অপার্থিব

যুক্তিবাদ এক কথায় এমন একটি জীবনাদর্শ বা ব্যক্তিগত দর্শন যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, যেখানে প্রযোজ্য সেখানে যুক্তি এবং সাক্ষ্যই প্রাধান্য পায় । যুক্তিবাদ কেবল ‘যুক্তি, প্রমাণ ও সুবিচার চিন্তার দ্বারাই সত্যতা যাচাই ও বাস্তব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়’– এই পথকে স্বীকৃতি দেয় । যুক্তিবাদের এক আবশ্যিক প্ৰথম শর্ত হল সংশয়বাদ, অর্থাৎ যুক্তি প্রমাণ ও সহায়ক উপাত্তের অভাবে কোন কিছুর সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত বিচার বা সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকা ৷ অনেকে যুক্তিবাদের সাথে মুক্তচিন্তাকে যুক্ত করেন । যুক্তিবাদ যদিও আবশ্যিকভাবে মুক্তচিন্তা বোঝায়, কিন্তু মুক্তচিন্তা সব ক্ষেত্রে যুক্তিবাদের সমার্থক নাও হতে পারে । মুক্তচিন্তার অর্থ হল বস্তুজগৎ বা জীবন সম্পর্কে কোন স্থির মতবাদ বা দৈব আদেশ বা ধর্মীয় বিধানকে আশ্রয় না করে স্বকীয় চিন্তার দ্বারাই অভিমত বা সিদ্ধান্ত নেয়া । কাজেই দেখা যাচ্ছে যে যুক্তিবাদ আবশ্যিকভাবে মুক্তচিন্তা বোঝায়, যেখানে স্বকীয় চিন্তার দ্বারাই অভিমত বা সিদ্ধান্ত নেয়া এবং প্রমাণের দ্বারা চালিত । কিন্তু ‘স্বকীয় চিন্তা’ যুক্তি এবং প্রমাণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নাও হতে পারে, যদিও তা কোন মতবাদ বা দৈব আদেশের উপর নির্ভরশীল নয় । সে ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা যুক্তিবাদের সমার্থক হতে পারে না । যেমন উত্তর-আধুনিকতাবাদ বা বিশৃঙ্খলাবাদ । এই দুই মুক্তচিন্তা ভিত্তিক ‘বাদ’ যুক্তি প্রমাণের উপর নির্ভর করে না, আবার কোন প্রচলিত মতবাদ বা ধর্মীয় বিধানও স্বীকার করে না । অনেকটা ‘যেমন খুশী তেমন ভাব’-এর মত ব্যাপার।

যুক্তিবাদ এমন একটি দর্শন যা কঠোর মানসিক শৃঙ্খলা দাবি করে । কাজে ও কর্মে এটা অনুসরণ করা অনেকের কাছেই কষ্টকর ব্যাপার মনে হতে পারে । আবার অনেকে সত্যিকার অর্থে যুক্তিবাদী না হয়েও নিজেকে যুক্তিবাদী হিসেবে গণ্য করেন। এর কারণ হল তারা কিছু আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্তিবাদের অংশ বলে মনে করেন, যদিও আসলে তা যুক্তিবাদের ফলশ্রুতি নয়। যুক্তিবাদের একমাত্র আবশ্যকীয় শর্ত হল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি । একজন যুক্তিবাদী কোন রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের প্রতি অন্ধ বা নিঃশর্ত আনুগত্য বা সমর্থন প্রদর্শন করতে পারেন না । একজন যুক্তিবাদী অনির্বচনীয় বাক্যকে (non-propositional statement) প্রমাণ বাক্য (statement of truth) বলে চালাতেও পারেন না । উদাহরণস্বরূপ, যুক্তিবাদীরা এই ঘোষণা দিতে পারেন না যে ‘ঈশ্বর নাস্তিমান’, কারণ ঈশ্বরের সঠিক ও অসঙ্গতিমুক্ত সংজ্ঞা না থাকায় ঈশ্বর কোন প্রতীতি ধারণা নয় । তাই ‘ঈশ্বর নাস্তিমান’ এটা সত্যিকার অর্থে কোন বচন বাক্য (proposition) নয় । কাজেই এটা প্রমাণ বাক্যও হতে পারে না । যুক্তিবাদীরা আস্তিকদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের দাবি ও তার সহায়ক যুক্তির ত্রুটিসমূহ প্রতিযুক্তির মাধ্যমে বা দ্বান্দ্বিক পথে ধরিয়ে দিতে পারেন । এর বেশি নয় । ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে যুক্তিবাদীরা তাই আবশ্যিকভাবেই অপ্রতীতিবাদী (noncognitvist) । তারা অজ্ঞেয়বাদীও (agnostic) হতে পারেন না, কারণ অজ্ঞেয়বাদীরা ঈশ্বরের সংজ্ঞা আছে ধরে নিয়েই (যদিও তারা সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দিতে অক্ষম) কেবল এটাই বলেন যে ঈশ্বর আছেন কি নেই এটা তাদের জানা নেই, বা প্রমাণের অভাবে এখনো জানা সম্ভব নয় । কিন্তু ঈশ্বরের প্রকৃত সংজ্ঞা না থাকায় যুক্তিবাদীরা অজ্ঞেয়বাদীদের এই বাক্যকেও যুক্তিবহির্ভূত মনে করেন।

