“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায় ৷
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো ।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিষ্কার করে।”
-নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
কাঁথির একটি সংস্থা ‘মুক্তায়ন’। মুক্তায়ন নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করে বছরে একবার। প্রচ্ছদেই ঘোষণা—একটি যুক্তিবাদী, মানববাদী সংস্থা। ভিতরে বিদ্যাসাগরের কথার চেয়ে বিবেকানন্দের বাণীর ভিড় বেশি। মুক্তায়নের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে মঞ্চে বসে পত্রিকাটিতে চোখ বোলাতে বোলাতে শিক্ষাবিদ সম্পাদক মশাইয়ের বক্তব্য শুনছিলাম মনে হল তিনি প্রতিজ্ঞা করে নেমেছেন, শ্রোতাদের বুঝিয়েই ছাড়বেন–বিবেকানন্দ বড় মাপের যুক্তিবাদী ছিলেন, তিনি আমাদের আদর্শ । তারপরেই আর এক ধাক্কা! তিনি বলতে লাগলেন, বিদ্যাসাগর আমাদের জেলার গর্ব। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি আমাদের আদর্শ।
বিবেকানন্দ আর বিদ্যাসাগর দু’জনের মূল নীতির অবস্থান দুই মেরুতে । বিবেকানন্দ বিধবা বিবাহের বিপক্ষে, বিদ্যাসাগর পক্ষে। বিবেকানন্দ সতীদাহ প্রথার সমর্থক, বিদ্যাসাগর চরম বিরোধী। বিবেকানন্দ বেদান্তবাদী, বিদ্যাসাগর বেদান্ত বিরোধী। দু’জনের বিরোধ এতই ব্যাপক যে ফর্দ বাড়াতে থাকলে একটা বই হয়ে যাবে। তারপরও দু’জনেই কোন যুক্তিতে ‘আদর্শ’ হন? মাথায় ঢোকে না। একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের প্রচারককে যুক্তিবাদী বলে চালাবার এই প্রবণতা শুধু কাঁথিতে আটকে নেই, ভারত জুড়েই সংক্রামিত হয়েছে? কেন ?
‘যুক্তি দিয়ে কি সব কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারেন?’ প্রশ্নটা পেয়েছিলাম শিলচরের একটি অনুষ্ঠানে। উত্তর দিতে হল, “না পারি না। আজও আমরা ক্যানসারের উৎপত্তির কারণ খুঁজে পাইনি। কিন্তু খোঁজ চলছে। যুক্তির পথ ধরেই খোঁজ চলছে। যে ভাবে এইডস প্রতিরোধ করতে গবেষণা চলছে। পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের কাছে হাজারো বিষয়ের ব্যাখ্যা জানা ছিল না যুক্তি-বুদ্ধির পথ ধরে এগিয়েই আমরা তা জেনেছি, ভবিষ্যতেও জানবো।”
২০০২। ভারত তেতে আছে। সংঘ পরিবারের সদস্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, ভারতীয় জনতা পার্টি প্রায়ই হুংকার দিচ্ছে—এ’দেশে থাকতে হলে ভারতীয় দর্শনকে সম্মান দিতে হবে। বৈদিক ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের মানুষদের চাওয়াকে সম্মান জানাতে হবে। মোদ্দা কথায় বোঝাতে চাইছিল, বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানাতে চাওয়াকে মেনে নিতে হবে।
এ’সব খবর পত্রিকায় বেরোচ্ছে। আবহাওয়া গরম হচ্ছে। এক রবিবার সকালে জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে গেছি। জ্যোতিদা সংঘ পরিবারের কথা টেনে তেতে উঠে বললেন, “কী ইডিয়টের মত কথা বলে চলেছে দেখেছো? ওরা দেশের ইতিহাসকেই পাল্টে দিতে চায়। ‘ভারতীয় দর্শন’ মানে শুধু ‘বৈদিক দর্শন’ বা ‘হিন্দু দর্শন’–এই মিথ্যেটাকে ওরা এসটাবলিশ করতে চাইছে। বৌদ্ধ, জৈন, মুসলিম, খ্রিষ্টান, শিখ, ব্রাহ্ম—ইডিওলজি এ’দেশে আছে। এই সব ইডিওলজির অস্তিত্বকে অস্বীকার স্পষ্টতই মিথ্যাচারিতা। ভারতের হিন্দু দার্শনিকরাও সংঘ পরিবারের এই মিথ্যাকে সত্যি করে তুলতে গোয়েবেলের ভূমিকা পালন করে চলেছে।” দার্শনিক ধ্রুবজ্যোতি মজুমদারও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কাটোয়ার একটি অনুষ্ঠানে মুখোমুখি হতেই,
“এদেশে সৎ দার্শনিকের সংখ্যা আঙুলে গোনা। বাকি সব্বাই
হিন্দুত্ববাদের প্রচারক। এটা অনেক দিনের পুরোন রোগ।
স্যার এস রাধাকৃষ্ণণের কথাই ধরুন। তিনি
অনাত্মাবাদী বুদ্ধকে আত্মাবাদী
বানিয়ে ছাড়লেন।
সৎ ইমেজের আড়ালে এঁরা কী ভয়ংকর রকমের অসৎ মানুষ—ভাবা যায়? স্যার এস রাধাকৃষ্ণণের লেখা Indian Philosophy, Vol-1, Page 355 খুললেই দেখতে পাবেন। ভারতে নিরীশ্বরবাদী দর্শনের রমরমার ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য, মীমাংসার মত নিরীশ্ববাদী দর্শনকে ‘খুব খারাপ দৰ্শন’ বলে মিথ্যে প্রচারে শামিল so called দার্শনিকরা। যাঁরা জানেন এক রকম, জানান আর এক রকম, তাঁরা আবার দার্শনিক?”
