অনেক অধ্যাত্মবাদী নেতা ও প্যারাসাইকোলজিস্টদের লেখায় ও কথায় আজকাল মাঝে-মধ্যেই ঝলসে উঠছে- ‘বিজ্ঞান ও আত্মার অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে।‘ এমন আশাও লিখিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে- অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞান ভূত ও পরলোকের অস্তিত্বকে মেনে নেবে।

এই ধরনের প্রচারের পিছনে কতটা সততা বা কতটা অসততা আছে, আসুন আমার যুক্তির নিরিখে বিশ্লেষণ করে দেখি।

অধ্যাত্মবাদীদের দেওয়া, ধর্মীয় বিশ্বাসের দেওয়া ‘আত্মা’র সংজ্ঞা থেকে আমরা যদি নির্যাস তুলে নিই, দেখব উঠে এসেছে প্রধান দুটি মত। একঃ চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মনই আত্মা। আগে এই প্রথম মতটিকে নিয়েই আলোচনা শেষ করে নিই।

মনের অস্তিত্বকে বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান কখনোই অস্বীকার করে না। ‘মন’কে মেনে নেওয়া মানে আত্মাকেও মেনে নেওয়া, আত্মার অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া- এমন অর্থ যদি কেউ করেন, করতে পারেন। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। ধরুন, কাল কেউ যদি এসে আপনাকে বলেন, “আপনি কি স্বীকার করেন, মানুষের নাক আছে?” আপনি তখন কি বলবেন? নিশ্চয়ই বলবেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই স্বীকার করি।“ তখন প্রশ্নকর্তা যদি বলেন, “আমি এবং আমার ভক্তরা নাককেই আত্মা বলি। এ’বার আপনি কি আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারছেন?” তখন আপনি বলতেই পারেন, “আপনি যদি নাককে ‘আত্মা’ বলতে চান, বলতেই পারেন। সে বাক-স্বাধীনতা আপনার কাছে। আমার নাকের অস্তিত্ব মেনে নেওয়াকে আত্মার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া বলে আপনি প্রচার করতে পারেন। আপত্তি করব না। কিন্তু আপনি, যদি এরপরের ধাপে বলে বসেন, ‘আত্মা অমর’, এবং আমি আত্মার অস্তিত্ব মেনে নিয়েছি, অর্থাৎ আত্মার অমরতাকেও মেনে নিয়েছি, তবে এমন উদ্ভট কথার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করব। ‘মানুষের নাকগুলো অমর’, একজন সুস্থ স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আমি কখনোই এমন পাগলামো মেনে নিতে পারি না। এটা স্পষ্ট করে বলি, ‘নাক’-এর অস্তিত্ব মেনে নেওয়া কখনোই ‘নাক’-এর অমরতাকে মেনে নেওয়া নয়।“

ঠিক এই একই ধরনের যুক্তিতে, মনরূপী আত্মাকে অমর বলে কেউ দাবি করার পাগলামি দেখালে সুস্থ-স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে আমরা নিশ্চয়ই তা মেনে নিতে পারি না। যারা প্রচার করেন- ‘বিজ্ঞান আত্মার অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে’, তাঁরা আসলে এই ধরনের প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মাথায় ঢোকাতে চান, বিজ্ঞান আত্মার অমরত্বকেই মেনে নিয়েছে।

বিজ্ঞান পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে- মন, চিন্তা বা চৈতন্য মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরই ক্রিয়া-বিক্রিয়া বা কাজ-কর্মের ফল, মস্তিষ্ক বহির্ভূত কোনও বস্তু বা পদার্থ নয়। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ ছাড়া চিন্তা মনের অস্তিত্ব অসম্ভব বা অবাস্তব। শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, পোকা-মাকড়ের চিন্তার ক্ষেত্রেও রয়েছে স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়া। প্রাণীদের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের কাজ সবচেয়ে উন্নত, তাই তার চিন্তা ক্ষমতাও সবচেয়ে বেশি, এই যা। মানুষের মৃত্যু ঘটলে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বাস্তব অস্তিত্বই বিলীন হতে বাধ্য। কারণ মৃত্যুর পর সাধারণভাবে দেহও বিলীন হয় পুড়ে ছাই হয়ে, কবরের মাটিতে মিশে গিয়ে, অথবা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পচে গলে জন্তুর পেটে গিয়ে। দেহ বিলীনের সঙ্গে সঙ্গে দেহাংশ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষও বিলীন হয়। এরপর মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ নেই, কিন্তু তার কাজ-কর্ম আছে এবং কাজ-কর্মের ফল হিসেবে মনও আছে- এমনটা শুধু কল্পনাতেই সম্ভব।