যুক্তিবাদের আলোচনা থেকে অনেকের মনে হতে পারে যে, যুক্তিবাদীদের কোন ব্যাপারে অভিমত থাকতে পারে না । কিন্তু তা ঠিক নয় । কোন অভিমত যদি যুক্তি, প্রমাণ ও পর্যবেক্ষণ বিরোধী না হয়, তাহলে তা যুক্তিবাদ বিরোধীও নয়। এরকম অভিমত যুক্তিবাদীরা আপাতত গ্রহণ করতেই পারেন । তবে পরে প্রমাণ ও পর্যবেক্ষণ তা ভুল বলে প্রতীয়মান করতে পারে এই সম্ভাবনাকে মেনে নিয়ে খোলা মন রাখাও যুক্তিবাদের অংশ । অণুকল্প (Hypothesis) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । অণুকল্পকে বৈজ্ঞানিক অভিমতই বলা যায় । অনুকল্প যখন বৈজ্ঞানিক আশ্রয়বাক্য (premise) সহযোগে প্রপঞ্চবিষয়ক কোন প্রমাণবাক্য দেয় তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলা হয় (scientific theory)। তত্ত্ব যখন পুনঃ পুনঃ পর্যবেক্ষণ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় তখন তা বৈজ্ঞানিক সূত্র বা বিধি (law) বলে গণ্য হয়। আগেই বলেছি যুক্তিবাদ কোন স্থির মতবাদে বিশ্বাস করে না । সেহেতু স্থির মতবাদভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেমন ধর্মবাদী বা কম্যুনিস্ট রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থক হতে পারেন না । কোন কোন বুদ্ধিজীবী বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শকে প্রগতিশীল আখ্যা দিয়ে ভুলবশত যুক্তিবাদের সঙ্গে যুক্ত করেন । স্থির মতবাদ ভিত্তিক নয় এমন রাজনৈতিক আদর্শ বা দলের ব্যাপারে অবশ্য যুক্তিবাদ নিরপেক্ষ । সেখানে ব্যবহারিক বিবেচনা ও সাধারণ জ্ঞানের মৌলিক প্রয়োগই যথেষ্ট । অনেক বুদ্ধিজীবী আবার মনে করেন যে যুক্তিবাদী মাত্রই গর্ভপাতের প্রশ্নে ইচ্ছা/অনিচ্ছা অর্থাৎ পছন্দের পক্ষ নেবেন, বা মানুষের আচরণে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রভাবের প্রশ্নে পরিবেশের পক্ষ নেবেন, বা নৈতিক আপেক্ষিকতায় (moral relativism) বিশ্বাস করবেন ইত্যাদি । এও ভ্ৰান্ত চিন্তা ৷ যুক্তিবাদীরা বিজ্ঞানের আলোকেই শুধু বিচার বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন । বিজ্ঞান ও যুক্তি যেখানেই চালিত করে যুক্তিবাদীরা সেখানেই দ্বিধাহীনভাবে যেতে প্রস্তুত থাকবে, যদি তা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সহজাত প্রবৃত্তিজনিত পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধেও যায়। সত্য অপ্রিয় হলেও তাকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়াই হচ্ছে যুক্তিবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। যুক্তিবাদ হৃদয়হীন। যুক্তি ও প্রমাণের কাছে নিজের আপনজন, প্রিয়জন, নিজের দেশ, ধর্ম, ভাষা কোনটারই বিশেষ স্থান নেই । যুক্তির কাছে সবই সমানভাবে একই নিরিখে বিচার্য । এ কারণে যুক্তিবাদীর জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা বেশি নয় । যুক্তিবাদ রাজনৈতিক সঠিকতার ধার ধারতে পারে না। সব মন্দ বা দোষ সমান এমন স্বীকার্য যুক্তিবাদবিরোধী, যদিও রাজনৈতিক সঠিকতা তাই বলে । যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ দ্বারা ভাল বা মন্দের মানগত তারতম্য নির্ধারণ করাই যুক্তিবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ । যুক্তিবাদের কাছে জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ইত্যাদি গৌণ । যুক্তি ও প্রমাণই মুখ্য। কোন সময় যুক্তিবাদ জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে, আবার কোন সময় তার বিরুদ্ধে যেতে পারে । এমনকি মানবতাও যুক্তিবাদ থেকে লব্ধ কোন ধারণা নয় । মানবতা একটি পৃথক স্বতঃসিদ্ধ (aniom) হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। মানবতা যুক্তিবাদের সঙ্গে যুক্ত হলে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি লব্ধ হয়। মূল্য বিচার (value judgement) যুক্তিবাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়।

