আমার সম্পাদিত ‘যুক্তিবাদীর চোখে ধর্ম’ বইটির যে সমালোচনা ‘দেশ’ পত্রিকায় ৩ অক্টোবর ‘৯২ প্রকাশিত হয়েছিল তাতে বহু প্রশংসা অবিরল ধারায় বর্ষিত হলেও শুরুতে একটা খোঁচা ছিল। শিকড় সমেত ‘যুক্তিবাদকেই লোপাট করতে চাওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল ;
‘বাদ’ শব্দটা আমরা সাধারণত ইংরেজি ‘ইজমে’র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করি। ‘ইজম’ বলতে বোঝায় বিশেষ কোনো বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি। যুক্তি কোনো বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না, হতে পারে কোনো বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিতে পৌঁছনোর একটা সোপান মাত্র। অবশ্য যুক্তিবাদ বলতে যদি এই বোঝায় যে, যে-কোনো চিন্তা, পথ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রথা, পদ্ধতিতে একমাত্র যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করেই গ্রহণ করতে হবে, তাহলে যুক্তিকে ধরে নিতে হবে (absolute), অনপেক্ষ কিছু। কিন্তু দার্শনিক বিচারে তেমন কোনো পরম যুক্তি (গণিত এবং জামিতিক চিত্রের কথা বাদ দিলে) আছে কিনা সন্দেহ।’
‘যুক্তিবাদ’ নিয়ে বাদানুবাদের এই জটটা ছড়য়ে নিয়ে তারপর বিস্তৃত আলোচনায় ঢুকব। প্রথমে দেখা যাক, ‘বাদ’ বা ‘ism’ ব্যাপারটা ঠিক কী? প্রথমত, জীবন ও জগৎ ঠিক কী রকম, সে-প্রসঙ্গে কোনও দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক মতকে ‘বাদ’ বা ‘ism’ বলা হয়ে থাকে, যেমন বার্কলের ‘Solipsism’, হিউমের ‘Agnosticism’। দ্বিতীয়ত, কোনও দার্শনিক মতের ধরন বা দৃষ্টিভঙ্গিকেও ‘ism’ বলা হয়, যেমন ‘Idealism’, ‘Realism’ ইত্যাদি। আবার তৃতীয়ত, দার্শনিক আলোচনার পদ্ধতি বা দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জ্ঞানতত্ত্বগত উপায়কেও অর্থাৎ সোপানকেও ‘ism’ বলা হয়, যেমন ‘Empiricism’, ‘Criticism’, ‘Secpticism’, দেকার্তের ‘Ratio- nalism’ ইত্যাদি। এ-ছাড়াও আরও অসংখ্য অর্থে ‘Ism’ বা ‘বাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সে-সব খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা এ-ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া যেতে পারে, কারণ ‘যুক্তিবাদ কোনও স্বতন্ত্র বাদ নয়’ বলে যাঁরা প্রচার করতে চান, তারাও তাঁদের কুযুক্তির অবতারণা করতে ওইসব খুঁটিনাটিকে ধর্তব্যে আনে না। অতএব ‘যুক্তিবাদ’ যে একটা ‘বাদ’ এটা প্রমাণ করতে আমরাও ও-সব খুঁটিনাটিকে আলোচনার বাইরে রাখছি।
‘বাদ’ বা ism’ বলতে গিয়ে ‘তৃতীয়ত’ বলে যে ‘বাদ’–এর ব্যাখ্যা হাজির করেছি, তাতে দেখতে পাচ্ছি যে, সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর সোপানকেও ‘বাদ’ বা ‘ism’ বলা হয়। যুক্তি যেহেতু কোনও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিতে বা দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর সোপান, অতএব ‘যুক্তিবাদ’ অবশ্যই একটি ‘বাদ’ বা ‘ism’ । কিন্তু যেন তেন প্রকারেণ ‘যুক্তিবাদ’ কে একটি ‘বাদ’ বলে চালাতে পারাটাই বড় কথা নয়। বরঞ্চ আমরা দেখাতে চাই ‘বাদ’ বা ‘ism’ বলতে ‘প্রথমত’ ও ‘দ্বিতীয়ত’ বলে যে ব্যাখ্যা দুটি হাজির করেছি সেই দুই অর্থেও ‘যুক্তিবাদ’ অবশ্যই একটি ‘বাদ’ বা ‘ism’। অর্থাৎ
‘যুক্তিবাদ’ শুধু বিচার-বিশ্লেষণের কিছু পদ্ধতিগত
কায়দা-কানুন নয়, ‘যুক্তিবাদ’ একটি সামগ্রিক
জীবনদর্শন, একটি বিশ্ব-নিরীক্ষণ
পদ্ধতি, একটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি।
কেন? কী ভাবে? উদাহরণ দিই।
লজিক বা তর্কশাস্ত্র আজ বহুদূর এগিয়েছে। একে এখন প্রায় বিশুদ্ধ গণিতের মতোই একটি আলাদা বিষয় বলে ধরা যায়। জটিলতাও এখন বহুদূর বিস্তৃত। তবু আমাদের আলোচনায় সরলতম উদাহরণটি নিলেই যথেষ্ট। তর্কশাস্ত্র সম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কায়দা-কানুনকে দুটো স্পষ্ট ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হল ডিডাকশন বা অবরোহ, আর একটা ইন্ডাকশন বা আরোহ। এ সমস্তই একেবারে টেকনিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার, অনেকে হয়তো জানেনও তবু যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য যেটুকু না বললে নয়, সেটুকু আলোচনাই করছি।
অবরোহ হল কোনও ব্যাপক বা সাধারণ সত্য থেকে বিশেষ সত্যে পৌঁছনোর কায়দা। ধরুন, বলা হল “সব মানুষই মরণশীল”। তারপর বলা হলো “রামবাবু একজন মানুষ।” এই দুটো বাক্য থেকে কী বেরিয়ে আসে? অনিবার্যভাবে, “রামবাবু মরণশীল”।
সিদ্ধান্তটি সঠিকই হয়েছে। এ-বার পদ্ধতিটা বিশ্লষণ করি আসুন। কী পাচ্ছি? রামবাবু একই সঙ্গে অমর ও মরণশীল হতে পারেন না। যে কোনও একটা তাঁকে হতেই হবে। কিন্তু তিনি অমর হলে প্রথম বাক্যের বিরোধিতা করা হয়। অর্থাৎ রামবাবু মানুষ নন। কিন্তু রামবাবু মানুষ হলে তার মরণশীল হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এক্ষেত্রে “সব মানুষ মরণশীল” –এই সাধারণ সত্য থেকে আমরা একজন বিশেষ মানুষ সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছি। অতএব এটা বহুর বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে একের সিদ্ধান্তে নেমে আসছি, এটা অবরোহমূলক যুক্তি।
তাহলে উপরের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, অবরোহ যুক্তির পিছনে আছে আত্মবিরোধিতা বা স্ববিরোধিতা না করার নীতি (Law of non- selfcontradiction)। আর তারও পিছনে আছে একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি— “জগৎ-সংসার স্ব-বিরোধী নয়’। কারণ, তা না হলে স্ব-বিরোধিতা করলেও যুক্তি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকত।
এই গোড়ার কথাটা মাথায় রেখে আরোহমূলক যুক্তির আলোচনায় আসুন নিচের কয়েকটা বাক্য মন দিয়ে লক্ষ করা যাক:
‘ক’ বাবু পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন এবং মরেছেন। ‘খ’ বাবু পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন এবং মরেছেন। ‘গ’ বাবু পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন এবং মরেছেন। ‘ঘ’ বাবু পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন এবং মরেছেন।
এমনি করে শ’খানেক পটাশিয়াম সায়ানাইড খাওয়া বাবুর উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেল তাঁরাও পটাশিয়াম সায়ানাইড খাওয়ার কারণে মারা গেছেন। সুতরাং এই একশো জনের উপর চালানো পরীক্ষার ভিত্তিতে বলা চলে, “সম্ভবত, যে পটাশিয়াম সায়ানাইড খায় সেই মরে”।