বিপাশা চ্যাটার্জি দর্শনে এম.এ., ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছিল। বিপাশা দুঃখ করছিল, “কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি—ভারতীয় দর্শন মানে বৈদিক দর্শন, মানে আস্তিক্য দর্শন, অধ্যাত্মবাদী দর্শন। কিন্তু এতো সত্যি নয়, ভারতে আরও বহু দর্শন ছিল, নাস্তিক্যবাদী দর্শন প্রবলভাবে ছিল। আমার ভাবনা জেনে প্রফেসররা স্পেশালি আমাকে পই-পই করে বলতেন, ভালো রেজাল্ট করতে হলে সত্যি বলে যা জেনেছো, তা লিখো না। বইয়ে যা আছে, তাই লিখো। রাষ্ট্র এবং সরকার শিক্ষাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে—ভাবলে ডিগ্রির জন্য মিথ্যে লিখতে ঘেন্না হয়।”
এ’গুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ’সবই আমাদের অবিচ্ছিন্ন সমাজচিত্র। সত্যি বলতে কী—এ হল হিমশৈলের জেগে থাকা চুড়ো।
ভারতের এক সময়ের মূল চিন্তাধারা কি শুকিয়ে যাচ্ছে?
ভারতীয় দর্শনের মূল চিন্তাধারা বা আদি চিন্তাধারা ছিল নিরীশ্বরবাদী—এ কথা আগেই বলেছি। সেই নিরীশ্বরবাদী চিন্তার ঐতিহ্যের সূত্র ধরে ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’- এর উৎপত্তি এই ভারতেই। ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদ বা নিরীশ্বরবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু।
সমকালীন যুক্তিবাদীরা মনে করেন না যে, একজন মানুষ নাস্তিক হলেই সে সুন্দর এক অসাম্যের সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে আদর্শ ভূমিকা পালন করবে। মানবিক গুণের আধার হবে।
নাস্তিক যদি স্বার্থপর ও অসৎ হয়, সে সমাজকে শুধু বিষই দিতে
পারে। একজন নাস্তিক মানবিক গুণে ঋদ্ধ হলে তিনি
আমাদের উদীপ্ত করেন, আদর্শ
হয়ে ওঠেন।
ঈশ্বর, অলৌকিকতা, নিয়তি, জন্মান্তর, কর্মফল, মন্ত্র-তন্ত্র, তাগা-তাবিজ ইত্যাদি স্থূল কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে থাকাটা ‘যুক্তিবাদী’ হওয়ার পূর্বশর্ত। কিন্তু শেষ কথা নয় শেষ কথাটি হল—অবশ্যই তাকে মানবতাবাদী হতে হবে। অর্থাৎ ‘মানবতাবাদী’ হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত, যুক্তিবাদী হতে হবে। আমরা বোধহয় বলতে পারি, ‘যুক্তিবাদ’ ও ‘মানবতাবাদ’ পরিপূরক একটা মতবাদ।
জীবনে এমন মোড় অনেক আসে, যখন স্পষ্ট করে ‘না’ বলতে হয়। ব্যক্তিত্বের অভাবে আমরা অনেক সময় ‘না’ বলতে পারি না। এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী। কিন্তু একটা মতবাদ বা ism-এর ক্ষেত্রে নেতিবাচক শব্দের মানসিক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক শব্দের তুলনায় খারাপ হতে বাধ্য ।
‘নাস্তিক্যবাদ’ বা ‘নিরীশ্বরবাদ’ নেতিবাচক শব্দ। তাকে ইতিবাচক শব্দে পরিবর্তিত করে আমরা বলতে পারি ‘যুক্তিবাদ’। যা পারি, তা করতে অসুবিধে কোথায় ?