এখন প্রশ্ন হল প্রকৃত যুক্তিবাদী কোন নিরিখে বিচার্য? সবাই তো নিজেদের যুক্তিবাদী দাবি করতে বা ভাবতে চায় । ধর্মবাদী, সাম্যবাদী বা যে কোন ‘বাদী’রাও দাবি করবেন যে তারা যুক্তি ও প্রমাণ মেনে চলেন ও কাজ করেন । এই প্রশ্নের আলোচনায় যেতে একটু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন । স্থির বা ডগমাটিক মতবাদের সমর্থকদের যুক্তি ও প্রমাণ সার্বজনীন বা বস্তুনির্ভর (objective) নয় । বস্তুত তাদের যুক্তি হল পূর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্তে উপনীত হবার উদ্দেশ্যে যুক্তিবিজ্ঞানের নিয়ম বহির্ভূত নিজস্ব সৃষ্ট সুবিধাবাদী ও আত্মনির্ভর বা বিষয়ীমুখ (subjective) যুক্তি । কিন্তু যুক্তিবাদীদের যুক্তি হল সেই যুক্তি যা শত শত বছরের পরীক্ষিত, যা সার্বজনীন ও বস্তুনির্ভর, শিক্ষায়তনের পাঠ্যসূচিতে গৃহীত এবং যার প্রয়োগের মাধ্যমেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সৃষ্টি, যার সাফল্য অবিসংবাদিত । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যুক্তিশাস্ত্রের মধ্যে গুণগত কোন তফাৎ নেই । আশ্রয়বাক্যের (premise) গঠন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু সিদ্ধান্তের (inference) পদ্ধতির বিশেষ কোন পার্থক্য নেই । নির্ভুল যুক্তি যেহেতু বস্তুনির্ভর, সেহেতু আবশ্যিকভাবেই সাৰ্বজনীন।