যত বেশি লোকের উপর পরীক্ষা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হবে, ততই সিদ্ধান্তটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।
এই যুক্তির ক্ষেত্রে আমরা কোন পদ্ধতি গ্রহণ করলাম? এখানে আমরা অবরোহ যুক্তির উল্টোভাবে কিছু বিশেষ ব্যক্তির সম্পর্কে পাওয়া কিছু তথ্য থেকে একটা সাধারণ বা ব্যাপক সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছি। এটাই হল আরোহমূলক যুক্তি।
বিশ্লেষণ করা দরকার একেও। কী বেরিয়ে আসে বিশ্লেষণে? সব ঘটনারই কারণ থাকে, এবং কারণটি অবশ্যই ঘটনার আগে ঘটবে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে পটাশিয়াম সায়ানাইডকে মৃত্যুর কারণ বলে চিহ্নিত করা হল। গোটা পদ্ধতিটার পিছনে রয়েছে কয়েকটি মৌলক বিষয়। প্রথমত, প্রত্যেক ঘটনার একটি কারণ রয়েছে (Law of causation), এই প্রত্যয়। এই প্রত্যয় না থাকলে মৃত্যুর আদৌ কোনও কারণ আছে কি না তাই নিয়ে ধন্ধে পড়তে হত এবং তার পূর্ববর্তী কোনও ঘটনার মধ্যে কারণ খোঁজার প্রশ্নই আসত না।
দ্বিতীয়ত, একই কারণ সব সময় একই ফল দেবে (Law of uniformity of nature), এই প্রত্যয়। এই প্রত্যয় না থাকলে গাদা গাদা লোক পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মরলেও একই পরিস্থিতিতে অন্য লোক মরবে কি না সে সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তই নেওয়া যেত না।
এবং তৃতীয়ত, অনুসন্ধান করলে প্রতিটি ঘটনার কারণই সম্পূর্ণ বোধগম্য হতে বাধ্য, এই প্রত্যয়। এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে কার্য-কারণে বিশ্বাস করলেও কোনও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এক পাও এগোনো সম্ভব হবে না। আপনি যদি ভাবতে থাকেন, যে মৃত্যুর কারণ থাকলেও তা বুদ্ধির অগম্য, তাহলে বিষ বা ওই জাতীয় কোনও বাস্তব বিষয়ের মধ্যে কারণ খুঁজে বেড়ানোর কথা মাথাতেই আসা উচিত নয়।
সবচেয়ে গোঁড়া ভাববাদীও এ-সব মেনে না চললে কোনও কাজই করতে পারবেন না। সুতরাং মুখে অন্য কথা বললেও বাস্তব জীবনে তাকে এ-সবই মাথায় রাখতেই হয়।
তাহলে এ-বার আলোচনাটা গুটিয়ে নিই। আরোহ বা অবরোহ—যে ধরনের যুক্তিই আমরা প্রয়োগ করি না কেন, কতকগুলো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়—যেমন, স্ব-বিরোধিতা চলবে না, প্রতিটি ঘটনার কারণ খুঁজতে হবে, কারণগুলো সর্বজনীন হবে এবং তাকে বোঝাও যাবে।
কিন্তু প্রশ্ন—কার স্ব-বিরোধিতা করা বা না করা? কীসের ঘটনা? কীসের ই বা কারণ? একই কারণ একই ফল দেবে, এটা কার সম্পর্কে, কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে? কার্য-কারণ, তার সর্বজনীনতা, তার বোধগম্যতা কি শূন্যে দাঁড়িয়ে ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ছে? তা হতে পারে না। বরঞ্চ এইসব সম্পূর্ণ তাৎপর্য তখনই পায়, যখন এক পরিবর্তনশীল বস্তুতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ-গুলো চিন্তা করি। এবং যে কোনও সফল, সার্থক, ইতিবাচক চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষ চিরকাল তাইই করে আসছে। যুক্তিবাদ তাই আসলে বস্তুবাদই।
বস্তুময়তা এবং বাস্তব পরিবর্তনশীলতার ধারণা ছাড়া লজিক একেবারেই দাঁড়ায় না। সেই জন্যেই ভাববাদী চিন্তা-ভাবনায় নিখুঁতভাবে লজিকের পদ্ধতি-প্রকরণ প্রয়োগ করলেও স্ব-বিরোধিতা এড়ানো যায় না, যায় না জীবনের সমস্ত দিকের সঙ্গে তার সমন্বয়-সাধন করা। তাই বস্তু-পরিবর্তন-যুক্তি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। একমাত্র বিমূর্ত চিন্তায় ছাড়া অন্য কোথাও আমরা তাকে অবহেলা করতে পারি না।
যুক্তিবাদ তাই আমাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি, আমাদের আত্মমগ্নতা ও বহির্মুখিনতা উভয়েরই সঙ্গী। ‘যুক্তিবাদ’ মানে একটা গোটা বিশ্ববীক্ষা অর্থাৎ গোটা বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতি, একমাত্র স্ব-বিরোধিতাহীন জীবন-দর্শন।
‘যুক্তিবাদ’ শব্দটি যখন যে কোনও যুক্তির নিরিখে সুচিন্তিতভাবে একটি ‘ism’ বা ‘বাদ’ তখন ‘দেশ’ পত্রিকার গ্রন্থ-সমালোচক শ্রীসমীর চৌধুরী কেন এমন কিছু কথা লিখলেন যার দ্বারা তাঁর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও ভ্রান্তিই প্রকট হয়ে উঠল? এমন চূড়ান্ত ভ্রান্ত বক্তব্য কেমনভাবে সম্পাদক দ্বারা প্রকাশের ছাড়পত্র পেল? তবে কি জন-মানসে যুক্তিবাদের প্রভাব দ্রুত-বর্ধমান দেখে এই ‘বাদ’কে ঠেকাতে শঙ্কিত যন্ত্রীরা সমালোচককে যন্ত্রের মতোই কাছে লাগিয়েছেন, এবং এ-ক্ষেত্রে সমালোচকের ভ্রান্তিগুলো নিতান্তই উদ্দেশ্যমূলক? আর সর্বশেষ সম্ভাবনাই অত্যধিক, কারণ ‘যুক্তিবাদ’ হল সেই সামগ্রিক জীবনদর্শন যার সাহায্যে বঞ্চিত মানুষরাও তাদের বঞ্চনার কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে, আর এর মধ্যেই তো রয়েছে শোষক শ্রেণির সর্বনাশের বীজ।
‘যুক্তির দ্বারা বিচার’ বা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান’ বলতে আমরা সাধারণত পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোকে বুঝি। কিন্তু বাস্তবে জিজ্ঞাসু মনের পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের আগে বা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু করার একটু আগে থেকেই অসম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ, অসম্পূর্ণ তথ্য থেকে আমরা একটি আনুমানিক সিদ্ধান্ত মনে মনে খাড়া করি। এবং এই আনুমানিক সিদ্ধান্তই আমাদের পথ বাতলে দেয়, আমরা বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণে অবতীর্ণ হব কি না, বা হলে কী ভাবে? কোনও পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণে নামার আগের এই আনুমানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়কে Logic বা ন্যায়শাস্ত্রে বলে হাইপোথিসিস্ (Hypothesis) বা প্রকল্প। অনুসন্ধানের এই পর্যায়টির কোনও ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। বরং বলা চলে এই আনুমানিক সিদ্ধান্ত আসে অনেকটাই পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, যা অনেকটাই ইনট্যুইটিভ (intutive) বা স্বজ্ঞাত, অর্থাৎ সচেতন বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে জানা। এই আনুমানিক সিদ্ধান্তের পিছনকার প্রক্রিয়াটি এমনই দ্রুত, স্বতঃস্ফূর্ত ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক যে প্রায়ই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। এই হাইপোথিসিস্-এর গুরুত্ব যুক্তি বিচার ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে হাইথিসিসের পর্যায়কে বাদ দিলে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে সমস্ত রকম সতর্কতা ও নিষ্ঠা সত্ত্বেও তার পরিণতি হাস্যকর হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টা পরিষ্কার করতে একটা উদাহরণ হাজির করতে পারি। আমার বন্ধুর একটি লেখার উদাহরণ এখানে দিলাম, উদাহরণটা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। কিন্তু আমি নিশ্চিত—একটু ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়ে ফেললে যুক্তিবাদের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় পর্যায় ‘হাইপোথিসিস্’ বা ‘প্রকল্প’ বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
