের অন্ধ- বিশ্বাসকে—যার ওপর নির্ভর
করেই গড়ে উঠেছিল অধ্যাত্মবিদ্যা।
আজও যাঁরা বলেন, বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং অধ্যাত্মবাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই, বরং অধ্যাত্মবিদ্যার এবং অধ্যাত্মতত্ত্বই ‘পরমবিজ্ঞান’, তাঁরা এটা ভুলে যান—প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রথম ধাপটিতে পা রাখাই সম্ভব নয়।
লোকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন—চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতন্যস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনামাত্র।
লোকায়ত দর্শনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শঙ্করাচার্য যে যুক্তি রেখেছিলেন তা হল- লোকায়ত দর্শনের মতে দেহের মূল উপাদান জল, মাটি, আগুন, বায়ু ইত্যাদি ভূত-পদার্থ। এই প্রতিটি ভূত-পদার্থই জড় বা অচেতন পদার্থ। তাহলে এই অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চয়ই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেওয়া উচিত—চৈতন্য বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। আত্মা বিষয়ে অন্যান্য বহু ভাববাদী দার্শনিকেরা যে-সব তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্যেই শঙ্করাচার্যের এই যুক্তির সুর লক্ষ করা যায়। তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—জড় বা অচেতন পদার্থের গড়া দেহ তো সরল যুক্তিতে অচেতনই হওয়ার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে?
লোকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তি হাজির করেছেন—মদ তৈরির উপকরণগুলোতে আলাদা করে বা মিলিত অবস্থায় কোনও মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোকেই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানোর পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মদ। আত্মা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা ৷
লোকায়তিকদের চৈতন্যের সঙ্গে মদশক্তির তুলনা নিয়ে কোনও বিপক্ষ দার্শনিকই কূটতর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। তবে, তাঁরা দৃষ্টান্ত হিসেবে এনেছেন মৃতদেহের তুলনা। চৈতন্য যদি দেহেরই লক্ষণ বা ধর্ম হয়, তবে মৃতদেহেও তো চৈতন্য থাকার কথা, থাকে না কেন? মৃতদেহও দেহ। লোকায়ত দর্শনের আত্মা বা চৈতন্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের এটাই সবচেয়ে জোরালোতম যুক্তি।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন-এর বিপক্ষে জোরালো কোনও যুক্তি হাজির করতে পারেনি। প্রাচীনকালের পটভূমিতে শারীরবিদ্যার অনগ্রসরতার যুগে এই ধরনের যুক্তির কোনও উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আজ বিজ্ঞানের তথা শারীরবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু জেনেছি, পরবর্তীকালে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছুই জানব। যেটুকু জেনেছি, তারই ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি দেহ ও মৃতদেহের ধর্ম সমান নয়। চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া।
মৃতদেহের ক্ষেত্রে মৃতদেহেরই অংশ মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষেরও যেহেতু মৃত্যু ঘটে, তাই স্নায়ুকোষের ক্রিয়াও ঘটে না, ফলে মৃতদেহের ক্ষেত্রে চৈতন্য বা চিন্তা থাকে অনুপস্থিত।
লোকায়ত দর্শনে আত্মা, পরলোক এবং পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এমন অনেক কথা বলা হয়েছে যেগুলো তীক্ষ্ণতা এযুগের যুক্তিবাদীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মতো। দু-একটা উদাহরণ হিসেবে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। যদিও নিশ্চিতভাবে জানি আমার অক্ষম বাংলা তর্জমায় মূল শ্লোকগুলোর রস অনেকটাই শুকিয়ে যাবে।
উদাহরণ ১ : ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু করেছেন শ্রাদ্ধাদি বিহিত।।
এছাড়া কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।
উদাহরণ ২ : যদি শ্রাদ্ধকর্মে হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ ।
তবে নেতা প্রদীপে দিলে তেল উচিত জ্বলন ।।
উদাহরণ ৩ : পৃথিবী ছেড়ে যে পঞ্চভূতে
তার পাথেয় দিতে পিণ্ডদান বৃথা ।
যেমন, ঘর ছেড়ে যে গ্রামান্তরে
তার পাথেয় (খাদ্যবস্তু) ঘরে দেওয়া বৃথা।।
উদাহরণ ৪ : চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা ?
তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা।।
উদাহরণ ৫ : যদি, জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে
বলি দিলে পশু যায় স্বর্গে।
তবে, পিতাকে পাঠাতে স্বর্গে
ধরে-বেঁধে বলি দাও যজ্ঞে।।
উদাহরণ ৬ : ভণ্ডরা পশুর মাংস খেতে চান।
তাই তাঁরা দিয়েছেন বলির বিধান।।
আত্মা, পরলোক ইত্যাদি নিয়ে ভাববাদীদের সঙ্গে বস্তুবাদীদের
চিন্তার ও মতের এই যে পার্থক্য, এটা নিছক দুটি
মতের পার্থক্য নয়। এটা মতাদর্শগত পার্থক্য,
মতাদর্শগত সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম।
শোষণ ব্যবস্থাকে কায়েম রাখতেই মগজ ধোলাই চলছে
সময় এগোচ্ছে। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন থেকে খসে পড়ছে অনেক সংস্কার, অনেক মূল্যবোধ। মানুষ অনেক পুরোনো ধ্যান-ধারণা বিদায় দিচ্ছে। মানুষের এই অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধনীরাও শোষণের নানা নতুন নতুন কৌশল বের করছে, বের করছে গরিব মানুষগুলোর মগজ ধোলাইয়ের নানা প্যাঁচ-পয়জার। এইসব কূট কৌশল যেমন ধনীদের ভাড়া করা কিছু বুদ্ধিমান মানুষদের মস্তিষ্ক থেকে বের হচ্ছে, তেমনই কিছু কিছু বুদ্ধিমানদের কাছে সে-সব ধরাও পড়ে যাচ্ছে। এই সব বিক্রি না হওয়া বুদ্ধিমানদের কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন বঞ্চিত মানুষদের ঘুম ভাঙাতে। তাঁদের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে উঠছে নানা সংগঠন, নানা গোষ্ঠী। এইসব সংগঠন ও গোষ্ঠী বঞ্চিতদের ধোলাই করা মগজ আবার ধোলাই করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নতুন চিন্তা, গড়ে তুলছে নতুন চেতনা, গড়ে উঠছে নতুন সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ।
হুজুরের দল অবশ্যই এই অবস্থায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে এক সময় বঞ্চিত মানুষগুলোর সোচ্চার দাবি ও ক্ষোভকে সম্মান জানিয়ে রাজ্য-পাট ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাস নেয় না। ওরা অবশ্যই প্রতিরোধ গড়ে তোলে, প্রতিআক্রমণ চালায়। শোষকরা ভালোমতোই জানে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখে দাবিয়ে চলার মতো পুলিশ ও সেনা রাষ্ট্র-শক্তির নেই। তাই নানা কৌশলে চেষ্টা করে শোষিত ক্ষুব্ধ মানুষগুলোকে দমিয়ে রাখতে বিভিন্ন পন্থা ও কৌশলের সাহায্য নিতে।
নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলের
লড়াইতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়, তার পুরোটা
যেহেতু ধনী হুজুরের দলই জোগায় তাই রাষ্ট্র-ক্ষমতা
দখলকারী রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রশক্তি হয়ে
দাঁড়ায় ধনীদের বিশ্বস্ত ‘যো-হুজুর’ -এর দল।
এরই সঙ্গে হুজুরের দল আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর বিবেক কিনতে বাজারে নেমে পড়ে। টপাটপ বিক্রিও হয়ে যায় অনেকেই। শোষিত মানুষগুলোর মগজ ধোলাই করতে হুজুরের দল ময়দানে নামিয়ে দেল রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের। নেমে পড়ে সরকারি ও ধনী মালিকানাধীন প্রচার-মাধ্যম, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি। মগজ ধোলাই করা হতে থাকে প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ভাবে। পাশাপাশি তথাকথিত ধর্মীয় চেতনা জনমানসে বাড়াবার চেষ্টা চলতে থাকে। প্রয়োজনে জাত-পাত ও সাম্প্রদায়িক নানা চিন্তাকে উসকে দেওয়ার নানা কৌশলও টপাটপ বের করতে থাকে হুজুরের উচ্ছিষ্টভোগী পরামর্শদাতা ও দালালের দল। ভক্তিরসের বান ডাকানো হতে থাকে নানা ভাবে। অদৃষ্টবাদ, অলৌকিকত্বের রমরমা বাজার তৈরি করতে সূক্ষ্ম বুদ্ধির কৌশলেই কাজ হয়। জ্যোতিষ ও প্যারাসাইকোলজিস্ট নামধারী প্রবঞ্চকের দল রাষ্ট্রশক্তির আসকারায় তাঁদের উদ্ভট সব চিন্তা সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে নিজেদের আখের গোছাবার পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। প্রতিটি ক্লাব, গণসংগঠন, লাইব্রেরি, স্কুল, কলেজকে কুক্ষিগত করে নিজেদের ইচ্ছেমতো সাংস্কৃতিক চেতনা মাথায় ঢোকাতে কখনও রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজে লাগায় হুজুরের দল। কুক্ষিগত করার জন্য লোভ, ভয়, বলপ্রয়োগ ইত্যাদিকে পাথেয় করে রাজনীতি পেশার মানুষগুলো। কখনও বা সাহায্যের বদান্যতায় সংস্থাগুলোর ইচ্ছেমতো চলার ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। আবার কখনও বা ওইসব সংস্থার নেতাদের বিবেক কিনেই সংস্থাকে পকেটে পুরে ফেলে হুজুরের দল। কখনও নিজেদের বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে ওই ধরনের সাজানো আন্দোলন শুরু করা হয়; আন্দোলনে শামিল মানুষদের বিভ্রান্ত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট করার চেষ্টায়। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রশক্তি আন্দোলনকারীদের দেশের সাধারণ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে জাতীয়তাবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী, উগ্রপন্থী, ইত্যাদি ছাপ মেরে দেয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সরকারি, বেসরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোর নিরবচ্ছিন্ন প্রচারে শোধিত মানুষদের এই প্রতিরোধের বিরুদ্ধে দেশের শোষিত মানুষরাই বিরূপ মনোভাব পোষণ করে ।
কখনও বা সওদা হতে না চাওয়া উন্নত শির,
বিপদজনক নেতাদের চরিত্র হননের নানা
প্রচেষ্টা চালানো হয় সাজানো
আন্দোলনকারীদের সাহায্যে।
কখনও বা নেতাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে গুলিবিনিময়ের আষাঢ়ে গল্প ফাঁদা হয়। অথবা গল্প ফাঁদা হয় পতিতাপল্লি রেইড করতে গিয়ে ধরাপড়া নেতার গুলি বিনিময় এবং মৃত্যুর।
এই যে কথাগুলো লিখেছি, এর একটা কথাও কল্পনাপ্রসূত নয়। যখনই কোনও দরিদ্র শোষিত জনগোষ্ঠী ঘুম থেকে জেগে উঠেছে, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে, আঘাত হেনেছে হুজুরদের দুর্গে, তখনই সেই আন্দোলনকে ধ্বংস করতে শোষকশ্রেণি ও তার সেবক রাষ্ট্রশক্তি এই পদ্ধতিগুলোকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রয়োগ করে চলেছে।
যারা শোষণ করছে তারা চায়, যাদের শোষণ করছি তাদের এমন নানা নেশায় ভুলিয়ে রাখব, মাতিয়ে রাখব যে তারা নিজেরা নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকবে যে তারা আমাদের বিরুদ্ধে কোনও দিনই সম্মিলিত শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
আন্দোলনকে জয়ী দেখতে চাইলে হুজুরের দল ও তাদের রক্ষার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার আন্দোলন ধ্বংস করতে কী কী কৌশল গ্রহণ করে থাকে সে বিষয়ে আমাদের একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা একান্তই প্রয়োজনীয়। সম্ভাব্য আক্রমণ বিষয়ে অবহিত থাকলে সেই আক্রমণ প্রতিহত করা এবং পাল্টা আক্রমণ চালানো সহজতর হয়।