এখন আসা যাক যুক্তিবাদ সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণার আলোচনায় । কেউ বলেন যে যুক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করা ভুল । কারণ যুক্তিরও ভুল থাকতে পারে । কারণ যুক্তি তো মানুষেরই সৃষ্টি । মানুষের ভুল হওয়া স্বাভাবিক । শুনতে ‘যুক্তিসঙ্গত’ কথাই মনে হয়। কিন্তু মানুষের ভুলের জন্য যুক্তি ভুল হয় না । বরং মানুষের ভুল হয় বলেই যুক্তির উপর নির্ভর করা প্রয়োজন, যুক্তির সৃষ্টিই সে কারণে । যুক্তিবিজ্ঞানের কোন নিয়ম বা পদ্ধতি ভুল প্রমাণিত হলে তা অবশ্যই সংশোধিত হত । তাছাড়া কোন যুক্তি ভুল না শুদ্ধ সেটা যাচাই করতেও তো যুক্তি বা প্রমাণেরই আশ্রয় নিতে হয়, যুক্তি-প্রমাণের বাইরে থেকে নয় । অনেকে যুক্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলেন । যুক্তির সীমাবদ্ধতা মানুষের সীমাবদ্ধতারই প্রতিফলন । কিন্তু যুক্তির সীমাবদ্ধতার ধুয়া তুলে যুক্তির প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না, বা যুক্তির চাইতে শ্রেয় কোন বিকল্পের প্রশ্নও ওঠে না। এবং এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করেই তো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সত্যকে সর্বদা পরীক্ষামূলক (tentative) মর্যাদা দেয়। ‘পরম সত্যের’ কোন স্থান নেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। কারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মানুষের ভুল হওয়ার সম্ভবনাকে গুরুত্বের সাথে স্বীকৃতি দেয়। অনেকে স্বজ্ঞা বা অভিকল্পকে (intuition) সত্যকে জানার জন্য যুক্তি প্রমাণের চেয়েও উন্নততর পন্থা বলে মনে করেন । কিন্তু কোন বিশেষ ক্ষেত্রে স্বজ্ঞার প্রয়োগে আপাত সত্যে উপনীত হওয়া গেলেও এটা প্রমাণিত হয় না যে সাধারণভাবে স্বজ্ঞা যুক্তির চেয়ে শ্রেয় । তবে যুক্তি যে জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে সব সময়ে প্রযোজ্য হবে এটা মনে করাও ভুল । অনেক ক্ষেত্রে যেখান সঠিক বা আগাম তথ্য জানা সম্ভব নয়, সেখানে বুদ্ধিদীপ্ত অনুমান স্বজ্ঞার ওপর নির্ভর করতেই হয় । অবশ্য সে ক্ষেত্রেও যুক্তি সঠিক অনুমানের জন্য সহায়ক হতে পারে।

যুক্তিবাদ জীবনের সর্বপ্রকার সমস্যা নিরসনের বা সব ব্যাপারে সাফল্যের গ্যারান্টিও নয় । যুক্তিবাদ জীবনের সর্বক্ষেত্রে (যেমন বিবাহ) সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারেও গ্যারান্টি দিতে পারে না । অনেকে যুক্তিবাদকে রসকষহীন, সৌন্দর্য বা রোমান্টিকতাহীন, মায়া মমতাহীন বলে হেয় জ্ঞান করেন। এটি এক ধরনের ভিত্তিহীন চিন্তা । যুক্তিবাদ মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের পৃথকীকরণের ওপর জোর দেয় ঠিকই, তবে হৃদয়কে সরিয়ে সেখানে মস্তিষ্ক বসানোর কথা বলে না । কিছু কিছু মানবিক বৈশিষ্ট্য সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে নিহিত, কাজেই তা যুক্তিবাদের আওতায় পড়ে না ৷ প্রেম, ভীতি, পরোপকারিতা, বিবেক, ইত্যাদি জীববৈজ্ঞানিক সহজাত প্রবৃত্তিতে (biological instinct) নিহিত। যুক্তিবাদের সঙ্গে প্রবৃত্তির কোন সম্পর্ক নেই । সহজাত প্রবৃত্তি বহুলাংশে বংশাণুজনিত (genetic), যা মস্তিষ্কের বিশেষ এক আঙ্গিকতন্ত্র (limbic system) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যুক্তিবাদী চিন্তা মূলত বংশাণুজনিত হলেও পরিবেশের প্রভাবেরও অবদান আছে, আর যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার নিয়ামক হল মস্তিষ্কের বল্কল (cortex) নামক অঙ্গ । লিম্বিক তন্ত্র সকল মানুষের মস্তিষ্কেই বিরাজমান । যুক্তিবাদের দ্বারা (অর্থাৎ কর্টেক্স এর দ্বারা) লিম্বিক তন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না । কাজেই অন্য সবার মতই একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তি বিশেষ পরিবেশে ভীতি অনুভব করতে পারেন, বা কোন বিশেষ মানুষের জন্য গভীর আবেগ অনুভব করতে পারেন, কে যুক্তবাদী আর কে ভাববাদী, বা কে বেশি যুক্তিবাদী আর কে কম, সেটা নির্ধারিত হয় তাদের কর্টেক্স এর পার্থক্যের কারণে । কিন্তু সব মানুষের লিম্বিকতন্ত্র একই ধরনের । তাই কোন অতীব সঙ্কটময় মুহূর্তে, যেমন জীবন মরণ প্রশ্নে, যখন লিম্বিকতন্ত্র মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই মুহূর্তে যুক্তিবাদী বা অযুক্তিবাদীর মধ্যে আচরণগত কোন তফাৎ থাকে না । কোন কোন রুচিও অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তিজনিত (যেমন খাবারের রুচি, পোশাকের রুচি) । তাই যুক্তির দ্বারা রুচির সৃষ্টি বা পরিবর্তন হয় না।