একটা সময়, সময়টা ধরুন আড়াই হাজার বছর আগের। সেই সময় থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা (intellect) এবং আমাদের বুদ্ধি (reason) আমাদের মতামত (opinion) তৈরিতে সাহায্য করেছে। যতই সময় এগিয়েছে ততই আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের অভিজ্ঞতা থেকে ঋদ্ধ হয়েছি। এভাবেই মানুষ শিল্প-সাহিত্য-সংগীত- ক্রীড়া-বিজ্ঞান প্রতিটি বিভাগে এগিয়ে চলেছে। যে জয় গোস্বামীর অক্ষর জ্ঞানের শুরু হয়েছিল বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় দিয়ে, তারপর তিনি মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নীরেন্দ্রনাথ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়ে প্রতিনিয়ত পরিশীলিত হতে হতে আজকের শক্তিমান কবি জয় গোস্বামী হয়েছেন। তিনি যদি দু’শো বছর আগে জন্মাতেন, তবে তাঁর কবিতা দু’শো বছর পিছিয়েই থাকতো। এটাই নিয়ম।
তবে সবাই যে পূর্বসূরিদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজের জ্ঞানকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধ প্রমুখ চিন্তাবিদ্রা যে যুক্তি-বুদ্ধি-বিচার শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, আড়াই হাজার বছর পরেও এদেশের বহু আই এ এস, অধ্যাপক, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ বুদ্ধের যুক্তি-বুদ্ধিকে আত্মস্থ করতে পারেননি। তাঁরা মানসিক ভাবে পড়ে আছেন আদিম সমাজের ম্যাজিক বিলিফের সময়ে।
এটা আমাদের মত পিছিয়ে পড়া দেশের আবেগপ্রবণ মানুষদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আবেগ সব সময় যুক্তির সবচেয়ে বড় শত্রু। শ্রীচৈতন্য নারী-পুরুষ ও জাত-পাতের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে নারী ও নিম্নবর্গীয়দের ‘মানুষ’ পরিচয়ে বাঁচার অধিকার দিয়েছিলেন। এর জন্য তাঁর অবশ্যই প্রশংসা প্রাপ্য। কিন্তু তিনিই এই বাংলার মানুষদের ভক্তি রসের আবেগে এমনই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলার যুক্তি চর্চা, মুক্তচিন্তার চর্চা, তাতে খড়-কুটোর মতই ভেসে গিয়েছিল। তিনি যুক্তি চর্চার যে সর্বনাশ করেছিলেন, তার জন্য নিন্দাও তাঁর প্রাপ্য।
মানুষের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে দেখতে পাবো—নানা উত্থান-পতন, অগ্রগামীতা-পশ্চাৎগামীতার পরও শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রগতির ধারা বজায় রয়েছে। আমরা দেখেছি, শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বও বাতিল হয়েছে, নতুন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে। তাই তো বিজ্ঞানী বলেন, “এখনও পর্যন্ত জানা তথ্যের ও তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে…।” হ্যাঁ, বিজ্ঞানী এ’ভাবেই বলেন। নতুন তত্ত্ব এসে পুরোন তত্ত্বকে বাতিল করে জায়গা করে নিতে পারে, এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই এ’ভাবে বলেন। জিজ্ঞাসাই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নাতীত আনুগত্য স্থবিরতা আনে, “আত্মবিনাশের পথ পরিষ্কার করে।”
বুদ্ধ কোনও গ্রন্থকেই স্বতঃপ্রমাণ, চির-সত্য বা absolute বলে মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, আজকের জানা ও ভবিষ্যতের জানা এক নাও হতে পারে; কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা জ্ঞানকে আরও পরিণত করে।
বুদ্ধের এক বৈপ্লবিক অনিত্য মতামতকে শ্রদ্ধা করেন অনেক মার্কসবাদী
চিন্তাবিদ। আবার মার্কসবাদীদেরই অনেকে বলেন, ‘মার্কসবাদ
সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা বিজ্ঞান’। এ’সব দেখে-শুনে
শঙ্কিত হই—ওঁরা কি মার্কসবাদকে বেদ-কোরান-
বাইবেল বানাতে চাইছেন? চির-সত্য
বলে মনে করেন ?