এই আলোচনা শেষে আমরা নিশ্চিত সিদ্ধাতে পৌঁছতে পারি, চিন্তা, চেতনা বা মনই যদি আত্মা হয়, তবে সেই আত্মা কখনোই অমর হতে পারে না।

এ’বার আমরা আলোচনা করব দ্বিতীয় মতটি নিয়ে। এই মতটি হল- চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন হল আত্মারই কাজ-কর্মের ফল। অর্থাৎ আত্মার ক্রিয়া হিসেবেই মন বা চিন্তার উৎপত্তি।

শরীর-বিজ্ঞানের ও মনোবিজ্ঞানের চিত্রটা এখন আমাদের কাছে খুবই পরিষ্কার। এখন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গেই আমরা বলতে পারি- এই দ্বিতীয় মতাবলম্বীরা মনকে ‘আত্মা’ না বলে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষকেই ‘আত্মা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, যার ক্রিয়া থেকে চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মনের উৎপত্তি, বিজ্ঞান তাকে বলে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ ; যদিও কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস ও কিছু ধর্মগুরু তাকে ‘আত্মা’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

মানুষ মরণশীল। গোটা মানুষটাই যখন মরণশীল, তখন তার দেহাংশও যুক্তিগত ভাবে মরণশীল হতে বাধ্য। অতএব আমরা খুব সহজেই এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি- মানুষের দেহাংশ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষও মরণশীল। মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ মরণশীল হলে তাকে ‘আত্মা’ ‘চৈতন্য’ বা যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তা মরণশীলই থাকবে, অমরত্ব লাভ করবে না।

‘মন’ বা ‘মনের কারণ’-কে এক সময় অধ্যাত্মবাদীরা অমর বলে মনে করেছিলেন। শুরুতে কোনও গভীর ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনার সঙ্গ হিসেবে এমনটা প্রচার করেনি। শোষকদের সুবিধে করে দেবার জন্যেও এমনটা প্রচার করেননি। শুরুর এই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল তাঁদের শরীর বিজ্ঞানকে জানতে না পারার অক্ষমতা। অধ্যাত্মবাদীরা সে সময় ‘মন’কে মনে করতেন দেহাতীত বা দেহ-বিচ্ছিন্ন এক অদ্ভুত কিছু, যা দেহকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করলেও দেখা যায় না, যা স্পর্শ করা যায় না, অথচ যাকে সব সময়ই অনুভব করছি। ‘মন’ আছে কি নেই, এই প্রশ্ন যে করাচ্ছে, সেই মন। অর্থাৎ ‘মন’ এমনই একটা কিছু, যাকে অনুভব করা যায়, যা মুহূর্তে লক্ষ- কোটি মাইল ঘুরে আসে, যাকে দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, তলোয়ারের আঘাতে ছিন্ন করা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না।

মনকে ‘আত্মা’ বলে, বা মনের কারণ-কে ‘আত্মা’ বলে চিহ্নিত করে একে এক রহস্যময় বিষয় করে তুলেছে অধ্যাত্মবাদীরা। অজ্ঞানতার অন্ধকারই ‘মন’ –এর এই রহস্যময়তা সৃষ্টির কারণ।

অধ্যাত্মবাদীরা এক সময় মানুষের মৃতদেহ দেখে গভীরভাবে চিন্তা করেছে, জীবিত ও মৃত মানুষের দেহর পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে। তাঁদের মনে হয়েছে, দুটি ক্ষেত্রেই দেহ তো উপস্থিত, অনুপস্থিত শুধু ‘চৈতন্য’ বা ‘মন’। এই ‘চৈতন্য’ বা ‘মন’ –এর অনুপস্থিতির জন্য একটি দেহ মৃত এবং তারপর এই দেহকে সংরক্ষণের চেষ্টা করলে তাতে পচন ধরবেই। এই অবস্থাই তাদের চোখে এক সময় আত্মা যে দেহাতিরিক্ত বিষয়, তারই প্রমাণ হিসেবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ‘চিন্তা’ বা ‘মন’ –এর উৎপত্তি কোথা থেকে এটা তো মানুষ এক দিনে জানেনি। শরীর বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে ধাপে ধাপে মানুষ পরিচিত হয়েছে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ ও তার কাজ-কর্মের সঙ্গে। আর তারপর যত বেশি বেশি করে মানুষ এই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের কাজ-কর্ম ও আত্মার সংজ্ঞা, উভয়ের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছে, ততই আত্মা তার অমরত্ব হারিয়েছে।