যুক্তিবাদকে হেয় করে দেখার আর এক কারণ হতে পারে যে, অনেকে মনে করেন যে মানবিক কাজ করার প্রেরণা কেবল হৃদয় থেকে আসতে পারে, যুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে নয় । আপাতদৃষ্টিতে কথাটি চিত্তাকর্ষক বটে। কিন্তু আগেই আভাস দিয়েছি যে পরার্থিতা (altrusim), আত্মত্যাগের তাড়না ইত্যাদি জীববিজ্ঞানের মৌলিক তাড়নাতেই নিহিত । কাজেই কেউ যুক্তিবাদী হলেও তার সেই সহজাত প্রবৃত্তি বা তাড়নাটা বিলুপ্ত হয় না । যুক্তিবাদ বড়জোর সেই প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশের রূপকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, প্রবৃত্তির কার্যকারিতা বা সুফলের উপর কোন ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে না। মানুষে মানুষে এই সহজাত তাড়নার তারতম্যের পেছনে রয়েছে বংশাণুজনিত পার্থক্য। যুক্তিবাদের কোন অবদান নেই এই তারতম্যে । তবে যুক্তিবাদ সহজাত প্রবৃত্তি বা তাড়না সৃষ্টি বা নিয়ন্ত্রণ না করলেও, এই প্রবৃত্তি বা তাড়নার বহিঃপ্রকাশকে শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সঠিক দিকে চালিত করতে পারে, যাতে তা অধিকতর কার্যকরী হয় । আবেগের দ্বারা চালিত পরার্থতা বা আত্মত্যাগ সব সময় সর্বাধিক কার্যকরী নাও হতে পারে। অবশ্য একজন যুক্তিবাদীও আবেগের দ্বারা পরার্থতা বা আত্মত্যাগ করতে পারেন । কারণ তা যুক্তিবিরুদ্ধ নয়। যুক্তিবাদ সত্যিকার অর্থে যেখানে অভিমত, চিন্তা, বিচার, জানা, বোঝা ও সমস্যা সমাধানের প্রশ্ন, সেখানেই প্রযোজ্য, যেখানে আবেগ বা মূল্যবিচারের প্রশ্ন, সেখানে নয়।

 

যুক্তিবাদের সংজ্ঞা

ঐতিহাসিকভাবে যে মতবাদে কেবল বৌদ্ধিক যুক্তিকেই (reasons) সত্যকে জানার বা জ্ঞানার্জনের মুখ্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয় তাকেই যুক্তিবাদ বলা হয় । এ মতবাদের প্রবক্তারা মনে করতেন যে মানুষের মধ্যে সত্যকে জানার এক বংশানুগত বুদ্ধি (intellect) ও পূর্বজ্ঞান (apriori knowledge) আছে যার দ্বারা সত্যকে জানা সম্ভব, যা অভিজ্ঞতার দ্বারা অর্জন করা যায় না।