“মনে করুন, কোনও এক ‘ক’ মশায়ের হঠাৎ মনে হল যে তাঁর পাশের ফাঁকা চেয়ারটিতে একজন মানুষ বসে রয়েছে, কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না, যেহেতু তার শরীর একেবারে স্বচ্ছ কোনো অজানা পদার্থ দিয়ে তৈরি। যেহেতু ‘ক’ বাবু বিজ্ঞানের খোঁজ খবর রাখেন না, তিনি দারুণ সংশয়াকুলভাবে কথাটা তাঁর বন্ধু ‘খ’ বাবুকে বললেন, যিনি কি না বিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু ‘খ’ বাবুও এমন কোনো বস্তুর কথা ছাত্রজীবনে পড়েছিলেন বলে মনে করতে পারলেন না। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের (এবং সামগ্রিকভাবে মনুষ্যজাতির) জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ, সুতরাং তিনি স্থির করলেন যে এবিষয়ে চটজলদি কিছু বলাটা ঠিক হবে না। তিনি আরও ভাবলেন যে, লোকটি নিশ্চয় একদম চুপচাপ বসে আছে এবং তার দেহযন্ত্র এমনভাবে তৈরি যে, শ্বাসপ্রশ্বাসের দরকার হয় না, কারণ তা নাহলে নাড়াচাড়া শ্বাসক্রিয়ার শব্দ পাওয়া যেত। প্রচণ্ড বিভ্রান্ত হয়ে ‘খ’ বাবু তাঁর এক ফিজিক্সে পি-এইচ-ডি করা এবং গবেষণারত আত্মীয়ের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা সবিস্তার বর্ণনা করলেন। সেই আত্মীয় একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল বিজ্ঞানী, তিনি নিজের চোখে না দেখে কিচ্ছুটি বিশ্বাস করেন না। তিনি সরেজমিন তদন্তে গিয়ে স্বচক্ষে দেখলেন যে, যা বলা হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র ফাঁক নেই। তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে, ল্যাবরেটরি থেকে জিনিসপত্র আনিয়ে, প্রচণ্ড সতর্কভাবে, একজন সত্যিকারের সিরিয়াস ও নিরলস বিজ্ঞান কর্মীর মতো দু’টি এক্সপেরিমেন্ট করলেন। প্রথমত, চেয়ারের ধার কাছ থেকে মেঝের কাছ ঘেঁষে কিছু বায়ু সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরীক্ষা দ্বারা দেখলেন তাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অনুপাত একেবারে স্বাভাবিক, অর্থাৎ চেয়ার সংলগ্ন অঞ্চলে শ্বাসপ্রক্রিয়া ঘটেছিল বা ঘটছে এমন প্রমাণ নেই। এই ফলাফল ‘খ’ বাবুর অনুমানকে সমর্থন করে, কারণ ‘খ’ বাবু সন্দেহ করেছিলেন অদৃশ্য লোকটির শ্বাসক্রিয়া হয় না।
দ্বিতীয়ত, তিনি ঐ গোটা চেয়ারটিকে বিদেশ থেকে আনানো উঁচুমানের নিখুঁত স্প্রিং ব্যালেন্স দিয়ে ওজন করলেন; ফলাফল দেখে তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে গেল। কী আশ্চর্য? ওই চেয়ারটির ওজন একেবারে একটি চেয়ারের ওজন যা উচিত, ঠিক তাই— একচুল বেশি বা কম নয়। তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে হয় লোকটির ভর শূন্য বা প্রায় শূন্য, অথবা তার শরীর এমন কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি যার ওপর মাধ্যাকর্ষণের কোনো ক্রিয়া নেই। এবং শীঘ্রই যে বিজ্ঞানের জগতে একটি বিপুল আলোড়ন ঘটতে যাচ্ছে তা অনুমান করে তিনি যারপরনাই রোমাঞ্চিত হলেন। আর, প্রকৃত বিজ্ঞানীর মতো উপরিউক্ত পরীক্ষাগুলো বার বার করে নিঃসংশয় হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি আরও সুদূরপ্রসারী। সেই ভদ্রলোক এক স্বনামধন্য প্রফেসরের সঙ্গে এব্যাপারে কথা বললেন। প্রোফেসর নিজে গিয়ে সবকিছু দেখে শুনে ইন্টারন্যাশনাল বায়োফিজিসিস্ট ও বায়োকেমিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টদের দু’খানা চিঠি লিখলেন। তখন পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটা কমিটি তৈরি হল। তাঁরা এসে অতি সূক্ষ্ম এক্সরে স্ক্যানার ও কম্পিউটার চালিত স্পেক্ট্রোমিটার দিয়ে কোনও সজীব কোষ-কলা বা অস্থি-মজ্জার সন্ধান পেলেন না। শেষ পর্যন্ত এক যুগান্তকারী রিপোর্টে যা লেখা হল তার সারমর্ম এই : “যদিও আমাদের বর্তমানে সংগৃহীত জ্ঞান ও তথ্যের ভিত্তিতে এমন কথা বলা যাচ্ছে না যে, সাধারণ আলোক ও এক্সরে-র সাপেক্ষে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং প্রায় ভরশূন্য কোন সজীব অস্তিত্ব সম্ভবপর (বিশেষত এমনকী শ্বাসক্রিয়াও যেখানে অনুপস্থিত), তবু আমরা মনে করছি যে এ সম্পর্কে শেষ কথা বলতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধানের দরকার আছে। সঠিকতম সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য আমরা অসীম সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি, এবং প্রত্যেক বিজ্ঞানমনস্ক লোকই তাই, আমরা আশা করি। আমরা এব্যাপারে পৃথিবী-ব্যাপী কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তাব রাখছি।” এনিয়ে পৃথিবীর সমস্ত নামী কাগজেই লেখালেখি হল, শুধু দু’একটি ভারতীয় কাগজ দুঃখ প্রকাশ করল যে, প্রথম থেকেই এব্যাপারে একাধিক ভারতীয়ের নাম জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও সমস্ত কৃতিত্বটাই পেলেন বিদেশি বিজ্ঞানীরা।
আমার একান্ত ধারণা, যে উপরিউক্ত উদাহরণটি পড়ে যে কোনও স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন লোকই বলবে যে, গুণমানের দিক থেকে উল্লেখিত গবেষণাটি অতিশয় ওঁচা ধরনের। কিন্তু কথা হল, এখানে ত্রুটিটা কোথায়? প্রত্যেকেই জ্ঞানীগুণী, বিনয়ী ও পরিশ্রমী, যে ক’টি এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে প্রতিটাই প্রাসঙ্গিক, পরীক্ষায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি উঁচুমানের এবং সেগুলো ঠিকই ফলাফল দিয়েছে, এমনকী, ফলাফল থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোও সবই যুক্তিসম্মত ও সম্ভাব্য । ”
