যুক্তিবাদী ও জ্যোতিষী

২৭ এপ্রিল আমাদের সমিতি সংক্রান্ত চারটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিগুলোর উত্তর প্রকাশিত না হলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে জেনে চারজনের উত্তর দিচ্ছি।

(১) মণিমালার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। চারটি ছবি ও প্রশ্ন তাঁর কাছে এ মাসের মধ্যে পাঠিয়ে দেব। ছবি ও প্রশ্ন তিনি গ্রহণ করলে ১৬ জুন শনিবার বিকাল চারটের সময় আমরা কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সামনে মিলিত হব। সেখানেই তাঁর দাবির যাথার্থতা প্রমাণ হবে। চিঠির শেষ লাইনে মণিমালা লিখেছেনঃ তবে অবশ্যই প্রশ্নগুলোতে যেন প্রবীরবাবুর পূর্বের ক্রিয়াকলাপের মতো কোনও ভাওতাবাজি না থাকে।” এর সঙ্গে অতীতের প্রসঙ্গ জড়িত। জ্যোতিষীদের ভাঁওতাবাজি ধরতে একটু ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নেওয়া আমার একান্তই প্রয়োজন ছিল।

(আকাশবাণীর সেই কিংবদন্তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী জ্যোতিষীদের সামনে জাতকদের পোশাকআশাক পাল্টে পেশ করেছিলাম; স্বীকার করছি। কিন্তু আমার সেই ভাঁওতাবাজিতে তাঁরা কেন বধ হলেন ? জ্যোতিষশাস্ত্র কি তবে জন্ম সময়ের চেয়ে জাতকের পোশাকআশাককে বেশি গুরুত্ব দেয় ?)

(২) হস্তরেখাবিদ নমরেন্দ্রনাথ মাহাতো ২৮.১০ ৮৮ তারিখে আমাকে প্রথমবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ১১ ডিসেম্বর ‘৮৮ আমাদের সমিতির ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হতে আহ্বান জানাই এবং জামানত হিসেবে ৫ হাজার টাকা জমা দিতে বলি। জয়ী হলে তিনি প্রণামী ৫০ হাজার টাকাসহ মোট ৫৫ হাজার টাকা পাবেন। পরাজিত হলে ৫ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত হবে। শ্রীমাহাতো সাংবাদিক সম্মেলনে আসেন নি। এই নিয়ে তৃতীয়বার তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে দেখছি। তিনি বাস্তবিকই সততার সঙ্গে হস্তরেখাবিদ্যাকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করতে চান কিনা, এ ব্যাপারে আমাদের সমিতির পরিপূর্ণ সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও আমরা আশা রাখব আমাদের সমিতির দেওয়া তৃতীয় ও শেষ সুযোগ তিনি গ্রহণ করবেন। শ্রীমাহাতো যেন ১৫ মে’র মধ্যে আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ৭২/৮ দেবীনিবাস রোড, কলকাতা-৭৪-এ জামানতের ৫ হাজার টাকা জমা দেবেন। ৫ জুনের মধ্যে তাঁকে ১০জন জাতকের হাত দেখতে দেব এবং ৫টি করে প্রশ্ন দেব। প্রত্যেক জাতকের অন্তত ৪টি করে প্রশ্নের উত্তর ঠিক দিতে পারলে পরাজয় মেনে নেব। প্রণামী দেব ৫০ হাজার টাকা, ফেরত দেব জামানতের ৫ হাজার টাকা। ভেঙে দেব সমিতি।

(৩) কাশীনাথ কংসবণিকের চিঠি পেয়েছি, পড়েছি; কিন্তু উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। যতদূর মনে পড়েঃ তিনি জানিয়েছিলেন—আমরা যেন একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকি, সেখানে তিনি আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখবেন। এই অদ্ভূত আবদার পড়ে পত্রলেখকের মস্তিষ্কের সুস্থতা বিষয়ে সন্দেহ জেগেছিল। প্রায় প্রতিদিনই এমন চ্যালেঞ্জ জানানো চিঠি পাই। তাঁরা প্রত্যেকেই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার বায়না ধরেন এবং জামানতের টাকা জমা দিতে বললেই সরে পড়েন। শ্রীকংসবণিক ১৫ মে’র মধ্যে টাকা জমা দিলে তাঁর মুখোমুখি হব ১৬ জুনের সাংবাদিক সম্মেলনেই ।

(সেই সম্মেলনে শ্রীকংসবণিক যদি প্রমাণ করতে পাবেন তাঁর বা তাঁর পরিচিত কারও অলৌকিক ক্ষমতা আছে অথবা জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান, তবে জিতে নিবেন পঞ্চাশ হাজাব টাকাঃ ফেরৎ পাবেন জমা রাখা পাঁচ হাজার।)

(৪) বীরেন আচার্যের চিঠির উত্তরে জানাইঃ রোগ-নিরাময়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। শরীরের নানা স্থানের ব্যথা, হাড়ে, বুকে বা মাথায় ব্যথা, বুক ধড়ফড়, পেটের গোলমাল, গ্যাসট্রিকের অসুখ, ব্লাডপ্রেসার, কাশি, ব্রঙ্কাইল অ্যাজমা, ক্লান্তি, অবসাদ ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে রোগীর বিশ্বাসবোধকে কাজে লাগিয়ে ঔষধ-মূল্যহীন ক্যাপসুল, ইঞ্জেকশন বা ট্যাবলেট প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়া যায়। একে বলে ‘প্লাসিবো’ চিকিৎসা পদ্ধতি ।