এই শঙ্কারই প্রতিফলন দেখেছি চিন্তাবিদ ও মার্কসবাদী জ্যোতি ভট্টাচার্যের লেখায়। ‘জীবন, ধর্ম, রাজনীতি’ প্রবন্ধে তিনি বলছেন, “মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে প্রায় আরেকটা প্রতিষ্ঠানিক ধর্মে রূপান্তর করার যে প্রচেষ্টা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে করা হয়েছে, সেটা অ-মার্কসীয়, অ-ধার্মিক (মানবধর্ম বিরোধী) এবং বিপজ্জনক। ঈশ্বরে যিনি বিশ্বাস করেন না, তিনি যদি ঈশ্বরের জায়গায় একজন বা কয়েকজন মানুষকে বসিয়ে সেই মানুষদের অলৌকিক ক্ষমতা বা দিব্যদৃষ্টিতে বিশ্বাস করতে থাকেন নেতা বা পাটিকে সর্বজ্ঞ, সদা অভ্রান্ত এবং পূজনীয় বলে ভাবতে থাকেন, তাহলে বিপদ কিছু কম হয় না। ভগবানের জায়গায় একজন মানুষকে বসিয়ে তাঁর পুজো করার চেয়ে ভগবানে বিশ্বাস ভালো—ভগবানে সেই বিশ্বাস যতক্ষণ একান্ত নিভৃতে আপন ব্যক্তিগত চর্চায় থাকে।” (“যুক্তিবাদীর চোখে ধর্ম’ গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধ সম্পাদকঃ প্রবীর ঘোষ )
জ্যোতি ভট্টাচার্যের এমন বক্তব্য তুলে ধরার জন্য কেউ কেউ আমার ওপর যথেষ্ট রাগ করতে পারেন, কারণ আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা এমনটাই। তাঁদের জন্য এবার লেনিনের একটি বক্তব্য তুলে ধরছি।
লেনিন লিখেছেন, “মার্কসের তত্ত্বকে আমরা সম্পূর্ণকৃত
ও অলঙ্ঘনীয় একটা কিছু
বলে মনে করি না;
বরঞ্চ আমরা প্রত্যয়শীল যে তা সেই বিজ্ঞানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে সমাজতন্ত্রীদের যাকে অবশ্যই সকল দিকে বিকশিত করতে হবে, যদি তারা জীবনের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে চায়।” (V.L.Lenin, Our Programe, Collected Works, Vol-4, Progress Publishers, Moscow, Page 211 )
এরপরও একজন মার্কসের ভক্ত-পূজারী বিশ্বাসী কি বলতে পারেন—‘মার্কসবাদ, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সদা অভ্রান্ত,অলঙ্ঘনীয়’ ইত্যাদি বাতুল ও চটুল কথা? ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া মার্কস-ভক্তের তো আর মার্কসবাদী হওয়ার দায় নেই ।
যাঁরা মনে করেন মার্কসবাদ কার্ল মার্কসের কোনও পূর্ব-অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ নয়, মার্কসের চিন্তায় হঠাৎ করেই এমন মতবাদের উদ্ভব—তাঁরা আর যাই হোন, মার্কসবাদী বা যুক্তিবাদী নন।
কার্ল মার্কসও তাঁর মতামতে পৌঁছোবার আগে ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন, উপাসনা-ধর্মের উদ্ভব ও বিবর্তন, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান সঞ্চয় করেছেন। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর যুক্তিবোধকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অবস্থাকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং একটি সমাজ বিজ্ঞানের তত্ত্বকে দাঁড় করিয়েছেন।
“কমিউনিজম’ শব্দটা মার্কস উদ্ভাবন করেননি। কমিউনিজমের অস্পষ্ট কাল্পনিক চিন্তাদর্শ মার্কসের বহু পূর্ব থেকে য়ুরোপের জনগণের অন্তরে ফল্গুস্রোতের মতো চলে আসছিল। মার্কসের পূর্ববর্তী কমিউনিস্টরা অনেকেই যিশু খ্রিস্টের প্রথম শিষ্যদের দ্বারা আচরিত কমিউনিজম-এর কথা বলতেন। এঁদের চিন্তাদর্শে কমিউনিজম আর খ্রিষ্টধর্ম প্রায় অভিন্ন ছিল। মার্কস কমিউনিজম-কে অলৌকিক বিশ্বাসের কাঠামো থেকে মুক্ত করে বিজ্ঞান-ভিত্তিক বাস্তব বিপ্লব-প্রচেষ্টার বিষয়ে পরিণত করেছিলেন।” (‘জীবন, ধর্ম, রাজনীতি’, জ্যোতি ভট্টাচার্য)
যুক্তিবাদী হেগেল দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় সমাজ বিকাশের ব্যাখ্যায় পৌঁছেছিলেন। মার্কস তাকেই বাস্তব দুনিয়ার শক্ত জমির ওপর দাঁড় করিয়ে ছিলেন। মার্কস তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা বা অর্জিত জ্ঞানকে আত্মস্থকরণের পর যুক্তির ধরেই তাঁর মতামতে (যা মার্কসবাদ নামে পরিচিত) পৌঁছেছিলেন।
কিছু মার্কস পূজারী এই বলে গর্ব অনুভব করেন যে, মার্কসবাদের-ই অংশ
যুক্তিবাদ। অর্থাৎ সমস্ত রকম যুক্তিকে তুচ্ছ করে, পাত্তা না দিয়ে
মার্কস হঠাৎ করে তাঁর মতামতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর
মার্কস এলেন, তাই প্রকৃতির নিয়মে যুক্তি দেখা দিল।
যেন মার্কসের আগে মেঘ
ছাড়াই বৃষ্টি হত।
কারও কারও মনে হতে পারে মার্কসবাদীদের ভক্তিবাদে গা ভাসানো নিয়ে আলোচনা, যেন—ধান ভানতে শিবের গান। আমার কিন্তু মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল, মার্কসবাদীরা ভক্তিরসে আপ্লুত হলে যুক্তিবাদ বড় রকমের ধাক্কা খাবেই। কারণ হিসেবে আবারও বলি ভক্তির আবেগ বা ভক্তিবাদ যুক্তিবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর, যুক্তিমনস্কতা মার্কসবাদের পূর্ব শর্ত।