এ মতবাদের পর্যবেক্ষণ ও ইন্দ্রিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানাহরণের ক্ষেত্রে গৌণ বা অবান্তর বিবেচনা করা হয়। ঐতিহাসিক যুক্তিবাদের সাথে জাগরণ যুগের (rennaissance) তিন প্রখ্যাত দার্শনিককে জড়িত করা হয় । এরা হলেনঃ

১. রেনে দেকার্তে (Rene Descartesm, 1596-1650)

২. গটফ্রিড উইলহেলম লাইবনিজ (Gottfried Wilhelm Leibniz, 1646- 1716)

৩. বারুখ স্পিনোজা (Barukh Spinoza, 1632-1677)

ঐতিহাসিকভাবে যুক্তিবাদের প্রতিযোগী মতবাদকে অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism) বলা হয়, যেখানে প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্ৰিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকেই সত্যকে জানার বা জ্ঞানার্জনের মুখ্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। অভিজ্ঞতাবাদের প্রধান প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক (John Locke), ডেভিড হিউম (David Hume) ও বিশপ বার্কলে (Bishop Berkeley). তবে এটি বলা বাহুল্য যে ঐতিহাসিক যুক্তিবাদ অন্ধ বিশ্বাস আর মতাদর্শেরও (dogma) পরিপন্থী । অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের প্রখ্যাত মার্কিন যুক্তিবাদী দার্শনিকেরা অন্ধ বিশ্বাস আর মতাদর্শবাদের (dogmatism) বিরুদ্ধেই বেশি সোচ্চার হয়েছিলেন তাদের লেখায় । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’জনের নাম হল রবার্ট ইঙ্গারসোল (Robert Ingersoll) ও ইথান এলেন (Eathan Allen). ইঙ্গারসোলের বিখ্যাত লেখার মধ্যে নাম করতে হয় ১৮৫৪ সালে লেখা বই ‘যুক্তি: মানুষের একমাত্র দৈববাণী’ (Reason: The Only Oracle of man) তিনি যুক্তি আর সুবিচার চিন্ত ার (critical thinking) গুরুত্বের কথা জোর দিয়ে লেখেন । আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির আলোকে ঐতিহাসিক যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের পার্থক্য এখন আর স্পষ্ট করে টানা যায় না । আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জানতে পারি যে জ্ঞান আহরণ ও বিকাশে বংশাণু (Gene) এবং অভিজ্ঞতা দুইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে । আবার বিজ্ঞানের আলোকে এও জানতে পারি যে সত্য জানার ব্যাপারে স্বজ্ঞা ও ইন্দ্রিয় উভয়ই কখনো কখনো বিভ্রান্তিকর হতে পারে । সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তি (logic) সাক্ষ্য (evidence) ও অভীক্ষা (testing) অপরিহার্য । তাই বিজ্ঞানের আলোকে যুক্তিবাদের ঐতিহাসিক ধারণাকে অপরিপক্কই বলা যায় । যুক্তিবাদকে আরো বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন । যদিও বিজ্ঞানের গবেষণায় আমরা জানি যে, জ্ঞান ও সত্য জানার ব্যাপারে বংশাণুগত স্বজ্ঞার (genetic intution) ভূমিকা আছে, কিন্তু আবার বিজ্ঞানের ফলশ্রুতিতেই জানতে পারি যে বংশাণুগত স্বজ্ঞা অনেকক্ষেত্রেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে । কাজেই বর্তমান দৃষ্টিতে সত্য বা জ্ঞানের আহরণে বংশাণুগত স্বজ্ঞার গুরুত্বকে স্বীকার করে নিয়েও সত্য ও জ্ঞানের যথার্থতা যাচাই করায় সার্বজনীন দর্শনলব্ধ যুক্তি (logic) ও প্রমাণকেই (evidence) প্রাধান্য দেয়, অন্ধ বিশ্বাস বা মতবাদকে নয়।

error: Content is protected !!