পাকুড়হাস গ্রামের দেবীদূর্গার মৃত্তিকা ও চরণামৃত খেয়ে যাঁরা রোগমুক্ত হয়েছেন তাঁদের আরোগ্যের পিছনে দেবীদূর্গার কোনও বৈশিষ্ট্য সামান্যতম কাজ করেনি, করেছে দেবীদুর্গার ! প্রতি রোগীদের অন্ধবিশ্বাস। শ্রীআচার্য একটু অনুসন্ধ্যান করলেই দেখতে পাবেন, রোগমুক্তরা সেইসব রোগেই ভুগছিলেন, ‘প্লাসিবো’ চিকিৎসায় যে সব রোগ আরোগ্য সম্ভব। প্রয়োজনীয় তথ্য ও সহযোগিতার জন্য শ্রীআচার্য আমাদের সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাধিত হব ।

প্রবীর ঘোষ। কলকাতা-৭৪

২৬ মে ‘৯০ বরানগর পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্টার্ড উইথ এ/ডি (রসিদ নম্বর ২৯২৪) একটি চিঠি চারটি ছবি সমেত পাঠালাম মণিমালাকে। ঠিকানা লিখেছিলাম ৩৫/১৭ এ, পদ্ম পুকুর রোড, কলিকাতা-২০, পিন ৭০০ ০২০। আপনাদের কৌতুহল মেটাতে চিঠিটি তুলে দিচ্ছি।

 

মাননীয়া মণিমালা,

আপনার অলৌকিক জ্যোতিষ-ক্ষমতা বিষয়ে আমাদের সমিতিকে পরীক্ষা চালাতে সহযোগিতা করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

চারটি ছবি চিঠির সঙ্গে পাঠালাম। প্রতিটি ছবির পিছনে আমার স্বাক্ষর সহ ১ থেকে ৪ পর্যন্ত সংখ্যা লেখা রয়েছে।

প্রতিটি ছবির ক্ষেত্রে চারটি করে প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে হবে। প্রশ্নগুলো হলো- ১। বর্তমান শিক্ষাগত যোগ্যতা

২। বর্তমান পেশা

৩। বর্তমান আয়

৪। কোন সালে বিয়ে করেছে

১৬ জুন ৯০ শনিবার বিকেল চারটের সময় কলকাতা প্রেস ক্লাবে আপনার মুখোমুখি হবো, উত্তরগুলো তখনই শোনা যাবে। এবং উত্তরের যথার্থতা বিষয়ে প্রমাণ আমি হাজির রাখবো ৷ হাজির করা প্রমাণ মিথ্যে প্রমাণিত হলে আমি এবং ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ পরাজয় স্বীকার করে নেব। সাংবাদিক সম্মেলনে ছবি চারটি সঙ্গে আনবেন।

আপনি ব্যর্থ হলে আশা রাখি একজন সৎ মানুষ হিসেবে জ্যোতিষ পেশা থেকে বিরত থাকবেন।

শুভেচ্ছাসহ

প্রবীর ঘোষ

 

চিঠিটা ফেরৎ এলো N/K লিখে I N/K অর্থে Not Known অর্থাৎ ওই ঠিকানায় মণিমালা থাকেন না।

তাহলে ব্যাপরটা কি হলো ? হলো, অনেক মজাই হলো। মণিমালার চিঠি প্রকাশিত হযেছিল ২৭ তারিখ। ২৯ তারিখ রবিবার বিকেলে গিয়েছিলাম মণিমালার দেওয়া ঠিকানায় । ওটা সংগীত শিল্পী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। কথা বললেন তরুণবাবুর স্ত্রী। আমি ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে দেখা করেছিলাম। সঙ্গী আশিস-এর পরিচয় দিয়েছিলাম প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে। তবুণবাবুর স্ত্রী জানিয়ে ছিলেন, এ-বাড়িতে তো মণিমালা থাকে না । এক রত্ন ব্যবসায়ীর দোকানের ঠিকানা দিয়ে বললেন, ওখানে গেলে পেয়ে যাবেন। বাড়ি ঠিকানা এবং ফোন নম্বরও দিলেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য মণিমালাকে ধন্যবাদ জানাতে বলায় বললেন, এই দু-দিনে প্রচুর মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছেন ওঁকে।

পরের দিনই মণিমালার বাড়িতে ফোন করলাম মেদিনীপুরের এক জ্যোতিষী হিসেবে পরিচয় দিয়ে। চ্যালেঞ্জ জানানর জন্য অভিনন্দন জানালাম এবং তাঁর লড়াইতে আমরা