গত কয়েক দশক ধরে এদেশের কিছু চিন্তাবিদ প্রত্যাশা রেখেছিলেন মার্কসবাদীদের ওপর। ভেবেছিলেন, পার্টি অফিসগুলোতে স্টাডি ক্লাস হবে। মার্কস-লেনিনের রচনাবলীর সঙ্গে যাঁদের কিছুটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, তাঁরা ক্লাস নেবেন। মার্কসবাদের পাঠ নিতে আসা আদর্শবাদী, আন্তরিক মানুষ বুঝবেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্ব। বুঝবেন, বিপ্লবের আগে, বিপ্লবের সময় ও বিপ্লবের পরে যুক্তিবাদ নির্ভর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই। যুক্তিবাদী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকারীরাই বিপ্লবের অগ্রবাহিনী। এরাই তো মানুষের চেতনায় ঢুকে থাকা কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে পরিষ্কারের দায়িত্ব নেবে। এরাই আন্তরিকতার সঙ্গে বঞ্চিত মানুষদের সত্যিকে বোঝাবে। মানুষ বুঝবে, তার বঞ্চনার কারণ ভাগ্য, পূর্বজন্মের কর্মফল বা ঈশ্বরের কৃপা পাওয়া না পাওয়া নয়। দায়ী সমাজের এই কাঠামো। বোঝাতে হবে গণতন্ত্রের আসল চেহারা। এই সমাজ কাঠামোয় নির্বাচনে জিতে কেন্দ্রের বা রাজ্যের শাসন ক্ষমতা দখল করতে হয়। নির্বাচনে জিততে যে বিপুল পরিমাণ টাকার দরকার হয়, তার প্রায় পুরোটাই তোলা হয় ধনী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। শিল্পপতি ধনীরা সেইসব রাজনৈতিক দলকেই টাকা দেয়, যাদের নির্বাচনে জেতার মত দলীয় পরিকাঠামো আছে। সৎ হলেই নির্বাচনে জেতা যায় না। প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে হয়। নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে নির্বাচনী অফিস করতে হয়। ভোটার তালিকায় কারচুপি করতে হয়। জাল ভোট দেবার ক্যাডার রাখতে হয়। বিরোধী নির্বাচন কর্মীকে নির্বাচন কেন্দ্র থেকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে হয়। বিরোধী দলের ভোটারদের গৃহবন্দি, ফ্ল্যাটবন্দি বা গ্রামবন্দি করে রাখতে হয় অস্ত্রের জোরে। রিগিং নিশ্চিত করতে নির্বাচন কেন্দ্রে ব্যাপক বোমাবাজি করতে হয়, প্রয়োজনে গুলিও চালাতে হয়। বুথ দখল করতে আরও ব্যাপক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও আছে প্রচারের জন্য গাড়ি-পোস্টার-ব্যানার-হোর্ডিং- কাটআউট-ক্যাডর ও গুন্ডা, আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদির বিপুল খরচ। সব মিলিয়ে এক একটা কেন্দ্রের নির্বাচনী খরচ কয়েক কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ খরচের টাকা যে’সব ধনীরা দেয়, তারা উশুল করতে পারার প্রতিশ্রুতি নিয়েই দেয়। নির্বাচনের পরও অনেক সময় ত্রিশঙ্কু অবস্থাকে স্থিতি দিতে বিধায়ক ও সাংসদ বেচা-কেনা হয় ।
যারাই সরকার তৈরি করুক, আর যারাই বিরোধী আসনে বসুক— সব্বাই
ধনীদের ধনের দৌলতেই করে খায়। ফলে শেষ পর্যন্ত দেশের
আইন এমনভাবে তৈরি হয়, যাতে ধনীরা মসৃণগতিতে শোষণ
চালিয়ে যেতে পারে। সরকার যেখানে পুতুল নাচের পুতুল,
সেখানে পুলিশ-প্রশাসন-আমলাদের তুড়ি
বাজিয়ে নাচানো যায়।
সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদের-ই সমাজের এই কাঠামো ও তার সঙ্গে শোষণের সম্পর্ককে বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে, নাগরিক হিসেবে সংবিধান আমাদের কিছু অধিকার দিয়েছে। আমরা প্রতিটি দেশবাসী শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, পানীয় জল, থাকার মত খাদ্য পাবার অধিকারী। আমাদের এইসব অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। সংবিধান স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় পরিষেবার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। বোঝাতে হবে বিভিন্ন শব্দের সংজ্ঞা। বোঝাতে হবে ‘দেশপ্রেম’ মানে দেশের মাটির প্রতি প্রেম নয়। ‘দেশপ্রেম’ মানে দেশের সংখ্যাগুরু শোষিতে মানুষের প্রতি প্রেম। ‘জাতিয়তাবাদ’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘উপাসনা-ধর্ম’, ‘নিয়তিবাদ’ ইত্যাদি সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে সাধারণের মধ্যে একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন কখনই সদস্য বাড়িয়ে দল ভারী করার হুজুগ নয়।
এই আন্দোলন কিছু আগিয়ে থাকা চিন্তাকে বহু মানুষের
মধ্যে ছড়িয়ে দেবার আন্দোলন।
রাজনীতিক থেকে আমলার দুর্নীতির, শিল্পপতি থেকে প্রচার মাধ্যমের দুর্নীতির ওপর নজরদারি করবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকারীরাই। দুর্নীতিকে চিহ্নিত করে জনসাধারণের সাহায্য নিয়েই তাদের ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলতে হবে।