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতেই পারেন- চেয়ারে একটি অদৃশ্য মানুষ বসে আছে এরকম সন্দেহ করা হল কেন? সেই এইচ জি ওয়েলস্-এর ‘দি ইন্ভিজিবল ম্যান’ উপন্যাসে যে ধরনের অদ্ভুত সব কাণ্ড-কারখানা ঘটেছিল, তা যদি না ঘটে তাহলে একজন সুস্থ, প্রকৃতিস্থ, স্বাভাবিক মানুষ এই ধরনের বিদঘুটে সন্দেহ শুধু শুধু করতে যাবে কেন ? এই প্রশ্নের উদয় হলেই অমন নিরলস গবেষণা অর্থহীন হয়ে পড়ে। গবেষকের চিন্তায় এই প্রশ্নটিই গবেষণায় নামার আগে খোঁচা দেয়, এটাই হল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও যুক্তিসম্মত অনুসন্ধানের প্রথমতম পর্যায়—হাইপোথিসিস্ বা প্রকল্প। হাইপোথিসিস্ বা প্রকল্পটি যদি ভুল বা ভিত্তিহীন হয় তবে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের পথ ধরে এগুলোও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হাস্যকর পরিণতি ঘটতে পারে। এতক্ষণ যে কাল্পনিক উদাহরণটি আপনাদের কাছে হাজির করলাম, তাতে গবেষক পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইলেও সিদ্ধান্তটি ভুল হয়েছে, কারণ হাইপোথিসিস্টাই ছিল ভিত্তিহীন।
এতক্ষণ আলোচনার পর তাহলে . আমরা কী পেলাম? সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম— বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যেমন হাইপোথিসিসস্ বা প্রকল্পের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তেমনই যুক্তির আগেও অত্যন্ত মৌলিক ধরনের কিছু হাইপোথিসিসের মূল্যবান ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত আলোচনাকে গুটিয়ে আনলে পাচ্ছি যুক্তি মানে কেবলমাত্র লজিক বা তর্কশাস্ত্র নয়। যুক্তি মানে লজিক এবং সেই বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতি যা লজিককে সম্ভবপর করে তোলে। এই অর্থে যুক্তির ইংরেজি প্রতিশব্দ logic হবে না, হবে reason বা rationality । সুতরাং যুক্তির সঙ্গে বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতি বা বস্তুবাদের রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
যদি আমরা ঐতিহাসিক দিক থেকে আমাদের দর্শন, বিজ্ঞান ও সমস্তরকম চেতনার আবির্ভাব এবং বিকাশের বিষয়টা ভেবে দেখি, দেখতে পাব, যখন আমরা যুক্তি প্রয়োগ করি, তখন একটা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই করি। অর্থাৎ, যুক্তি মেনে চললে অবস্তুবাদী হওয়া যায় না।
সেই আদিম যুগে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যখনই আমরা হাতিয়ার ব্যবহার করেছি, সেই হাতিয়ার গাছের ডাল হলেও তাকে আমরা ঘষে ছুঁচোলো করেছি, পাথর ঘষে ধারালো অস্ত্রের রূপ দিয়েছি। প্রয়োজনের তাগিদে এই অস্ত্রকে আরও উন্নততর করতে চেয়েছি। যতই পরিবেশকে বেশি বেশি করে বুঝেছি, বেশি বেশি করে চিনেছি, ততই সচেষ্ট হয়েছি প্রাকৃতিক পরিবেশকে জয় করতে, সামাজিক পরিবেশকে পাল্টাতে। পরিবেশকে যেমন আমরা পরিবর্তন করেছি, একই সঙ্গে পরিবেশও আমাদের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বাস্তবকে যত ভলোভাবে চিনতে পারছি, বুঝতে পারছি ততই আমাদের পরিবেশকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা যাচ্ছে বেড়ে, এবং প্রকৃতিকে আরও বেশি পরিবর্তিত করলে প্রকৃতিকে আরও বেশি নিখুঁত ভাবে চেনা যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে। আরও বেশি করে চেনা ও বোঝার জন্য ক্রমশ বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে ব্যাপকভাবে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নির্ণয়ের প্রয়োজন দেখা দিল। প্রয়োজন হল শ্রেণি বিভাজনের। এখানেই বস্তু থেকে ধারণাকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি হল বিমূর্ত চিন্তনের। এইভাবে বিমূর্ত চিন্তনের সাহায্যে সৈন্য-সামন্ত ও সম্পদ গণনার জন্য সৃষ্টি হল পাটিগণিতের, জমির মাপ-জোকের জন্য জ্যামিতি ও শস্য উৎপাদনের স্বার্থে ঋতু পরিবর্তনের হিসেব রাখতে গিয়ে সৃষ্টি করা হল জ্যোতির্বিজ্ঞানের। সুতরাং যুক্তি-গণিত- বিজ্ঞান আসলে আমাদের লড়াই করে বেঁচে থাকার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে একাকার হয়ে গেছে।
এরপরেও অবশ্য একটা গুরুতর প্রশ্ন থেকে যায়। যুক্তি মেনে চললে যদি বস্তুবাদী হতেই হয়, তবে যুক্তি মেনেও এত খ্যাতিমান ব্যক্তিরা ভাববাদী হন কী করে? ভাববাদী দার্শনিকেরাও তো কাঁটায় কাঁটায় যুক্তি মেনেই আলোচনা চালান! ভাববাদী দার্শনিকদের যুক্তিগুলো কেমন, একটু দেখা যাক। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো মত প্রকাশ করেছিলেন—আমরা যে জগৎটা দেখছি যে বস্তু সকল দেখছি বলে মনে করি, তা সবই বাস্তবতাহীন, নকল বিমূর্ত ধারণার জগৎই আসল এবং চিরন্তন। আঁরি বেগস, ব্রাডলের মতো বিশ্ববিখ্যাত ভাববাদী দার্শনিকরা মনে করতেন— জগতের স্বরূপ যুক্তিসিদ্ধ বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা পাওয়া বা বোঝা সম্ভব নয়। তাঁদের বক্তব্য-যুক্তি ব্যাপারটাই কোনও কাজের নয়। যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষণ কোনও পথ দেখাতে পারে না। যুক্তির যুক্তিহীনতা এবং যুক্তির বস্তুবাদের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা বোঝাতে গিয়ে এইসব প্রচারে অতিবিখ্যাত দার্শনিকেরা অসহায়ভাবে যুক্তি-তর্কেরই আশ্রয় নিয়েছেন। এঁরা দার্শনিক আলোচনায় এক আলো-আঁধারি, আধা-মিস্টিক রহস্যে ঘেরা পরিবেশ তৈরি করেন। অনেকে লজিকের সাহায্য নিয়ে জগতের এক অবাস্তব মডেল তৈরি করেন। যেমন ভাববাদী দর্শনের এক কর্ণধার বার্কলে বলেছিলেন, এই জগৎ সংসারে বস্তু-টস্তু কিছু নেই, সবই আমাদের নিজেদেরই মনের ধারণা। বস্তুর যে স্বরূপ তাঁর অজানা, তাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অজানা ঈশ্বরেরও আমদানি করেছিলেন। অজানা জিনিস দিয়ে অজানা জিনিসকে ব্যাখ্যার চেষ্টা অর্থহীন এবং হাস্যকর।
অন্যদিকে আর এক দল আছেন, যাঁরা নিজেদের সোচ্চারে যুক্তিবাদী বলে ঘোষণা করেন, যুক্তির গুরুত্ব বোঝেন এবং প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুকে মেনে নিতে নারাজ। কিন্তু যুক্তি বলতে এঁরা শুধুমাত্র তর্কশাস্ত্রকেই বোঝেন, বোঝেন যুক্তি-তর্কের কিছু প্যাচ-পায়জার। ফলে এই শ্রেণির যুক্তিবাদীরা আকারগত তর্কশাস্ত্রের কিছু উন্নতি ঘটানো ছাড়া আর কিছুই করেন না। যেহেতু বস্তুর গুণ বা ধর্ম ব্যক্তিনিরপেক্ষ নয়, সেহেতু তাঁরা। কেবলমাত্র ব্যক্তিনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য সমূহের খোঁজে জীবন কাটিয়ে দেন