মেদিনীপুরের জ্যোতিষীরা এক কাট্টাভাবে তাঁর পাশে আছি—এই প্রতিশ্রুতি দিলাম ।

মণিমালা বললেন, প্রবীর ঘোষকে প্রতিরোধ করার দরকার ছিল। অনেক আগেই দরকার ছিল। কোনও জ্যোতিষী সাহস করে যা করলেন না, আমি তাই করেছি। আপনারা পাশে আছেন শুনে ভাল লাগল । প্রয়োজনে নিশ্চয়ই সাহায্য চাইব ভাই।

কিন্তু মণিমালার চিঠি প্রকাশ ও আমার চিঠি প্রকাশের মধ্যেকার সময়ে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেল।

৫ মে’র দুপুর। মণিমালাকে ওঁর মানিকতলার বাড়িতে ফোন করলাম, মেদিনীপুরের সেই জ্যোতিষীর পরিচয়ে। জানালাম, “দিদি, আমার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কাল আপনাকে একটু প্রণাম জানাতে যেতে চাই। ওঁরা আপনাকে একটু চোখে দেখে নয়ন সাৰ্থক করতে চায়।”

মণিমালা জানালেন, কাল সময় বের করাই মুশকিল ।

শেষ পর্যন্ত তোষামোদ আর বিনয় দিয়ে মন ভেজালাম। পরদিন সকাল দশটায় দেখা করার অনুমতি পেলাম ।

পরের দিন সময় মত পৌঁছে গেলাম মণিমালার বাড়িতে, রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে বাড়ি । খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধে হলো না। দরজায় ‘নক’ করতে যিনি দরজা খুললেন, তিনিই মণিমালা। স্বাস্থ্যবতী, দীর্ঘাঙ্গী, মধ্য বয়স্কা, গলায় বিশাল রুদ্রাক্ষের মালা। দরজা খুলতেই পরিচয় দিলাম। পরিচয় পেয়ে চোখে-মুখে যেমন প্রচণ্ড অস্বস্তি প্রকাশিত হলো এবং যে অতি বিরসভাবে ভেতরে আসতে বললেন, তাতে বুঝলাম, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে।

আমরা ঢুকলাম, আমরা অর্থে আমি ও আমার কয়েকজন সহযোদ্ধা। আমার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। গলায় বিশাল এক রুদ্রাক্ষের মালা। হাতে একগুচ্ছ গ্রহরত্নের আংটি। কপালে গোলা সিঁদুরের দীর্ঘ টিপ। আর চুলে চশমায় কিছুটা অন্যরকম প্রবীর।

ঘরে ঢুকে বুঝলাম, সতর্কতার জন্য মানিকতলা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা-ভাবে যে- সব সহযোদ্ধারা নানা অলস পথচারী কি মটোরবাইক ও স্কুটার দাঁড় করিয়ে কয়েকজন আড্ডাবাজ তরুণ-তরুণীর ভূমিকা পালন করে চলেছে, তা মোটেই অপ্রয়োজনীয় ছিল না। লক্ষ্য করলাম, চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ে মণিমালার ব্যবহারটাও কেমন পাল্টে গেছে। ঘরে তিনজন যুবক হাজির ছিলেন। তাঁদের মণিমালা ‘আমাদের পাড়ার ছেলে, ভাই আর ‘কী’ বলে পরিচয় দিলেন। তাদের চেহারা-চালচলন দেখে তেমন ‘নিরীহ’ পাড়ার ছেলে বা ভাই বলে মনে হলো না। আমরা গুছিয়ে বসে মণিমালাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভেতরের ভেজান দরজা ঠেলে ঢুকলেন এক তরুণ। জানালেন, মণিমালাকে ভেতরে ডাকছেন !

মণিমালা ফিরে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, প্রেস কনফারেন্সটা কবে হচ্ছে ? সেটার তারিখ কি আপনিই ঠিক করবেন ?

মণিমালা তৎপরতার সঙ্গে জবাব দিলেন, “না না, সে-রকম কোনও ব্যাপার নেই। কনফারেন্সের ব্যাপারে আমার কোনও, মানে নিজস্ব মাথাব্যথা নেই এবং সেই বিষয়ে আমার কোনও মতামতও নেই। এটা কোনও ব্যাপারও নয়। সে-বিষয় নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাই না ।”

মাত্র চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে এমন কী ঘটল, যাতে মণিমালার কথা-বার্তা ও ব্যবহারই গেল পাল্টে । তবে কি ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে মণিমালাকে জানিয়ে দেওয়া হলো, জ্যোতিষীর ছদ্মবেশে সম্ভবত প্রবীরই এসেছেন? ভেজান দরজার আড়ালে কয়েক জোড়া চোখের দৃষ্টি যে আমাদেরই দিকে, কথা বলতে বলতে দরজার ফাঁকে মাঝে-মধ্যে আলতো করে চোখ ঘুরিয়ে নিতেই দেখতে পাচ্ছিলাম।

বললাম, আমাদের যদি কোনও কিছু করণীয় বলেন, যদি গায়ে গতরে খাটতে বলেন, ঠিকানাই দিয়ে দিচ্ছি; আমাদের আসতে বললে আসব, আপনি যেখানে যেখানে পাঠাবেন, আপনার নেতৃত্বে যেমনভাবে বলবেন, তেমনভাবে কাজ করতে পারি।