শোষকশ্রেণি বা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন যাঁরা চালাবেন তাঁদের এটা অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, প্রতিটি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির ওপর যথেষ্ট নজর রাখে রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার। সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের রয়েছে বহু বিভাগ। আমাদের সরকারের ইন্টেলিজেন্ট ডিপার্টমেন্টেরই রয়েছে তিরিশের ওপর বিভাগ বা সেল। ছাত্র, রাজনৈতিকদল, ডাকাত অপরাধ, নকশাল সংগঠন ইত্যাদি প্রত্যেকটা বিভাগের জন্যে রয়েছে সেল। গোয়েন্দারা এইসব সংগঠনগুলোর ওপর নজর রাখেন। এ-ছাড়াও গোয়েন্দা দপ্তরের ও বিভিন্ন থানারই রয়েছে নিজস্ব ইনফর্মার। এই ইনফর্মাররা প্রতিটি সেলেই তথ্য জোগাচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। এরা সরকারি চাকরি করে না। এদের আত্মপরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে এক একজন বড় পুলিশ অফিসারদের হাতে থাকে সরকারি খরচে নিজস্ব বিশ্বস্ত ইনফর্মার। এরা কোথায় নেই? কোনও সংগঠন সরকারের পক্ষে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে সন্দেহ করলেই তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ইনফর্মার। এ-ছাড়া গোয়েন্দারাও নজর রাখেন। সুতরাং বহু আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিষয়েই সরকার ও শোষকশ্রেণি সব সময়ই ওয়াকিবহাল। বিভিন্ন আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বুঝে তাকে রুখতে সরকার হাজির করে নানা কৌশল।
এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য কৌশল হল, সাধারণ মানুষের চিন্তাধারাকে নিজের প্রয়োজনীয় খাতে নিয়ে যাওয়া।
মানুষের চিন্তাধারাকে কোনও একটা বিষেষ খাতে বওয়াতে, চিন্তায় কোনও বিশ্বাসকে স্থায়ীভাবে গাঁথতে যে পদ্ধতিটি এখনও সবচেয়ে বেশি সফল বলে স্বীকৃত, তা হল অসীম ধৈর্যের সঙ্গে সুযোগ পেলেই মিথ্যেকেও বার বার নানা ভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে পরিবেশন করতে থাকা। কোনও একটি মিথ্যে বিশ্বাসকে মানুষের মাথায় সত্যি বলে ঢোকাতে হলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রচার করে ওই বিশ্বাসে তোমার এবং বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির রয়েছে অগাধ আস্থা ও অচল ভক্তি। সফল রাজনীতিকদের এসব বিষয় জানতে হয়, নইলে শিল্পপতিদের কাছে কলকে পাওয়া যায় না। ওরা ধৈর্য ধরে সুযোগ বুঝে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণকে মাঝে মধ্যেই জানাতে থাকে ওদের জ্যোতিষ-বিশ্বাস ও জ্যোতিষ নির্ভরতার কথা, ঈশ্বর বিশ্বাস ও অলৌকিক ক্ষমতাবান ধর্মগুরুদের প্রতি বিশুদ্ধ ভক্তির কথা। এতে কিছু কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ধর্মগুরুর শিষ্যদের ভোট প্রভাবিত হয়, জনসাধারণের মধ্যে জ্যোতিষ ও ভাগ্য-নির্ভরতা বাড়তে থাকে। কর্মফলে বিশ্বাস, ঈশ্বরনির্ভরতা, গুরুনির্ভরতা ইত্যাদি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাস হ্রাস পেতে থাকে। আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ আত্মনিবেদন করতে জানে, আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে দুঃখ ও বঞ্চনাকে ভুলতে জানে কিন্তু লড়াকু হতে জানে না। যে মানুষ লড়াকু নয়, তাকে আবার ভয় কী?
মার্কসবাদের সঙ্গে অপরীক্ষিত এবং শুধুমাত্র বিশ্বাসনির্ভর জ্যোতিষশাস্ত্রের চূড়ান্ত বিবাদ থাকলেও কিছু কিছু মার্কবাদী মন্ত্রী কিন্তু জ্যোতিষীদের সম্মেলনে হাজির হন প্রধান অতিথি, সভাপতি ইত্যাদি হয়ে। ওইসব সম্মেলনে শুভেচ্ছা বাণী-টানিও পাঠান। মেহনতী মানুষের বন্ধু ওইসব মার্কসবাদী দলগুলো তাদের মন্ত্রীদের এমন মার্কস-বাদ-ই কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার ফতোয়া জারি করেন না কেন? কেন এমন অদ্ভুত আচরণ? ওইসব কার্যকলাপ কি শুধুই মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত চ্যুতি বা নীতিভ্রষ্টতার নিদর্শন? না কি ক্ষমতার শাঁসে জলে থাকার পরিণতিতে সাধারণ মানুষের চেতনাকে অদৃষ্টবাদী করে তোলার কূট কৌশল?