বিপ্লব এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কুসংস্কার, শোষণ, দুর্নীতি সব—এমনটা মনে করা মার্কসবাদীদের সংখ্যা কম নয়। তাঁরা এ’জাতীয় বক্তব্যের পিছনে যে যুক্তি দেন, তা হল –বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজ কাঠামো (structure) পাল্টে দিতে পারলে সমাজের উপরিকাঠামো (super structure) এমনি-ই পাল্টে যাবে। উপরিকাঠামো মানে ‘ভাবাদর্শগত সম্পর্ক’; যার মধ্যে পড়ে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, রাজনীতি, মূল্যবোধ, নীতি-দুর্নীতি ইত্যাদি। তাঁদের মতে— সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনে উপরিকাঠামোর পরিবর্তন ঘটে। সমাজ-কাঠামো হল উপরিকাঠামোর নিয়ন্তা-শক্তি। ফলে যুক্তিবাদী আন্দোলন বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মত উপরিকাঠামোর আন্দোলন শেষ পর্যন্ত একটি নিষ্ফলা ও অপ্রয়োজনীয় আন্দোলনে পরিণত হতে বাধ্য। মার্কসবাদ কিন্তু এইসব মার্কসবাদীদের সঙ্গে একমত না হয়ে অন্য কথা বলছে।
“কাঠামোর উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও উপরিকাঠামো কাঠামোকে
প্রভাবিত করে। সমাজ জীবনে ধ্যান-ধারণা, সাংস্কৃতিক চেতনার ফল,
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সহ অন্যান্য উপরিকাঠামোগত
বিষয়গুলির ভূমিকা, বনিয়াদ বা কাঠামোর উপর গুরুত্বপূর্ণ
প্রভাব বিস্তার করে। এবং কাঠামো
পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে
দ্রুত করে।”
(What Is Historical Materialism ? by Z. Berbeshkina, L. Yakovleva, D. Zerkin, Progress Publisherss, 1985, Moscow)
বিপ্লব-ই শেষ কথা নয়। শোষিত, মেহনতি মানুষদের দ্বারা ক্ষমতা দখলই শেষ কথা নয়। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পর ও তাকে টিকিয়ে রাখাটা জরুরি। তার জন্য একটা লাগাতার সাংস্কৃতিক আন্দোলন চাই-ই। নতুবা নজরদারির অভাবে গদিতে বসা নেতারা দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করতে পারে। স্বজনপোষণে ডুবে থাকতে পারে। সব রকম খারাপ কাজই মুখোশের আড়ালে অথবা ক্ষমতায় ভয় দেখিয়ে করে যেতে পারে।
এ’দেশের নির্বাচন-নির্ভর মার্কসবাদী পার্টিগুলোর দিকে তাকালেই অবস্থা কিছুটা টের পাবেন। দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকা বাস্তুঘুঘুরা বিপ্লব থেকে বহু দূর সরিয়ে রেখেছে পাটিকে। সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা তরুণরা আর পার্টি অফিসে স্টাডি ক্লাশ করতে আসে না। পার্টি অফিস প্রমোটার বা ব্যবসায়ীদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে থাকে। মন্ত্রী থেকে ক্যাডার সব্বাই নব্য-পুজোকালচার নিয়ে মেতেছেন। এঁরা ভারতের নিরীশ্বরবাদী চিন্তাধারার ঐতিহ্যকে তুলে ধরবেন—এমন প্রত্যাশা ছিল। আজ সেই প্রত্যাশার কিছুই অবশিষ্ট নেই।
রাজনীতি ও সমাজনীতি সচেতন অশোক মিত্রের কথা গলায় গলা মিলিয়ে বলতে হচ্ছে, “অধঃপাতের আবর্তে বিরাজ করছি আমরা, শ্রদ্ধা করা যায়, সম্মান জানানো যায়, যাঁদের দৃষ্টান্তে উদ্দীপ্ত হওয়া যায় এমন ব্যক্তির সংখ্যা, পৃথিবীতে না হলেও অন্তত আমাদের দেশে, ক্রমশ ক্ষীয়মান; মেরুদণ্ডগুলি বেঁকে যাচ্ছে, আরও বেঁকে যাচ্ছে।”
ভারতের এক সময়ের মূল চিন্তাধারা ছিল নিরীশ্বরবাদী ও যুক্তিবাদী। কয়েক হাজার বছরে আমরা কতটা এগোলাম? ইতিহাস বলছে—আমরা পিছিয়েছি, এবং এই পশ্চাৎগামীতাই আমাদের সমাজের মূল স্রোত। খাঁটি নিরীশ্বরবাদী ও যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ খুঁজে পাওয়া ভার। যাঁরা নিজেদের নিরীশ্বরবাদী ও যুক্তিবাদী বলে জাহির করেন, তাঁদের মধ্যে ভেজাল-ই বেশি।
এ’দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি-ই ঠিক করে দেয় প্রচার মাধ্যম কী ছাপবে, কী চাপবে, সাহিত্য-শিল্প-সংগীত কেমন হবে, কেমন হবে অর্থনীতি, মূল্যবোধ, আইনের প্রয়োগ যে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিক এ’সব ঠিক করে দেয়, তারা নিজেদের আদর্শগত অবস্থান নিয়ে একটুও মাথা ঘামায় না। নির্বাচনী রাজনীতিতে কৌশল-ই আসল । আর এও সত্যি—এ’দেশে নির্বাচন-নির্ভর রাজনীতিকরা-ই সন্দেহাতীতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর বাইরে অতি-সংখ্যালঘু কিছু রাজনীতিক অবশ্য আছেন, সরকার যাঁদের ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ইত্যাদি বলে ঘোষণা করেছে। কুকুর’কে হত্যার আগে ‘পাগলা কুকুর’ বলে ঘোষণা করার মত ব্যাপার আর কী!