“আপনাদের অ্যাড্রেসটা রেখে যেতে পারেন।” কথা বললেন একটি ‘পাড়ার ছেলে’। আমি ওর কথা না শুনেই ভাবাবিষ্টের মত, বা বকবক করা আধ-পাগলা মানুষের মত বলেই যেতে লাগলাম, আমাদের যেমনভাবে বলবেন, আমরা সমস্ত রকমভাবে আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করব। এ-কথা আগেই বলেছি, আবারও বলছি।

“হ্যাঁ, সেটা তো বলেছেন।” বললেন, মণিমালা। আমি আবার শুরু করলাম। “হয়তো কিছুই লাগবে না; তা সত্ত্বেও যদি বলেন যে কিছু চাঁদা-পত্তর তুলে দিতে, আমরা তাও করব। আপনার নেতৃত্বে আমরা সবাই আছি। যে কথা আগেও বলেছিঃ আপনি বললেই আমাদের অঞ্চলের অনেক জ্যোতিষীকে নিয়ে আসতে পারব। এবং আপনাকে আমারা একটি অভিনন্দনও দিতে চাই।’

আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে মণিমালা বললেন, “না, এটা যেটা বলছেন, অভিনন্দন দিতে চাই, আমি তো অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল কথাবার্তাগুলো ঠিক বাড়িতে খুব একটা বলি না, যা কিছু বলি চেম্বাবেই বলি ।”

প্রমাদ গুণলাম, চেম্বার মানে সেই জ্যোতিষ-ব্যবসায়ীর দোকান, যেখানে এক সময় এ- যুগের খনা’ পারমিতা বসতেন। দোকানের মালিকের এক লক্ষ জেরার পাহাড় ডিঙিয়ে সেবার খনার মুখোমুখি হতে পেরেছিলাম। বেতার অনুষ্ঠানের সময়কার সে সব স্মৃতি মুহূর্তে ভেসে উঠল। তিনিই কি তবে এমন নির্দেশ দিয়েছেন মণিমালাকে ? মণিমালা কি তবে আমাব চ্যালেঞ্জকে এড়িয়ে যাবার রাস্তার খোঁজ করছেন ? আজকের কথাগুলো এমন বিদঘুটে কেন ? সরাসরি ফ্যসলাব এমন একটা সুযোগ কি মণিমালার পৃষ্ঠপ্রদর্শনের জন্য ব্যর্থ হবে ? শঙ্কিত হলাম। সত্যি বলতে কি, এমন আশঙ্কাও হলো ভেজান দরজার আড়ালে একজোড়া চোখের মালিক ওই জ্যোতিষ-ব্যবসায়ী ননতো ?

মণিমালা বলেই চললেন, “আমি তো মহিলা একজন, সেই হিসেবে ক্লোজ ধরুন, এই আমার ভাই-টাইয়েরা এলো, বা বোন-টোনেরা এলো, এ-ছাড়া, চেম্বারে আসুন। আমি যেটা বলছি, কনফারেন্স বা ইত্যাদি ব্যাপার, যে-সব ব্যাপার নিয়ে ঠিক এখন আমি কথা বলতে চাইছি না। তার কারণ আমি প্রস্তুতও নই, মানসিকভাবেও প্রস্তুতি আমার কোনও নেই।” (কথাগুলো হয়তো যথেষ্ট অগোছালো মনে হতে পারে, কিছু কিছু পাঠক-পাঠিকাদের পক্ষে। কেমন যেন ভাষার বাঁধুনির অভাব। কি করি বলুন ? মণিমালা যেভাবে কথাগুলো বলেছিলেন, সে-ভাবেই আমার লেখায় যতটা সম্ভব তুলে ধরতে চাইছি টেপ বাজিয়ে শুনে শুনে।)

“না, ওই যে একটা চিঠি যে বেরিয়েছে, সেই চিঠিতে তো, আপনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন যে প্রেস কনফারেন্সেই ফেস করবেন……” বলছিলাম আমি। কিন্তু আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়েই মণিমালা বললেন, “প্রেস কনফারেন্সে ঠিক ফেস করব বা কিছু, বা করতে চাই, চিঠিটা সে ধরনের গেছে ঠিক কথাই, কিন্তু এর মধ্যেও অনেক ব্যাপার আছে।”

“কী ?” জিজ্ঞেস করলাম ।

“মানে, সেই ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছি না। এটা নিয়ে আমি, আপনারা দেখতেই পাবেন, এটা নিয়েই কিছু একটা বেরুবে। এটা নিয়ে এখন আমি কিছু বলতে চাইছি না। এটা নিয়ে কথাটা পরে আপনারা জানতে পারবেন। এর বেশি কিছু জানতে হয়, চেম্বারে চলে আসুন, চেম্বারে কোনও অসুবিধেই হবে না। কোন আপত্তিও নেই। আপনি যাবেন ওখানে, ওখানে গিয়ে কথা বলবেন।”

বললাম, “আপনি একা ভাবার কোনও দরকার নেই। এবং আপনি জয়ী হলে নিঃসন্দেহে আমাদের সবারই জয়। আপনার জয়ের অমরা শেযার করব অন্যভাবে। ”