একটু তলিয়ে দেখলেই দেখতে পাবেন ওইসব তথাকথিত
অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতারা প্রকৃতপক্ষে
সম্পূর্ণ অদৃষ্টবাদ বিরোধী চরমবাস্তববাদী।
‘ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবেই’ বলে
কোনও রাজনৈতিক নেতা বা দলই
নির্বাচনের লড়াইতে হাত
গুটিয়ে বসে থাকে না।
মিটিং, মিছিল, প্রচারের বিশাল ব্যয়, কর্মী, পেশিশক্তি, আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড়, বোমের স্টক, জালিয়াতির নব-নব কৌশলকে কাজে লাগানোর প্রয়াস, বুথ দখল ইত্যাদি সকল বিষয়েই বিরোধী প্রার্থীকে টেক্কা দিয়েই জেতার চেষ্টা করে।
মগজ ধোলাই প্রসঙ্গে
রাজনীতিকদের জ্যোতিষ ও রাজনীতি
তাবৎ ভারতবাসীদের চেতনাকে প্রভাবিত করার মতো একটি ঘটনা ঘটল ২১ জুন ’৯১। ভারতের নবম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরসিমহা রাও ওই দিন শপথ নিলেন পাঁজিপুঁথি দেখে রাহুর অশুভ দৃষ্টি এড়াতে ১২টা ৫৩ মিনিটে ।
পি. ভি. নরসিমহা রাও সুপণ্ডিত, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বহুভাষাবিদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, রাষ্ট্রের কান্ডারি। এমন একজন বিশাল মাপের মানুষ জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি যখন অগাধ আস্থা পোষণ করেন, তখন সাধারণ মানুষেরও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আস্থা বাড়ে। জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততা বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বহু মানুষই এরপর শাস্ত্রটিকে অস্বীকার করাটা কিঞ্চিৎ মূঢ়তা বলে মনে করতেই পারেন। অসাধারণ মানুষের বিশ্বাস সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রভাবিত হলে সাধারণ মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে জন্মকালেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। জীবনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আগে থেকেই ঠিক হয়ে রয়েছে। এ অমোঘ, অব্যর্থ ।
নির্ধারিত কথার অর্থ— যা ঠিক হয়েই রয়েছে; যার পরিবর্তন সম্ভব নয়। জ্যোতিষীরা দাবি করেন, জ্যোতিষশাস্ত্র এমন একটি শাস্ত্র যে শাস্ত্রে-নির্ধারিত পথে বিচার করে একজন মানুষের পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য গণনা করা যায়।
মজাটা হল এই, সাধারণ মানুষ যখন শ্রীনরসিমহা রাওয়ের জ্যোতিষ পরামর্শ মেনে শপথ গ্রহণ করার ঘোষণায় শ্রীরাওকে জ্যোতিষশাস্ত্র পরম শ্রদ্ধাবান ও বিশ্বাসী বলে মনে করছেন, তখন শ্রীনরসিমহা রাও কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর সামান্যতম আস্থা প্রকাশ করে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে বসে থাকেননি। শ্রীশরদ পাওয়ারকে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রতিযোগিতায় পরাজিত করার জন্য বিড়লা, হিন্দুজা, আম্বানিদের মতো বিশাল শিল্পপতিদের দোরে দোরে ঘুরছেন। নিজের দলের সাংসদদের সমর্থন আদায় করতে নাকি প্রত্যেক সমর্থক সাংসদকে ৫০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছেন শ্রীশরদ পাওয়ারের শিবির, যাতে শামিল হয়েছিলেন কিলস্কার, বাজাজ, নুসলি ওয়াদিয়া, গুলাবচাঁদ প্রমুখ শিল্পগোষ্ঠী। শ্রীনরসিমহার পক্ষে সিংহভাগ সাংসদদের সমর্থন নিশ্চিত করতে শ্রীনরসিমহার সমর্থক শিল্পগোষ্ঠীই নাকি অর্থ জুগিয়েছেন। এ-সবই এই বইটির পাঠকদের কাছে পুরোনো খবর হয়ে গেছে। কারণ এই খবর তামাম ভারবর্ষের বহু পত্র-পত্রিকাতেই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল ‘৯১-এর ২০, ২১, ২২ জুন। শ্রীনরসিমহা সত্যিই যদি জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন, তবে নিশ্চয়ই তাঁর নিত্যকার দুপুরের ভাত-ঘুমকে নির্বাসনে পাঠিয়ে শ্রীশরদকে রুখতে শিল্পপতিদের কাছে হত্যে দিয়ে পড়তেন না, পাওয়ার দখলের জন্য প্রাণকে বাজি রেখে লড়াই চালাতেন না। জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিশ্বাস করে, ভাগ্যকে বিশ্বাস করে শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার রুটিনই বজায় রাখতেন। ভাগ্য যদি পূর্বনির্ধারিত থাকে, তবে কে তাকে খণ্ডাবে? এ তো অমোঘ, অব্যর্থ। আর ভাগ্যে যদি প্রধানমন্ত্রী হওয়া লেখা না থাকে, তবে কোনও চেষ্টাতেই তা হবে না। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বঞ্চিত হলে সে বঞ্চনার কারণ অবশ্যই ভাগ্য; যে ভাগ্য জন্মকালীন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে গেছে।