এ’দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে উপাসনা-ধর্মকে কাজে লাগাবার, উসকে দেবার দুর্নীতি উত্তরোত্তর বেড়ে-ই চলেছে। এই অবস্থায় নির্বাচন-নির্ভর মার্কসবাদী দলগুলোও আদর্শ-টাদর্শ শিকেয় তুলে যে’ভাবে ধর্মে-কর্মে ডুব দিয়েছে, তাতে তাদের কাছে আদর্শের কথা তুলতে যাওয়া মানেই ঝুঁকি নেওয়া। মিথ্যে মামলায় ঝুলে যাওয়ার ঝুঁকি, ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দাগি হওয়ার ঝুঁকি, এনকাউন্টারে প্রাণ হারাবার ঝুঁকি।
বুদ্ধিচর্চাহীন, মুক্তমনহীন, ভন্ড, ধান্দাবাজে ভরে যাওয়া এই দেশে এক সময়ের এগিয়ে থাকা নিরীশ্বরবাদী ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ’ভাবে সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে দেব কিনা, তা নির্ভর করছে আপনার, আমার, আমাদের উপর। আমাদের নিস্পৃহতার চাদর উড়িয়ে দেবার উপর
কীসব বেয়াড়া প্রশ্ন ! মুখ ছুটে মিশে যায় মুখোশে
৩১ জুলাই ২০০২। বেশ কয়েকটা দৈনিক সংবাদপত্রে একটা খবর বেরিয়েছে, উপরাষ্ট্রপতি কৃষ্ণকান্তের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাস্তু না মানা। তেলেগু দেশম পার্টির সংসদীয় দলনেতা ইয়েরান নাইডু লোকসভার স্পিকার মনোহর জোশীকে বলেছেন, হায়দরাবাদের এক ‘বাস্তুশাস্ত্র’-বিশারদ তাঁকে জানিয়েছেন, সংসদের নতুন গ্রন্থাগারের কাঠামোটি বাস্তুমতে ঠিক নয়। তারই পরিণতিতে কৃষ্ণকান্তসহ অন্যান্য সাংসদের মৃত্যু হয়েছে। নাইডুজীর এমন বক্তব্যকে কারও কারও কাছে মনে হতে পারে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। কিন্তু মাননীয় স্পিকার সাহেব জোশীজীর এমনটা মনে হয়নি। খবর কাগজের ভাষ্য অনুসারে—“নাইডুজীর কথায় জোশীজীর দুশ্চিন্তা বেড়েছে। তিনিও জানালেন, একটা জ্যোতিষশাস্ত্রের পত্রিকা জানিয়েছিল ২৭ জুলাই ও ২ আগস্ট—এই দুটি দিন খুব অপয়া। এই দু’দিন সংসদের দুই নামী ব্যক্তির মৃত্যু হবে। দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক, কারণ ২৭ জুলাই চলে গেলেন কৃষ্ণকান্ত। ২ আগস্ট কার পালা ?” উৎকণ্ঠায় ছিলেন। জ্যোতিষ-বিশ্বাসী ও অজ্ঞেয়বাদী দ্বিধাগ্রস্ত আমজনতা। ২ আগস্ট অতিক্রান্ত। জ্যোতিষশাস্ত্রের নাক-কান মুলে দিয়ে সাংসদরা দিব্বি ২ আগস্ট পার করে দিলেন। বহালতবিয়তে।
৩১ জুলাই-এর আলোচনার শেষ এখানেই নয়। দু’জনের কথা শুনে প্রাক্তন স্পিকার এবং বর্তমানে কংগ্রেস সংসদীয় দল নেতা শিবরাজ পাতিল জানালেন, “ওই গ্রন্থাগারের উদ্বোধন যে দিন হয়েছিল, সে দিনই ব্যাঙ্গালোরে তাঁর মেয়ে মারা যায়।”
মন্দ লোকেরা এই প্রসঙ্গে কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন তুলেছেন। প্রতি বছর বেশ কিছু সাংসদ মারা যান, নতুন গ্রন্থাগার তৈরির আগে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা কেন গেছেন ? তাঁদের যদি বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন অসুখের শিকার হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে, তবে গ্রন্থাগার তৈরির পর সাংসদদের মৃত্যু স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হবে না কেন? বাস্তু মেনে গ্রন্থাগার ভবনের কিছু দরজা-জানলা-আসবাব এদিক-ওদিক করে দিলে সাংসদ থাকাকালীন কারো মৃত্যু হবে না—এই গ্যারান্টি কে দেবেন ? নাইডুজী, না বাস্তু-বিশারদ? কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত বাস্তু-বিশারদদের পিছনে ‘পাবলিক মানি’ ঢালার আগে গ্যারান্টি আদায় জরুরি, যাতে চুক্তিভঙ্গের দায়ে জেলে পাঠানো যায়। এরপর টাকা খরচে আপত্তি নাও তোলা যেতে পারে। কারণ এর ফলে দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যাবে।