“জয়ের কথা নয়। ব্যাপারটা জানেন তো, এরা মনে করে জ্যোতিষটার একটা বুজরুকি । অ্যাসট্রোলজিও একটা বিজ্ঞান। পাঁচজন মানুষ যে ছুটে ছুটে আজকে যাচ্ছে, এটার নিশ্চয় কোনও একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।” বললেন মণিমালা ।

গতকাল ফোনে মণিমালার সঙ্গে যে কথা হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ টেনে বললাম, “কালকেই তো আপনাকে বলেছি রেডিও প্রোগ্রামের ক্যাসেটটা আমরা করেছি। প্রয়োজনে আপনাকে ক্যাসেটটা দেব। আপনার যে-সব তথ্যের প্রয়োজন বলবেন, চেষ্টা করব সেগুলো আপনার কাছে হাজির করতে।”

“আচ্ছা, আপনাদের অনেক রিসার্চ ওয়ার্ক আছে।”

“কাল ফোনে তো আপনাকে বলেইছি, ওই রেডিও প্রোগ্রামটার ব্যাপাবে; দিদি, আপনাকে যা যা বলা হয়েছে, ঠিক সে-রকমভাবে কিছু হয়নি। আমি ফোনে বলেছিলাম, প্রবীরবাবু সাজিয়ে লোক হাজির করে অ্যাস্ট্রোলজারদের চীট করেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু আপনি যে বলছিলেন, প্রবীরবাবু প্রশ্নগুলোও হাজির করেছিলেন আলতু ফালতু; মানে—”

“হ্যাঁ, কার ব্যাগে ক’টা পয়সা আছে ? আমি এ-রকমই শুনেছি। আমি তো রেডিও প্রোগ্রামটা শুনিইনি।” বললেন মণিমালা।

বললাম, “যাঁরা বলছেন, তাঁরা যদি মিথ্যে কথা বলে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অন্য রকম বলেন, তাতে লড়াই করতে আপনারই অসুবিধে হবে।”

তারপর বেতার অনুষ্ঠানটিতে কি কি প্রশ্ন জ্যোতিষীদের কাছে হাজির করা হয়েছিল, তাঁরা কি কি জবাব দিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কিছু কথা বললাম। এক সময় এও বললাম, “আপনি যদি নিতে চান, আমার ফোন নম্বর ও ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি।” তারপর আবারও জিজ্ঞেস করলাম। “প্রেস কনফারেন্সটা কবে নাগাদ হবে, কিছু “

“না, সেটা সম্বন্ধে কোনও আভাসও আমি পাইনি, সেটা আপনাকে বললাম। যদি কিছু জানতে পারি, যদি কিছু হয়, জানতে পারবেন।

মণিমালা আরও একটা কথা জানালেন, তাঁরা পত্রিকায় একটা চিঠি দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “ওই প্রেসকনফারেন্সের ব্যাপারে ?”

“প্রেস কনফারেন্সের ব্যাপারটা, বা যেটা আমি ‘চ্যালেঞ্জ’ মানে আমার নাম করে যেটা ‘চ্যালেঞ্জ’ বলে…’ দেওয়া হয়েছে। সে-ব্যাপার সম্বন্ধে ডিটেলসভাবে আপনি জানতে পারবেন।” বললেন মণিমালা। (পাঠক-পাঠিকারা, অনুগ্রহ কবে একটু লক্ষ্য রাখবেন, মণিমালা ‘আমি চ্যালেঞ্জ মানে আমার নাম করে যেটা চ্যালেঞ্জ বলে….’ কথাগুলো বলেছিলেন।)

“তার মানে কী, আপনার নাম করে যেটা দেওয়া হয়েছে, সেটা ঠিক নয় ?” জিজ্ঞেস করলাম ।

“সেটার মধ্যেও অনেক গণ্ডগোল আছে। “

“উপস্থিত একজন পাড়ার ছেলে” মুখ খুললেন, “প্রবীরবাবু তো অ্যাকসেপ্টও করেন নি।”

“কাজেই সেই হিসেবে এখনও পর্যন্ত আমি ঠিক, মানে ডিসিশনে আসিনি যে কি করব এই নিয়ে কথা চলছে। কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করছি।” জানালেন মণিমালা।

অবাক আমি বললাম, “কি করব মানে ? চ্যালেঞ্জ তো আপনি অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছেনই। কাল পর্যন্ত অন্তত তাই তো বললেন ।”

“না, চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করার ব্যাপারে ঠিক; এ-ব্যাপারটা এমন একটা ব্যাপার নয় যে এটা একটা চ্যালেঞ্জের পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে।” বললেন মণিমালা ।

“আপনি কিন্তু চ্যালেঞ্জ দিয়ে আবার পিছিয়ে আসবেন না।” বললাম আমি। “পিছিয়ে আসার প্রশ্ন নেই। তবে এখানে শুধু আমি কেন ? জেনারেলভাবে আজ যদি জ্যোতিষীদের একটা অ্যাসোসিয়েশন থাকত, তাহলে সেক্ষেত্রে কি হতো ? তখন সকলে মিলে সার্বিকভাবে জিনিসটা করতেন।” বললেন মণিমালা ।

“চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করায় অনেকেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন বলছিলেন।” একটু উস্কে দিতে চাইলাম ।