মহা-বিস্ময় জাগে যখন দেখি সুপণ্ডিত, ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ শ্রীনরসিমহা রাও কথা ও কাজে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন। সমস্ত প্রচার মাধ্যমগুলোর সাহায্যে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার কথা প্রচার করছেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি, নিজের ভাগ্যের লিখনের প্রতি সামান্যতম বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা না রেখে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে সংগ্রাম চালিয়েছেন।
কেন এই দ্বিচারিতা? তবে কি ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ শ্রীরাও চান তাঁর শাসনকালে বঞ্চিত মানুষগুলো তাদের প্রতিটি বঞ্চনার জন্য নিজ-ভাগ্যকেই দায়ী করুক? তাই কি ডংকা বাজিয়ে জ্যোতিষ বিশ্বাসের পক্ষে তাঁর প্রচার? তাঁর এই স্ববিরোধী চরিত্রের কথা দেশবাসীরা যদি তোলে তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁদের উদ্দেশে কী বলবেন? তখন কী উপদেশ দেবেন, “হে দরিদ্র-ভারতবাসী, হে মূর্খ-ভারতবাসী, আমি যা বলি তাই কর, যা করি তা কর না।”
যে শিল্পপতি, ধনীদের দেওয়া সহস্র কোটি টাকা ব্যয় করে শ্রীরাওয়ের দল ক্ষমতায় এসেছেন, যে শিল্পপতিদের পছন্দের মানুষ হিসেবে শ্রীরাও নেতা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও কিছু করার চিন্তা নিশ্চয়ই শ্রীরাও বা তাঁর দল কখনওই করবেন না, করতে পারেন না। তেমনটা করলে শ্রীরাও এবং তাঁর দলের সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
১৯৯০-এর নভেম্বর চন্দ্রশেখর যখন প্রধানমন্ত্রী হন এবারের চেয়েও বেশি টাকার খেল হয়েছিল। সে-বারও ‘কিংমেকার’ শিল্পগোষ্ঠীরাই চন্দ্রশেখরকে পছন্দ করেছিলেন বলেই চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। শিল্পপতিরা নিশ্চয়ই তাঁদের কৃপা করবে, তাঁদের পিছনেই অর্থ ঢালবে, শাসনক্ষমতায় বসাবে, যাঁরা শিল্পপতিদের একান্তই বিশ্বস্ত। অতএব এইসব শাসকগোষ্ঠী ধনকুবেরদের যে বিরোধিতা করতে পারে না, করার সাধ্য নেই এ-কথা অতি স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে।
সংসদীয় নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দল শাসনক্ষমতা দখলের দিকে এগোতে চাইলে, লোকসভায় বা বিধানসভায় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়ে দাপট বজায় রাখতে চাইলে সেই রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে বিপুল অর্থ ঢালতেই হবে। বর্তমানে নির্বাচন মানেই এক-রাজসূয় যজ্ঞ। বিশাল প্রচার ব্যয়, রিগিং, বুথদখল, ছাপ্পা ভোট এ-সব নিয়েই এখনকার নির্বাচন। এ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মাসলম্যানদের পিছনেও বইয়ে দিতে হয় অর্থের স্রোত। এই শত-সহস্র কোটি টাকা গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের এক-টাকা দু-টাকা বা পাঁচ-টাকা চাঁদায় তোলা যায় না। তোলা হয়ও না।
নির্বাচনী ব্যয়ের শতকরা ৯৯ ভাগেও বেশি টাকা জোগায়
ধনকুবেররা। বিনিময়ে তারা এইসব দলগুলোর কাছ থেকে
পায় স্বস্তিতে শোষণ চালাবার গ্যারান্টি। বড় বড় রাজনৈতিক
দলগুলো কৌশল হিসেবে খেটে খাওয়া মানুষদের
কাছ থেকে নির্বাচনী তহবিলের জন্য চাঁদা
আদায় করে দেখাতে চায়
“মোরা তোমাদেরই লোক।”
এইসব রাজনৈতিক দলের নেতারা যখন মাঠে-ময়দানে, পত্র-পত্রিকায়, বেতারে, দূরদর্শনে, গরিবি হটানোর কথা বলেন, শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলেন, মেহনতি মানুষের হাতিয়ার বলে নিজেদের ঘোষণা করেন, তখন কিন্তু এইসব তর্জন গর্জনে শোষকশ্রেণির সুখনিদ্রায় সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটে না। শোষকশ্রেণি জানে তাদের কৃপাধন্য, তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের এইসব বজ্রনির্ঘোষ স্রেফ ছেলে ভুলোনো ছড়া; সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষকে ভুলিয়ে রাখার এ এক কৌশল। হুজুরের দল চায় এ-ভাবেই তাদের ক্রীড়নক রাজনৈতিক দলগুলো শোষিতদের আপনজনের মুখোশ পরে শোষিতদের বিভ্রান্ত করুক, যাতে তাদের সম্মিলিত ক্ষোভ দানা বেঁধে বিস্ফোরিত হতে না পারে। এই সমাজ-ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে শোষণ কায়েম রাখার স্বার্থেই শোষণকারীদের দালাল রাজনৈতিক দলগুলো শোষিত সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে নানা ভাবে।
হুজুরদের কৃপাধন্য রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার মধুর লোভে সব সময়ই চায় ক্ষমতায় কাছাকাছি থাকতে।
বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে
নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে শোষকশ্রেণির
দালালির অধিকার লাভের প্রতিযোগিতা।
ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই চায় মানুষ অদৃষ্টবাদী হোক, বিশ্বাস করুক পূর্বজন্মের কর্মফলে, ঘুরপাক খাক নানা সংস্কারের অন্ধকারে। এমন বিশ্বাসগুলো শোষিত মানুষগুলোর মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারলে শোষিত মানুষ তাদের প্রতিটি বঞ্চনার জন্য দায়ী করবে নিজের ভাগ্যকে, কর্মফলকে, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়াকে।
সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে গতিশীল করতে, সমাজ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যুক্তিবাদী দর্শনের বিশাল ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনই যুক্তিবাদী দর্শনের সঠিক প্রয়োগের জন্যেই সমাজ সম্পর্কিত বেশ কিছু শব্দ বা বিষয় সম্বন্ধে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে সেই সব শব্দ বা বিষয়ের প্রকৃত স্বরূপ জানা, নব-মূল্যায়ন করা, নতুন মূল্যবোধ গড়ে তোলা একান্তই প্রয়োজন। এই শব্দ বা বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’, ‘গণতন্ত্র’, ‘দেশপ্রেম’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’, ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘জনসেবা’, ইত্যাদি বহু কিছু, যে-সব নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলো ভ্রান্ত এবং শাসক ও শোষকশ্রেণি তাদের শ্রেণি স্বার্থেই ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে এইসব ভ্রান্ত ধারণাকেই জিইয়ে রাখতে, পুষ্ট করতে সচেষ্ট। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্বার্থে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বার্থে অতি প্রয়োজনীয় বিবেচনায় এমনই কিছু বিষয় নিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী আলোচনায় যাচ্ছি।
অধ্যায়ঃ এক
♦ বিভ্রান্তির সংস্কৃতিঃ বাঁচাও তাহারে মারিয়া
অধ্যায়ঃ দুই
♦ অপসংস্কৃতি ও সুস্থ সংস্কৃতিঃ পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হোক সুচেতনার পথে
অধ্যায়ঃ তিন
♦ সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ পৃথিবীর পথে হাজার বছর হাঁটা
অধ্যায়ঃ চার
♦ ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ কেউ কথা রাখেনি
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ নকশালবাড়ির সংগ্রামে উব্ধুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন, সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ এসো আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ যুক্তির পথচলাঃ লোভের অন্ধকারে ঢোকে না দিনের আলো
অধ্যায়ঃ নয়
♦ অতি ব্যবহৃত কিছু শব্দঃ সিন্দুকেতে মন ভরেছে ভেতরে তার কি আছে কেই বা রাখে খোঁজ?
“সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