‘গুণ ও ধর্ম ব্যক্তিনিরপেক্ষ নয়’ শব্দ’কটির অর্থ কারো কারো কাছে কঠিন ঠেকতে পারে বিবেচনায় দু-কথায় কিছু বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। ধরা গেল একটা ছোট রবারের বল আপনার হাতে তুলে দেওয়া হল। আপনি বলটা টিপে অনুভব করলেন না নরম, না শক্ত। আপনার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী একটি মানুষের হাতে বলটি তুলে দিলে সে বলটিকে আপনার অনুভূতির তুলনায় অনেক বেশি নরম অনুভব করবে। আবার একটি শিশুর হাতে বলটি তুলে দিলে তার মনে হবে বলটা যথেষ্টই শক্ত। অভিনেতা হিসেবে মিঠুনকে যেমন মিঠুন-ফ্যানরা দুরন্ত ভালোবাসে, তেমনি অনেকের কাছেই মিঠুনের অভিনয় অসহ্য ঠেকে। মাধুরী দীক্ষিতকে অনেকে সৌন্দর্যের রানি বলে প্রচণ্ড রকম মাতামাতি করলেও আমিই তো মাধুরীর সৌন্দর্যে তেমন কিছুই খুঁজে পাই না। এই তিনটি দৃষ্টান্ত থেকে আমরা পেলাম—কোনও কিছুর গুণ বা ধর্ম ব্যক্তি বিশেষে ভিন্নতর, অর্থাৎ ব্যক্তিনিরপেক্ষ নয়। ভাববাদীরা এই সুযোগে সিদ্ধান্ত নেন যে-বস্তুর অস্তিত্বটাই মনের ধারণার উপর নির্ভরশীল। আবার সেই জায়গায় যান্ত্রিক-বস্তুবাদীরা বস্তুর ব্যক্তিসাপেক্ষ বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে ব্যক্তিনিরপেক্ষ কোনও কিছুর তল্লাশে নিজেদের ব্যাপৃত রাখেন। আসলে আপনি আমি যেটাকে দেখছি, শুনছি বা যার ঘ্রাণ নিচ্ছি, অথবা যাকে স্পর্শ করছি সেটা আসলে আপনার আমার সঙ্গে বস্তুর একটা পরিবর্তনশীল বাস্তব সম্পর্ক। আমি একটা পাতার রং যে ভাবে দেখছি, সেটা যেমন বাস্তব, একজন বর্ণান্ধ যখন পাতাটার রংটিকে ভিন্নতর ভাবে দেখছে, সেটাও সমানভাবেই বাস্তব। আবার বিশুদ্ধ জল পান করার পর যে আমি কোনও স্বাদ পাচ্ছি না সেটা যেমন বাস্তব, তেমনি খানিকটা খয়ের বা আমলকী চিবোনোর পর সেই আমার কাছেই জল মিষ্টিমিষ্টি লাগছে এও কিন্তু বাস্তব।
আমার সঙ্গে একজন বর্ণান্ধের যেমন পার্থক্য আছে, তেমনই আমলকী খাওয়ার আগের আমির সঙ্গে পরের আমিরও পার্থক্য আছে। সুতরাং একই বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কেও যথেষ্ট পার্থক্য থাকবে। কোনওটার থেকে কোনওটা কম বা বেশি বাস্তব নয়। সুতরাং পার্থক্য আছে বলে বাস্তব অস্তিত্বকেই উড়িয়ে দেওয়া যেমন পাগলামি, তেমনই অর্থহীন হল শুধুমাত্র ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য খুঁজে বার করার চেষ্টা, কারণ ওইরকম কোনও কিছু আসলে নেই ৷ একই লোক যেমন একই সঙ্গে একই সময়ে কারুর বাবা, কারুর ভাই, কারুর ছেলে, কারুর জামাই, কারুর মেসোমশাই হতে পারে, তেমনই একই বস্তু একই সময়ে কারুর কাছে শক্ত, কারুর কাছে নরম, কারুর কাছে উজ্জ্বল, কারুর কাছে অনুজ্জ্বল ইত্যাদি হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সবই যদি এইভাবে বাস্তব হয় তাহলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ভিত্তি কী হবে? একটু ভাবলেই বোঝা যায়, “অমুক বস্তুর অমুক ধর্ম শাশ্বত ও চিরন্তন”–এই লাইনে যে কোনও অনুসন্ধান মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। বরঞ্চ বলতে হবে—“অমুক পরিস্থিতিতে অমুক বস্তু অমুক ধর্ম দেখাবে”, কারণ ধর্ম (Properties) ব্যাপারটা আসলে একটি সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু নয়। এই সম্পর্কে পরিবর্তন সমূহের মধ্যেকার খুঁটিনাটি নিয়মকানুন অধ্যয়ন করা, তাদের মধ্যেকার যোগসূত্র খুঁজে বার করা এবং তার দ্বারা অজানা পরিস্থিতিতে কী বস্তুধর্ম দেখা যাবে তা আঁচ করা— এই হল বিজ্ঞানের কাজ। আর এ-ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি জুগিয়ে বিজ্ঞানকে বিপথগামী না হতে দেওয়া এবং সৌন্দর্যবোধ ও নীতিবোধের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য স্থাপন করা—এই হল দর্শনের কাজ। এ-ছাড়া আর কোনও কাজ তাদের নেই।
কিন্তু এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি না থাকার ফলে যান্ত্রিক-বস্তুবাদীরা ব্যক্তি- নিরপেক্ষ বা সর্বজনগ্রাহ্য বস্তু-ধর্ম খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। অথচ এই শ্রেণির যুক্তিবাদী পণ্ডিতরা সাধারণভাবে যেহেতু বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে সবিশেষ উৎসাহী, ফলে এঁদের কাছে বস্তু হয়ে দাঁড়ায় কিছু গাণিতিক সমীকরণমাত্র। ফলে শ্রোয়েডিঙ্গারের “Mind and Matter” –এর মতো ভাববাদী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় প্রাগ্যাটিক দর্শনের। এই দর্শনের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল, এই দর্শনে বিশ্বাসী বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকরা বুঝে উঠতে পারেন না, এই নৈর্ব্যক্তিক, খণ্ডিত বিশ্ব নিরীক্ষণ পদ্ধতি তাঁরা সমাজজীবনে কীভাবে কাজে লাগাবেন, কী ভাবেই বা তা দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন সৌন্দর্যবোধ, নীতিবোধ ইত্যাদি বাস্তব বিষয়গুলোর। ফলে এই ধরনের দর্শনে বিশ্বাসী মানুষরা হয় তাত্ত্বিকভাবেই ভাববাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন, আর না হয় ব্যক্তিগত জীবনে সুবিধাবাদের আশ্রয় নেন। এরই জ্বলন্ত উদাহরণ তথাকথিত বিশিষ্ট ‘বস্তুবাদী’ ইংরেজ দার্শনিক-ডেভিড হিউম। তাঁর দার্শনিক আলোচনায় তিনি আত্ম ও ঈশ্বরের ধারণাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর এক প্রতিবেশী হিউমকে বলেন, হিউম যদি বিশ্বাস করতেন যে আত্মা অবিনশ্বর, তাহলে হয়তো তাঁর মায়ের দেহ শেষ হয়ে গেলেও আসলে এখনও মায়ের অস্তিত্ব আছে— এই ভেবে তিনি সান্ত্বনা পেতে পারতেন। কিন্তু অবিশ্বাসী হওয়ায় তিনি সে সান্ত্বনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।
তখন শোকাভিভূত হিউম মন্তব্য করেন, দার্শনিক আলোচনায় তিনি হয়তো অনেক কিছুই প্রমাণ করতে পারেন না, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস সাধারণ মানুষের থেকে এমন কিছু আলাদা নয়। আত্মার অবিনশ্বরতায় তিনিও বিশ্বাসী ।
যেহেতু ভুল বোঝার কোনও সুযোগই রাখতে চাই না, অতএব আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, এটা কিন্তু হিউমের ব্যক্তিগত স্ববিরোধিতা বলে আমরা মনে করি না। বরঞ্চ ঘটনা হল, যে এটা তাঁর দর্শনের অনিবার্য ফলশ্রুতি।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে আসছে। রামকৃষ্ণ, অরবিন্দ প্রমুখ ধর্মীয় প্রবক্তাদেরও অনেকে দার্শনিক বলে থাকেন। কেন বলেন তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে চূড়ান্ত অযৌক্তিক এবং কাণ্ডজ্ঞান বর্জিত হওয়া সত্ত্বেও এর বিরোধিতায় কিছু জায়গা এবং সময় খরচ করতেই হচ্ছে, যেহেতু এ ব্যাপারে প্রচারটা বেশ শক্তিশালী, তাই মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাটাও যথেষ্টই বেশি। নামীদামি লোক থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, পানের দোকানের মালিক-কাম-দোকানদার পর্যন্ত হরেক কিসিমের লোককে চোখ উল্টে বলতে শুনেছি—রামকৃষ্ণ? বাপরে বাপ্! দার্শনিকের বাবা !
কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল, ভাববাদী বা যান্ত্রিক বস্তুবাদী দার্শনিকরা যে অর্থে সফল দার্শনিক (তাঁদের মতামত গ্রহণ করছি কি না সেটা অন্য প্রসঙ্গ), এই অধ্যাত্মিক প্রবক্তারা সেই অর্থেও দার্শনিক নন। এঁরা আদৌ কোনও স্বতন্ত্র, স্পষ্ট, সুষ্ঠু চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন না, কোনও রকম প্রমাণ, ব্যাখ্যা, যুক্তিতর্কের ধারকাছ দিয়েও হাঁটেন না। এঁদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থকে ভিত্তি করে ‘বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু’, ‘বহ্মসত্য জগৎ মিথ্যা’, ‘উক্তিমার্গই শ্রেষ্ঠমার্গ’, ‘আত্মাই সত্য’, ইত্যাদি অন্তঃসারশূন্য অর্থহীন কথা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিচিত্র ঢঙে ও ঘনিষ্ঠ, আন্তরিক ভঙ্গিতে বলা। এসব ‘গোলা’ কথার বিরুদ্ধে নানা বইতে, নানা আলোচনায়, সমিতির নিয়মিত শিক্ষাচক্রে বারবার আমরা যুক্তির আক্রমণ চালিয়েছি, কিন্তু আপাতত বলার কথা শুধু এইটা যে, এঁরা দার্শনিক বলে গণ্য হওয়ার যোগ্যই নন; মতামতের মূল্যায়ন তো পরের কথা। তবে আলোচনার পদ্ধতির দিক থেকে না হলেও দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্যের দিক থেকে এঁরা ভাববাদী দার্শনিকদের মনের মানুষ। এখানে একটা কথা বলে নিলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। অতি সাম্প্রতিক কালের ‘ভাষা-দার্শনিক’ নামক পাশ্চাত্য দার্শনিকগোষ্ঠীর মতে পূর্ববর্তী সমস্ত দার্শনিকের তত্ত্বই নাকি আসলে ভাষার মার-প্যাঁচ, এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁদের দ্বারা আলোচিত নানা সমস্যাবলি আসলে দর্শনের সমস্যাই নয়, ব্যাকরণের সমস্যা। তর্কবিশারদ দার্শনিকদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ দাঁড়াবেন কোথায় সেটা ভাববার বিষয় ।
সে যাই হোক, এই পরিস্থিতিতে অধ্যাত্মবাদী নেতারা কিন্তু যাকে বলে ‘রাইজিং টু দি ওকেশন্’ তাই করে দেখাচ্ছেন। তাঁরা যান্ত্রিক বস্তুবাদের নানা ফাঁকফোকরকে কাজে লাগাচ্ছেন ভাববাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। আর এছাড়াও আধুনিক পদার্থবিদ্যার নানা জটিল, বিতর্কিত বিষয় থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পরিভাষা চয়ন করে ধোঁয়াশায় ভরা সস্তা ধরনের দার্শনিক ব্যাখ্যা আরোপ করে দাবি করছেন, আধুনিক বিজ্ঞান ভাববাদেরই সমর্থক। এ ব্যাপারে মদত দিচ্ছেন কতিপয় অ্যানিমিয়াগ্রস্ত মূল্যবোধহীন পেশাদার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ। এঁরা হাতে গ্রহরত্নের আংটি পরেন, নিয়মিত সন্ধ্যাহ্নিক-পুজো-আর্চা করেন এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরীক্ষা যাতে ব্যর্থ না হয় তার জন্য সদলবলে পুজো চড়ান। অনেকে বলেন, তাঁরা এছাড়া আরও অনেক কিছুই করেন।
যথা— মৌলিক গবেষণা বাদ দিয়ে আমলাতান্ত্রিক পদ লাভ করার জন্য সহকর্মীদের সঙ্গে খেয়োখেয়ি (ও বসের পায়ে তৈলমর্দন)।
একটা মজার ঘটনা বলি। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে একদিন দেখলাম এক আজগুবি জিনিস। আমার একজন পরিচিত ভেতরে গেছেন স্পোকেন ইংলিশ কোর্সের ফর্ম আনতে, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি— প্রবেশ দ্বারের সামনে ব্ল্যাকবোর্ডে খড়ি দিয়ে বড় বড় করে লেখা—‘আজকের বিষয় : কোয়ান্টাম ফিজিক্সের চোখে বেদান্ত দর্শন’! বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত জনৈক বাঙালি অধ্যাপকের নাম বক্তা হিসেবে ছিল। দেখেই ঝট করে আমার সেই ভয়ংকর আঁতেল পাগলাটে বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। ভর দুপুরে কফি হাউস থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী রে? তুই সেই কী যেন সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে গবেষণা করছিলি?” সে অত্যন্ত বিরক্তভাবে বলল, “যাচ্চলে! এও জানিস না? আমার লেটেস্ট বিষয় হলো—তেলাপোকার চোখে প্লেটোনিক প্রেম এবং বাজার অর্থনীতির সম্পর্ক ! ”
স্পষ্টতই এইসব ধান্দাবাজ ব্যক্তিরা যথার্থ সুবিধেবাদী প্রাগম্যান্টিক্সের মতনই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুযোগসুবিধে ভোগ করতে পিছপা নন, শুধু বিচার বিশ্লেষণকে গুলিয়ে দিতে চান। দেবতা ধ্বংস হওয়ার বদলে তাঁরা চান, যে দেবতার প্রণামী গোনবার জন্য মন্দিরে-মন্দিরে কম্পিউটার সিস্টেম বসুক।
বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে খাপ-খাইয়ে টিকে থাকার জন্য অনেক অধ্যাত্মবাদী নেতারাই অধ্যাত্মবাদী কথার ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞানের কথাকেও গুঁজে দিচ্ছেন। ওদের এমন গজ-কচ্ছপমার্কা অধ্যাত্মবাদী কথা-বার্তা বলার অর্থ—সাধারণ মানুষের মগজ-ধোলাই করে এমন চিন্তা ঢোকান যাতে তারা মনে করে অধ্যাত্মবাদ বিজ্ঞান বিরোধী নয়, বরং অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও বিরোধ-ই নেই, অধ্যাত্মবাদ হল চূড়ান্ত বিজ্ঞান।
এইসব যান্ত্রিক বস্তুবাদী ও অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের ভ্রান্ত, অজ্ঞতাপ্রসূত চিন্তাধারা থেকে উঠে আসা ভাসা-ভাসা কথাগুলোর অর্থ বুঝতে না পেরে অবুঝ মানুষরা ধরে নেন—এ সবই গভীর জ্ঞানময় কথা, যার অর্থ অনুধাবনের ক্ষমতা তাঁদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। ফলে ভ্রান্ত, অজ্ঞতা-প্রসূত চিন্তার স্রষ্টা অধ্যাত্মিক নেতারা দার্শনিক আখ্যায় ভূষিত হন, পূজিত হন।
এ-ভাবেই আমরা দেখেছি ভাববাদ ও যান্ত্রিক বস্তুবাদকে প্রকাশিত হতে— যে দুই দর্শনের মধ্যেই বিশ্ব নিরীক্ষণ পদ্ধতির নাম-গন্ধের দেখা মেলে না। আসলে এই দুই দর্শনের সাহায্যে কোনও দিনই আমাদের বাস্তব-সামাজিক- মূল্যবোধ এবং বাস্তব-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে একটি মাত্র দার্শনিক সূত্র দিয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় তার বাস্তব প্রয়োগও। সেটা সম্ভব একমাত্র বস্তুবাদী বিশ্ব নিরীক্ষণ পদ্ধতির দ্বারাই। একমাত্র এই দৃষ্টিভঙ্গিই পারে নীতিবোধের যৌক্তিকতা এবং যুক্তির নৈতিকতা প্রমাণ করতে।
এতক্ষণ যে আলোচনা করলাম, তাকে বিদেশের দৃষ্টান্ত বেশি টানায় কেউ কেউ ক্ষুণ্ন হতে পারেন। এমনকী, এও মনে করতে পারেন-তর্কবিদ্যা-অর্থাৎ ন্যায়দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রধান গৌরব বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল কাঁটায় কাঁটায় যুক্তি-তর্কের পথ ধরেই। ভারতীয় দর্শনের ভাববাদ যদি যুক্তিবাদের বিরোধীই হবে, তবে কেন তর্কবিদ্যা অর্থাৎ ন্যায়দর্শনের এমন গৌরবময় ভূমিকা ইতিহাসের স্বীকৃতি পেল?
বিষয়টা পরিষ্কার না করলে বিভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক। পাশ্চাত্যে প্রচলিত যুক্তিবাদী বলতে যে যান্ত্রিক বস্তুবাদী চিন্তাকে বোঝানো হয়, ভ্রান্তিকে বুঝতে না পারলে সঠিক যুক্তিবাদের অর্থাৎ বস্তুবাদের সঙ্গে যান্ত্রিক বস্তুবাদ নির্ভর যুক্তিবাদের পার্থক্য বোঝা যাবে না। দু’য়ের পার্থক্য না বুঝলে সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভ্রান্তি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এবার আসা যাক পরবর্তী প্রসঙ্গে। ভারতীয় ভাববাদীরা, ভারতীয় তর্কবিদ্যা ও ন্যায়দর্শনের স্রষ্টা, পালক ও পুষ্টকারীরা যুক্তি-তর্কের লড়াইকে পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। (১) বেদ ও ধর্মশাস্ত্রের অভ্রান্ততায় পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেও যেখানে যুক্তি-তর্কের কূট কচকচালি চালিয়ে যাওয়া যায় । (২) যুক্তি-তর্ক যেখানে প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুকেই অভ্রান্ত বলে মানতে নারাজ— এমনকী, তা বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র হলেও।
ধর্মশাস্ত্রকার মনুর বিধান হল, বেদকে ‘শ্রুতি’ এবং ‘ধর্মশাস্ত্রকে’ স্মৃতি বলে মানবে। বেদ ও ধর্মশাস্ত্রই হল সব ধর্মের মূল। এ-নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে কোনও বিতর্ক চলবে না। কোনও তার্কিক দ্বিজ যদি তর্কবিদ্যার সাহায্য নিয়ে ‘শ্ৰুতি’ ও ‘স্মৃতি’ অবমাননা করে তাহলে সাধু ব্যক্তিরা তাকে সমাজ থেকে দূর করে দেবে।
মনু বেদ নিয়ে তর্ককে প্রশংসা করেছেন। তবে সে তর্ককে এগোতে হবে অবশ্যই বেদের অভ্রান্ততাকে মেনে নিয়ে। বেদের প্রামাণ্যকে শিরোধার্য করে জটিল প্রশ্ন তুলে তর্ক চালিয়ে গেলে সাধারণের মধ্যে বেদভক্তি ও ধর্মবিশ্বাস আরও প্রবল হবে— এটাই ছিল মনুর ধারণা।
কথা উঠতেই পারে, হঠাৎ মনুকে এতটা গুরুত্ব দিলাম কেন? মনু কে? দু-চার কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, হিন্দু ভাববাদীদের বিশ্বাস মনু কোনও রমণীর গর্ভজাত নন, ব্রহ্মার দেহ থেকে উদ্ভূত। এই হেতু তাঁর আর এক নাম ‘স্বয়ম্ভূ’ মনু। মনুর স্ত্রী শতরূপা, ছেলে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ, কন্যা আকুতি, দেবাহুতি ও প্রসূতি। এঁদের ছেলে-মেয়েদের থেকেই নাকি মানুষ বা মনুষ্যজাতির বিস্তার। ব্রহ্মার কাছ থেকে মনু স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এই স্মৃতিশাস্ত্রই ধর্মশাস্ত্র বা প্রাচীন আইনের বিধান। আইন কর্তা মনু এমন শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন যার প্রধান শর্ত হল অন্ধ শাস্ত্ৰ-বিশ্বাস।
এই আলোচনার মধ্য দিয়ে নিশ্চয় বোঝা গেল ভারতীয় তর্কবিদ্যা বা ন্যায়দর্শন নিয়ে যত বেশি বেশি করে অগ্রগতির প্রচার হয়েছে তত বেশি বেশি করে মানবসভ্যতার চিন্তাশীলতা পিছু হটেছে।
ভারতীয় তর্কবিদ্যা ও ন্যায়দর্শনের যে পণ্ডিতকে যত বড়
দার্শনিক বলে প্রচার চালানো হয়েছে তিনি তত বড়ই
ভ্রান্ত-দর্শনের পণ্ডিত। এ যেন ঘোড়ার ডিম
নিয়ে গবেষণা করা এক উন্মাদকে
‘পণ্ডিত’ বলে প্রচার করার
মতোই হাস্যকর।
ভ্রান্ত-চিন্তার, ভ্রান্ত-দর্শনের বড় মাপের পণ্ডিত মানেই, বড় মাপের মূর্খ, এ সেই – যে যত বড় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ও যত বড় জ্যোতিষী, সে তত বড় প্রতারক—কথাটির মতোই পরম সত্য।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের এক প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, যাঁকে অনেকে দার্শনিক বলেই মনে-টনে করেন, আমাকে বলেছিলেন, “মানছি ঈশ্বরের অস্তিত্ব এখনও নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি, মানছি মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের গোলমালের ফলে অনেক মানসিক রোগী যেমন বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত অনুভূতির শিকার হন, তেমনি ভ্রান্ত অনুভূতির ফলে ঈশ্বর-দর্শন বা ঈশ্বরের কথা শোনাও সম্ভব। কিন্তু এ-কথাও মানতেই হবে, ‘ঈশ্বর নেই’ এমন কথাও কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। এমন তো বহুবারই ঘটেছে অতীতে যা প্রমাণিত সত্য ছিল না বর্তমানে তা প্রমাণিত সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্বকে এই মুহূর্তে অস্বীকার করলেও ভবিষ্যতে যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হবে না— এমন গ্যারান্টি দেওয়াটা কি যুক্তিযুক্ত? যুক্তিবাদিতায় নিষ্ঠা রাখার পর আমার এই যুক্তিকে অস্বীকার করবেন কী করে ?”
এ প্রশ্ন শুধু ওই ভাববাদী দার্শনিকের প্রশ্ন নয়। বহু ভাববাদী দার্শনিক, অধ্যাত্মবাদী নেতা এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এ-প্রশ্ন উঠে আসতে দেখেছি। আর বারবার এই উত্তর হাজির করেছি।
প্রমাণ ছাড়া ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমরা মানতে চাইছি কেন? দ্বীপ-দেশ- পরমাণু-রোগ জীবাণু-ব্ল্যাকহোল এসবের অস্তিত্ব তো আমরা বিনা প্রমাণে মেনে নিইনি।
অমনি ভাববাদীদের তরফ থেকে যে প্রশ্নটা লাফিয়ে এসে পড়ে তা হল, “আমরা বায়ু দেখিনি, বিদ্যুৎ দেখিনি, সম্রাট অশোককে দেখিনি, এমনকী নিজের প্রপিতামহকেও দেখিনি। এত কিছু না দেখেও যদি এদের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারি, তবে ঈশ্বরের বেলায় অসুবিধেটা কোথায়?” কিন্তু এই সমস্ত ক্ষেত্রেই পরোক্ষ প্রমাণের সাহায্যে এদের অস্তিত্ব আছে বোঝা সম্ভব। চোখে না দেখলেও বায়ুর স্পর্শ আমরা পাই, বায়ুকে কাজে লাগিয়ে উইন্ড মিল হচ্ছে, পতাকা উড়ছে, বায়ু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। বিদ্যুৎ তামার তারে দৃশ্যমান না হলেও আলোয়, পাখায়, টেপ রেকর্ডারে, টিভিতে, নানা যন্ত্রপাতি চালাতে বিদ্যুৎ তার অস্তিত্বকে সোচ্চারেই ঘোষণা করে। সম্রাট অশোকের কথা প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিলে পাই বলেই মানি। প্রপিতামহের অস্তিত্ব ছাড়া আমার অস্তিত্ব তাত্ত্বিকভাবেই অসম্ভব, তাই আমার অস্তিত্বই আমার প্রপিতামহের অস্তিত্বের প্রমাণ। এর পরে এমন প্রশ্ন ভাববাদী এবং অধ্যাত্মবাদী নেতাদের কাছ থেকে এসেছে, “আপনি কি প্রমাণ করতে পারেন আপনি যাকে বাবা বলছেন, তিনিই আপনার জন্মদাতা?” আমাদের সমাজের সাধারণ প্রচলিত প্রথা অনুসারে মায়ের বিবাহিত পুরুষ সঙ্গীকেই (‘স্বামী’ কথাটি ব্যবহার করতে চাইলাম না। কারণ, এই শব্দটির মধ্য দিয়ে স্ত্রীর ওপর বিবাহিত পুরুষ সঙ্গীর স্বত্বাধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়) আমরা বাবা বলে থাকি। বাবাই আমার জন্মদাতা কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়াটা একান্তই অবান্তর মনে করি। তবে আমার আপনার জন্ম যখন হয়েছে, তখন জন্মদাতা কোনও পুরুষ নিশ্চয়ই আছেন, নতুবা তাত্ত্বিকভাবেই আপনার আমার জন্ম অসম্ভব। তবে প্রয়োজনে ডি এন এ টেস্ট করে নিশ্চিত হতে পারেন। এখন লাখো কথার এক কথা হল, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে এ-ধরনের কোনও পরোক্ষ প্রমাণ আছে কি? উত্তর একটাই –নেই।