“হ্যাঁ, চেম্বারে অনেকে এসেছেন-টেসেছেন। এসে বলেছেন-টলেছেন। তবে আমি এখনও এটাকে এত সিরিয়াসলি নিইনি। তার কারণটা একটা জিনিস তো ঠিক, এটা তো একটা গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার তো বটেই। যতটা সুচারুভাবে বা যতটা নিখুঁতভাবে উত্তরটা দিতে পারা যাবে জ্যোতিষীদের, মানে আমাদের তরফ থেকে, ততটাই তো আমরা লাভবান হবো এ ব্যাপারটা নিয়েও আর একটু গবেষণা বা আরো চর্চার প্রয়োজন। সেই জন্যেই আমি একটু চুপ করে আছি।”

“চুপ কোথায় ? একেবারে তো বোমা ফাটিয়ে দিয়েছেন দেখছি।” বললাম । 

“ঠিক কথাই, তবে আপনারা শিগগিবিই এ-ব্যাপারে জানতে পারবেন।”

“কাগজে কি আপনার স্টেটমেন্ট কিছু বিকৃত করা হয়েছে ?”

আমার কথা শুনে একজন “পাড়ার ছেলে” বললেন, “মানে একটুখানি – ওটা জাস্ট…. “একটা ব্যাপারে আমি হয়তো বিশ্বাস নাও করতে পারি। সেখানে আমি আপনার প্রফেশন নিয়ে আমি কেন ঘাঁটাঘাটি করব ?”

মণিমালা এবার আলোচনায় ছেদ টানতে চাইলেন, “আপনারা যেমনভাবে এলেন, আমাব খুবই ভাল লাগল। আসলে এখানে ক-জন জ্যোতিষী রয়েছেন তো, তাঁরাও মানে, এখানে একসঙ্গে মিলে আলোচনা রয়েছে।”

বিদায় নিলাম আমরা ।

 

৭ মে আমাদের সমিতির পক্ষে আমার চিঠি প্রকাশিত হতেই আবার একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন INDIA TODAY – Principal correspondent উত্তম সেনগুপ্ত। উত্তমবাবুর কাছ থেকে এক নতুন খবর পেলাম। উনি মণিমালার সঙ্গে পত্রিকার তরফ থেকে দেখা করেছিলেন। মণিমালা এবং মণিমালা যে দোকানে বসেন, তাঁর মালিক নাকি উত্তমবাবুকে জানিয়েছেন প্রেস কনফারেন্সে প্রবীরবাবুর মুখোমুখি হওয়ার বা প্রবীরবাবুর পাঠান প্রশ্ন ও চারজনের ছবি গ্রহণ করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। কারণ মণিমালার চিঠি বলে যে চিঠি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা নাকি মণিমালার চিঠিই নয়। উত্তরে উত্তমবাবু জানিয়েছিলেন, তবে আনন্দবাজাবে চিঠি দিয়ে জানাচ্ছেন না কেন, ওই চিঠির লেখিকা মণিমালা নন। তাঁর উত্তরে ওরা নাকি জানিয়েছেন, এই ধরনের চিঠি দেবেন কিনা, সেটা ভেবে দেখছেন। এবং ওঁরা নাকি আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করছেন।

মণিমালার সঙ্গে আমার কয়েকদিনের কথাবার্তার ক্যাসেট শুনিয়ে বললাম, “চ্যালেঞ্জ যে মণিমালাই গ্রহণ করেছিলেন এটা তো বুঝলেন ? এখন পরাজয় নিশ্চিত বুঝে চ্যালেঞ্জ এড়াবাব রাস্তা খুঁজছেন। আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে জাল চিঠি ছাপার অভিযোগ এনে কেস করে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে দেবেন, এমন আহাম্মক ওরা কখনই হবে না। আবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মত বোকামো করতেও নারাজ।”

তারপর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত, আজ পর্যন্ত মণিমালার কোনও প্রতিবাদ-পত্র আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়নি। মণিমালা কোনও মামলাও আনেন নি আনন্দবাজার পত্রিকার বিরুদ্ধে। আর আমার রেজেষ্ট্রি ডাকে পাঠান চিঠি যে ফেরৎ এসেছিল, সে খবর তো আগেই জানিয়েছি।

হায, মণিমালা । এত-বড় বড় কথা বলে জ্যোতিষী ও জ্যোতিষে বিশ্বাসীদের মনে আশার সঞ্চার করে শেষ পর্যন্ত তাঁদের পথে বসিয়ে শকুন্তলাদেবীর মতই পলায়নই বাঁচার একমাত্র রাস্তা বলে ধরে নিলেন ? আপনি অন্যের ভাগ্য বিচার করেন, আর নিজের ভাগ্যটুকু বিচার করতে পারলেন না ? আপনি ভূত নামিয়ে, অংক কষে এতে কিছু জানতে পারেন, কিন্তু আর সব পরাজিত, বিধ্বস্ত, পলাতক জ্যোতিষীর মতই জানতে পারলেন না শুধু নিজের অপমানজনক পরিণতির কথা ।

বেতার অনুষ্ঠানে পরাজিত জ্যোতিষসম্রাট ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তী তাঁর লেখা বই ‘জ্যোতিষ-বিজ্ঞান কথা’র ভূমিকাতে লিখেছেন, “সেদিন ফাঁদ রচনাকারীরা সুকৌশলে চাতুরীর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে আমার অর্থাৎ জ্যোতিষশাস্ত্রের ব্যর্থতা প্রচার করে যে – বিদ্রুপের হাসি হেসেছিলেন, তারই জ্বালা প্রশমনের জন্য সে রাতেই ভাগ্য-দেবতা এগিয়ে দিল লেখনী”, তিনিও আপনারই মত জ্যোতিষী হয়েও নিজ ভাগ্য বিপর্যয়ের আগাম খবরটাই জানতেন না ? এমন কী, চ্যালেঞ্জ নিয়ে এক মাস ধরে অনেক আঁক কষেও পোশাক .. পরিচ্ছদের আড়ালে আসল মানুষগুলোর লুকিয়ে থাকা পরিচয় বের করতে পারলেন না ? – প্রতারকদের ধরতে ফাঁদ পাতার রেওয়াজ তো আজকে নতুন নয়হে জ্যোতিষসম্রাট। সম্রাটকে উপদেশ দেওয়া আমার মত সাধারণের শোভা পায় না, তবু বলি, সাম্রাজ্য রক্ষার স্বার্থে .. কি আপনার কিল খেয়ে কিল হজম করা উচিত ছিল না ? সাধারণ মানুষের রচিত একটি ফাঁদকে যিনি গুণেও ধরতে পারেন না, তাঁকে সাধারণ মানুষ যদি ‘জ্যোতিষসম্রাট’ না বলে ‘জ্যোতিষ-চামচিকে’ বলেন, তখন কী একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে ভাবুন তো ?

মণিমালা দেবী, আপনার সঙ্গে ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তীর একটা দারুণ রকম মিল আছে । তিনিও চেয়ে আছেন ভবিষ্যতের দিকে। যেদিন আরো জ্যোতিষচর্চা ও জ্যোতিষগবেষণার মধ্য দিয়ে এমন একজন মহাজোতিষীর আবির্ভাব ঘটবে, যিনি আমাকে ধ্বংস করে জ্যোতিষ- কণ্টক দূর করবেন, প্রতিষ্ঠা করবেন জ্যোতিষশাস্ত্রকে। অসিত চক্রবর্তী তো তাঁর লেখা ওই বইটিতে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির প্রসঙ্গ টেনে সেই প্রত্যাশার কথাই লিখে ফেললেন । ১৫২ পৃষ্ঠায় লিখছেন “যখন প্রকাশক বইটি (অলৌকিক নয়, লৌকিক) প্রচারের জন্য “প্রকাশনার পর তিন মাস অতিক্রান্ত তবু চ্যালেঞ্জ জানাবার সৎ সাহস দেখাতে পারলেন না কেউ” বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন, তখন আমাদের মনে এসে যায় বাতাবি আর ইল্বলের কথা ৷ ”

‘বাতাবি’ ও ‘ইল্বল’ কে? বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড থেকে তুলে দিচ্ছি- ইল প্রহাদের গোত্রজাত অসুরবিশেষ। ইবল কোন ব্রাহ্মণের নিকটে ইন্দ্রতুল্য একটি পুত্র প্রার্থনা করে। ব্রাহ্মণ প্রার্থনা পূর্ণ না করায়, ইবল তদবধি ব্রহ্মঘাতক হয়। মায়াকৃত মেষরুপী বাতাবির মাংস ব্রাহ্মণকে খাওয়াইয়া ইবল পরক্ষনেই বাতাবির নাম ধরিয়া ডাকিত ও বাতাবি উদর বিদীর্ণ করিয়া নির্গত হইত। এইরূপে অনেক ব্রাহ্মণ নিহত হইলে, মহর্ষি অগস্ত্য মেষরূপী বাতাবিকে উদরস্থ ও জীর্ণ করিয়া ব্রহ্মকণ্টক দূর করেন।

ভাল কথা। আপনাদের সাধ্যে তাহলে কুলোল না, অতএব আপনারা কোনও এক অগস্ত্য মুনির আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনুন, যেদিন তিনি এসে চ্যালেঞ্জরূপী বাতাপিকে হজম করে যুক্তিবাদীদের মায়া থেকে আপনাদের উদ্ধার করবেন। আচ্ছা, একটি কথা বলতে পারবেন গুণে, গেঁথে ওই অগস্ত্য আগমন কবে ঘটবে, এবং ঘটবে আপনাদের উত্তরণ ? এখানেও আপনাদের গণনা, আপনাদের ভবিষ্যদ্বাণী চূড়ান্তভাবেই ব্যর্থ হবে। কারণ, আপনাদের অগস্ত্য কোনও দিনই আসবেন না। যদিও বা আসেন, ‘বাতাবি’র সিংয়ের গুঁতো ফাঁসবে তাঁরও পেট। আপনারা অনেক ব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য না গুণেই, যে ভবিষ্যদ্বাণী শোনালাম, সে একেবারেই অব্যর্থ। আপনাদের ভবিষ্যৎ বলে সত্যিই কিছু দেখছি না। এক ‘বাতাবি, ‘ইল্বলকে’ ঠেকানই আপনাদের কম্মো নয়; এই বই যে হাজার হাজার ‘বাতাবি’, ‘ইবল’-এর জন্ম দেবে; তারা যে আপনাদের ঝাড়ে-বংশে শেষ করে দেবে ‘ মশাই ৷

এদিকে নরেন্দ্রনাথ মাহাতোকে নিয়ে আর এক কেলেংকারি। একই দিনে একই সঙ্গে নরেনবাবুর পাঠান দু’টি খাম পেলাম। দুটি চিঠিই উনি লিখেছেন ৮ মে ‘৯০ তারিখে। সঙ্গে ‘বিপ্লবী মেদিনীপুর টাইমস’ পত্রিকায় কিছু কপি, সেগুলোতে নরেনবাবুর ধারবাহিক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। লাল ও নীল উড পেন্সিলে প্রায় প্রতিটি লাইনে ছাপার ভুল সংশোধন করে পাঠিয়েছেন নরেনবাবু। চিঠি দুটিতে ‘মজার ছত্রিশ ভাজা’ পরিবেশিত হয়েছে। ( সমস্ত মজাই পরের বই ‘যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জর রাতে নিয়ে আসব।) শেষে এক জায়গায় জানিয়েছেন, তিনি নীতিগতভাবে জমানতের পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে রাজি নন। এবং তা সত্ত্বেও যেন ১৬ জুন ১০ এর প্রেস কনফারেন্সে আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই ।

উত্তরে জানিয়েছিলাম চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিনা ঝুকিতে ফালতু কিছু কামানোর ধান্ধায় অনেকেই আমার সময়ের প্রচণ্ড অভাবের মধ্যে থাবা বসাতে চায়, তাদের সামাল দিতেই এই জামানতের ব্যবস্থা । জামানত রাখি না শুধু বিখ্যাতদের ক্ষেত্রে। তবে নতুন একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি পরাজিত হলে আপনার মাথার আধখানা কামিয়ে দেব। আর লিখিতভাবে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, আর কোনও দিনই হস্তরেখাচর্চা, জ্যোতিষচর্চা করবেন না। এতে রাজি হলে ওই দিনের সম্মেলনে আপনার মুখোমুখি হবো।

আবারও নরেন্দ্রনাথ রণে ভঙ্গ দিলেন। সাহস কবে আধমাথা চুলের ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে রাজি হলেন না।

এই যুক্তিবাদী আন্দোলনের শ্রমিক হওয়ার সূত্রে এবং চ্যালেঞ্জ ঘোষাণার কল্যাণে মজার মজার অনেক অভিজ্ঞতা এই ১৩৬০ গ্রাম ওজনের ছোট-খাট, মোটা-সোটা মগজটিতে জমা হয়ে রয়েছে। জমা থেকে খরচ কবে আমি আসলে এক ঢিলে দুই পাখি মারব ঠিক করেছি। এক নম্বর পাখি; অভিজ্ঞতা খরচে মাথা কিছুটা কৃশ হবে। দু’নম্বর পাখি; আপনাদের কিছু মজার ঘটনা শোনানো। এতে প্রতারক বাবাজী মাতাজীদের প্রতারণার নানা ক্রিয়াকাণ্ড ও গোপন রহস্যের সঙ্গে পরিচিত হবার পাশাপাশি কিছু মজাও পেতে পারেন আপনারা। অবশ্য মজা দিতে পারব কিনা, সে বিষয়ে নিজেরই ঘোরতর সন্দেহ আছে। কারণ লক্ষ্য করেছি, রসের ঘটনা আমার মস্তিষ্ক-কোষ থেকে কলমের ডগায় যখন এসে হাজির হয়, তখন সেগুলো বেমালুম নিরস হয়ে পড়ে। রসের লক্ষ্যভেদে আমি চিরকালই আনাড়ি। পরের বই ‘যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা’তে পরাজিত, বিধ্বস্ত, পলাতক ও হামাগুঁড়ি দেওয়া জ্যোতিষীদের বহু কাহিনীই নিয়ে আসব, অনেক অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের চরম ব্যর্থতার কাহিনীর পাশাপাশি। কোন কোন জ্যোতিষীরা আসবেন ওই বইতে ? কারা কারা পরাজিত পলাতকের তালিকায় আছেন ? কতজনের নাম বলব বলুন তো ? তারচেয়ে বলা অনেক সোজা কারা নেই ? সে তালিকায় কেউই তো প্রায় নেই। সে সব জ্যোতিষীদের এই খণ্ডটিতে হাজির করলে কলেবরের সঙ্গে সঙ্গে বইটির কি ধরনের মূল্য বৃদ্ধি পাবে ভাবতে গিয়েই অন্য বইটিতে তাদের হাজির করার কথা ভেবেছি। যাঁরা এখনও পরাজিত হন নি। তাঁদের বিনীত অনুরোধ, চ্যালেঞ্জ আপনাদের প্রতিও দেওয়াই রয়েছে। যুক্তিবাদের অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা থামাতে একবার চেষ্টা করেই দেখুন না।

 

error: Content is protected !!