বহুক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে, শিক্ষিত এমনকি চিকিৎসকরাও শরীর বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান ও ধারণা থাকার জন্য ‘মন’ বা ‘চেতনা’র কারণ যে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ, এ কথা জানেন ; কিন্তু জানেন না ‘আত্মা’র সংজ্ঞা ; ফলে ছোট-বেলা থেকে জেনে আসা কথা, ‘আত্মা অমর’, তাতেই বিশ্বাস করে বসে আছেন। তারা যদি একবারের জন্যেও জানতে পারতেন অধ্যাত্মবাদীরা কেউ ‘মন’কে কেউ বা ‘মনের কারণ’ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষকে ‘আত্মা’ বলে চিহ্নিত করেছেন, তাহলে এইসব শরীর বিজ্ঞান জেনেও আত্মায় বিশ্বাসীদের বিশ্বাস যেত চটকে।

বর্তমানে মানুষ যখন ইজ্ঞানের প্রযুক্তিকে জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহার করছে, শরীর বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ স্কুল গণ্ডিতেই হয়ে যাচ্ছে, তখন অধ্যাত্মবাদীরা তাদের টিকে থাকার প্রয়োজন অধ্যাত্মবাদীরা একই সঙ্গে মিথ্যাচারিতা, অসচ্ছ ভাসাভাসা কথা ইত্যাদির আশ্রয় নিচ্ছে। ওরা এক দিকে যেমন ‘মৃত্যু ও পরলোক’ মৃত্যুর পরেও আত্মার কথা’ ইত্যাদি জাতীয় বইগুলোতে নিজ আত্মার বিশ্ব ব্রহ্মান্ড পরিক্রমার নানা গল্প পর্যন্ত ফাঁদছে, তেমনই ‘আত্মা’র সংজ্ঞা বিষয়ে অদ্ভুত রকম নীরবতা পালন করছে। কারণ এইসব অধ্যাত্মবাদীরা খুব ভাল মতই নিজেদের বাস্তব অবস্থান ও দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ওঁরা জানেন সাধারণের কাছে আত্মার সংজ্ঞা, আত্মার ধর্মীয় ধারণাগুলোর বিস্তৃত আলোচনাই আত্মার মরণ ডেকে আনবে।

কিছু কিছু অধ্যাত্মবাদী নেতা আত্মার অমরতায় বিশ্বাস করে বসে আছেন শরীর বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে, এ’কথা সত্যি। তারই সঙ্গে এও সত্যি, এ’যুগে অধ্যাত্মবাদের নেতৃত্ব রয়েছে জানা, বোঝা শিক্ষিতদের হাতেই, যারা জানেন ও বোঝেন  এক রকম, জানান ও বোঝান আর এক রকম। এমনটা হওয়ার কারণ, আজও আমাদের সমাজে অধ্যাত্মবাদীরা পূজিত হন, অর্থ ও ক্ষমতা দুইই পোষা কুকুরের মতই তাঁদের পাশে পাশে ঘোরে।

এরই পাশাপাশি আমাদের অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক শক্তি তাদের টিকে থাকার স্বার্থেই অধ্যাত্মবাদকে টিকিয়ে রাখতে চায়, অধ্যাত্মবাদকে পুষ্ট করতে চায়। অসম বিকাশের এই দেশের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও অনেক সাধু-সন্তদের কাছে নতজানু হওয়ার মধ্যে কিছুটা ‘গাইয়াপনা’ খুঁজে পান। এই শ্রেণীর মানুষদের জন্য সমাজ নিয়ন্ত্রক শক্তি হাজির করে প্যারাসাইকোলজিস্ট নামধারী বিজ্ঞানের মুখোশ আঁটা অধ্যাত্মবাদীদের।

অধ্যাত্মবাদীদের দু’টি শিবিরের দ’টি শিবিরের দেওয়া আত্মার সংজ্ঞা বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করলে আমরা একটিমাত্র সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে বাধ্য- আত্মা মরণশীল।

এরপর ভূত-প্রেত প্ল্যানচেট-পরলোক-পরলোকের বিচারক পরমাত্মা-স্বর্গ-নরক ইত্যাদি প্রতিটি বিশ্বাসই অলীক হয়ে যায়।

এই সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছেছি অধ্যাত্মবাদের তত্ত্বকে মেনে যুক্তির পথ ধরে, অধ্যাত্মবাদের তত্ত্বকে অস্বীকার করে নেয়।

error: Content is protected !!