যাঁরা এমন যুক্তি হাজির করেন— “ঈশ্বরের অস্তিত্ব আজ প্রমাণিত না হলেও ভবিষ্যতে প্রমাণিত হতেই পারে”, অথবা ‘এমন উদাহরণ তো বহু আছে, অতীতে যা অপ্রমাণিত ছিল, বর্তমানে তা প্রমাণিত, ঈশ্বরের ক্ষেত্রে তো তেমনটা ঘটতেই পারে’, কিংবা “আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন, ঈশ্বর নেই”, তাঁদের এই জাতীয় যুক্তিগুলিকে লজিক বা ন্যায়শাস্ত্র মতে বলা হয় ‘প্রতারণাপূর্ণ যুক্তি’ বা ‘fallacious reasoning’ । এই ধরনের যুক্তির সাহায্যে যে কোনও কিছুর অস্তিত্বই প্রমাণ করা সম্ভব। আমি যদি বলি, ঘোড়ায় ডিম পাড়ে’, আপনি কোনওভাবেই প্রমাণ করতে পারছেন না ঘোড়ায় ডিম পাড়ে না। কারণ আপনি যদি বলেন, “আজ পর্যন্ত কেউ কখনই ঘোড়াকে ডিম পাড়তে দেখেনি”, আমি বলব, “পৃথিবীর প্রতিটি ঘোড়াকে প্রতিটি মুহূর্তের জন্য কি নজরে রেখে দেখার পর এ কথা বলা হচ্ছে? যেহেতু তেমনভাবে বাস্তবে নজর রাখা সম্ভব নয়, তাই যখন কোনও ঘোড়া ডিম পাড়ে, তখন তা মানুষের নজর এড়িয়ে যায়। আর তা ছাড়া ঘোড়ারও একটা প্রবণতা আছে, মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে ডিম পাড়া। যেহেতু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি গতকাল যা প্রমাণিত নয়, আজ তা প্রমাণিত, তাই ঘোড়ার ডিমের অস্তিত্বের ব্যাপারটাও এই মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়।” আমার এ-কথার জবাবে আপনি কী বলবেন? আপনি যেহেতু এই যুক্তির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তাই ঘোড়ার ডিমের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে পক্ষীরাজ ঘোড়া, ভূত-পেত্নী-দত্যি-দানো-গজকচ্ছপ ইত্যাদি সব কিছুর অস্তিত্বকেই আপনাকে মানতে হবে। আসলে অস্তিত্ব প্রমাণের দায়িত্ব সব সময়ই দাবিদারের। যুক্তিবাদীরা দাবির যৌক্তিকতাকে চুলচেরা বিচারের পরই গ্রহণ করবে, অথবা বর্জন করবে।
এই প্রতারণাপূর্ণ যুক্তির গলদটা কোথায়, আপনারা নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন। হ্যাঁ, পূর্ব আলোচনার সূত্র ধরে ঠিকই ধরে ফেলেছেন, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের আগে বা যুক্তি বিচারের আগে যে অসম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ তা তথ্য থেকে আনুমানিক একটি সিদ্ধান্ত মনে মনে খাড়া করি, যাকে বলা হয় প্রকল্প বা হাইপোথিসিস্। সেই প্রকল্পেই রয়ে গেছে গোলমাল ৷
ইতিহাস বলে, যে দেশে বা যে সম্প্রদায়ের মধ্যে যত বেশি সংখ্যক মানুষ সুস্থভাবে জীবনধারণের সুযোগ পেয়েছে সেই দেশের বা সম্প্রদায়ের মানুষের অগ্রগামিতার হার ততই বেড়ে গেছে। এই অগ্রগামিতা শিল্পে-বিজ্ঞানে- প্রযুক্তিতে, সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়েছে।
ইতিহাসের পাতা থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের
যুক্তিমনস্কতা এ কথাই ভাবাচ্ছে, প্রত্যেকটি মানুষের
সুস্থভাবে বাঁচার প্রয়োজন আছে, আর
তাহলেই আমরা সবাই মিলে
সবচেয়ে ভালোভাবে
বাঁচতে পারব।
হাতুড়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে ছোট-খাটো পরিবেশ পরিবর্তনের যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি অনেক দিন। আজ আমাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা এতটাই উঁচুমানে পৌঁছেছে যে, আমরা পূর্বপরিকল্পনামাফিক বিরাট ধরনের পরিবেশীয় পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা রাখি।
এগিয়েছে সমাজ। সমাজের এই অগ্রগতির নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি কিছু নিয়ম-ধারাকে। সমাজের এই নিয়মধারা যত বেশি বেশি করে বুঝতে শিখেছি, ততই এগিয়েছে সমাজ-বিজ্ঞান। আমরা দেখেছি, নানা মূল্যবোধ পাল্টে যেতে। আমরা শিখেছি, ত্রুটিপূর্ণ নীতিবোধ ও মূল্যবোধ পাল্টাবার উপায় । পাশাপাশি আমরা দেখেছি কীভাবে বিভিন্ন নীতিবোধ ও মূল্যবোধ সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয় শাসক ও শোষকশ্রেণির যৌথ উদ্যোগে। আমরা পরিচিত হয়েছি নব মগজ ধোলাই পদ্ধতির সাহায্যে, যেগুলোর প্রয়োগ-কর্তা শাসক ও শোষক শ্রেণি। আমরা জেনেছি সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শোষক ও শাসকশ্রেণি তাদের মগজ ধোলাইয়ের পদ্ধতি পাল্টায়, তাদের শোষণের হাতিয়ার ভাববাদী দর্শন পাল্টায়—ওরা কখনই একটা স্তরে থমকে থাকে না। এই জানা থেকে সমাজ-বিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, বস্তুবাদী যুক্তিবাদকে মানব-সমাজের অগ্রগামিতার কাজে লাগাতে চাইলে বস্তুবাদী যুক্তিবাদকে কখনই একটা স্তরে অনড় করে রাখা চলবে না। প্রতিটি স্তরে শাসক ও শোষক শ্রেণির শোষণ কৌশল পাল্টাবার পাশাপাশি যুক্তিবাদ পাল্টায়, আবার যুক্তিবাদ পাল্টাবার পাশাপাশি শোষণ পদ্ধতিও পাল্টে ফেলে শোষকরা। আমরা এও দেখেছি সাধারণ মানুষের দুঃখ বঞ্চনা ও শোষণ থেকে মুক্তি লাভের তীব্র আকুতি থেকে কিছু মানুষ উত্তরণের পথ খুঁজছে। এই উত্তরণের পথ খোঁজার মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে মহৎ আদর্শ, নতুন মূল্যবোধ। মানুষের এই সংগ্রাম কখনও জয়ী হয়েছে, জয়ী হয়েছে কোনও আদর্শবাদ।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে আদর্শবাদী কিছু মানুষ। সমাজ-বিজ্ঞানই শিখিয়েছে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতায় বসা সংগ্রামী ও আদর্শের প্রতীক মানুষগুলো আদর্শবোধের অন্তর্গত ত্যাগ ও মহত্ত্বের পরিবর্তে কী ভাবে ধীরে ধীরে ভোগ-লালসার শিকার হয়েছে, নতজানু হয়েছে ক্ষমতার কাছে, দুর্নীতির কাছে। বঞ্চিত মানুষের, আদর্শবান মানুষের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। ভুল থেকেই আবার আদর্শবাদীরা শিক্ষা নিয়েছে— রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলই শেষ কথা নয়, এভাবে আদর্শবাদকে লোভের ঘুণ পোকার হাত থেকে রক্ষা করা যায় না। আদর্শবাদকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিনিয়ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশের অগ্রগামিতা বজায় রাখতেই হবে। এই অগ্রগামিতাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যুক্তির মাধ্যমেই আমরা বুঝতে শিখেছি, পরিকল্পনামাফিক অসাম্যের শিকড়-বর্জিত নীতিবোধ তৈরি করা যায়। আর সেদিকে পদযাত্রা করতেই যুক্তিবাদী দর্শন প্রস্তুত।
এই আমাদের নীতিবোধের বিজ্ঞান, আর বিজ্ঞানমনস্কতার নীতি।
এই আমাদের আপ্লুত বাঁচার লড়াই, আমাদের উত্থানময় অস্তিত্ব,
যার এক পিঠে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-সাহিত্য, অন্যপিঠে নীতি
ও মূল্যবোধ। আর এই আমাদের যুক্তিবাদী দর্শন,
যার সাহায্যে আমরা নিজেকে পাল্টাতে
পাল্টাতে বুঝি, আর বুঝতে
বুঝতে পাল্টাই।
অধ্যায়ঃ এক
♦ বিভ্রান্তির সংস্কৃতিঃ বাঁচাও তাহারে মারিয়া
অধ্যায়ঃ দুই
♦ অপসংস্কৃতি ও সুস্থ সংস্কৃতিঃ পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হোক সুচেতনার পথে
অধ্যায়ঃ তিন
♦ সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ পৃথিবীর পথে হাজার বছর হাঁটা
অধ্যায়ঃ চার
♦ ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ কেউ কথা রাখেনি
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ নকশালবাড়ির সংগ্রামে উব্ধুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন, সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ এসো আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ যুক্তির পথচলাঃ লোভের অন্ধকারে ঢোকে না দিনের আলো
অধ্যায়ঃ নয়
♦ অতি ব্যবহৃত কিছু শব্দঃ সিন্দুকেতে মন ভরেছে ভেতরে তার কি আছে কেই বা রাখে খোঁজ?
“সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