মন্দ লোকেরা এমন প্রশ্নও তুলেছেন, গত ১৩ ডিসেম্বর সংসদ চলাকালীন সংসদভবনে আক্রমণ চালালো উগ্রপন্থীরা। আশ্চর্য ব্যাপার—একজন সাংসদের গায়েও সামান্যতম আঁচড়টি কাটতে পারলো না এই পরিকল্পিত আক্রমণ । এর কারণ যদি হয়, বাস্তু না মানা, তবে বাস্তু না মানাকেই ভালো বলতে হয়। শুভ বলতে হয়। অন্তত সাংসদদের পক্ষে তো শুভ।
গ্রন্থাগার উদ্বোধনের দিন পাতিলজীর মেয়ে মারা গেছেন। অতএব প্রমাণিত হল—গ্রন্থাগারের জন্মদিন অশুভ দিন। এমন সরলীকরণ যে সব সাংসদ করেন, তাঁরা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি ও শ্রীরাজীব গান্ধির মৃত্যু নিয়ে কী ব্যাখ্যা দেবেন? দিন দু’টি তো গ্রন্থাগারের জন্মদিন ছিল না। তবে কি গ্রন্থাগারের অ-জন্মদিন আরও বেশি রকমের অশুভ ?
নাগরিকদের জীবন ও মননকে সুরক্ষা দেবার, সুসংস্কৃতির বাতাবরণ এনে দেবার প্রতিজ্ঞাদৃঢ় অঙ্গীকার রেখেছেন সাংসদরা। তারপরও কী সব বেয়াড়া প্রশ্নরাশি । মন্দলোক কত কী-ই বলে, সে সব ধরতে নেই। আবার মন্দলোকেরা যখন মানুষের মনে উস্কে দেয় যুক্তির আঁচ, তখন ওদের হেলা-ফেলা করাটা কতটা ঠিক হবে— এটাও একটা প্রশ্ন। এই বেয়াড়া, বজ্জাত, প্রশ্নাতীত বলে কোনও কিছু মানতে না চাওয়া মানুষগুলো আসলে যুক্তিবাদী। এরাই মানবপ্রজাতির অগ্রগতির বিবেক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির বোধ।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৫ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
ধর্মঃ সংজ্ঞায় গোলমাল
অধ্যায়ঃ দুই
উপাসনা ধর্মঃ প্রাচীন মত
♦ উপাসনা- ধর্মের (religion) উৎপত্তি
♦ একঃ দৈব-প্রত্যাদেশ বা অপৌরুষেয় প্রত্যাদেশ
♦ দুইঃ ঈশ্বরে বিশ্বাস; সহজাত প্রবৃত্তি
♦ তিনঃ ধর্মীয় আচরণ বাদে ঈশ্বর বিশ্বাস
♦ আধুনিক নাস্তিক্যবাদ ‘মার্কসবাদ’
অধ্যায়ঃ তিন
‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু
♦ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ চির নতুন
♦ তোমার আমার দুই চেতনার ভালো-খারাপ
♦ মারাদোনার পায়ের জাদু ও যুক্তিবাদ
♦ প্রেমের রহস্যময়তা ও যুক্তিবাদ
♦ ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’, ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস’ : আকাশ-পাতাল
অধ্যায়ঃ চার
উপাসনা ধর্মঃ আধুনিক মত
♦ উপাসনা-ধর্ম : নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে
অধ্যায়ঃ পাঁচ
ভারতবর্ষের জাদু সংস্কৃতি
♦ আদিম উপজাতি, আধুনিক উপজাতিঃ একই কথা
♦ ধর্মীয় জাদু বিশ্বাস ও ম্যাজিক শোঃ দুই পৃথিবী
অধ্যায়ঃ ছয়
তন্ত্রের প্রথম ধাপ যোগ, তারপর…
অধ্যায়ঃ সাত
বৈদিক সাহিত্য, জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞে যৌনাচার
♦ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব কষে ভন্ড
♦ বৈদিক সাহিত্যের গপ্পো ও দুই ডাক্তার
♦ বৈদিক সাহিত্যে জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞের নামে যৌনাচার
অধ্যায়ঃ আট
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ নয়
শক্তিধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ দশ
রেইকি গ্রাণ্ডমাষ্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি