সমাজ গড়িয়েই চলল। এল ১৯৮৫-র ১ মার্চ। এই দিনটিতে কিছু সমাজ-সচেতন, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল্যায়নে সক্ষম, নিপীড়িত মানুষদের মুক্তিকামী, বে-পরোয়া, নিষ্ঠ, কিছু দামাল ছেলে দমদমের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে (৭২/৮ দেবীনিবাস রোড) ঘরোয়া আলোচনা শেষে গড়ে তুলল একটি সংগঠন—ভারতের যুক্তিবাদী সমিতি। তাদের ঘোষণা-পত্রে বলা হল—“আমরা সমাজ-সচেতনতার মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি ভারতের শোষিত জনগণের মুক্তির জন্য এতাবৎকাল যে সকল সংগ্রাম হয়েছে তার ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ— সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের গুরুত্ব আরোপ না করা। শোষকদের রাজনীতি ও অর্থনীতি যখন শোষিতদের প্রতিরোধের মুখে সংকটে পড়ে, তখন আত্মরক্ষার চূড়ান্ত পন্থা হিসেবে শোষকরা লড়াকু মানুষদের লড়াইকে শেষ করতে সমাজে অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকে দুর্নীতির সংস্কৃতির, ভাষা-ভিত্তিক সংস্কৃতির, জাত-পাতের সংস্কৃতির, ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির, ভোগ-সর্বস্ব সংস্কৃতির, অদৃষ্টবাদী সংস্কৃতির, পূর্বজন্মের কর্মফলে বিশ্বাসী সংস্কৃতির, আপসকামী সংস্কৃতির, সুবিধাবাদীর সংস্কৃতির, ক্যারিয়ারিস্ট সংস্কৃতির, দ্বিচারিতার সংস্কৃতির, মস্তান-নির্ভর রাজনীতির সংস্কৃতির, কুসংস্কারের সংস্কৃতির, অন্ধবিশ্বাসের সংস্কৃতির, মগজ ধোলাইয়ের সংস্কৃতির। শোষক ও শাসকগোষ্ঠী তাদের আপন স্বার্থে, টিকে থাকার ও শরীরবৃদ্ধির প্রয়োজনে নিপীড়িত মানুষদের মগজ ধোলাই করে তাদের একত্রিত সংগ্রামের সমস্ত চেষ্টাকে বার বার ভেঙে দিয়েছে ধর্ম, জাত-পাত বা প্রাদেশিকতার ভেদাভেদের ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে। কুসংস্কারের আফিং খাইয়ে বঞ্চিত মানুষদের মাথায় ঢোকাতে চাইছে—প্রতিটি বঞ্চনার কারণ অদৃষ্ট, পূর্বজন্মের কর্মফল, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়া। একই সঙ্গে নিজেদের মতো করে ‘দেশপ্রেম’, ‘জাতীয়তাবোধ’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ ইত্যাদি বহুতর বিষয়ে ব্যাখ্যা হাজির করে লাগাতার প্রচারে সে-সব ব্যাখ্যাকে জনগণের মাথায় গুঁজে দিচ্ছে। যেন-তেন প্রকারেণ শোষিতদের চেতনাকে কুসংস্কারের মধ্যে, মগজ ধোলাই করে ঢুকিয়ে দেওয়া ব্যাখ্যার মধ্যে বন্দি করে রাখতে পারলে ওদের প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে রাখা যায়। শোষকদল শোষণ ব্যবস্থা কায়েম রাখতেই নানা ভাবে মগজ ধোলাই করে গড়ে তুলে চলেছে নতুন নতুন সংস্কৃতি, যা অবশ্যই অপসংস্কৃতি।

আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের লক্ষ্য হবে সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বিপ্লব, আর তাই আমাদের সমিতি সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে থাকা বিভিন্ন ভ্রান্ত ও অস্বচ্ছ চিন্তাকে দূর করতে। আমরা মনে করি শোষিত মানুষদের হাতিয়ার যুক্তিবাদী চিন্তার প্রবলতম শত্রু তথাকথিত ধর্ম, অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদী দর্শন, বিশ্বাসবাদ ইত্যাদি। তথাকথিত ধর্মের এই যুক্তি-বিরোধী স্বরূপকে সঠিকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে না পারলে কুসংস্কার মুক্তির, চেতনা মুক্তির, শোষক-শোষিত সম্পর্ক অবসানের কল্পনা শুধুমাত্র কল্পনাই থেকে যাবে।

যারা ট্রটস্কিবাদী-নীতি মেনে মনে করে—রাজনৈতিক বিপ্লব

হলেই সব হয়ে যাবে—আমরা মনে করি তাদের

এই মনোভাবের পিছনে রয়েছে সমাজ বিজ্ঞান

সম্পর্কে অজ্ঞতা ও বাস্তববোধের অভাব।

ডান-বাম নির্বিশেষে ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই সংসদীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রাখতে হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনই ক্ষমতা দখলের একমাত্র পথ। শোষক-শোষিত সম্পর্ক অবসানের কথা বলা রাজনৈতিক দলগুলোও সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নিতে গিয়ে যে কোনও উপায়ে ভোট সংগ্রহ করাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে বসেছে। ফলে মানুষের অন্ধ-বিশ্বাস ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে গিয়ে মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত করার চেয়ে ভোটার তোষণনীতিকেই অভ্রান্ত অস্ত্র হিসেবে মনে করতে শুরু করেছে। তাই তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত হানার সময় এঁলে কৌশল হিসেবে কে কখন কতটুকু মুখ খুলবে—এটাই তাদের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। দরিদ্র-শৃঙ্খলিত মানুষদের শৃঙ্খলমুক্তির লক্ষ্যেই যে সংসদীয় গণতন্ত্রে ঢোকা, তা বিস্মৃত হলে উপলক্ষ্যই (সংসদীয় গণতন্ত্রে ঢোকা) লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে যাবে। আমরা গভীরভাবে লক্ষ করেছি—আমাদের দেশে বাস্তবিকই আজ পর্যন্ত জনজীবনে কোনও ব্যাপকতর গুণগত সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে একইভাবে শোষিতদের চিন্তার ভ্রান্তির জালে আবদ্ধ রেখে শোষকরা শোষণ চালিয়েই যাচ্ছে। এতাবৎকাল আমাদের দেশে কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের নামে অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নামে যা যা ঘটেছে তার কোনওটাই বাস্তবিক অর্থে আদৌ সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। ভারতবর্ষে সংগঠিত তথাকথিত রেনেসাঁস যুগের আন্দোলন ছিল সমাজের উপরতলার কিছু ইংরেজি শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ কিছু সংস্কার প্রয়াস মাত্র। তৎপরবর্তী তথাকথিত সাংস্কৃতি আন্দোলনগুলি ছিল শুধুমাত্র কলাক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। তাদের আন্দোলনের এমন সীমাবদ্ধতার কারণ দু’টি হতে পারে। একঃ নেতৃত্বের ‘সংস্কৃতি’ বিষয়ে ভুল ও অস্বচ্ছ চিন্তা। দুইঃ নেতৃত্বের ব্যাপকতর সাংস্কৃতিক আন্দোলন আদৌ গড়ে উঠতে না দেওয়ার কৌশল ।

আমাদের যুদ্ধ শোষণের শক্তিশালীতম হাতিয়ার প্রতিটি কুসংস্কার ও ভ্রান্ত-বিশ্বাসগুলোর বিরুদ্ধে, যে ভ্রান্ত-বিশ্বাসগুলির মধ্যে রয়েছে ‘দেশপ্রেম’, ‘জাতীয়তাবোধ’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ইত্যাদি বহু বিষয়ে শোষক শ্রেণির মধ্যে ঢুকিয়ে দেখা বিশ্বাস। আমাদের যুদ্ধ ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে, শোষকশ্রেণি সৃষ্ট বা পালিত অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। কুসংস্কারের আবর্জনা সাফ করার প্রসঙ্গ উঠলেই যারা সোচ্চার হয়— “মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত নয়”, “ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাতের মতো হঠকারী কাজ করলে আঘাতকারী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য” – তাদের বিরুদ্ধে। যারা নিপীড়িত জনগণকে একত্রিত সংগ্রাম থেকে বিরত করতে “জাতের নামে বজ্জাতি”-র রাজনীতি করে, তাদের বিরুদ্ধে। যারা অদৃষ্টবাদ ও পূর্বজন্মের কর্মফলজাতীয় ভ্রান্ত-চিন্তা প্রচারের মাধ্যমে বঞ্চিত মানুষদের মাথায় ঢোকাতে চায়, তাদের পঞ্চনার প্রতিটি কারণ অদৃষ্ট, পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদি— তাদের বিরুদ্ধে। যারা ধর্মের নামে মানুষের মানবিকতার চূড়ান্ত বিকাশ-গতিকে রুদ্ধ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে। আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, প্রতিটি বিজ্ঞান-মনস্ক, যুক্তিবাদী মানুষই চরমতম ধার্মিক। একটা তলোয়ারের ধর্ম যেমন তীক্ষ্ণতা, আগুনের ধর্ম যেমন দহন, তেমনই মানুষের ধর্ম মানুষ্যত্বের চরম বিকাশ সেই বিচারে যুক্তিবাদী সমাজ সচেতন আমরাই ধার্মিক, কারণ আমরা শোষিত মানুষদের মনুষ্যত্ববোধকে বিকশিত করতে চাইছি। মানুষের চিন্তায়, মানুষের চেতনায় ঘটাতে চাইছি বিপ্লব—সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

আমরা জানি, যে দিন বাস্তবিকই যুক্তিবাদী আন্দোলন দুর্বার গতি পাবে, সে-দিন দু’টি জিনিস ঘটবে। একঃ আন্দোলন শোষকশ্রেণির স্বার্থকে আঘাত হানবেই। এবং শোষকশ্রেণি তাদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তীব্র প্রত্যাঘাত হানবেই। এই প্রত্যাঘাতের মুখে কেউ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগ্রামকে, অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, কেউ পিছু হটবে না। দুইঃ যুক্তিবাদী চিন্তা বঞ্চিত জনতার চেতনার জগতে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাবে, তারই পরিণতিতে গড়ে উঠবে নতুন নেতৃত্বঃ যে নেতৃত্বে থাকবে সমাজ পরিবর্তনের, হুজুর-মজুর সম্পর্ক অবসানের, সার্বিক বিপ্লবের অঙ্গীকার।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব যখন শোষিতদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক

বিপ্লবে পরিণত হবে, তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সংগ্রামী

মানুষরাই রাজনৈতিক বিপ্লবেরও সংগ্রামী মানুষ

হয়ে উঠবেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী ও

রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে

তথাকথিত সীমারেখার দেওয়াল

আপনিই ভেঙে পড়বে-

আন্দোলন দুটি মিলেমিশে

একাকার হয়ে যাবে।

আমরা সুনিশ্চত লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে চাই, তাদেরকে আমাদের চিন্তার শরিক করতে চাই। আমরা চাই আমাদের চিন্তার, আমাদের দর্শনের বিস্তার। আমাদের চিন্তাকে নিয়ে যেতে চাই সেখানেই, যেখানে রয়েছে মানুষ। আমরা তাই ডান, অতি-ডান, বাম, অতি-বাম বিচার না করে প্রত্যেকের আহ্বানেই হাজির হব— আমাদের নানা অনুষ্ঠানের পশরা নিয়ে—নাটক নিয়ে, মাইম নিয়ে, গণসংগীত নিয়ে, আলোচনাসভা ও সেমিনার নিয়ে, লেখা-পত্তর নিয়ে। আমরা মানুষদের চিন্তাকে প্রভাবিত করতে, আমাদের চিন্তার খাতে বওয়াতে প্রবন্ধে, গল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, দূরদর্শনে এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে আমাদের মতাদর্শকে তুলে ধরতে সচেষ্ট হব। জনগণকে যত বেশি সম্ভব প্রভাবিত করার স্বার্থে বেশি বেশি করে সমস্ত রকম প্রচার-মাধ্যম এবং গণ-মাধ্যমগুলিকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকব। এই বিষয়েও অবশ্যই সতর্ক থাকব, যাতে প্রচার-মাধ্যম ও গণ-মাধ্যমগুলি শোষিত মানুষদের স্বার্থ বিরোধিতায় আমাদের না কাজে লাগাতে পারে।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তীব্রতর করতে সাংস্কৃতিক ‘ফ্রন্ট’ গড়ার বৈপ্লবিক তাৎপর্য মাথায় রেখে আমাদের সমিতির সদস্য নয়, কিন্তু আমাদের কাজ-কর্মে অনুরাগী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ইত্যাদি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সংঘবদ্ধ করে এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বাহিনী গড়ে তুলব। আমাদের সমিতির শাখা নয়, অথচ আমাদের কাজ-কর্মে শ্রদ্ধাবান বিভিন্ন গণ-সংগঠনগুলিকে একত্রিত করতে গণ-সংগঠনগুলির সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করব । আমরা সচেষ্ট থাকব এইসব সাহিত্যিক, শিল্পী, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী এবং গণ-সংগঠনকর্মীদের চিন্তাকে আমাদের মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত করতে।

আমরা চাই আমাদের মতাদর্শের, আমাদের দর্শনের বিস্তার।

আমরা শাখা বিস্তার করতে চাই সেখানেই—যেখানে

রয়েছে মানুষ। আমরা মনে করি সাংস্কৃতিক

ময়দানের লড়াইয়ে জয়লাভ করতে না

পারলে, শোষিত মানুষদের মুক্তির

লড়াইয়ে জয়লাভ অধরাই

থেকে যাবে।

আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম—‘বৈপ্লবিক সংস্কৃতি’ গড়ার কাজে। যে কোনও ত্যাগ বা অত্যাচারের মুখোমুখি হব হাসিমুখে। আদর্শের প্রয়োজনে, সমিতির নেতৃত্বের নির্দেশে প্রাণ-বিসর্জন দিতে সব সময়ই প্রস্তুত থাকব। ‘

সমমনোভাবাপন্নদের এই আন্দোলনে শামিল করার চেষ্টা যখন চলছে, বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতা, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের সংঘবদ্ধ করে এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বাহিনী গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে চলেছি, তখন (’৮৬-র জানুয়ারিতে) ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ওরফে চেম্বার ওরফে পাভলভ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল-এ অনুষ্ঠিত এক ঘরোয়া আলোচনায় ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর প্রবলতম সম্পাদক ডঃ অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সমিতির কাজ-কর্ম চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুললেন। এবং জানালেন ভারতবর্ষে যখন কোভুরের প্রতিষ্ঠিত র‍্যাশনালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের অস্তিত্ব রয়েছে এবং খোদ কলকাতাতেই রয়েছে কোভুর প্রতিষ্ঠিত যুক্তিবাদী সমিতির শাখা তখন যুক্তিবাদী আন্দোলনের নামে আর একটি সমিতির কাজ চালিয়ে যাওয়ার যে কোনও চেষ্টার তিনি বিরোধিতাই করবেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন তিনটি। এক: আমরা কোভুরের দলের সঙ্গে আমাদের সমিতিকে মিশিয়ে দিই। দুই: আমরা উৎস মানুষের উইং বা শাখা হিসেবে কাজ করতে পারি। তিন: আমরা পাভলভ ইনস্টিটিউটের উইং হিসেবে কাজ করতে পারি ।

এমন একটা প্রস্তাবে সায় দেওয়া আমাদের পক্ষে কখনওই সম্ভব ছিল না। যুক্তিবাদী সমিতিকে যাদের অভিভাবকত্ব মেনে নিতে বলা হয়েছিল তাদের অবস্থাটা একবার বিচার করে দেখা প্রয়োজন। যাদের অঙ্গুলি হেলনেই যুক্তিবাদী সমিতির যাবতীয় ভাবাদর্শ ও কর্মোদ্যোগ নিয়ন্ত্রিত হবে—সেই তিন সংস্থা বিপ্লবী চিন্তার দ্বারা কতটুকু পরিচালিত হয়, তা নিশ্চয়ই বিচার করার পরেই যুক্তিবাদী সমিতি সিদ্ধান্ত নিতে পারে আমরা সমচিন্তার পথিক কি না।

ডঃ কোভুর প্রতিষ্ঠিত র‍্যাশনালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান অস্তিত্ব একটি মাত্র পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একই পরিবার থেকেই প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি ও ট্রেজারার উঠে এসেছেন—কারণ পরিবারের বাইরে সমিতি ব্যাপ্তিই পায়নি। কলকাতায় ওই অ্যাসোসিয়েশনের শাখা বলতে একটি মাত্র মানুষ যাঁর কর্মক্ষমতা বা মানুষকে আন্দোলনে শামিল করার ক্ষমতা একটি বিরাট শূন্য। এ-তো কোভুর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের বর্তমান হাল হকিকত; এ-বার একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক ডঃ কোভুর কি দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তার দিকে।

ডঃ কোভুর সাহসিকতার সঙ্গে কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন, অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি বা বুঝতে চানও নি— কুসংস্কার সৃষ্টি ও টিকে থাকার পিছনে রয়েছে অসম্পূর্ণ জ্ঞান, ভ্রান্ত জ্ঞান, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, অসাম্য ও সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠা একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। শোষক হুজুরের দল ও তাদের তল্পিবাহক রাষ্ট্রশক্তিই যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও শ্রীবৃদ্ধির স্বার্থেই জনচিত্তে কুসংস্কারকে বদ্ধমূল রাখতে প্রয়াসী—এই সত্য কোনও সময়ই ডঃ কোভুর বঞ্চিত, শোষিত মানুষদের চেতনাকে সমাজ-সচেতন করার চেষ্টা না করে, অন্ধ-কুসংস্কারের মূল ধরে টান দেওয়ার চেষ্টা না করে দরিদ্র, বঞ্চিত, অসহায় মানুষদেরই কুসংস্কারের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে নিন্দা করেছেন।

ডঃ কোভুরের এমনতর ক্রিয়াকলাপের তিনটি কারণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এক : ডঃ কোভুরের সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে পরিপূর্ণ অজ্ঞতার জন্যই এমনটা ঘটেছে। দুই : ডঃ কোভুর সাধারণ মানুষকে, শোষিত মানুষকে সমাজ সচেতন করতে চাননি। বরং চেয়েছিলেন গুটিকয়েক অবতারকে জোচ্চোর প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে জনগণকে উত্তেজনার আগুন পোহানোর ভাগীদার করে একটা মেকি যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে। তিন : শোষক ও শাসকগোষ্ঠী ডঃ কোভুরকে দাবার ঘুঁটির মতো কাজে লাগিয়ে সমাজ সচেতন মানুষদের মগজে ঢোকাতে চাইছিল একটি ভ্রান্ত ধারণা— ‘যুক্তিবাদী আন্দোলন ও অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য উদ্ঘাটন সমার্থক শব্দ’। যুক্তিবাদী চিন্তাকে প্রতিরোধ করতে এমন একটি ভ্রান্ত চিন্তার প্রসারের প্রয়াস হুজুরশ্রেণির পক্ষে একান্তই অনিবার্য ছিল।

‘উৎস মানুষ’ পত্রিকার কাজ-কর্ম একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পত্রিকার সম্পাদক ডঃ অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় পুলিশের একজন পদস্থ অফিসার। পুলিশকর্তার নেতৃত্বে বিপ্লব হবে এরকম আহাম্মকের চিন্তা আমাদের মধ্যে ছিল না। পত্রিকা প্রকাশের বাইরে আর কোনও বৃহত্তর লক্ষ্য পত্রিকাগোষ্ঠীর ঘোষণায় নেই। আন্দোলন গড়ার আয়াসসাধ্য, নিবেদিত-প্রাণ প্রচেষ্টার সঙ্গে যাঁদের সামান্যতম সম্পর্ক নেই, তাঁদের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক অন্দোলন গড়ে তোলা বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করা বিপ্লবী সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। ‘উৎস মানুষ’ পত্রিকা গোষ্ঠী যে-ভাবে ডঃ কোভুরকে ‘সুপার হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, ‘ব্যক্তি-পূজা’কে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে সেটা অন্ধ-স্তাবকতার নামান্তর বই কিছুই নয়— কারণ ডঃ কোভুর কখনওই একটা দর্শনের স্রষ্টা নন যাতে তাঁর প্রতি ব্যক্তি শ্রদ্ধা একটা আদর্শের প্রতীকের প্রতি শ্রদ্ধা হয়ে উঠতে পারে, একটা শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা হয়ে উঠতে পারে। ডঃ কোভুর বা উৎস মানুষ যুক্তিবাদ বলতে না বোঝেন সেটা আদৌ যুক্তিবাদই নয়, বরং প্রকৃত যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে প্রচণ্ড বাধাস্বরূপ। তা-ছাড়া যে সংস্থার সামনে মহৎ কোনও আদর্শ নেই, সেই সংস্থার আঙুলে গোনা কয়েকজন লেখক বা সংগঠক মহানগর থেকে পত্রিকা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে উত্তেজনার আগুন পোহাতে পারবেন, ‘প্রগতিশীল’-‘সমাজসচেতন’- ‘যুক্তিবাদী’ ইত্যাদি স্বঘোষিত তকমা এঁটে সাধারণ মানুষের থেকে নিজেদের উচ্চতর শ্রেণির বিবেচনার নাসিকা কুঞ্চন করতে পারবেন—কিন্তু কোনও দিনই সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনার জন্য সমস্ত রকম ঝুঁকি নিয়ে সঠিক নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে পারবেন না ।

‘পাভলভ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল’ বাস্তবে কোনও শিক্ষাকেন্দ্র অথবা হাসপাতালও নয়—একটি ক্ষুদ্র চেম্বার মাত্র, যেখানে বসে ডাক্তার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় রোগী দেখেন। বিভিন্ন সরকারি সহযোগিতা সাহায্য নেওয়ার জন্যেই ব্যক্তিগত চেম্বারকে একটি কাগুজে নাম-ভারী প্রতিষ্ঠান সাজানো হয়েছে। এই সংস্থারও সমাজের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা নেই অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার মতো কোনও আয়াসসাধ্য ব্যাপার-স্যাপারে সামান্যতম আগ্রহী নয়—একথা চূড়ান্তভাবে সত্য। তিনি একটি পত্রিকা বের করতেন নাম ‘মানবমন’। প্রচার সংখ্যা খুবই সামান্য। কমিউনিস্টদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। ডাক্তার গঙ্গোপাধ্যায় যে-ভাবে হুজুরদের অর্থে গদিতে বসা সরকারের ছত্রছায়ায় আন্দোলন গড়তে উৎসাহী, মন্ত্রীদের স্নেহধন্য হতে হতে উৎসাহী, তাতে তাঁকে একজন আপসকামী সুবিধাবাদী, আত্মসমর্পণকারী বুদ্ধিজীবী ও লেখক ছাড়া আর কিছুই মনে হওয়ার মতো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দেখি না। এখন লেখক ডাক্তার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে ‘সোভিয়েত দেশ নেহেরু পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’–এ পুরস্কৃত হওয়াই তো স্বাভাবিক, শাসকশ্রেণির কাছে প্রাপ্য। এমন এক ব্যক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানের শাখা হিসেবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব গড়ে তোলার চেষ্টা বিশ-শতকের অন্যতম সেরা মূর্খতা বই আর কিছুই নয়।

উপরোক্ত সংগঠনগুলোর সীমিত সামাজিক অবদান ও তার কিছু সদস্যদের কর্মোদ্যোগ ও সৎ প্রচেষ্টাকে স্বীকার করে নিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, যেহেতু যুক্তিবাদী সমিতির কাজের ধারা সামগ্রিকভাবে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে নিয়ে একটি বিশাল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে, আর তুলে ধরছে একটি সম্পূর্ণ জীবনদর্শন—তাই আমাদের সমিতির পক্ষে এইসব বিক্ষিপ্ত, খণ্ডিত, ব্যক্তিনির্ভর সংগঠনগুলোর শাখা বা উইং হিসেবে এবং পুলিশ কর্তানির্ভর, সিপিএম পার্টিনির্ভর হিসেবে কাজ করা ব্যবহারিক ভাবেই অসম্ভব।

অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষদের নিয়ে, উৎস-মানুষ, পাভলভ ইনস্টিটিউট-এর মতো প্রতিষ্ঠানদের নিয়ে সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলা যায়, কিন্তু ওদের মতো অস্বচ্ছ দৃষ্টির অথবা সুবিধাবাদীদের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না—এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকার জন্যেই আমাদের সমিতি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাজির করা প্রতিটি প্রস্তাবকেই আত্মহননকারী প্রস্তাব হিসেবে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৮৫-তেই আমাদের আন্দোলনে বাড়তি গতির সঞ্চার করেছিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত একটি বেতার অনুষ্ঠান। ‘৮৫-র ১৮ জুলাই রাত ৮টা থেকে ৮-৩০ পর্যন্ত (যে সময়টা বেতার অনুষ্ঠানের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে চিহ্নিত) আকাশবাণী কলকাতার ‘ক’ কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল ‘জ্যোতিষ নিয়ে দু-চার কথা শিরোনামে। অনুষ্ঠানটি শুনে মতামত জানানোর জন্য পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে চিঠি পাঠান আকাশবাণীর বিজ্ঞান বিভাগের প্রযোজক অমিত চক্রবর্তী। চিঠিতে অবশ্য অনুষ্ঠানটিকে ‘জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আলোচনায় জ্যোতিষী ও ভাগ্য গণনাকারীদের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন নামী-দামি চার জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদার। বিজ্ঞানের তরফে ছিলাম শুধু আমি একা। আলোচনায় চার জ্যোতিষী পদে পদে হোঁচট খেয়ে শেষ পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়েছিলেন (অলৌকিক নয়, লৌকিক-৩য় খণ্ডতে পুরো বেতার অনুষ্ঠানটি প্রকাশিত হয়েছে)। প্রচারিত অনুষ্ঠানটি জনমানসে এত বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছিল, যে বিভিন্ন ভাষাভাষী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা, চিঠি-পত্র, এমন কী সম্পাদকীয় পর্যন্ত। বেতার অনুষ্ঠানটির প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন ভাষাভাষী পত্র-পত্রিকায় প্রায় বছর দু’য়েক ধরে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। কৃষ্টি সংসদ (সোনারপুর) তাঁদের নাটক ‘ভাগ্যে ভূত ভগবান’-এ বেতার অনুষ্ঠানটিকে নিয়ে এসেছেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী জ্যোতিষ সম্রাট ডঃ অসিতকুমার চক্রবর্তী তো এই দিয়ে একটা ঢাউস বইই লিখে ফেললেন, নাম— ‘জ্যোতিষবিজ্ঞান কথা’। বেতার অনুষ্ঠানে প্রভাবিত জনতার অনেকেই যুক্তিবাদী আন্দোলন ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলেন, শ্রদ্ধা পোষণ করলেন, সমর্থন জানালেন, সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হলেন।

১৯৮৬-র জানুয়ারিতে ‘কলিকাতা পুস্তকমেলা’ ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’—বইটির প্রথম খণ্ডটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমিতির কাজে যেন জোয়ার এল। অনেক মানুষ অনেক সংগঠন এগিয়ে এলেন। গড়ে উঠতে লাগল শাখা সংগঠন। অনেক সংগঠন নিজ সংগঠনের অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহী দেখে আমরা বিভিন্ন সমমনোভাবাপন্ন সংগঠনগুলির সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করলাম। নেতৃত্বে বহুজনকে তুলে আনতে আমরা শুরুতেই প্রতিমাসে অন্তত একটি করে ‘শিক্ষণ-শিবির’ পরিচালনা করতে শুরু করলাম। এইসব ‘শিক্ষণ-শিবির’ বসত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে। তারই সঙ্গে প্রতি সপ্তাহের শনি রবি ও ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চলে আমন্ত্রণে অথবা আমাদেরই উদ্যোগে বসতে লাগল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার-আসর ।

১৯৮৬-র মাঝামাঝি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বেজায় নামী যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা জেমস র‍্যান্ডি আমাকে একটি চিঠি দিয়ে আমাদের সমিতিকে C.S.I.CO.P-র সঙ্গে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। আমেরিকার যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব যে সংস্থাটির হাতে, তার নাম ‘কমিটি ফর সাইন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন অফ ক্লেমস্‌ অফ দ্য প্যারানরমাল’ সংক্ষেপে C.S.I.CO.P.। এদের যুক্তিবাদী আন্দোলন যে শুধুমাত্র অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা সংস্থার নামটি শুনলেই বুঝতে পারা যায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বঞ্চিত মানুষদের চেতনাকে যুক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, যুক্তিবাদী চিন্তা প্রসারের আন্দোলনকে ঠেকাতে মেকি যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার অতি-প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল আমেরিকার ধনকুবের গোষ্ঠী। আর সেই অতিপ্রয়োজনীয়তা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল C.S.I.CO.P.নামক সংস্থাটির। এমন একটি সংস্থার নেতৃত্বে আমাদের সমিতি কাজে নামলে কিছু কিছু সুবিধে ও অসুবিধে দুইই আছে। সুবিধে অনেক—প্রচার, বিদেশ-ভ্রমণ, অর্থ, ইত্যাদি। অসুবিধে একটাই— সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে প্রতিহত করার দায়িত্ব পালন করতে হবে বিবেকে পাষাণ চাপিয়ে।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার যে অঙ্গীকার নিয়ে যুক্তিবাদী সমিতির জন্ম, সেই অঙ্গীকারেরই সম্পূর্ণ বিরোধী কাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা একান্তই অসম্ভব বিবেচনায় জেমস্ র‍্যান্ডির আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম আমরা।

কিছু মানুষ ও প্রতিষ্ঠান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিরাজমান যারা বিদেশি সাহায্য শিকারি এমনি এক বিদেশি সাহায্য শিকারি তামিলনাড়ুর জাদুকর বি. প্রেমানন্দ C.S.I.CO.P-র পরিকল্পনা মাফিক ধাঁচে এ-দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে ঢেলে সাজাবার অঙ্গীকার করে C.S.I.CO.P.-র সহযোগিতা পেলেন একটু বেশিই। ‘৮৮ সালের মধ্যে ভারতের পাঁচটি প্রদেশে ‘স্টেট গ্রুপ’ গঠন করতে সক্ষম হলেন প্রেমানন্দ। আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া পেতে, বিদেশি সংস্থার সহযোগিতা পেতে মুক্তকচ্ছ হয়ে এগিয়ে আসা কিছু সংস্থাকে নিয়ে গড়ে তোলা হলো ‘স্টেট গ্রুপ’। এই সংস্থাগুলো হল : অন্ধ্রপ্রদেশ-সেন্টার ফর সেল্যুলার অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি, হায়দ্রাবাদ, গুজরাট-সত্য শোধক সভা, অধ্যক্ষ, এম. বি. টি. আর্টস কলেজ, সুরাট। কনটিক (১) ব্যাঙ্গালোর সায়েন্স ফোরাম, ন্যাশনাল কলেজ বিল্ডিংস, ব্যাঙ্গালোর। (২) সাউথ কানাড়া র‍্যাশনালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, ম্যাঙ্গালোর। (৩) ন্যাশনাল ব্রাদারহুড ট্রাস্ট, মণিপাল। তামিলনাড়ু-তামিল র‍্যাশনালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, কোয়েম্বাটোর। পশ্চিমবঙ্গ-উৎস মানুষ, সল্টলেক, কলকাতা ।

বর্তমানে Indian C. S. I.CO. P-র অবস্থানটা কেমন সেটা বিচার করতে গেলে প্রথমে তাদের অভিভাবক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের CSICOP-র অবস্থাটা বিচার করে দেখা একান্তই প্রয়োজনীয়, কারণ আমেরিকা CSICOP-র অঙ্গুলি হেলনেই ভারতীয় CSICOP-র কর্মোদ্যোগ ও ভাবাদর্শ নিয়ন্ত্রিত হয়। আজ বুঝে নিতে হবে বাস্তবিকই শোষণ মুক্তির জন্য যে বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন সেই আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষমতা CSICOP আমেরিকান নেতৃত্বের নেই। শোষণ মুক্তির জন্য জনচেতনাকে সমাজসচেতন করতে কোন্ পথ ধরতে হবে তার হদিশ CSICOP-র কাজ-কর্মে অনুপস্থিত। কারণ বিপ্লব বিরোধী CSICOP-কখনওই শোষিত মানুষের চেতনাকে আদৌ অতদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচছুক নয়, যাতে শোষিতরা বুঝতে পারে তাদের বঞ্চনার কারণ অ-সম সমাজ ব্যবস্থা। প্রকৃত যুক্তিবাদী আন্দোলনকে ঠেকাতেই মেকি যুক্তিবাদীদের সৃষ্টি—এই পরম সত্যকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলে, ওদেরকেও ‘সমমনোভাবাপন্ন তবে একটু কট্টর কম’ ধরে নিয়ে আন্দোলনে নামলে সে আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য।

এই মুহূর্তে প্লেটোর একটা কথা বড় বেশি রকম মনে পড়ছে। প্লেটো বলেছিলেন—“মহান মিথ্যে ছাড়া রাষ্ট্র চালানো যায় না।” এই ‘মহান মিথ্যে’ দিয়েই শোষিত মানুষগুলোর প্রতিবাদের কণ্ঠ, বিপ্লবের ইচ্ছে, একত্রিত সংগ্রামের প্রয়াসকে প্রতিহত করার চেষ্টা চলছে ধারাবাহিকভাবে।

এককালে ‘ঈশ্বরতত্ত্ব’ মহান মিথ্যে হিসেবে রাষ্ট্রচালকদের পক্ষে যতখানি কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিল এখন আর ততখানি জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলির রাষ্ট্রশক্তির কাছে ঈশ্বরের জীবন্ত প্রতীক হিসেবে অবতারদের হাজির করার প্রয়োজনীয়তা তাই অনেক কমেছে। রাষ্ট্রশক্তি এখন বিজ্ঞান বিরোধিতা করতে বিজ্ঞানীদের উপরই বেশি করে নির্ভর করছে। এসেছে প্যারাসাইকোলজিস্টের দল, যারা বিজ্ঞানের নামাবলি গায়ে দিয়ে বিজ্ঞানেরই বিরোধিতা করতে চায়। উদ্দেশ্য—বিজ্ঞান মনস্কতার ছোঁয়া থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে রাখা।

আশির দশকের শেষ প্রান্তে এসে সোভিয়েত বিজ্ঞান আকাদেমি ঘোষণা করেছিল, তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মেয়ে কুলাগিনা অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী। ইতিমধ্যে কুলাগিনাকে নিয়ে ফিল্ম তোলা হয়েছে। নিজের দেশে এবং বিদেশে দূরদর্শনের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের সামনে কুলাগিনাকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবেই হাজির করা হয়েছে। সোভিয়েত পত্র-পত্রিকায় কুলাগিনা সম্পর্কে বিজ্ঞান-আকাদেমির সিদ্ধান্তের কথা অতি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হওয়ায় ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান আন্দোলন ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের অলৌকিক বিরোধী বক্তব্যের ক্ষেত্রে বহু মানুষের মধ্যেই যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের যুক্তি, রুশ সায়েন্স আকাদেমি কি আর মিথ্যে বলেছে? ভারতস্থ সোভিয়েত দূতাবাস থেকে প্রকাশিত ‘যুব সমীক্ষা’য় কুলাগিনাকে নিয়ে একটি বহু ছবি-সহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনেও বিজ্ঞান আকাদেমির পরীক্ষা গ্রহণ ও সিদ্ধান্তের কথা লেখা ছিল। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রধান সম্পাদক হিসাবে ‘যুব সমীক্ষা’কে এই প্রসঙ্গে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছি আমাদের সমিতির কর্মপদ্ধতি। জানিয়েছি, আমাদের সমিতির একটি দল কুলাগিনার অলৌকিক ক্ষমতার পরীক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক। এও জানিয়েছি, কুলাগিনার ঘটানো তথাকথিত অলৌকিক ঘটনা লৌকিক উপায়েই আমি ঘটাতে সক্ষম। শেষ পংক্তিতে ছিল—আপনাদের তরফ থেকে সহযোগিতা না পেলে ধরে নিতে বাধ্য হব—আপনারা সত্য প্রকাশে অনিচ্ছুক এবং সেই সঙ্গে অন্ধ-বিশ্বাস, অতীন্দ্রিয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কালো দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট। দূতাবাস আমাদের চিঠি পেয়েছে। আমাদের সমিতির কাজ-কর্ম সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অবহিত থাকা সত্ত্বেও তারা কুলাগিনাকে অলৌকিকতার ঘেরাটোপের মধ্যে রাখতে যে ভাবে আমাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছে তাতে বুঝেছিলাম সোভিয়েত রাষ্ট্রশক্তি আজ মানুষকে অতীন্দ্রিয়তার নেশায়, ধর্মের নেশায় ডুবিয়ে রাখতে, ভ্রান্ত-বিশ্বাস প্রোথিত করতে বিজ্ঞানের বিরোধিতা করতে বিজ্ঞানকেই কাজে লাগিয়েছে।

এই ধরনের উদাহরণ দেওয়া যায় ভূরি ভূরি। শুধু সোভিয়েত দেশেই নয়, পৃথিবীর বহু দেশের রাষ্ট্রশক্তিই বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে রাখতে বিজ্ঞানীদেরই কাজে লাগাচ্ছেন, প্যারাসাইকোলজি বা অতীন্দ্রিয় ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে গবেষণাকে নানাভাবে উৎসাহিত করছেন। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়।

যুক্তিবাদী আন্দোলন থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে বহু ধরনের প্রচেষ্টায় ও পরিকল্পনায় হাত দিয়েছে সেই সব রাষ্ট্রশক্তি, যারা সাধারণ মানুষের চেতনাকে বেশি দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে ভয় পায়, যারা জানে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও আবেগতাড়িত মানুষগুলোকে ‘মহান মিথ্যের সাহায্যে অবহেলে শাসনে রাখা যাবে, শোষণ করা যাবে। এই পরিকল্পনারই অঙ্গ ‘যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জনগণের চিন্তাকে রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে চালিত করা ।

এখন রাষ্ট্রশক্তিগুলি টিকে থাকার পদ্ধতি পাল্টাচ্ছে। যুক্তির

বিরুদ্ধে বিপরীত যুক্তির আক্রমণ চালিয়ে সরাসরি লড়াইতে

নামার চেয়ে যুক্তিনির্ভর কোনও আন্দোলনের পাল

থেকে হাওয়া কেড়ে নিতে আপাতদৃষ্টিতে সমধর্মী

যুক্তিনির্ভর সাজানো আন্দোলনকে গতিশীল

করাকে অনেক বেশি কার্যকর

মনে করছে।

তারই প্রকাশ ধারাবাহিকভাবে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্দোলনের ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইউরোপে নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলন থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে দিতে ‘যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি’কে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা ও রাশিয়া যুক্তভাবে প্রচারে নেমেছিল নিউক্লিয়ার বোমের বিরুদ্ধে।

ভারতবর্ষে অসমান বিকাশের ফলে কোনও অঞ্চলে পুরোহিত তন্ত্র প্রবল বিক্রমে বিরাজ করছে, কোথাও পরাবিদ্যা সে জায়গা দখল করতে হাজির করেছে কম্পিউটার জ্যোতিষ, অ্যাস্ট্রোপামিস্ট, বিজ্ঞানসম্মতভাবে জ্যোতিষ চর্চার নানা প্রকরণ, আবার কোথাও যুক্তিবাদের সম্প্রসারণ ঠেকাতে মুখোশধারী যুক্তিবাদীদের পথে নামিয়েছে হুজুরের দল। আমাদের দেশের রাষ্ট্রশক্তি মহান মিথ্যে হিসেবে এ সবের সঙ্গে আসরে নামিয়েছে লটারি, জুয়া, টেলিভিশন স্ক্রিনে রামায়ণ, মহাভারত, নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

বিভিন্ন যুগে ‘মহান মিথ্যে’ পাল্টায়, কারণ যুক্তিবাদ কখনওই

একটা স্তরে স্থির থাকে না, স্থির থাকতে পারে না।

প্রতিটি স্তরের যুক্তিবাদের পাশাপাশি ‘মহান

মিথ্যে’ পাল্টায়, পাল্টায় কুসংস্কার।

আমাদের দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করতেই কোনও কোনও বিদেশি রাষ্ট্রশক্তি এবং আমাদের দেশের রাষ্ট্রশক্তি অতি মাত্রায় সচেতন হয়ে উঠেছে। কারণ যুক্তিবাদীদের আবির্ভাব রাষ্ট্রশক্তির কাছে এক বিপদ সংকেত। কুসংস্কার ও জাতপাতের বিশ্বাস যতদিন শোষিত মানুষগুলোর চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে, ততদিন শ্রেণি সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগোতে পারবে না। শোষিত একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আর একটি গোষ্ঠীর অবিশ্বাস ও ঘৃণাকে যতদিন বজায় রাখা যাবে, ততদিন তাদের মধ্যে শ্রেণি চেতনা, শ্রেণি সংগ্রাম চূড়ান্ত রূপ পাবে না।

শ্রেণি চেতনা বৃদ্ধি পেলে কুসংস্কার, জাতপাতের মতো বিষয়গুলো দূরে সরে যায়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই শ্রেণি সংগ্রাম এবং শ্রেণি চেতনাই হিন্দু মুসলমানদের একসঙ্গে লড়াইতে নামিয়ে ছিল। মাও সে তুং-এর ‘হোনান’ রিপোর্টেও দেখি শ্রেণি চেতনায় উদ্বুদ্ধ কৃষকরা নিজেরাই বাড়ির ও থানের অধিষ্ঠিত কাঠের দেবমূর্তিগুলিকে অপ্রয়োজনীয় এবং কুসংস্কারপ্রসূত জ্ঞান করে চ্যালা কাঠ করে জ্বালানি বানিয়েছিল।

আমাদের দেশে ‘যুক্তিবাদ’ এখন আন্দোলন গড়ার স্তরে। প্রতিরোধে স্বার্থান্বেষী মহল অতি সচেতন। ‘যুক্তিবাদী আন্দোলন’ থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদকে কাজে লাগাবার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। মেকি আন্দোলন সৃষ্টি করতে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা, রাষ্ট্রশক্তি। বিদেশি সাহায্যে বা রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতায় শুরু হয়ে গেছে তথাকথিত যুক্তিবাদী আন্দোলন।

১৯৮৬-তেই ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামের কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান এতই জনপ্রিয়তা লাভ করল যে আমাদের সমিতির শাখা, সহযোগী সংস্থা ও সমমনোভাবাপন্ন সংগঠনের সাহায্যে আদিবাসী ঘরের নিরন্ন ছেলে-মেয়েরাও এগিয়ে এল। বাংলার মানুষ সবিস্ময়ে দেখল এইসব অবহেলিতরা কী আসাধারণ দক্ষতায়, প্রাণঢালা আন্তরিকতায় নিপীড়িত মানুষের ঘুম ভাঙার গান বেঁধেছে, গাইছে, নাটক করছে, আলোচনাচক্রে অন্যদের বোঝাচ্ছে, হাতে-কলমে ঘটিয়ে দেখাচ্ছে বাবাজি-মাতাজিদের নানা অলৌকিক ক্ষমতার গোপন কৌশল, ওঝা-গুনিনদের চমৎকারী ক্ষমতার আসল রহস্য। সাধারণ মানুষদের দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যে কোনও অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা তারা দেবে, গ্রহণ করবে যে কোনও অবতার ও জ্যোতিষীদের চ্যালেঞ্জ। ওরা বোঝাচ্ছে আপনাদের দুঃখ বঞ্চনার কারণ কোনও কল্পনার দেবতা বা আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নয়, পূর্বজন্মের কর্মফলও নয়। আপনাদের বঞ্চনার কারণ এই সমাজেরই কিছু লোভী মানুষ। লোভী মানুষদের ও তাদের দালালদের চিনে নিন আপনাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তারপর বঞ্চনার শিকল ভাঙার পালা। সে তো আপনাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ভাঙতে হবে। শোষক আর তাদের দালালরা তো আপনাদের মুখের কথায় কুবেরের ঐশ্বর্য গড়ে তোলার মূলমন্ত্র ‘শোষণ’ ছেড়ে দেবে না। সংগ্রাম করেই আপনাদের অধিকার কায়েম করতে হবে।

এইসব নিবেদিতপ্রাণ ছেলে-মেয়েদের প্রতিটি ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার আশ্বাস ও চ্যালেঞ্জকে মূল্য দিতে, রক্ষা করতে আমাদের সমিতি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ-এই বিশ্বাসটুকু এইসব দামাল ছেলে-মেয়েদের মস্তিষ্কে গেঁথে দিতে পেরেছিলাম। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা ও সমমনোভাবাপন্ন মানুষদের নিয়ে স্টাডি ক্লাসও শুরু করে দিলাম-জ্ঞানকে পরিমার্জিত ও স্বচ্ছ করতে।

 

পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চঃ ধর্মে আছ, জিরাফেও আছ

এই সময় পশ্চিমবাংলার প্রধান রাজনৈতিক দল সিপিআইএম-এর দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষিত হল জনমানসে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখে, আমাদের কর্মধারা দেখে। সঙ্গে কিছু চিন্তারও উদয় হয়েছিল। কারণ যে সময়ে একটি ক্ষুদ্র স্কুল, ততোধিক ক্ষুদ্র পাঠাগারের কর্তৃত্ব দখল করতে রাজনৈতিক দলগুলো ছল-বল-কৌশল প্রয়োগ করে থাকে সর্বশক্তি দিয়ে, তখন এমন একটা সংগঠন কাদের পক্ষে কাজ করছে ও করবে এটা জানা অনেক রাজনৈতিক দলের কাছেই একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। সিপিআইএম নেতৃত্বের বুঝতে অসুবিধে হয়নি আমাদের সংগঠন কাজ করছে অত্যাচারিত শোষিত মানুষদের পক্ষে, যুক্তিবাদ প্রসারের পক্ষে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পক্ষে । ওঁরা এও বুঝে নিয়েছিলেন—আমাদের সমিতির নেতৃত্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী অথবা সমর্থক, আবার অনেকেরই কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই সম্পর্ক নেই। যুক্তিবাদী সমিতির সভ্যের প্রাথমিক শর্ত হল – সে হবে যুক্তিবাদী। এমন একটা সমিতি যারা সাধারণ মানুষদের মধ্যে কাজ করে চলেছে সিপিআইএম-এর নির্দেশ ছাড়া, যারা সিপিআইএম-এর সুরে সুর মিলিয়ে ‘জল উঁচু’ বললে ‘জল উঁচু’ বলতে এবং ‘জল নিচু’ বললে ‘জল নিচু’ বলতে রাজি নয়, তাদের কাজ-কর্ম বাড়তে দেওয়া পার্টির ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পক্ষে ভালো নয় বিবেচনায় আমাদের আন্দোলন ঠেকাতে বিজ্ঞান আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিজের পার্টির একটি শাখা খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৮৬-র ২৯ নভেম্বরে এক কনভেনশনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’। ‘৮৭-তে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশ করল বত্রিশ পৃষ্ঠার একটি ছোট্ট পুস্তিকা, যাতে বিজ্ঞান মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক ‘বিজ্ঞান আন্দোলনের ভূমিকা’ বলতে গিয়ে বললেন, “মানুষকে বোঝাতে হবে যে তাঁদের অনুভূত সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান । এই সমস্যাগুলি সাধারণত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। (১) ব্যবহারিক সমস্যা এবং (২) সামাজিক সমস্যা। সাধারণ মানুষকে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ব্যবহারিক সমস্যা ও তার সমাধানের বিজ্ঞানসম্মত উপায় সম্পর্কে বোঝাতে হবে। পরিবেশ দূষণ, রোগ প্রতিরোধ, জলসেচ, মৃত্তিকার পরীক্ষা, কীটনাশকের প্রতিক্রিয়া, পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা, জ্বালানি ও শক্তির সমস্যা ইত্যাদি সময়োপযোগী সমস্যা বিষয়ে মানুষের মধ্যে ক্রমাগত প্রচার চালানো বিজ্ঞান আন্দোলনের একটি প্রধান কাজ। এইজন্য নিয়মিত আলোচনার ব্যবস্থা করা, বিশেষজ্ঞের সহায়তায় মানুষকে বোঝানো, বিজ্ঞান প্রদর্শনী এবং বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করা এবং প্রয়োজনে বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীদের পক্ষ থেকে মানুষকে হাতে-কলমে সাহায্য করা উচিত।”

একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ বিরোধিতা করল অবতার ও জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোকে। ওদের মতে এই পথ ‘হঠকারী’ পথ। এতে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। বিজ্ঞান মঞ্চের নেতৃত্বের চোখে বিজ্ঞান আন্দোলনের অর্থ-বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আন্দোলন।

আমাদের সমিতির দৃষ্টিভঙ্গিতে বিজ্ঞানের সুযোগ সুবিধে পৌঁছে দেওয়ার কাজ সরকারের প্রশাসনের। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ, ফোন, দূরদর্শন ইত্যাদি বিজ্ঞানের সুযোগ-সুবিধে পৌঁছে দেওয়া যদি বিজ্ঞান আন্দোলনের লক্ষ্য হয়, তবে তো আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকেই ভারতবর্ষের বিজ্ঞান আন্দোলনের সর্বকালের সেরা নেতা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

আমাদের সমিতির চোখে বিজ্ঞান আন্দোলনের

অর্থ-বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ার আন্দোলন,

সাধারণ মানুষকে যুক্তিনিষ্ঠ করে

তোলার আন্দোলন ৷

 

ফিরে আসি পুরোনো কথায়

১৯৮৭-এর ১ মার্চ ভারতের যুক্তিবাদী সমিতি (Rationalists’ Asso- ciation of India) নামটির সামান্য পরিবর্তন করে ঘোষিত হল নতুন নাম-ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি (Science and Rationalists’ Association of India ) ।

এই বৃহৎ নামটির থেকে ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ বা ‘Rationalists Asso ciation’ নামটি অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পেল সাধারণ মানুষের কাছে, প্রচার মাধ্যমগুলোর কাছে, যেমন ভাবে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ অনেক বেশি পরিচিত হয়েছে ‘কংগ্রেস’ নামে, ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট)’ সমধিক পরিচিত ‘সিপিআইএম’ নামে অথবা আরও সংক্ষিপ্ত নাম ‘সিপিএম’-এ।

ইতিমধ্যে ১৯৮৬ ও ১৯৮৭-তে আমরা এমন দুটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটিয়েছিলাম যা জনচিত্তে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। ‘৮৬-তে আমরা ফিলিপিনের ফেইথ হিলার রোমিও পি. গ্যালার্ড-এর অলৌকিক অস্ত্রোপচার রহস্য উন্মোচিত করি। ইতিপূর্বে ফেইথ হিলারের ওপর বহু তথ্যচিত্র পরিবেশন করেছে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সভ্য দেশ। বি.বি.সি ও গ্রানাডা টেলিভিশন কোম্পানি ফেইথ হিলারের অলৌকিক রহস্যময়তার ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে লৌকিক ব্যাখ্যা হাজির করতে ব্যর্থ হয়। (CSIOP-এর বিশিষ্ট নেতা এবং অলৌকিক রহস্য ফাঁস করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচার পাওয়া ব্যক্তিত্ব জেমন র‍্যান্ডি-ও ফেইথ হিলারের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন। ফেইথ হিলারদের বৈশিষ্ট্য ছিল—রোগীর শরীরে অস্ত্রোপচার করতেন কোনও অস্ত্র ছাড়া, স্রেফ নিজের আঙুলগুলোকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। রোগীকে অজ্ঞান করা হত না, তবু রোগী কোনও ব্যথা অনুভব করত না। অস্ত্রোপচার শেষে সামান্য মালিশ করতেই মিলিয়ে যেত অস্ত্রোপচারের চিহ্ন। বহুক্ষেত্রেই রোগী রোগমুক্ত হতেন।

ফেইথ হিলারের অস্ত্রোপচারে রহস্য উন্মোচন এবং কী ভাবেই বা কিছু কিছু রোগী রোগমুক্ত হচ্ছেন তার ব্যাখ্যা হাজির করতেই এ-দেশের গণ্ডি পার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফিলিপিনস-এর বেতার ও দূরদর্শনেও এই রহস্য উন্মোচন নিয়ে প্রচারিত হয় অনুষ্ঠান (এই নিয়ে স-চিত্র বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ২ খণ্ড গ্রন্থে)।

দ্বিতীয় ঘটনাটিও ঘটেছিল আর এক আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী মানবী কম্পিউটার শকুন্তলাদেবীকে ঘিরে। শকুন্তলাদেবী ‘৮৭-র কলকাতা পুস্তকমেলা চলাকালীন কলকাতার সান্ধ্য দৈনিক ‘ইভিনিং ব্রিফ’-এর পাতা জুড়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘অ্যাস্ট্রোলজি ইজ অলসো এ পার্ট অফ ম্যাথামেটিক্স’ অর্থাৎ জ্যোতিষ অঙ্কেরই একটি শাখা। ওই সাক্ষাৎকারেই আর এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘অ্যাস্ট্রোলজি ইজ দ্য কিং অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স’ অর্থাৎ কিনা জ্যোতিষশাস্ত্র হল ব্যবহারিক বিজ্ঞানের রাজা। শকুন্তলাদেবী সাক্ষাৎকারে এও জানিয়ে ছিলেন—“তিনি কোনও অনুষ্ঠানে অঙ্ক কষায় কোনও ভুল করেননি।’

তারপর আমাদের সমিতির খোলা-মেলা চ্যালেঞ্জের মুখে শকুন্তলাদেবীর গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে পলায়ন এবং তা নিয়ে ভারতবর্ষের বহু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লোমহর্ষক খবরগুলো মানুষের মনে প্রত্যয় এনে দিয়েছিল যুক্তিবাদী সমিতি পারে যে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে জয়কে ছিনিয়ে আনতে; পারে যে কোনও তথাকথিত অলৌকিক রহস্যের ব্যাখ্যা দিতে (শকুন্তলাদেবীর প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে)।

‘চ্যালেঞ্জ’ আমাদের যুক্তিবাদী আন্দোলনের একটা পর্যায় মাত্র—তার বেশি কিছুই নয়। প্রচারের ও বিজ্ঞাপনের দৌলতে যে গরুগুলো গাছে চড়ে বসেছে, তাদের মাটিতে নামিয়ে এনে আবার ঘাস খাওয়ানোর জন্যেই এই ‘চ্যালেঞ্জ’ দোদুল্যমান, সুবিধাভোগীও ঈর্ষাকাতরদের কাছে এই ‘চ্যালেঞ্জ’ ‘অশোভন’ মনে হতেই পারে—কেন না চ্যালেঞ্জ বাস্তব সত্যকে বড় বেশি রকম স্পষ্ট করে তোলে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় প্রশ্ন এটাই—যেখানে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেই দাবি প্রমাণ করা যায়, বাস্তব সত্যকে জানা যায়, সেখানে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে দ্বিধা থাকবে কেন?

‘চ্যালেঞ্জ’ অক্ষমদের কাছে ‘সস্তা চমক’ অবশ্যই, তবে আমাদের কাছে আন্দোলনের ‘হাতিয়ার’।

‘চ্যালেঞ্জ’কে যে সব ধাপ্পাবাজরা ‘নেশা’ বলে প্রচার করতে

চান, তাদের উদ্দেশে জানাই—সাধারণ মানুষকে, শোষিত

মানুষকে অবতার ও জ্যোতিষীদের ‘নেশা’ মুক্ত করতেই

আমাদের এই ‘চ্যালেঞ্জ’। যতদিন জনসাধারণের মধ্যে

ব্যাপকভাবে অবতার ও জ্যোতিষীদের ‘নেশা’

থাকবে, ততদিন ‘নেশা’ কাটাতে

আমাদের চ্যালেঞ্জের

‘নেশা’ও থাকবে।

এই কথাগুলো লিখলাম কিন্তু ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে নয়। আমাদের সমিতির সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট দৃঢ় কার্যক্রমের ফলে পালে যে হাওয়া লেগেছে, তা কেড়ে নিতে জনসমক্ষে আমাদের সমিতির কাজকর্মকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করে হাজির করতেই CSICOP এবং শাসকদলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা দুই মেকি বিজ্ঞান আন্দোলনের কুশলী নেতারা আমাদের চ্যালেঞ্জকে ‘সস্তা চমক’, ‘অশোভন ব্যাপার’, ‘প্রচারসর্বস্ব চ্যালেঞ্জের নেশা’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করেছেন। লড়াই তাদের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারের বিরুদ্ধে।

অবতার ও জ্যোতিষীরা যখন বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারে নেমে পড়েছেন হই-হই করে, তখন ভাববাদী দর্শনের ধারক-বাহক-পালকদের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য প্রতিটি কৌশল এবং প্রতিটি পদক্ষেপই অতি-প্রয়োজনীয়।

এমতাবস্থায় আমরা বহুক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জকে ভাববাদী দর্শন বিরোধী, অলৌকিক বিশ্বাস বিরোধী, কুসংস্কার বিরোধী প্রচারের ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছি। যেহেতু প্রচার মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকার কাছে ‘অলৌকিকতা’, ‘চ্যালেঞ্জ’ইত্যাদির একটা ‘নিউজ ভ্যালু’ আছে, অর্থাৎ ‘পাঠক-পাঠিকারা খায় ভাল’ তাই ‘চ্যালেঞ্জ’ আমাদের অন্যান্য কাজ-কর্মের চেয়ে অনেক বেশি প্রচারের আলোয় এনেছে ।

আরও একটি ‘হাঁসজারু’ মজার মার্কা বৈপরীত্য ভারতীয় CSICOP -র কাজকর্মে লক্ষ করলেন আন্দোলন সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মীরা। অতি বিপ্লবীর মুখোশের আড়ালে CSICOP -র ঠিকা নেওয়া প্রতিবিপ্লবী পত্রিকাগোষ্ঠী সোচ্চারে ঘোষণায় মাতলেন—জেমস র‍্যান্ডি, মার্ক প্লামার, বি. প্রেমানন্দের নেতৃত্বে তাঁরা ভারতবর্ষে বিপ্লব আনবেন। এরই পাশাপাশি আরও দুটি পরস্পরবিরোধী কথা ঘোষণা করলেন— অবতার ও জ্যোতিষীদের প্রতি কোভুরের জানানো চ্যালেঞ্জ ‘মহান’ এবং প্রবীর ঘোষের জানানো চ্যালেঞ্জ ‘অশোভন’, ‘সস্তা চমক’। এঁদের এমন স্ববিরোধিতা ও যুক্তিহীনতার পিছনে দুটি সম্ভাবনা স্পষ্টতর। এক : তীব্র ঈর্ষাকাতরতা স্বাভাবিক যুক্তিকে গুলিয়ে দিয়েছে। দুই : বিদেশি সাহায্যকারীরা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে যে যোগ্য ও অপরিহার্য মানুষদেরই বেছে নিয়েছেন, এই বিষয়ে তাঁরা যে সর্বোত্তম, এমনটা প্রমাণ করতে গিয়ে উচ্ছ্বাস মাত্রা ছাড়িয়েছে। এমনও হতে পারে, দুটো কারণই একই সঙ্গে কাজ করেছে।

আমরা মনে করি এক-তরফাভাবে যুক্তিবাদী আলোচনায় সাধারণ মানুষের ওপর যতটা প্রভাব ফেলা যায়, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রভাব ফেলা যায় জ্যোতিষী, অবতার, অলৌকিক ক্ষমতাধর ও ভাববাদী দর্শনের প্রবক্তাদের মুখোমুখি হয়ে তাদের দাবির অসারতা প্রমাণ করতে পারলে। আমরা তাই বার বার জ্যোতিষীদের মুখোমুখি হয়েছি বেতারে, জ্যোতিষ সম্মেলনে, আলোচনাচক্রে। আমরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে হাজির হয়েছি আলোচনায়, আমাদের সমিতির আয়োজিত বিতর্কসভায় ধর্মের পক্ষে আমন্ত্রণ করে এনেছি স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, গৌরীনাথ শাস্ত্রী, ডঃ ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তীর মতো তাবড় ধর্মবেত্তাদের, আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে শ্রোতাদের সামনে আনতে পেরেছি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রথম শ্রেণির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের। এই সব বিতর্কগুলোতে বারবারই আমাদের দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব ও যৌক্তিকতা সংশয়াতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করেছি শত সহস্র দর্শকদের উপস্থিতিতে, সমাজপ্রতিষ্ঠিতদের উপস্থিতিতে। আমরা প্রতিটি অলৌকিক ক্ষমতাবান ও জ্যোতিষীদের মুখোমুখি হয়েছি তাদের দাবির অসারতা প্রমাণ করতে চাই। এ-পথে তাঁরা কিছুতেই এগোতে চাইবেন না, যাঁদের আত্মপ্রত্যয়ের অভাব আছে, যাঁদের অনেক জায়গায়ই হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নিজেদের খামতিকে আড়াল করতে তাই গোয়েবেলসের কায়দায় প্রচারে নেমে পড়েন অক্ষমরা। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর পাগল মেহের আলির মতোই রেকর্ড বাজিয়েই চলেন—‘চ্যালেঞ্জ-ট্যালেঞ্জ সব ফালতু হ্যায়’।

এই সময়টা ছিল আমাদের গড়ে ওঠার সময়, আন্দোলনকে পরিকল্পিত রূপ দেবার লক্ষ্যে সংগঠনকে বার বার ঠিক-ঠাক করে গুছিয়ে নেওয়ার সময়। এই সময় বহু ব্যক্তি ও সংস্থা বিভিন্ন তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা পেতে আমাদের সাহায্য চেয়েছেন, এবং আমরা আন্তরিকতার সঙ্গেই তাঁদের সাহায্য করেছি। যে ব্যক্তি ও সংস্থা আমাদের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রেই অসহযোগিতা করেছেন, তাঁরাও যখনই কোনও তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়েছেন অথবা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন—আমরা সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছি। আমরা এইসময় বহু সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা করেছি অলৌকিক বিরোধী, কুসংস্কার বিরোধী ছোট ছোট নাটক তৈরি করতে। এর মধ্যে বেশ কিছু নাটক তৈরি হয়েছিল এমনভাবে যাতে প্রয়োজনে যেই অলৌকিক রহস্য উন্মোচন নিয়ে কাহিনি, সেই অলৌকিক রহস্যই পালটে দেওয়া যায় । পাল্টে দেওয়াও হত—যে অঞ্চলে নাটক করতে যাওয়া, সেই অঞ্চলের ওঝা-গুনিন, জানগুরু বা ভগবানের সাক্ষাৎ এজেন্টদের যে-সব চমৎকারিত্বের খবর পাওয়া যেত, সেইসব চমৎকারিত্বের রহস্য ফাঁস করার স্বার্থে । এমনই নাটক ‘আগুনবাবা” ‘চমৎকারবাবা’, ‘বাবা ঢপেশ্বরানন্দ’, ‘ডাইন’, ‘জান-ডান’, ‘জ্যোতিষী ঢপানন্দ’, ‘ঠগ’, ‘চিচিংফাক’, ‘টেলিপ্যাথি’, আরও কত কী।

আমাদের সমিতি বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে হাজির হতে লাগল একটু নতুন ভাবে—এইসব গ্রামের মধ্যে আদিবাসীপল্লিও পড়ে। আমরা যখনই যাই তার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই স্থানীয় অনেকটা অঞ্চল জুড়ে যত ভরাবিষ্ট, অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদার, ভবিষ্যৎবক্তা, জানগুরু, সখা, সৎসখা, দিখলি, ওঝা আছে তাদের বিষয়ে খবর নিই—তারা কী কী ধরনের অলৌকিক ক্ষমতার (?) অধিকারী, অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ফলে আশ-পাশের গাঁয়ের মানুষ নানা অলৌকিক ঘটনা দেখার উৎসাহে হাজির হন। স্থানীয় অলৌকিক ক্ষমতাবানদের এতদিন ধরে ঘটানো ঘটনাগুলোই আমাদের সমিতির সভ্য-সভ্যারা অনুষ্ঠানে ঘটিয়ে দেখান। ঘটনাগুলো দেখাবার পর বোঝান—এগুলো ঘটাতে কোনও অলৌকিক ক্ষমতা লাগে না, লাগে কৌশল। আমরা বলি-আপনারাও যে কেউ চেষ্টা করলেই এমনটা ঘটাতে পারবেন, তারপর দর্শকদের দিয়েও ঘটনাগুলো ঘটানো হতে থাকে। উৎসাহী পল্লিবাসীরা হুড়মুড় করে এগিয়ে আসতে থাকেন। অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই প্রত্যয় বহু মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়—এতদিনকার দেখা তথাকথিত অলৌকিক ঘটনা তাঁরাও ঘটাতে পারেন, বন্ধ করে দিতে পারেন ওইসব চমৎকারবাবাদের চমৎকারিত্ব।

*আরও একটা কাজও আমরা করি। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা প্রকাশ্যে এবং ব্যাপক প্রচার চালিয়েই স্থানীয় অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসেন। চ্যালেঞ্জের জবাবে কেউ হাজির হলে তাঁরা প্রতিটি ক্ষেত্রে অবশ্যই পরাজিত হন উপস্থিত দশ-বিশটা গাঁয়ের মানুষদের সামনেই। আর হাজির না হলে গ্রামবাসীদের ওপর অনুপস্থিত অলৌকিক ক্ষমতাধরদের প্রভাব প্রচণ্ড রকম ভাবে কমে যায়। ওঝা, জানগুরু, সখা জাতীয় অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের বুজরুকি বন্ধ হলে ডাইনি চিহ্নিত করার কাজও বন্ধ হয়, কারণ এরাই ডাইনি চিহ্নিত করে।

এরই পাশাপাশি আমরা বোঝাতে থাকি ওদের ভ্রান্ত চিন্তা-ভাবনার সুযোগ নিয়ে কী ভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

আমরা দেখলাম—আমরা যুক্তিবাদীরা বাড়ছি। প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে বেড়েই চলেছি। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে সন্ধান পেলাম এক অমোঘ সত্যের-

অনুকূল পরিবেশের সাহায্য পেলে ইতিহাসের অনিবার্য গতি

বিশ্বাসের বিপরীতে যুক্তির অভিমুখে। অর্থাৎ মানুষের সামনে

প্রকৃত সত্যকে জানানোর সুযোগ করে দিলে, সুযুক্তির সঙ্গে

পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিলে সাধারণভাবে মানুষ

তা গ্রহণ করে। অতএব আমরা যদি আরও বেশি

করে বিভিন্ন ভাবে সুযুক্তি সৃষ্টিতে এগিয়ে

আসি, তার ফলশ্রুতিতে এক নতুন

চিন্তাধারার পরিমণ্ডল

সৃষ্টি হবেই।

মানুষকে নিয়েই সমাজ। একটি মানুষের চিন্তা, মনন, দর্শন, ভাবাদর্শ ইত্যাদি মানুষকে প্রভাবিত করে। ওই চিন্তাশীল মানুষটির মনন, দর্শন কথার মাধ্যমে অথবা গ্রন্থ-পত্র-পত্রিকা মারফত, অথবা অন্য কোনও প্রচার মাধ্যম, গণমাধ্যম, গণসংগঠন ইত্যাদির দ্বারা প্রচারিত হলে বহু মানুষই প্রভাবিত, সঞ্জীবিত ও উজ্জীবিত হন। উজ্জীবিত মানুষদের ভাবাদর্শের সক্রিয়তা আনে সমাজের প্রগতি।

‘অর্থনীতিই সমাজের একমাত্র নিয়ামক শক্তি’—এমন কথা কিছু কিছু মার্কসবাদী প্রচার করে থাকেন। এইসব তথাকথিত মার্কসবাদীদের জ্ঞানের অভাব, বোধশক্তির অভাব এবং না জেনে জ্ঞানী সাজার বিকট প্রবণতাই আজ মার্কসীয় চিন্তাধারা প্রসারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিতে এমন প্রয়োজনাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের প্রবণতার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে স্বয়ং এঙ্গেলস আত্মসমালোচনা করে বলেছেন, “তরুণরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটির প্রতি যে প্রয়োজনাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করছে, তার জন্য আংশিকভাবে মার্কস ও আমিই দায়ী। আমাদের শত্রুরা, যারা এই মূলনীতিকে অস্বীকার করেছিল, তাদের দিকে লক্ষ রেখে আমরা এই নীতির ওপর একটু বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাছাড়া আমাদের এমন সময় সুযোগ ও স্থান সব সময় ছিল না যে এই পারস্পরিক প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপাদানগুলিকে তাদের যথোপযুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।” (এঙ্গেলস : সিলেকটেড ওয়ার্কস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৩)।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংগঠিত করার স্বার্থেই আমাদের আজ বাস্তব সত্যকে অনুধাবন করতেই হবে। সত্যটা এই : শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা, সংগীত, নৃত্য, নাটক, ধর্ম, দর্শন, সংস্কার, অন্ধ-বিশ্বাস, জাত-পাত ও ভাষাভিত্তিক বিভেদ, রাজনীতি, আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রের বিকাশধারা অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বিকাশধারা ও অর্থনীতির বিকাশধারার উপরই যদিও ভিত্তিশীল, কিন্তু এরা সকলেই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরেও প্রভাব বিস্তার করে, প্রতিক্রিয়া বিস্তার করে। এটা কখনই ঠিক নয় যে-অর্থনৈতিক অবস্থাই সমাজের সাংস্কৃতিক ধারাগুলির একমাত্র নিয়ন্ত্রক, একমাত্র ভিত্তি এবং একাই সক্রিয়, আর অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি অর্থাৎ উপরিসৌধের বিভিন্ন উপাদানগুলো নিষ্ক্রিয় ।

দর্শন, চিন্তা একদিকে যেমন সমাজের অগ্রগতি সাধন করে, আবার অনুরূপভাবে সমাজকে পশ্চাদগামীও করতে পারে। দর্শন বা চিন্তা কী ভূমিকা নেবে তা নির্ভর করে ওই দর্শন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে কতটা সুরক্ষিত করে, কতটা প্রগতিশীল অথবা কতটা প্রতিক্রিয়াশীল করে, তার ওপরে।

আবার এও সত্যি—একটা দর্শন, একটা ভাবাদর্শ যতই প্রগতিশীল হোক না. কেন, একমাত্র প্রগতিশীলতার গুণদ্বারাই পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়তে সক্ষম হবে না। ভাবাদর্শ শুধুমাত্র তখনই সক্রিয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে পুরাতনের মলিনতাকে ভাসিয়ে নিয়ে সুন্দর কিছু সৃষ্টিতে সক্ষম হবে যখন সেই ভাবাদর্শ জনগণের মনকে আকর্ষণ করতে পারবে। অর্থাৎ প্রগতিশীল ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ জনগণই একটা সামাজিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে, একটা সুন্দর প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা গড়তে পারে।

ভ্রান্ত-চিন্তায় আচ্ছন্ন মানুষ, মুখোশধারী মানুষ যখন ব্যাপক প্রচারে প্রগতিশীল বলে প্রচারিত হন, তখন তাঁদের চিন্তা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে সমাজকে পশ্চাদগামীই করে। তাই সুন্দর সমাজ গড়ার স্বার্থেই ভ্রান্ত-চিন্তা প্রভাবিত অথবা মুখোশআঁটা তথাকথিত প্রগতিবাদীদের চিহ্নিত করা একান্তই প্রয়োজন। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার স্বার্থে, যুক্তিবাদী দর্শন প্রচারের স্বার্থে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বার্থে, শোষিত মানুষের শৃঙ্খলমুক্তির স্বার্থে মেকী প্রগতিশীলদের চিহ্নিত ও বিচ্ছিন্ন করা একান্তভাবেই প্রয়োজন। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার স্বার্থে মেকী প্রগতিশীলদের চিহ্নিত ও বিচ্ছিন্ন করা একান্তভাবেই প্রয়োজন। কারণ চেনা শত্রুর চেয়ে এই মুখোশধারীদের শত্রুতা বহুগুণ বেশি ক্ষতিকারক। আমরা সরব হলাম ডাইনি প্রথা বিরোধী জনপ্রিয়তম সমাজ সচেতনতার দাবিদার বুদ্ধিজীবী ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, অসিতবরণ চৌধুরী, গুরুচরণ মুর্মু প্রমুখের বিরুদ্ধে যাঁরা বিশ্বাস করেন ডাইনিদের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে; ডাইনিবিদ্যার অপকারিতা বিষয়ে ডাইনিদের সচেতন করা প্রয়োজন ; জানগুরুদের অলৌকিক কাজকর্ম বন্ধ করতে হলে তাদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা একান্তই প্রয়োজনীয়।

বুঝুন সরকারি ছত্রছায়ায় ও বদান্যতায় প্রতিপালিত আদিবাসী অন্তপ্রাণ, ডাইনি বিরোধী প্রথার নেতাদের চিন্তা-চেতনা যদি এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভারাক্রান্ত হয়, তবে আদিবাসীরা তাদের রোগের ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডাইনিদের অহিতকর অলৌকিক ক্ষমতাকে দায়ী করবে—এটাই তো স্বাভাবিক ৷

‘৮৭-তে ভারতবর্ষের প্রান্ত থেকে ছাব্বিশটি বিজ্ঞান সংগঠন একসঙ্গে মাসাধিককালব্যাপী সারা ভারত জন-বিজ্ঞান জাঠার আয়োজন করেছিলেন। দেশের পাঁচটি ভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঁচটি আঞ্চলিক জাঠা মোট প্রায় পঁচিশ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে, বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তুলতে যে সব বিষয় জাঠা বেছে নিয়েছিল সেগুলো হলঃ স্বনির্ভরতা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, জন-বিজ্ঞান আন্দোলন, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের নানাক্ষেত্র, বিজ্ঞান ও ভারতবর্ষ, স্বাস্থ্য ও ঔষধ, পরিবেশ দূষণ, জল, গৃহ, শিল্পক্ষেত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শান্তি।

না, মানুষের কুসংস্কার বিষয়ের কোনও স্থান ছিল না জাঠার বিষয়গুলোর মধ্যে। বিপুল অর্থব্যয়ের এই জন-বিজ্ঞান জাঠা তাদের কাছে এগিয়ে আসা শোষিত অন্ধ-সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষগুলোকে বিজ্ঞানমনস্ক করার চেষ্টা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিল। পশ্চিমবাংলার কিছু কিছু জায়গায় অবতারদের কিছু কিছু কৌশল সাধারণ মানুষদের কাছে ফাঁস করার অনুষ্ঠান হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো হয়েছিল নেহাতই হালকা চালে, সাধারণ মানুষকে ম্যাজিক দেখাবার মতো করে, অবসর বিনোদনের অনুষ্ঠানের মতো করে। পশ্চিমবঙ্গে এই জাঠা ছিল ধর্ম ও জ্যোতিষ বিশ্বাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে। ২ অক্টোবর মালদায় জাঠা উদ্বোধন করলেন এমন এক বিজ্ঞানী যাঁর নাম আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখেছি ধর্মানুষ্ঠান, ভাগবতপাঠের আসর, অবতারের জন্মদিন, ইত্যাদি অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে। ৭ অক্টোবর কলকাতার টালাপার্কে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান-জাঠার এক অনুষ্ঠানে একটি পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। জনৈক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ‘শক্তি’ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুতেই বললেন, ‘যবে থেকে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি….।’ বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই সভার গুঞ্জনে সচেতন হয়ে উঠলেন। বক্তব্য পাল্টে বললেন….. ‘অবশ্য আমরা বিবর্তনবাদে পড়েছি কেমন করে মানুষ এল…।’ জাঠার উত্তর কলকাতা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি দাপটে বিজ্ঞান সভার পরিচালনা করলেন, দু’হাতের আঙুলে গোটা চার-পাঁচেক গ্রহরত্নের আংটি ধারণ করে।

আমাদের সংগঠনের তরফ থেকে একটি মুখপত্র প্রকাশ জরুরি বলে যখন প্রস্তাব এল, তখন আমরা সমস্যাটাকে একটু অন্য ভাবে চিন্তা করলাম। সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের এ-কথাই মনে হয়েছিল, আমরা প্রথম থেকেই আমাদের মুখপত্র ‘যুক্তিবাদী’ প্রকাশ করতে থাকলে আমাদের সহযোগী সহযোদ্ধা বহু সংগঠন ও শাখা সংগঠন নিজের উদ্যোগে কোনও মুখপত্র প্রকাশ করার বিষয়ে উৎসাহ হারাবে এবং আমাদের পত্রিকার ও আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপরই বেশি রকম নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আমরা ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকার প্রকাশ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরিবর্তে আমরা উৎসাহিত করলাম বিভিন্ন সংগঠন, সহযোগী সংস্থা ও শাখা সংগঠনগুলোকে যাতে তাঁরা নিজেরাই যুক্তিবাদী চিন্তাধারা প্রসারে পত্র-পত্রিকা ও বই প্রকাশে এগিয়ে আসেন। আমরা বিভিন্ন সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরাসরি অথবা চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করে আমাদের বক্তব্য আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে ধরলাম। বললাম, আমরা সকলেই একই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় যখন নিবেদিত প্রাণ, তখন আসুন, আমরা সকলেই একই সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের প্রভাব থেকে জনগণকে মুক্ত করার কাজে সম্মিলিত হই।

যুক্তিবাদী চিন্তাধারার ব্যাপ্তি চাইলে ভাববাদী চিন্তার সমাপ্তি

চাইতেই হবে। আজ বোঝার সময় এসেছে, শোষিত

মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার যুক্তিবাদী চিন্তার

প্রবলতম শত্রু তথাকথিত ধর্ম, অধ্যাত্মবাদ,

বিশ্বাসবাদ ইত্যাদি অর্থাৎ সামগ্রিক

ভাবে ভাববাদী দর্শন।

তথাকথিত ধর্মের যুক্তি-বিরোধী স্বরূপকে যুক্তিযুক্তভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে না পারলে কুসংস্কার মুক্তির, হুজুর-মজুর সম্পর্ক অবসানের কল্পনা শুধুমাত্র কল্পনাই থেকে যাবে। কল্পনাকে বাস্তবরূপ দিতে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেই অনেক কিছু করতে পারি ।

আমরা আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে নিশ্চয়ই কুসংস্কারবিরোধী বুলেটিন, বই, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি প্রকাশ করতেই পারি, তা সে যত কৃশ কলেবরের বা হাতে লেখাই হোক না কেন। আমাদের মধ্যে যাঁরা চেষ্টা করলে কিছু লিখতে পারি, আসুন না তাঁরা সাধারণের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে সাধ্য-মতো কলম ধরি সংস্কার মুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে। এই জাতীয় লেখার বিষয়ের তো শেষ নেই। শেষ কথা তো কোনও দিনই বলা হবে না বা লেখা হবে না। যুক্তিবাদ এগোবে, প্রতিটি স্তরের যুক্তিবাদের পাশাপাশি ভাববাদী দর্শনও যুক্তিবাদকে রোখার স্বার্থে পাল্টাবে; এগোবে নতুন নতুন রূপে।

শত-সহস্র বছর ধরে আমরা ভাববাদী সাহিত্য, নাটক, শিল্প ইত্যাদি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই বেড়ে উঠছি। সেই পরিমণ্ডলের বাঁধন থেকে মুক্ত করতে চাই যুক্তিবাদী মুক্ত-চিন্তার এক পরিমণ্ডল। এর জন্য সাহিত্য, সংগীত, নাটক ইত্যাদিতে চাই ভাববাদী চিন্তার বিরোধিতা, যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসার। এর জন্য চাই বেশি বেশি করে ভাববাদ বিরোধী বই ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হোক, রচিত হোক সংগীত, নাটক শিল্প ।

বহু সংস্থা ও ব্যক্তি এ-বিষয়ে এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের সাধ্যমতো বিজ্ঞানমনস্ক বই ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করছেন, যদিও বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পক্ষে বর্তমানের এই সামগ্রিক প্রচেষ্টাও প্রয়োজনের তুলনায় যৎ-সামান্য। তবুও যুক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা হিসেবে প্রচণ্ড রকমের আশাব্যঞ্জক। আশা রাখি, নতুন চেতনার পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে আরও বেশি বেশি করে মানুষ ও সংস্থা এগিয়ে আসবেন এবং তাঁদের সাধ্যমতো নিজেদের ভূমিকা পালন করবেন।

আমাদের সমিতি মনে করে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনও ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন এবং আন্দোলনকর্মীদের বিশ্লেষণ-পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সঠিক নির্দেশ পাঠাচ্ছেন বলে অন্যান্য সহযোগী সংগঠন ও আন্দোলনকর্মীরা যদি নেতৃত্ব দানকারী সংস্থা বা ব্যক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে নিশ্চেষ্ট থাকে, তবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন শুধুমাত্র স্বপ্নই থেকে যাবে। কারণ শোষক ও শাসকদের স্বার্থরক্ষাকারী ভাববাদী দর্শনের ওপর সাংস্কৃতিককর্মীদের আক্রমণ যখন তীব্রতর হবে তখন শোষক শ্রেণি-স্বার্থ বা রাষ্ট্রশক্তি কঠিন প্রত্যাঘাত হানবে । এরা আন্দোলনের মূল উৎপাটন করতে নেতৃত্বদানকারী সংস্থা ও ব্যক্তিদেরই চিহ্নিত করে তাদের উপরও সর্বপ্রকার নিষ্ঠুর আক্রমণ চালাবে। এই জাতীয় আক্রমণে কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি শেষ হয়ে গেলেই যাতে আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে না যায় তারই জন্য প্রতিটি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সংস্থার যতদূর সম্ভব স্বাবলম্বী হওয়া একান্তই প্রয়োজন। এমনকী হতে পারলে, শোষক শ্রেণি ও রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে আন্দোলনের নেতৃত্বকে আঘাত হেনে আন্দোলন শেষ করে দেওয়ার প্রচলিত পদ্ধতি ব্যর্থ হতে বাধ্য।

আমরা চাইলাম, আন্তরিকভাবেই চাইলাম প্রতিটি আন্দোলনকর্মী এক একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ নেতা হিসেবে নিজেদের নিজেদের গড়ে তুলুন।

নেতা তিনি, যিনি নিজে যে কোনও ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ

করতে পারেন এবং আন্দোলনকর্মীদের বিশ্লেষণ পরবর্তী

করণীয় বিষয়ে নির্দেশ দিতে সক্ষম। এরই পাশাপাশি

নেতাকে হতে হবে সৎ, আবেগহীন, আত্মবিশ্বাসী,

বিনয়ী, জনসাধারণের সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে

মিশতে সক্ষম, আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও

লক্ষ্য বিষয়ে সচেতন ও

কৌশলগত বিষয়ে

ওয়াকিবহাল।

আন্দোলন কর্মীদের মধ্যে ভালো নেতার গুণগুলো জাগরিত হোক, নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বেশি বেশি করে মানুষ উঠে আসুক—সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বার্থেই আমরা এমন প্রয়োজনীয়তার কথা ভীষণভাবে অনুভব করেছিলাম। তাই ‘স্টাডি ক্লাস’-এর ওপর আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করলাম। একই সঙ্গে আমরা আমাদের সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্যদের সভায় খোলা-মেলা আলোচনা ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের চ্যুতি ভ্রান্তি বা বিপথগামিতার ক্ষেত্রে সদস্যদের মুখ খুলতে অনুপ্রাণিত করলাম। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের দেখে অন্যান্য গণসংগঠনের কর্মীরাও নেতাদের চ্যুতি, ভ্ৰান্তি বা বিপথগামিতার বিরুদ্ধে মুখ খুলুন। গণসংগঠনসর্বস্ব আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই নেতারা লোভ বা ভয়ের কাছে বিক্রি করে দেন আদর্শ, আন্দোলন ও সংস্থাকে। আন্দোলনকর্মীরাই পারেন নেতৃত্বকে সঠিক পথে চলার জন্য বাধ্য করতে, আদর্শচ্যুত নেতাদের বিচ্ছিন্ন করতে।

নিজেদের সংগঠনের কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রয়াস আমরা গ্রহণ করেছিলাম, যে দৃষ্টান্তের দ্বারা অন্যান্য আন্দোলনকারীদের প্রভাবিত করতে চেয়েছিলাম, সে প্রচেষ্টা বাস্তবিকই সার্থক রূপ পেয়েছিল। এমন শিক্ষণীয় পরিমণ্ডল প্রস্তুতির ফল পেয়েছিলাম হাতে-হাতে। প্রচুর নতুন নতুন ছেলে-মেয়েকে আমরা নেতা হিসেবে পেলাম। এ-বছরই কিছু সংগঠনকে আমরা সহযোগী হিসেবে, সংগ্রামের সাথী হিসেবে পেলাম, যাঁরা তাঁদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সরব হয়ে নেতাদের বাধ্য করেছেন CSICOP -অথবা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি পরিত্যাগ করে আমাদের সমিতির সঙ্গে অর্থাৎ মূল যুক্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামে নামতে ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেকি আন্দোলনের নেতাদের বিচ্ছিন্ন করে তাঁদের সংগঠনকে আমাদের সংগ্রামের সাথী করেছেন আন্দোলনকর্মীরা-এও আমরা দেখলাম । শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলো যখন পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট লাইব্রেরি-ক্লাব-স্কুল-পুজোকমিটিগুলোকে যেন-তেন-প্রকারেণ দখলে আনতে অতিমাত্রায় সচেষ্ট, তখন আমাদের মতো একটি জনপ্রভাবসৃষ্টিকারী সংগঠনকে দখলে আনতে চাইবেই—এটা আমাদের অজানা ছিল না। আমাদের সমিতির কয়েকজন নেতাকে এজেন্ট হিসেবে কাজেও লাগিয়ে দিল এক বিশাল রাজনৈতিক দল। পদ, চাকরি ও অর্থের লোভে ষড়যন্ত্র করলেন—আমাদের সমিতিকে ওই রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত করতে। ওইসব লোভী আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতক নেতা ও রাজনৈতিক দলের যুক্ত যড়যন্ত্র সে-দিন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন আমাদের সমিতির সচেতন কর্মীরাই। তাঁরা বিচ্যুত নেতাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যেভাবে সমালোচনা করে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন তা এক ইতিহাস। যে দলের রাজনৈতিক থাবা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, আই.এফ.এ., ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড কোনও কিছুই নিস্তার পায় না, সেখানে রাজনীতিকদের নখ-দন্তকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলার মধ্য দিয়ে অভাবনীয় জয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল আন্দোলনকর্মীদের সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনন্য মানসিকতা থেকে।

১৯৮৮-র ১১ ডিসেম্বর আমরা এক ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলাম, যার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সমগ্র দেশ জুড়ে। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে আহবান জানানো হয়েছিল ডাইনি সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তী, ‘শিক্ষা আশ্রম ইন্টারন্যশনাল’–এর সাঁই শিষ্য উপাচার্য ও হস্তরেখাবিদ নরেন্দ্রনাথ মাহাতো’কে।

ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তীর নানা অলৌকিক ক্ষমতার পক্ষে ভারতের পত্র-পত্রিকায় প্রচার তখন তুঙ্গে। সে সময় ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি প্রচার পাওয়া মানুষটি ছিলেন সম্ভবত এই ঈপ্সিতা। মন্ট্রিয়লে শিক্ষা ও ডাইনি হিসেবে দীক্ষা পাওয়ার পর ‘ওয়ার্ল্ড উইচ ফেডারেশন’–এর সর্বোচ্চ পদাধিকারী হয়ে বসেন। মারণ-উচাটন মন্ত্র, রোগ মুক্তি ও মানুষ দেখলেই তার নাড়ি-নক্ষত্রের খবর জানার মধ্যেই প্রধানত গণ্ডিবদ্ধ ছিল তার অলৌকিক ক্ষমতার প্রচার। এই সময় ঈপ্সিতার সঙ্গে ভিন্ন পরিচয়ে তবে সাংবাদিক হিসেবেই দেখা করি। তাঁর অলৌকিক দু-টি ক্ষমতার সে পরিচয় বিভিন্ন সাংবাদিকদের কাছে হাজির করতেন, সে দুটি আমার কাছে হাজির করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় তাঁর গোপন ক্ষমতার প্রকৃত রহস্য। ‘৮৮-র ১২ আগস্ট ‘আজকাল’ পত্রিকায় আধ-পাতা জুড়ে ছবিসহ ঈপ্সিতার অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। খবরটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পাঠক-পাঠিকারা প্রচণ্ডভাবে নাড়া খেলেও ভাষার প্রতিবন্ধকতার জন্য সর্বভারতীয় ভিত্তিতে আমরা সে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারিনি। ঈপ্সিতার বিরুদ্ধে প্রচারের ঝড় তুলতেই আমরা পরিকল্পিতভাবে ঈপ্সিতার অলৌকিক ক্ষমতা সাংবাদিকদের সামনে প্রমাণ করতে চ্যালেঞ্জ জানালাম। জানতাম, সাংবাদিকদের সামনে যে কৌশলের সাহায্য নেওয়া ডাইনি সম্রাজ্ঞীর পক্ষে সম্ভব ছিল, তা আমাদের সমিতির সামনে অসম্ভব।

উপাচার্য ও শ্রীমাহাতো সরাসরি আমাকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে সেই চ্যালেঞ্জ সানন্দে গ্রহণ করে চিঠি দিই ও ওই সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁদের ক্ষমতা প্রমাণের জন্য উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানাই।

উপাচার্যের চ্যালেঞ্জটি ছিল খুবই কৌতূহল জাগানো। তিনি জানিয়েছিলেন, স্রেফ সাঁইবাবার বিভূতি খাইয়ে সাঁইবাবার অপার অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দেবেন। বিভূতি খাওয়ার তিন দিনের মধ্যে আমার পেটে তৈরি হবে ছয় থেকে এগারোটি স্বর্ণমুদ্রা। চতুর্থদিন অপারেশন করলেই ওগুলো পেট থেকে হাতের মুঠোয় চলে আসবে।

হস্তরেখাবিদ নরেন্দ্র মাহাতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন—তিনি প্রমাণ করে দেবেন হস্তরেখা-বিদ্যা বিজ্ঞান।

আমরা যুক্তিবাদী। কেউ তাঁর দাবির সপক্ষে প্রমাণ হাজির করলে নিশ্চয়ই মেনে নেব। অতএব ওই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থেকে দাবি প্রমাণে উদ্যোগী হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম নরেন্দ্রনাথ মাহাতোকে ।

এমন এক সাংবাদিক সম্মেলনের গুরুত্ব অনুধাবন করে অনেক পত্রিকাই এই অভাবনীয় সাংবাদিক সম্মেলনের কথা প্রকাশ করছিলেন সম্মেলনের কয়েক দিন আগে বাড়তি গুরুত্ব সহকারে। সাংবাদিক সম্মেলনের দিন ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ প্রথম পৃষ্ঠায় চার কলম জুড়ে ছবি-সহ বিশাল করে এক সম্ভাব্য দারুণ লড়াইয়ের খবর ছাপল। ১১ তারিখ শেষ পর্যন্ত তিন অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারই হাজির হলেন না। ফলে যা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা হল, সাংবাদিক সম্মেলন বাতিল। পরিবর্তে সেদিন সাংবাদিকদের সামনে ওই তিন অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদার-সহ আরও অনেক বিখ্যাত তথাকথিত অবতারদের ঘটানো নানা বুজরুকি ম্যাজিক হাজির করলাম। আড়াই ঘণ্টার ম্যারাথন সাংবাদিক সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলাম ভারতব্যাপী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রচণ্ড গুরুত্ব সহকারে এবং বহু ক্ষেত্রেই ছবি সহ খবরটি পরিবেশিত হল । সম্পাদকীয় লিখলেন আনন্দবাজার ও বসুমতী। চিঠি-পত্রে এই নিয়ে বিতর্কও চলল কয়েক মাস ধরে। জনগণকে উজ্জীবিত ও আন্দোলিত করার ক্ষেত্রে ঘটনাটি যথেষ্টই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

সে দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। ‘কিশোর যুক্তিবাদী’ নামে একটি পত্রিকা সে-দিন প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর মনে যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসারকল্পে। সম্পাদনা করেছিল আমাদের সমিতির কিশোর সদস্য পিনাকী ঘোষ ।

 

পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেসঃ
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো

১৯৮৯-এর মার্চে দ্বিতীয় ‘পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেস’-এর অধিবেশন বসল কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণ এবং বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপে গড়ে ওঠা এই পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়ায় কিছু আর্থিক দায়-দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকার গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রশক্তি অর্থাৎ সরকারের পরিকল্পিত বিজ্ঞান আন্দোলন যেমনটি হওয়া উচিত ‘পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেস’ ছিল তেমনটি বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তোলার একটি প্রয়াস। যুক্তিবাদী আন্দোলন, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার যে আন্দোলন ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭’র মধ্যে ব্যাপকতা পেতে শুরু করেছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তিবাদী সমিতির নেতৃত্বে বা সহযোগিতায়, সেই আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে CSICOP-র বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ হল ‘এই পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেস’। এই সরকারি আন্দোলনের স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল-বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াকেই বিজ্ঞান আন্দোলনের লক্ষ্য বলে প্রতিষ্ঠা করা। তাই এমন এক বিজ্ঞান কংগ্রেসে আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্বনির্ভরতা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পরিবেশদূষণ জল সমস্যা, বাসগৃহ সমস্যা, ইত্যাদি থাকলেও ‘বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়া’, ‘যুক্তিবাদী মানুষ গড়া’ ইত্যাদি আলোচ্য বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ছাড়পত্র পায়নি। অবশ্য না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকারি পয়সায় সরকার নিজেদের ভিটে-মাটি ছাড়ার ব্যবস্থা করতে শোষিত মানুষদের বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তুলবে— এমন আহাম্মক চিন্তা আমি বা কোনও যুক্তিবাদী মানুষই করবেন না ।

দ্বিতীয় পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেসে আমাদের সমিতি আমন্ত্রণ পেয়েছিল। অধিবেশনে আমাদের সমিতির বক্তব্য ছিল অতি স্পষ্ট এবং সরকারি ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত আন্দোলনকারীদের মতের বিরোধী। আমাদের সমিতির বক্তব্য ছিল—বিজ্ঞান আন্দোলনের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পরিবেশ-দূষণ, জল সমস্যা, বাসগৃহ সমস্যা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে, আলোচনার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েই বলতে হচ্ছে, যে বিজ্ঞান আন্দোলনে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলন, কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলন, যুক্তিবাদী আন্দোলনের স্থান নেই, সেটা আর যাই হোক, বিজ্ঞান আন্দোলন নয়। পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেস বিজ্ঞান আন্দোলনের বিষয় হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু যুক্তিবাদী চেতনা গড়ার আন্দোলনকে পাশে সরিয়ে রেখে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা গড়ার আন্দোলন গাছের গোড়া কেটে আগায় জল দিয়ে সঞ্জীবিত করার ভণ্ড প্রয়াস ভিন্ন কিছু নয়। আমরা মনে করি বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার আন্দোলনকে বিজ্ঞান আন্দোলন বলে আপনারা যে সমবেত প্রচার চালাচ্ছেন, তা ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যমূলক। সরকারি প্রয়াসে এই আন্দোলন মেকী বিজ্ঞান আন্দোলন। বিজ্ঞান আন্দোলন রুখতেই এই সাজানো বিজ্ঞান আন্দোলন সরকার শুরু করেছেন। আজ যে সরকারি ও রাজনৈতিক দলের বিপুল অর্থানুকূল্যে আমাদের দেশের বড় বড় বিজ্ঞান আন্দোলনকারী সংস্থা কাজ-কর্ম করে চলেছে, কাল যদি সরকার গদি ওল্টায়, আপনারা কোথায় পাবেন সরকারি বিজ্ঞাপন, সরকারি অর্থসাহায্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা প্রাপ্ত বিজ্ঞাপনের অর্থ? বাস্তবিকই যদি আপনারা বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর মঙ্গলকামী হন, সমাজ-সচেতন হন, তবে আপনারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের স্বার্থে জন-আন্দোলন গড়ে তুলুন।

আমাদের বক্তব্যের জের টেনে বক্তব্য রাখলেন কেরলের ‘শাস্ত্রীয় সাহিত্য পরিষদ’-এর প্রতিনিধি। কেরল শাস্ত্রীয় সাহিত্য পরিষদ তখন কাগজে-কলমে ভারতের বৃহত্তম বিজ্ঞান আন্দোলনকারী সংগঠন। তাঁদের প্রতিনিধির কাছে প্রত্যাশা রাখা অন্যায় ছিল না, অগ্রজ হিসেবে অনুজদের দিশা দেখাবেন । এই প্রত্যাশাটা বিশেষত পশ্চিমবাংলার কিছু বিজ্ঞান আন্দোলনকারী সংগঠনের একটু বেশিই ছিল, কারণ কেরল শাস্ত্রীয় সাহিত্য পরিষদের নেতৃত্বের লাগামে ছিল সি.পি.আই.এম দলের হাতে, অতএব একটু বেশি রকমের প্রগতিশীল। তাঁদের প্রতিনিধি জানালেন—আমরা আপনাদের সমিতির কর্মধারা সম্পর্কে কিছু কিছু শুনেছি। আজ আপনাদের সমিতির বক্তব্যও শুনলাম। আপনারা কুসংস্কার মুক্ত করতে গিয়ে নিশ্চয়ই মানুষের নানা ধর্মীয় বিশ্বাসকেও আঘাত হানছেন? আপনারা কি এর ফলে সাধারণ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন না? সাধারণ মানুষই যদি আপনাদের সঙ্গে না থাকে, তবে কাদের নিয়ে আন্দোলন করবেন? কাদের জন্য আন্দোলন করবেন ?

ওঁর বক্তব্যের মাঝখানেই বলেছিলাম, আপনার যুক্তিকে ভুল ও অসার প্রমাণ করে আমরা, যুক্তিবাদীরা কিন্তু প্রতিটি দিনই বেড়েই চলেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, মানুষ সাধারণভাবে যুক্তিকে গ্রহণ করতেই ভালোবাসে। তারা ভালো যুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি বলেই খারাপ যুক্তিতেই আঁকড়ে আছে। ভাল যুক্তির সঙ্গে যখনই সাধারণ মানুষেরা পরিচিত হচ্ছে, তখনই তা গ্রহণ করছে। আমাদের কাজ সুযুক্তিগুলোর সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া। মাত্র কয়েকটা দিন আগে এখনকার এক অতিক্ষমতাধর বলে পরিচিত অবতার গৌতম ভারতী আমাকে আক্রমণের হুমকি দেন। দুর্বার জনরোধ আক্রমণকারীকে এমন জায়গায় ঠেলে নিয়ে গেছে যে মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে অবতার বাবা বোতল ভেঙে নিজের পেটে ঢুকিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এ-রকম বহু ঘটনার মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পেরেছি সঠিক যুক্তি থাকলে শেষ পর্যন্ত জন-সমর্থন আমাদের দিকে আসবেই। আর, বিচ্ছিন্নতার ভয়ে আপনি যে ভাবে পিছনে উপদেশ দিচ্ছেন সেই উপদেশ মান্য করে চললে রামমোহন সতীদার প্রধা বন্ধ করতে এগোতেন না, বিদ্যাসাগর এগোতেন না বিধবা বিহার প্রচলন করতে। পচন ধরা একটা সমাজে এই অগ্রগামী চিন্তার মানুষরা তো বিচ্ছিন্নই ছিলেন। কেরল শাস্ত্রীয় সাহিত্য পরিষদের প্রতিনিধি বললেন শুনে মনে হচ্ছে, এখানকার মানুষ চিন্তার দিক থেকে আমাদের কেরলের থেকে অনেক এগিয়ে আছেন, অথবা আপনাদের যুক্তিবাদী সমিতি এখানকার মানুষদের চিন্তাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের ওখানে আমরা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা ভাবতেই পারি না। আমাদের আপনার কথা পরিষদকে হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চান সব ধর্মের সভ্যদের নিয়েই চলতে হয় এবং হবে। আমাদের পক্ষে কারও ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত হানা অচিন্ত্যনীয়। তবে হ্যাঁ, আমরা এটা সদস্যদের বলি আপনারা পরিষদে ঢোকার আগে যার যার ধর্মীয় পতাকাগুলো বাইরে রেখে আসবেন। আমরা মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ার পক্ষে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী। আমাদের সমিতি তাই জনস্বাস্থ্য আন্দোলনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য আন্দোলন স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নতিতে সাহায্য করে। জনস্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে খাদ্য, পানীয় জল, বাসস্থান, পরিবেশ দূষণ রোধ, শিক্ষা ইত্যাদি। বলেছিলাম আপনি এবং আপনার পরিষদ বাস্তবিকই কী মনে করেন সরকারি সহযোগিতায় বিজ্ঞান আন্দোলন করে শোষিত মানুষদের সার্বিক দাবি-খাদ্য, পানীয় জল, বস্ত্র ও বাসস্থানের দাবি মেটাতে পারবেন? বাস্তবিকই সরকার জনগণের এই সার্বিক দাবিগুলো মেনে নেবেন বলে আপনারা মনে করেন? কী যুক্তিতে এমন অদ্ভুতুড়ে কথাগুলো আপনাদের কাছে সত্যি বলে মনে হল? আপনি যুক্তি দিয়ে আপনাদের বক্তব্যের বাস্তবতা প্রমাণ করতে পারলে আমরাও নিশ্চয়ই আপনাদের নেতৃত্বে আপনাদের আন্দোলনেরই শরিক হব— কারণ নিপীড়িত মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তিও আমাদের কাছে বিশালভাবেই কাম্য ।

না, পরিষদ প্রতিনিধি তার বক্তব্যের যুক্তিযুক্ততা প্রমাণে সামান্যতমও উৎসাহী ছিলেন না। এমন বক্তব্যে অস্বস্তিতে ছিলেন অনেকেই। তবু এরই মধ্যে বড় সংগঠনের বড় প্রতিনিধি বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা বিজ্ঞান আন্দোলনের নামে অনেক কিছু করলেও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার বিষয়টা সন্তর্পণে এড়িয়ে যেতে চান।

এপ্রিলে অনুষ্ঠিত যুক্তিবাদী সমিতির কার্যনির্বাহীদের সভায় দ্বিতীয় পিপলস্ সায়েন্স কংগ্রেস বিষয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করি। এই বিষয়ে আলোচনা শেষে কার্যনির্বাহীরা একমত হন যুক্তিবাদী আন্দোলন আমাদের সমিতির নেতৃত্বে সঠিক পথে এগুচ্ছে। আশাতীত দ্রুততার সঙ্গে যুক্তিবাদী চিন্তাধারা জনগণকে নাড়া দিতে শুরু করছে, জনগণের চিন্তা-চেতনাকে এগয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জনসাধারণ বুঝে নিতে শুরু করেছেন তাঁদের বঞ্চনার কারণ স্বর্গের ঈশ্বরের কোপ, পূর্বজন্মের কর্মফল বা আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নয়, কারণ এই

সমজেরই কিছু মানুষ। এই বুঝে নেওয়া ও না নেওয়ার উপরই নির্ভর করে জনবিক্ষোভ, জনসংগ্রাম, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের গদিতে টান বসায়।

ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষদের চেয়ে অনেক কম নিপীড়িত

মানুষরাও বহুদেশে শাসকদের গদি উল্টে দিয়েছে। সে-সব

দেশের জনগণের চেয়ে বহুগুণ বেশি শোষণ ও

বঞ্চনাকেও সংখ্যাগুরু ভারতীয়রা প্রতিবাদহীন

ভাবেই সহ্য করে আসছেন ভাগ্য ও

কর্মফলের দোহাই দিয়ে।

বঞ্চনার প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে অবহিত হলে, এবং সেই কারণ যেহেতু লৌকিক, অতএব প্রতিকারও সম্ভব- এই চেতনার উন্মেষ ঘটলে তার পরিণতিতে যে শাসকদের গদি উল্টোবেই, এই সত্যটা ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে শাসককুলের অজানা নয়। আর তাই শাসক ও শোষকদের সম্মিলিত পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলনকে প্রতিহত করতেই বিপুল সরকারি সাহায্যে গড়ে তোলা হয়েছে মেকি বিজ্ঞান আন্দোলন। যুক্তিবাদী আন্দোলনের স্বার্থে, শোষিত জনগণের স্বার্থে এইসব স্বার্থান্বেষী, বহুরূপী শাসক ও শোষকদের দালাল মেকি বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মীদের চিহ্নিত করা একান্তই প্রয়োজনীয়। এদের চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিটি সৎ বিজ্ঞান আন্দোলনকারীদের, সমাজ সচেতন সংস্থা ও ব্যক্তিদের। কারণ মুখোশধারীরা সব সময়ই মুখোশহীনদের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক।

 

গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্ৰঃ
জলেতে ডোবানো আছে বারুদভর্তি সিন্দুক

সি.পি.এম. নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাবগুলোকে নিজেদের দখলে আনার যখন চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন কিছু বিজ্ঞান ক্লাব ও বিজ্ঞান পত্রিকাগোষ্ঠী নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার তাগিদে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় গড়ার প্রয়োজনে সোদপুরে এক কনভেনশন ডাকলেন ১৯৮৯-এর ৮ জানুয়ারি। তারই সূত্র ধরে ’৮৯-এর ২২ ও ২৩ জুলাই কল্যাণীতে প্রথম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গঠিত হল ‘গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র’। উপস্থিত ২৩ টি সংগঠনের ২৩ জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হল সাধারণ পরিষদ। ঘোষিত কর্মসূচিতে বলা হল গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র চায়—একঃ মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানের প্রসার। দুইঃ কুসংস্কার ও জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তিনঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরদেশ-নির্ভরতা বন্ধের দাবি এবং জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে বিজ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগকে অগ্রাধিকার । চারঃ ভোগবাদী ক্রিয়াকর্মের সহায়ক রূপে বিজ্ঞানের ব্যবহারের বিরোধিতা করা। পাঁচঃ গণস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলা। ছয়ঃ পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস। সাতঃ যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন, পরীক্ষা ও প্রয়োগের বিরোধিতা করা। আটঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যাপক মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো। নয়ঃ বিজ্ঞান–প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রয়োগ ইত্যাদি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি জনগণকে নিয়মিত জানাতে হবে এই দাবি তোলা। দশঃ পরিবেশের — পক্ষে নিরাপদ এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এগারোঃ কৃষি, পশু-পক্ষী পালন, বনসৃজন, মৎস্যচাষ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজিনির্ভর প্রযুক্তির বিরোধিতা করা। বারোঃ কোনও প্রযুক্তি ‘সামাজিক বা পরিবেশের পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন না করলে তার বিরোধিতা করা। তেরোঃ উপরোক্ত কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গান, নাটক, গল্প, পোস্টার, স্লাইড ইত্যাদি তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। চোদ্দঃ সাধারণ মানুষকে গণবিজ্ঞান আন্দোলনে শামিল করতে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে ।

গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র ১৯৮৯-এর অক্টোবরে প্রকাশিত ‘রিপোর্ট ও সিদ্ধান্তবলি’তে জানান-সম্মেলনে কিছু বিতর্কিত বিষয় হাজির হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে কেন্দ্র সদস্য সংগঠনগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক চালিয়ে ঐক্যবদ্ধ মতামত তৈরির ধারাবাহিক প্রয়াস চালিয়ে যাবে। এই বিতর্কিত বিষয়ের মধ্যে ছিল ‘ধর্মাচরণ ও বিজ্ঞান আন্দোলনের সম্পর্ক’ এবং ‘বিজ্ঞান আন্দোলনে অন্যান্য ধারার সাথে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করা।

সমন্বয় কেন্দ্র বিজ্ঞান আন্দোলনের সেই সময়কার প্রধান দু’টি ধারা থেকে নিজেদের পৃথক সত্তা ও দূরত্ব বজায় রাখতে চাইল। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির চোখে বিজ্ঞান আন্দোলন হল বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষ গড়ার আন্দোলন, চেতনা মুক্তির আন্দোলন, যার মধ্য দিয়ে বঞ্চিত মানুষরা বঞ্চনা মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। এ আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যা সাবিক বিপ্লবের পক্ষে ভিত্তিভূমি এবং অপরিহার্য। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ চাইল ‘সবার জন্য বিজ্ঞান’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে জন-মানসে প্রতিষ্ঠা করা-বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধে পৌঁছে দেওয়াই বিজ্ঞান আন্দোলনের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত। গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র দু-নৌকায় পা দিয়ে চলতে চাইল।

আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কে শেষে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের নেতারা কী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, তারই সাক্ষ্য বহন করে ২৫.৩.৯০ তারিখে প্রচারিত সার্কুলার নম্বর ৮এ। এই সার্কুলার পাঠানো হল সদস্য সংগঠনগুলো ছাড়া কিছু সংগঠনকে।

সার্কুলারের শুরুতেই বলা হয়েছে কুসংস্কার ও অলৌকিকতার বিরুদ্ধে ‘গণ বিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র’ এই বিষয়ে এতদিনকার কাজের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।

কী সেই সিদ্ধান্ত? তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কিছুটা এখানে তুলে দিলাম : ‘আন্দোলনের ক্ষেত্রে কুসংস্কারকে অন্তত দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা অবশ্যই প্রয়োজন। যথা-জীবনযাত্রা নির্বাহের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিকারক ও তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিকারক নয়। তাৎক্ষণিকভাবে যে-সব কুসংস্কার ক্ষতিকারক নয় সেগুলো মূলত বস্তুনিরপেক্ষ-বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এর অনুশীলনমুখিতার চাইতে এগুলির তত্ত্বমুখীনতা অপেক্ষাকৃত বেশি। কখনোই বলা যায় না যে এগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে না। অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু যেহেতু এগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন ও তার সাফল্য সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে তথা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপক মানোন্নয়নের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত সেহেতু এ আন্দোলন এক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। পক্ষান্তরে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিকারক কুসংস্কারসমূহ প্রধানত মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক জীবনের উপর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবশালী। বলতে বাধা নেই এগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন পূর্বোক্ত শ্রেণির কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অপেক্ষা জরুরি। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন সমাজে ব্যাপকভাবে বিকাশলাভ না করলে পূর্বোক্ত আন্দোলনও শক্তিশালী হতে পারে না।”

গণবিজ্ঞান-সমন্বয়কেন্দ্র তাদের নবমূল্যায়নে কী কী সিদ্ধান্তে পৌঁছল একটু দেখা যাক।

১. কুসংস্কার অবশ্যই দুই প্রকার। একঃ তাৎক্ষণিক ক্ষতিকারক নয় যেমন অদৃষ্টবাদ, কর্মফলে বিশ্বাস, অলৌকিকত্বে বিশ্বাস, ঈশ্বর বিশ্বাস ইত্যাদি সংক্রান্ত কুসংস্কার। দুইঃ তাৎক্ষণিক ক্ষতিকারক যেমন স্বাস্থ্য বিষয়ক কুসংস্কার।

২. স্বাস্থ্যবিষয়ক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই বেশি জরুরি।

৩. অদৃষ্টবাদ, কর্মফলে বিশ্বাস, অলৌকিকত্বে বিশ্বাস, ভূত বা ঈশ্বর বিশ্বাসজাতীয় কুসংস্কার দূর করা যেহেতু দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার, তাই বঞ্চিত মানুষদের কুসংস্কারমুক্ত করার আন্দোলনের এখন প্রয়োজন নেই ।

৪. সমাজের বহু মানুষের মধ্যে অদৃষ্টবাদ, কর্মফল, ঈশ্বরবাদ, অলৌকিক- বিরোধী কুসংস্কার-মুক্তির আন্দোলন ছড়িয়ে না. পড়লে আন্দোলন শক্তিশালী হতে পারবে না, এই পরিপ্রেক্ষিতে এখন অলৌকিক- বিশ্বাসজাতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। ৫. আগে অলৌকিকতা বিরোধী, ঈশ্বরতত্ত্ব, অদৃষ্টবাদ-বিরোধী ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুলে ভুল পথ নেওয়া হয়েছিল।

এবার দেখা গেল গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র যুক্তিবাদী সমিতির লাইনকে পুরোপুরি বর্জন করে সরাসরি বিজ্ঞান মঞ্চের লাইনকে সমর্থন করল। তারা প্রথম সম্মেলনে গৃহীত দলিলের দু’নম্বর কর্মসূচি কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অঙ্গীকারকে লঙ্ঘন করল। অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় সুস্থ মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য— এই সত্য ভুলে থেকে সমাজের অসুস্থতার মধ্যেই দলে ভারী হওয়াকেই নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করল। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যে সংগ্রামের কথা সমন্বয় কেন্দ্রের কর্মসূচিতে ঘোষিত হয়েছিল, সেই ঘোষণার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করল বুদ্ধিমান, চতুর নেতারা। মৌলবাদ রুখতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে আঘাত দিতেই হবে—এছাড়া বিকল্প কোনও পথ নেই। কারণ বুঝতে মৌলবাদ শব্দটির অর্থ বুঝতে হবে। মৌলবাদ বা Fundamentalism শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো – ‘ধর্মশাস্ত্রের বিজ্ঞানবিরুদ্ধ উক্তিতেও অন্ধবিশ্বাস ।’ অতএব মানুষের ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসে আঘাত না দিয়ে মৌলবাদী চিন্তাকে রোখার স্লোগান চূড়ান্ত ভণ্ডামি বই কিছুই নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই নয়া-ঔপনিবেশবাদীরা ‘অস্ত্রযুদ্ধের’ সঙ্গে সঙ্গে ‘চিন্তার-যুদ্ধ’ কেও আরও বেশি বেশি করে গুরুত্ব দিতে শুরু করে— ইতিহাস তাই বলে। চিন্তার যুদ্ধের ক্ষেত্রে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম’ অবশ্যই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।

ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে প্রজা শোষণ প্রাচীন আমলেও ছিল। কিন্তু সেসময়ে ধর্মকে কাজে লাগিয়ে শোষিত মানুষদের এককাট্টা হওয়ার চেষ্টাকে তছনছ করে দেওয়ার মত প্রচেষ্টা শাসক শ্রেণির মধ্যে দেখা যায়নি। যদিও প্রাচীনকালে বস্তুবাদী দর্শন বা নাস্তিক্য দর্শনকে প্রতিহত করতে বহুভাবেই সচেষ্ট ছিলেন ভাববাদী দর্শনের ধারকরা। চার্বাক দর্শন বা লোকায়ত দর্শন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সে সব কথাও টেনে এনেছি এই বইতে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আমরা দেখেছি কী ভাবে ধর্ম ও অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে প্রজাকুলের অর্থ শোষণ করে রাজার অর্থভাণ্ডার স্ফীত করার পথ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’-এর প্রথম খণ্ডে)। কিন্তু ধর্মকে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কাজে সার্থকভাবে আমরা প্রয়োগ করতে দেখলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের। হেনরি এম ইলিয়ট যে চিন্তার যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন ১৮৪৯ সালে, তারই সূত্র ধরে ব্রিটিশ শক্তি ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগিয়ে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে এ-দেশে ধর্মের ভিত্তিতে শোষিত মানুষদের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি করেছিল সার্থকভাবে। উত্তরাধিকার সূত্রে কংগ্রেস এবং অন্যান্য, রাজনীতির ব্যাপারীরা এখনও ধর্মকে বিভেদ-সৃষ্টিকারী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেই চলেছে।

হেনরি এম ইলিয়ট ধর্মকে বিভেদ সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে শিখিয়ে ছিলেন, শতবর্ষ পরে ১৯৫০ সালে সেই চিন্তাকেই একটা ‘তাত্ত্বিক’ রূপ দেন অ্যালেন ওয়েলস্ ডালেস।

ডালেস তত্ত্বের মূল বক্তব্য ছিল : বস্তুবাদী দর্শন, যুক্তিবাদী দর্শনকে ঠেকাতে না পারলে শোষিত মানুষদের সম্মিলিত সংগ্রামকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আর কোনওভাবে সংগ্রামে শোষিত মানুষের জয় সূচিত হওয়ার অর্থ বর্তমান শোষণ প্রক্রিয়ার পরাজয়। শোষিত মানুষকে শোষণ করা যায় কারণ তাদের চেতনার স্তর শাসক ও পুঁজিবাদী শক্তির ধারক-বাহকদের তুলনায় বহু যোজন পিছিয়ে পড়া ততদিনই নিশ্চিন্তে শোষণ করা সম্ভব, যতদিন বঞ্চিত মানুষরা তাদের বঞ্চনার কারণ হিসেবে অদৃষ্ট, ঈশ্বর ইত্যাদিকে চিহ্নিত করবে—দায়ী করবে না পুঁজিবাদকে। শোষিতদের সংগ্রামী করে যে চেতনা, সেই জনচেতনার উত্থানকে প্রতিহত করতে নিশ্চয়ই সেনা-পুলিশ-অস্ত্ৰ ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু তার চেয়েও কার্যকর অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে।

ডালেস তাঁর পর্যবেক্ষণ বিষয়ে জানালেনঃ যে সব মানুষের মনের গভীরে ধর্ম-বিশ্বাসের শিকড় প্রোথিত রয়েছে, তারা কখনই যুক্তিবাদ, বস্তুবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। তারা কখনওই আন্তরিকতার সঙ্গে যুক্তিবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে গ্রহণ করতে পারে না। আস্তিক্যবাদের সঙ্গে নাস্তিক্যবাদের এই লড়াইকে পুঁজি করেই নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার মধ্য দিয়েই রক্ষা করা সম্ভব বর্তমান উৎপাদন ও শোষণ পদ্ধতিকে বজায় রাখা।

ডালেস শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের পথ-নির্দেশ দিয়ে বললেনঃ আমাদের কর্তব্য হল অঞ্চলভেদে-বস্তুবাদ ও নাস্তিক্যবাদ-বিরোধী ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে খুঁজে বের করা এবং জনগণের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে বাড়িয়ে তোলা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজবাদের পক্ষ অবলম্বনকারী বস্তুবাদী চিন্তার পথ অনুসারীদের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, শোষণকারী শক্তিগুলো সর্বনাশের ছায়া দেখতে পেল। তারা কোমর বেঁধে নেমে পড়ল নাস্তিক্যবাদী চিন্তার আক্রমণ থেকে পৃথিবীর বাকি জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টায় এবং নাস্তিক্যবাদীদের দুর্গে আঘাত করার পরিকল্পনায়। এই পথ অন্বেষণের একটা পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছল : আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের চেয়েও অর্থাৎ অস্ত্রের যুদ্ধের চেয়েও চিন্তার যুদ্ধ অনেক বেশি কার্যকর। ওরা যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী চিন্তার আগ্রাসন থামাতে ও তাদের দুর্গে আঘাত হানতে শুরু করল ‘চিন্তার যুদ্ধ (War of Ideas ) ” । এই যুদ্ধের সেনানীর ভূমিকায় এলেন মনোবিজ্ঞানীরা, সমাজবিজ্ঞানীরা, অর্থনীতিবিদরা। এই ‘চিন্তার-যুদ্ধে’ একটি আবশ্যিক হাতিয়ার হিসেবে রাখা হল ধর্ম-চিন্তাকে।

ভাববাদী চিন্তা ও সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার একছত্র সম্রাট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তারপর থেকে নিখুঁতভাবে জনমনে ঈশ্বর বিশ্বাস, ধর্ম বিশ্বাস জাগরণের কাজ করেই চলেছে প্রধানত মনোবিজ্ঞানীদের নির্দেশিত পথকে অনুসরণ করে। এজন্য তারা বিভিন্ন দেশেই দালাল খুঁজে নিয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থ-প্রাচুর্যের বন্যা এনে ধর্ম প্রচারে তাদের উজ্জীবিত করেছে, কখনও বা ধর্ম বিষয়ে ‘পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ’ প্রকাশের মাধ্যমে ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষিত মহলেও শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলে ‘ধর্ম-যুদ্ধ’ চালিয়েছে, কখনও বা রাজনীতিকদের মধ্যে ‘পুজো-কালচার’ সৃষ্টি করার কাজে ‘চিন্তার-যুদ্ধ’কে নিয়োজিত করেছে।

আবার কখনও ধর্মের পক্ষে মেকি মার্কসবাদীদের শামিল করছে। একই সঙ্গে ‘ধর্মে আঘাত নয়’ মার্কা মেকি বিজ্ঞান আন্দোলন সৃষ্টি করে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছে ।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের এই চিন্তার-যুদ্ধের পরিকল্পনা যে কী বিপুল সাফল্য লাভ করেছে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ শুধুমাত্র পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় ধস্ নামাবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, চিনের জনগণের মগজ ধোলাই করে বস্তুবাদী চিন্তা সাফ করে ভাববাদী ও ভোগবাদী চিন্তা ঢোকানোর মধ্যেই এর শেষ নয়— আজ সারা পৃথিবীতে মার্কিন একচেটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপনের মধ্যে অন্তর্নিহিত ৷ এই একচেটিয়াপনা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অস্ত্র যুদ্ধের চেয়ে চিন্তার-যুদ্ধ অনেক বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চিন্তা-যুদ্ধের কাছে, সাংস্কৃতিক চেতনার একচেটিয়াপনার কাছে সেইসব দেশকেই আত্মসমৰ্পণ করতে হয়েছে, যাদের চিন্তা-যুদ্ধকে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে, অস্ত্র-যুদ্ধের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বুঝে ওঠার পক্ষে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিপক্বতার অভাব ছিল।

ভারত পৃথিবীর বাইরের কোনও দেশ নয়। সুতরাং এ-দেশের মাটিতে যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠাও তাদের দর্শনের, তাদের শোষণ প্রক্রিয়ার পক্ষে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে—বুঝেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তারা এটাও বোঝে একের চিন্তা বহুতে সঞ্চারিত হয়। তাই ভারতের যুক্তিবাদী আন্দোলনকে রুখতে তারা একদিকে যেমন দালাল খুঁজে নিয়ে আপন মর্জিতে সাজিয়ে মেকি বিজ্ঞান আন্দোলন শুরু করল যুক্তিবাদীদের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিতে, তেমনই মেকি বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতাদের দিয়ে বারবার প্রচার রাখতে লাগল— ধর্ম, ঈশ্বরতত্ত্ব, অদৃষ্টবাদ ইত্যাদির বিরোধিতা একটি হটকারী লাইন, আর এ-সবেরই ফসল গণ-বিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের ওই সার্কুলার।

সার্কুলারটিতে এমন তালগোল পাকানো চিন্তার প্রকাশ ঘটায় এবং এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান মঞ্চের লাইনকে সমর্থন জানানোয় সভা সংগঠনগুলোর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই সময় বিজ্ঞান মঞ্চ ও সমন্বয় কেন্দ্র আরও কাছাকাছি এসে পড়ে ‘জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’কে বিজ্ঞান আন্দোলনের পক্ষে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে দুই পক্ষই বিবেচনা করায়। সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া এই ‘জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’ বিষয়ে এই মুহূর্তে আলোচনা করা অতি জরুরি। আসুন আমরা ‘জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’ নিয়ে খোলা মনে একটু আলোচনা সেরে নিই।

 

জনস্বাস্থ্য আন্দোলনঃ একটি মহান, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল মিথ্যা

‘২০০০ সালে সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামের স্লোগান এবং ‘জনস্বাস্থ্য আন্দোলন’ -এ বর্তমানে বিভিন্ন চিকিৎসক, চিকিৎসা বিষয়ক সংস্থা, সমাজসেবী এবং বিজ্ঞান ক্লাব শামিল হয়েছেন। শহরে আধা শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে সরকারি অর্থ ব্যয়ে অর্থাৎ আমাদেরই ট্যাক্সের টাকায় ‘সেমিনার’। বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কার মুক্ত, যুক্তিবাদী মানুষ গড়ার চেয়েও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে অবগাহন করার মধ্যে অনেক বেশি সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন কোনও কোনও বিজ্ঞান সংস্থার চতুর নেতারা ৷

‘জনস্বাস্থ্য’ আন্দোলন নীতির গভীর রহস্য বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে ‘জনস্বাস্থ্য’ ও ‘চিকিৎসা’ শব্দ দু’টির অর্থ। কারো কারো ক্ষেত্রে শব্দ দু’টি আপাতদৃষ্টিতে সমার্থক মনে হলেও বাস্তবে তা নয়।

কারও রোগ নিরাময়ের জন্য যে ডাক্তারি প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়, তাকেই বলা হয় ‘চিকিৎসা’। যেসব কারণ ও উৎপাদন রোগ উৎপত্তি প্রতিরোধ করে এবং স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নতিতে সাহায্য করে, তাকেই বলে ‘জনস্বাস্থ্য’। ‘চিকিৎসা’ নামক প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, চিকিৎসাকেন্দ্র, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধপত্র, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। ‘জনস্বাস্থ্য’ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে খাদ্য, পানীয় জল, বাসস্থান, আবর্জনা নিষ্কাশন, শিক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ, রোগ প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন, টিকা দান ইত্যাদি।

রোগ আক্রান্ত হলে রোগীর চাই চিকিৎসা। পরিবর্তে

‘জনস্বাস্থ্য’ বিষয়ক সাহায্য দিয়ে রোগীকে বাঁচানো

যাবে না। নীরোগ ব্যক্তিকে রোগ থেকে

দূরে রাখতে চাই ‘জনস্বাস্থ্য’ তখন

‘চিকিৎসা’ অপ্রয়োজনীয়।

১৯৮২ সালে ভারত সরকার তার লিখিত স্বাস্থ্যনীতিতে ঘোষণা করল, ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যনীতি। এই নীতিতে বলা হল, চিকিৎসকের সাহায্যে মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি কখনই সম্ভব নয়, স্বাস্থ্য রক্ষাও সম্ভব নয়। চিকিৎসার প্রতি মানুষের দৃষ্টি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আকর্ষিত হওয়ার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের মানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্যের উন্নতির স্বার্থেই চিকিৎসার প্রতি গুরুত্ব কমিয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। অর্থাৎ ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’, ‘সুস্থ জীবনের জন্য সুস্থ পরিবেশ’, ‘সস্তায় বাসগৃহ নির্মাণ’, ‘সস্তায় পায়খানা নির্মাণ’, ‘ধূমহীন চুল্লি’, ‘স্বনির্ভর প্রকল্প’ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে।

চিকিৎসায় গুরুত্ব দিলে জনস্বার্থের ক্ষতি হবে এ-জাতীয় সরকারি বক্তব্যের সমর্থনে অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংস্থা এগিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে যাঁরা বাম প্রগতিবাদী হিসেবে পরিচিত, তাঁদের মতে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রে শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিরোধের জন্যেই ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ আন্দোলনে শামিল হওয়া একান্তই প্রয়োজনীয়। এই আন্দোলন দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রকে প্রশস্ত ও উন্নত করার মধ্য দিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ রুখবে। জনগণের স্বাস্থ্যের স্বার্থেই চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, জনগণেৰ স্বাস্থ্যের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে জনগণেরই হাতে। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান ও পরিবেশ সমস্যার সমাধান ঘটবে। এ আন্দোলন জনগণের জন্য জনগণ দ্বারা আন্দোলন।

তথাকথিত প্রগতিবাদীদের বিপ্লবাত্মক বুকনির মোড়ক ছাড়িয়ে আসুন দেখা যাক আসল সত্য। চিকিৎসাক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ রুখতে ‘২০০০ সালে সবার জন্য স্বাস্থ্য’ শিরোনামে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে বলে যাঁরা সোচ্চারে দাবি করছেন, তাঁদেরকে আদ্যন্ত নির্ভেজাল মিথ্যাচারী বই আর কোনও উপযুক্ত শিরোপায় ভূষিত করার উপায় দেখি না। রাষ্ট্রসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারাই ঘোষিত হয়েছিল ‘২০০০ সালে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতি’ ভারতে প্রয়োগের কথা। রাষ্ট্রসংঘ চিকিৎসাক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ রুখতে এই জন স্বাস্থ্য নীতি ১৯৭৮ সালে ভারত সরকার রাষ্ট্রসংঘের চাপে এই নীতি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এবং ‘৮২ সালে ভারত সরকার লিখিতভাবে ঘোষণা করে এই নীতি ঘোষণা করেছিল— এমনটা ভাবার মতো কোনও কারণ দেখি না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলতে যেসব দেশকে বোঝানো হয়, সেসব দেশের প্রভাবই রাষ্ট্রসংঘে প্রবল। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রসংঘের ঘোষিত নীতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধী না হওয়ার স্বার্থরক্ষাকারী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি নয় কি? অন্তত আর যাই হোক,

রাষ্ট্রসংঘের ঘোষিত ‘২০০০ সালে সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নীতি

যেখানে সাম্রাজ্যবাদী বলে চিহ্নিত দেশগুলোর

সক্রিয় সমর্থন পেয়েছে, সেখানে ওই

নীতিকে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নীতি’

বলে প্রচারে সোচ্চার হওয়াটা

সত্যের দিক থেকে মুখ

ঘুরিয়ে রাখা ছাড়া

আর কিছু নয়।

রাষ্ট্রসংঘ কেন ‘জনস্বাস্থ্য’ নীতি ঘোষণা করল এবং ভারত সরকারের কাছে কেন তা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করল, এ বিষয়ে সম্ভাবনার দিকটা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য হল জনজীবনের মানোন্নয়ন, জনগণের জন্য খাদ্য, পানীয়-বাসস্থান ও পুষ্টির ব্যবস্থা এবং এসবের মধ্য দিয়ে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি। ভারতীয় সংবিধানের ৪৭ নম্বর ধারা এর ২৪৬ নম্বর সম্পর্কিত ৭ নম্বর তপশিলের রাজ্যতালিকায় ৬ নম্বর সূত্রে আছে জনজীবনের মানোন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতির কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করবে রাজ্য সরকারগুলি। সরকারের এই নীতি অনুসারে রাজ্য সরকারগুলো নিজ উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য কিছু হাসপাতাল স্থাপন করেছে। জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় এই সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা খুবই কম। জনগণ যখন বিনামূল্যে চিকিৎসা গ্রহণের সরকারি ব্যবস্থাকে আপন অধিকার হিসেবে ভাবতে শুরু করল, তখন দুর্নীতি ও ভুল অর্থনীতির জালে জড়িয়ে পড়া দেউলিয়া সরকার প্রমাদ গুনল। জনসাধারণের সংখ্যাগুরু অংশ বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার দাবি করলে এই আর্থিক কাঠামোয় সে অধিকার দেওয়া যাবে না। কারণ, একদিকে অর্থ সংকট, আর এক দিকে শোষণ প্রক্রিয়াও কিছুটা ব্যাহত হয়। আবার জনগণ যেভাবে উত্তরোত্তর বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার দাবি করছে, সেই দাবিকে পুরোপুরি অমর্যাদা করলে ভোট-নির্ভর রাজনীতিতে গদি বাঁচানোই অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই সংকট শুধু ভারতে নয়, ভারতের মতো অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই। এইসব দেশের শোষিত জনগণ যাতে চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার আদায়ের দাবিতে অতিমাত্রায় সোচ্চার না হয়ে ওঠে এবং সেই অধিকার আদায়ের লড়াই অন্যান্য অধিকার আদায়ের লড়াইতে নামতে যাতে উদ্বুদ্ধ না করে, সে দিকেই লক্ষ রেখে বিশ্বের শোষকদের একচ্ছত্র নেতৃত্বের অধিকারী দেশগুলো (যারা সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত) নিপীড়িত জনগণের চেতনাকে অন্য দিকে ঘোরাতে চাইল। আর চাওয়ার প্রয়োজনেই,

শোষিত জনগণের মগজ ধোলাইয়ের উদ্দেশে রচিত হল

চিকিৎসা নীতির বদলে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতি।

ঘোষিত হল জনস্বাস্থ্য আন্দোলন

কর্মসূচি – “২০০০ সালে

সবার জন্য স্বাস্থ্য।”

ঘোষিত জনস্বাস্থ্য নীতি নিশ্চয়ই সুন্দর। ভারত সরকার ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার জনস্বাস্থ্য নীতি গ্রহণ করছেন এবং কার্যকর করতে চাইছেন

এ খুবই ভালো কথা। কিন্তু আশংকা থেকেই যায়, জনগণের দৃষ্টি চিকিৎসা গ্রহণের অধিকারের দিক থেকে ঘোরাতেই, চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড় থেকে কমাতেই স্লোগান-সর্বস্ব এই জনস্বাস্থ্য নীতি হাজির করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি অবশ্যই স্বাগত জানাবার মতো—কারণ, শোষিত জনসাধারণের সার্বিক দাবি খাদ্য, পানীয় জল, বস্ত্র, বাসস্থানের দাবি। কিন্তু একি বাস্তবিকই বিশ্বাসযোগ্য যে সরকার জনগণের এই সার্বিক দাবিগুলো মিটিয়ে দেবে? তাহলে তো শোষণের মজাটাই বিদায় নেবে। যুক্তি-তর্কের বাইরে যদি ধরেও নেওয়া যায় সরকার জনস্বাস্থ্যের নীতিকে সার্থকরূপ দেবে, তবুও কিন্তু এর ফলে সরকারের চিকিৎসা নীতি কখনই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে না। কারণ, দেশে রোগী থাকৰে, চিকিৎসার প্রয়োজনও থাকবে। রোগীকে রোগমুক্ত করতে চিকিৎসারই প্রয়োজন এবং ‘জনস্বাস্থ্য’ কখনই ‘চিকিৎসা’র সমার্থক নয়।

 
গণবিজ্ঞান ও জনবিজ্ঞানের আন্দোলনঃ
জাল করেছি আমি আমার সর্বনাশের চাবি

গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র-র দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল শ্রীরামপুরে ৬ ও ৭ অক্টোবর ১৯৯১। সম্পাদক স্বপন শীলের স্বাক্ষরিত যে ছাপানো বক্তব্য প্রকাশিত হল তাতে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র গঠিত হওয়ার পর থেকে পথ চলার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। সম্পাদকের বক্তব্য ছিল, “আজকের দিনে কোনও পদ্ধতি রীতিনীতি বা ধারণাকে কুসংস্কার বললেও মনে রাখা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কুসংস্কারটির জন্মলগ্নে অবশ্যই থাকবে এক অনুকূল সামাজিক পরিস্থিতি, হতে পারে তা অবৈজ্ঞানিক। এই সামাজিক পরিস্থিতি থেকে আজকের সামাজিক পরিস্থিতির পার্থক্য মৌলিক। আজকের সমাজের সব কিছুরই ধারক রক্ষক সংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা যা অতীতে ছিল না। অতএব আজকের দিনে সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে।” বাঃ বাঃ সত্যিই বড় বিচিত্র এই প্রস্তাব।

এত ঢাকঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞান-আন্দোলন করতে নেমে শেষ

পর্যন্ত গণবিজ্ঞান আন্দোলনের নেতারা আবিষ্কার করলেন,

কুসংস্কারমুক্তির জন্য, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার জন্য

আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন আমাদের

আজকের সমাজে ‘শূন্য’।

শোষিত মানুষদের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের দাবি রাখতে হবে শোষকশ্রেণির তল্পিবাহক রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্থাৎ সরকারের কাছে। আমরা তেমন জোরালোভাবে দাবি রাখতে পারলে সরকার শোষিত মানুষগুলোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে খোল করতাল বাজিয়ে শোষকদের সঙ্গে নিয়ে বানপ্রস্থে চলে যাবে।

এ কথা ভুলে থাকার কোনও অবকাশ নেই, যাঁরা নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন, সেই সমাজের উপযুক্ত মানুষ গড়ার দায়িত্বও তাঁদেরই। আদর্শ সমাজ গড়তে আদর্শ মানুষ গড়া দরকার। নতুবা যে আদর্শের জন্য বহু ত্যাগের সংগ্রাম, তাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। একদিন সংগ্রামী মানুষগুলোই ক্ষমতার অপব্যবহারে রপ্ত হয়ে উঠবে। শুরু হবে নয়া শোষণ। তখন মনে হবে এত রক্তক্ষয়ের পর যা হল সে তো শুধুই ক্ষমতার হস্তান্তর, মহত্তর আদর্শ-সমাজ গড়ে উঠল কই?

গণবিজ্ঞান-সমন্বয়কেন্দ্রের সম্পাদকের ঘোষিত সিদ্ধান্তগুলোতে সমাজ সম্পর্কে যে চূড়ান্ত অজ্ঞতা ও আনাড়িপনা ফুটে উঠেছে, তা কি না বোঝার মূর্খতা থেকে? না কি গুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত? এই সিদ্ধান্তগুলো যে শোষক ও রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থ রক্ষাকারী এবং শোষিত মানুষদের শোষণমুক্তির চিন্তাধারার বিরোধী এটুকু বুঝে নেওয়া যেহেতু আকাট-মূর্খ ও বদ্ধ-উন্মাদ ছাড়া আর কারও পক্ষেই সামান্যতম কঠিন নয়, তাই এই বিষয় নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনায় যাওয়া একান্তই অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বিরত রইলাম। গণবিজ্ঞান-সমন্বয়কেন্দ্রের নেতারা অনেকের দ্বারা নিশ্চয়ই অভিনন্দিত হয়েছেন বছরের সেরা ডিগবাজি খেয়ে ভারতীয় রেকর্ড দখল করে। একটি বিনীত অনুরোধ জানাই, বর্ষশ্রেষ্ঠ চুটকি প্রতিযোগিতায় সম্পাদক সিদ্ধান্তটি পাঠান, পুরস্কার অবধারিত। তিন নম্বর সিদ্ধান্তটি কী অসাধারণ রসিকতার নিদর্শন বলুন তো— কুসংস্কার দূর করা যেহেতু দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার, তাই এই প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত সবার আগের বদলে সবার পরে।

যাঁরা গণবিজ্ঞান-সমন্বয়কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছেন, তাঁদের আরও একটু সতর্ক ও সচেষ্ট হতে অনুরোধ করব। তাহলেই দেখতে পাবেন সবের মধ্যেই এক যোগসূত্র। এই সমন্বয় কেন্দ্ৰ সেই আমেরিকার কুখ্যাত CSICOP-র দালাল পত্রিকাগোষ্ঠী ‘উৎস মানুষ’-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই কাজে নেমেছে, যে CSICOP-র কাজ হল পৃথিবীর যেসব দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে তাকে বিনষ্ট করতে দালালদের সাহায্যে মেকি বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তোলা।

ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের নেতৃত্বে ‘গণবিজ্ঞান’ আন্দোলন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের নেতৃত্বে ‘জনবিজ্ঞান’ আন্দোলন (এই দুই সংস্থা জনগণের আন্দোলনকে এই দু’টি নামেই চিহ্নিত করে থাকেন) ধর্ম, ঈশ্বর, আম্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, সামাজিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপরেখা ও প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নিয়ে সামান্যতম প্রশ্ন না তুলে, আগ্রহ না প্রকাশ করে নিবিড় ধান চাষ, ব্যাঙের ছাতার উন্নত চাষ, পানের চাষের জমি পরীক্ষা পদ্ধতি, পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সেই সঙ্গে সৌরশক্তির পারিবারিক ব্যবহার, ধূমহীন চুল্লি নির্মাণ, গোবর গ্যাসের উৎপাদন, জল ফুটিয়ে খাওয়ার উপকারিতা, খাবার ঢেকে রাখার উপকারিতা, মশারি টাঙিয়ে শোবার উপকারিতা, এড্‌স থেকে বাঁচতে জন্ম নিরোধক ক্যাপ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা জাতীয় সরকারি প্রচার মাধ্যম মারফত প্রচারিত বিষয়গুলো নিয়েই পুনঃসম্প্রচারণ চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবস’ উপলক্ষে বারো কিলোমিটার পদযাত্রা (আর আমাদের রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী ক্রিয়া কর্মের বিরুদ্ধে টু শব্দটি না করা), ‘জলা বাঁচাও দিবস’ উপলক্ষে মাছ হাতে ছ’কিলোমিটার দৌড়, বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে গাছ হাতে কুড়ি কিলোমিটার দৌড় এবং ‘হিরোসিমা দিবস’ ও ‘ভূপাল কমিটি’ দিবসে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মুণ্ডুপাত করে আগুন ঝরানো বক্তৃতা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদেধ প্রতিবাদ জানাতে ভাগলপুর থেকে নেপাল পথ-পরিক্রমা ইত্যাদি নিয়ে আবর্তিত হয়ে চলেছে এদের কর্মকাণ্ড। কুসংস্কার বিরোধী, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধী যে কোনও বক্তব্যকে এঁরা লেবেল এঁটে দেন ‘হঠকারী’ বলে।

আসলে এইসব নেতারা চতুর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গুণে নয়,

পরিমাণে শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছেন। ফলে এঁরা সংখ্যাগুরু

জনগণকে সঙ্গে পেতে তাদের চেতনার স্তরে নিজেদের

নামিয়ে নিয়ে আসতে শুরু করেছেন। এঁরা ইচ্ছে করেই

চাইছেন মানুষের চেতনার অগ্রগামিতা থামাতে।

কারণ, এইসব পোড়খাওয়া চতুর নেতাদের

মোটেই অজানা নেই— বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে

তোলার আন্দোলন সমাজ ব্যবস্থা

আমূল পরিবর্তনকারী

আন্দোলনেরই

ভিত্তিভূমি।

 

চলো যাই ফিরেঃ পুরোনো কথায়

১৯৯১-এর অক্টোবরে যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা আলোচনায় বসলেন— এবার আমরা কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সমিতির মুখপত্র ‘যুক্তিবাদী’ প্রকাশ করতে শুরু করব কি না? একটি মাত্র কারণে আমরা এতদিন ‘যুক্তিবাদী’ প্রকাশে বিরত ছিলাম। জানতাম, আমরা প্রথম থেকেই আমাদের মুখপত্র ‘যুক্তিবাদী’ প্রকাশ করতে থাকলে আমাদের সহযোগী সহযোদ্ধা বহু সংগঠন ও শাখা সংগঠন আমাদের উপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তাই এতদিন আমরা বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন ও শাখা সংগঠনগুলোকে উৎসাহিত করেছি পত্র-পত্রিকা, বুলেটিন ও বই প্রকাশে। কারণ, আমরা মনে করি, শুধুমাত্র কোনও সংস্থার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে যুক্তিবাদী চেতনা বিকাশের স্বপ্ন দেখলে তা কোনও দিনই বাস্তবায়িত হবে না। কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি শেষ হয়ে গেলেই যাতে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রতিহত না হয়, তার জন্যেই বেশি বেশি করে যুক্তিবাদী মানুষ ও সংস্থার স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা প্রয়োজন। এর ফলে, শোষক ও শাসক শ্রেণির পক্ষে আন্দোলনের নেতৃত্বকে আঘাত করে আন্দোলন শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য ।

আমাদের উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। ইতিমধ্যে পশ্চিমবাংলায় আমাদের যে শ’তিনেক সহযোগী সংগঠন ও শাখা সংগঠন আছে তাদের মধ্যে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে ষাটের ওপর যুক্তিনির্ভর, সমাজ-সচেতন পত্র-পত্রিকা । আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘যুক্তিবাদী’ প্রথম প্রকাশ ঘটাব ১৯৯২-এর কলিকাতা পুস্তক মেলায় অর্থাৎ জানুয়ারির শেষে। ছ’জনের সম্পাদকমণ্ডলী তৈরি করে কাজ শুরু হল। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হল তিন টাকা। ১৯৯২-এর পুস্তকমেলার মূল মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকার প্রকাশ ঘটল। প্রথম সংখ্যাটি সমিতির সভাপতি ডাঃ বিষ্ণু মুখার্জি তুলে দিলেন সমিতির উপদেষ্টা পবিত্র সরকারের হাতে। যুক্তিবাদী আন্দোলনের নতুন মাত্রা যুক্ত করল ‘যুক্তিবাদী’।

 

বিজ্ঞান জাঠাঃ বড় বেশি দেখা হল ধর্মত যা দেখা অপরাধ

‘৯১-এই অতি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে নতুন ধারা যুক্তিবাদী সমিতি নিয়ে এসেছে, তাই মূল স্রোত হয়ে উঠেছে- অন্তত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, তাই বা বলি কী করে ? ) ভারতের প্রায় সাতশোটি গণ-সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ক্ষুদ্র পত্রিকাগোষ্ঠীর সমন্বয়কারী হিসেবে নিবিড় সম্পর্ক রাখার সুবাদে আমাদের চিন্তাধারা যে তাদেরকেও নাড়া দিতে শুরু করছে— এ খবর আমরা পাচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে চিঠিপত্র ও সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিতে সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন। বাংলাদেশের ‘বাংলার বাণী’-সহ বহু পত্র-পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতেই লাগল আমাদের সমিতির কর্মকাণ্ডের কথা, যুক্তিবাদের কথা, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা। দেখলাম যুক্তিবাদী আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাল্টে দেওয়ার আন্দোলন সত্যিই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিকেই আন্দোলিত করছে। গ্রামগঞ্জের নিপীড়িত মানুষরা যেভাবে আন্দোলনের শরিক হচ্ছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং যে দ্রুততার সঙ্গে এই আন্দোলন ব্যাপকতা পাচ্ছে তাতে আন্দোলিত হুজুর শ্রেণি ও তাদের তল্পিবাহকরাও। হুজুরের থাবার ভেতর যেসব পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যম রয়েছে তার সকলগুলোকেই কাজে লাগানো হয়েছে আন্দোলন রুখতে, সংস্কারের শিকল ভাঙার অভিযান রুখতে, নতুন চিন্তার সাংস্কৃতিক পরিবেশ রুখতে।

আমাদের দেশের হুজুরের দল ও তাদের অর্থপুষ্টরা সাধারণ মানুষের চেতনা-মুক্তির এই আন্দোলনে দেখতে পেল অশনি সংকেত। তাইতেই তারা সাধারণ মানুষের চিন্তাকে নিজেদের পছন্দমতো ছাঁচে ঢালতে চাইল। চাইল বিভিন্নভাবে আক্রমণে আক্রমণে দানা বেঁধে ওঠা আন্দোলনকে ধ্বংস করতে। চাইল মেকি বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তুলে বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মীদের বিভ্রান্ত করে আন্দোলনের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিতে। আর তাই নানাভাবে কাজে নেমে পড়ল আমাদের রাষ্ট্রশক্তি, ধনকুবের গোষ্ঠী, নানা প্রচার মাধ্যম এবং বিদেশি রাষ্ট্রশক্তি। আমাদের মতো শোষণযুক্ত একটা বিশাল দেশের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক হতে বাধ্য। তাই ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ভেবে-বসে থাকতে রাজি নন পৃথিবীর কিছু কিছু মোড়ল দেশ।

এইসব ধরাণা যে কোনও সন্দেহপ্রবণ মানুষের চিন্তার ফসল নয়, তারই উদাহরণ ছড়িয়ে আছে আপনার আমার দৃষ্টির সামনেই। একটু সজাগ থাকুন, অনেক-অনেক উদাহরণ নজরে পড়বে।

C.S.I.CO.P. দোসর আমেরিকার The Nature পত্রিকার সক্রিয় সহযোগিতায় ভারতে পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান জাঠা বা Science mission অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হল। এই বিজ্ঞান জাঠা বিষয়ে পৃথিবীব্যাপী প্রচারের দায়িত্বও গ্রহণ করল ‘নেচার’ পত্রিকা। এই বিজ্ঞান জাঠার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রস্তুতি কমিটির আহবানে ১৬ নভেম্বর ’৯১ কিছু সায়েন্স ক্লাবকে নিয়ে এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল কলকাতার বিড়লা শিল্প ও কারিগরি সংগ্রহশালায়। স্বপ্নময় প্রাসাদের এয়ারকন্ডিশনের মিঠে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে রাজ্য সরকারের অতি স্নেহধন্য পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কিছু নেতা ও গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের কিছু নেতা বিজ্ঞান আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও ২০ কোটি টাকা বাজেটের সর্বকালের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান জাঠার মহৎ তাৎপর্য বুঝিয়ে বললেন। রাজ্য প্রস্তুতি কমিটির নেতারা জাঠা কমিটির একটি তালিকা পেশ করলেন ও পাশ করালেন। সভাপতি করা হল এক বিজ্ঞান পেশার অধ্যাত্মবাদে পরম বিশ্বাসীকে, যিনি একই সঙ্গে ধর্মগুরুর জন্মদিনে প্রণাম জানিয়ে বক্তৃতা দেন, গীতা, ভগবৎ পাঠের আসর মাতিয়ে রাখেন এবং বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কার্য-নির্বাহী সভপতি করা হয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি, দুর্গা পুজো কমিটির সভাপতির আসনেও জাঁকিয়ে বসেন। সম্পাদক করা হল বিড়লা শিল্প ও কারিগরি সংগ্রহশালার জনৈক প্রাক্তন ডিরেকটারকে। ইতিপূর্বে উনি বিজ্ঞান আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সময় দিতে পারেননি বিড়লার চাপানো গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর উনি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবার থেকে বিজ্ঞান আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন। জানি না, তাঁর এমন এক জনদরদি অসাধারণ সিদ্ধান্তর জন্যই প্রস্তুতি কমিটি তাঁর হাতে সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করে কৃতার্থ হয়েছিলেন কি না ; না, বিড়লা গোষ্ঠীর নির্দেশেই সম্পাদকের দায়িত্ব তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন? এমনটা ভাবার পেছনে অবশ্যই যুক্তি আছে। কারণ ১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কনভেনশনের সভাপতি ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল আমাকে সে রাতেই জানিয়েছিলেন জাঠার টাকার একটা মোটা অংশ জোগাচ্ছেন বিড়লা, টাটারা। (প্রত্যয় রাখি, ডাঃ শীল ভবিষ্যতে কারো চাপে পড়ে এমন কথা বলবেন না- “যা বলেছি, তা বলিনি”। তেমন চাপে যদিও বা বলেন, অবশ্যই প্রমাণ করতে সক্ষম হব-তিনি একথা বলেছিলেনই)। অবশ্য এ-সব টাকা নাকি ওঁরা জোগাচ্ছেন যথেষ্ট গোপনীয়তার সঙ্গে । নির্বাচনসর্বস্ব রাজনৈতিকদলগুলোর নির্বাচনী তহবিলের কায়দায় জনগণের কাছ থেকে অবশ্য দু-পাঁচ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হবে এটা দেখাতে-মোরা তোমাদেরই লোক, বড়লোকদের দালাল নই। সভাপতি ও সম্পাদক-পদ ছাড়া বাকি পদগুলোর সাম্রাজ্য প্রায় সমান দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন গণবিজ্ঞান-সমন্বয় কেন্দ্রের কিছু নেতা এবং রাজ্য সরকারের অতি স্নেহধন্য পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের নেতারা। তবে মঞ্চের নেতারা সকলে এবার ওই সংস্থার নাম করে কমিটিতে ঢোকেননি, ঢুকেছেন অন্যান্য সংস্থার নাম করে। এমনটা করার কারণ প্রথম বিজ্ঞান জাঠার দায়িত্ব গতবার বিজ্ঞান মঞ্চ পেয়েছিল। এবং ওদের বিরুদ্ধে ভারতের একাধিক প্রদেশের বিজ্ঞান – প্রতিনিধিরা এমনকী পশ্চিমবাংলার কিছু বিজ্ঞান-ক্লাবও বহু অনিয়ম ও দাদাগিরির অভিযোগ এনেছিলেন দ্বিতীয় বিজ্ঞান-জাঠা বিষয়ক কনভেনশনে।

একবার সুস্থ মাথায় যুক্তি দিয়ে ভাবুন তো, বাস্তবিকই কি এমন ঘটতে পারে, বিড়লা টাটার মতো ধনিক গোষ্ঠী ও ধনিক গোষ্ঠীর অর্থে নির্বাচনে জিতে শাসন ক্ষমতায় বসা সরকার এবং আমেরিকার সুবিখ্যাত পত্রিকাগোষ্ঠী বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিজ্ঞান-জাঠার মধ্য দিয়ে শোষিত জনগণের ঘুম ভাঙাবার গান শোনাবেন, সংস্কারমুক্তি ঘটাবেন, জাতপাতের পাঁচিল ভেঙে ফেলবেন, বোঝাবেন : ‘তোমাদের বঞ্চনার কারণ অদৃষ্ট নয়, পূর্বজন্মের কর্মফল নয়, ঈশ্বরের কোপ নয়, একদল অতিস্বার্থপর লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের শোষণের কারণেই তোমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বঞ্চনা, বঞ্চনা, এবং বঞ্চনা।”

হুজুরের দল ও তাঁদের তল্পিবাহকরা কি বাস্তবিকই পাগল হয়ে গেছে যে নিজ অর্থ ব্যয়ে বঞ্চিত মানুষদের বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী করে নিজেদের কবর নিজেরা খুঁড়বে ?

উত্তরঃ না, না এবং না।

বিজ্ঞান-জাঠার অর্থ বিনিয়োগকারীরা চাইছিলেন ব্যাপক প্রচারের

ঝড় তুলে, যুক্তিবাদী আন্দালন ও বিজ্ঞান আন্দোলনের যে

মূল লক্ষ্য বিজ্ঞামনস্ক, যুক্তিবাদী মানুষ গড়ার আন্দোলন,

সেই লক্ষ্যকে বিপথে পরিচালিত করতে ব্যাপক

পাল্টা প্রচার রাখবেন, “বিজ্ঞান আন্দোলনের

মূল লক্ষ্য বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি

সুযোগ সুবিধে সাধারণের

মধ্যে পৌঁছে দেওয়া । ”

এসব কথা বিজ্ঞান-জাঠা শুরুর মাস আটেক আগেই প্রকাশিত ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ -এর ৩য় খণ্ডে লিখেছিলাম। সেই সঙ্গে আরও লিখেছিলাম, জাঠার চালিকাশক্তি চাইছে, আন্দোলনকর্মীদের একটা বিশাল অংশকে জনসেবার কাজে আটকে রেখে আন্দোলনকে ব্যাহত করতে। বিজ্ঞান-জাঠা কুসংস্কার-বিরোধিতায় নামবে কুসংস্কারকে জিইয়ে রাখার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই। অদৃষ্টবাদ, আত্মা, পূর্বজন্ম, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, ইত্যাদি শোষক দলের শ্রেষ্ঠ হতিয়ারগুলোর বিরুদ্ধে ‘জাঠার মাথা খাওয়া’ নেতারা কখনই সামান্যতম আঘাত হানার চেষ্টা করবে না, করতে পারে না; যেমন হুজুরের অর্থে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া রাজনৈতিক দলগুলি প্রকৃত অর্থে কখনই হুজুরের স্বার্থবিরোধী কোনও কাজ করতে পারে না। যা পারে, সেটা হল, শোষিত মানুষদের বিভ্রান্ত করতে, শোষিত মানুষদের বন্ধুর অভিনয় করতে। বিজ্ঞান-জাঠাও এর বাড়তি কিছুই করতে পারবে না। ওদের কুসংস্কারবিরোধিতা সীমাবদ্ধ থাকবে গুটিকতক ম্যাজিক ও অলৌকিক রহস্য ফাঁসের মধ্যেই। এই কলমচির প্রতিটি কথার সত্যতা আপনারা মিলিয়ে নেবেন আপনাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে। জানি এ-লেখা বিজ্ঞান-জাঠার ঠিকা পায়া নেতারা অনেকেই পড়বেন-বার বার পড়বেন, ওঁদের বুদ্ধিজীবীরা আবার মানুষের মগজ ধোলাই করে নিজেদের কার্যক্রমের মহত্ত্ব সাধারণকে বোঝাতে সচেষ্ট হবেন। কিন্তু যুক্তির কূট কচকচালি যতই সৃষ্টি করার চেষ্টা করুন, বাস্তবে শাসক, শোষক ও বিদেশী শক্তির সক্রিয় সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন কখনই তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে পারে না, হবে না। পরিচালিত হবে অবশ্যই তাদেরই স্বার্থ রক্ষার্থে।

বিশাল অর্থ ও বিশাল প্রচারের সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞান-জাঠার ঝড় তুলে এইসব বিজ্ঞান আন্দোলনের মুখোশধারী বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের দল শোষিত মানুষদের চেতনা-মুক্তির গতিকে হয়তো সামান্য সময়ের জন্য স্তিমিত করতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় আমাদের হবেই ; জয় শোষিত মানুষদের হবেই ৷

সেদিনের বিজ্ঞান-জাঠা কনভেনশনে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতা বিপ্লব বসু দ্বিধাহীন ভাষায় জাঠায় টাকার উৎস জানতে চেয়ে বলেছিলেন, “টাকা খরচ না করলে আজকাল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী জোটে না।” অর্থের বিনিময়ে কর্মী হয়তো জোটে, কিন্তু এইসব ভাড়াটে সেনা দিয়ে আদর্শ-সচেতন মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জেতা যায় না।

নিপীড়িত ভারতবাসীদের দিকে দিকে জেগে ওঠার খবরে শোষক ও শাসকরাও আজ উদ্বেল। তাই বিপুল অর্থের বিনিময়ে নেতা কিনতে নেমে পড়েছে। বিক্রি হয়ে যাওয়া এইসব নেতাদের প্রত্যেককেই কলটেপা পুতুলের মতোই ব্যবহার করা শুরু করেছে ধনকুবের গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রশক্তি। একদা সংগ্রামী এইসব নেতাদের ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি হতে দেখে হৃদয় ব্যথিত হয়। এঁদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যাঁরা অনুরোধ জানান, তাদের জানাই এমন মুখোশধারী বন্ধুদের নিয়ে আন্দোলন গড়তে চাইলে আন্দোলন ধ্বংসের জন্য শত্রুর প্রয়োজন হয় না।

এমন অবক্ষয়, এমন দুর্নীতি, এমন নিলামের হাটে বিবেক

কেনা-বেচা দেখার পরও আমরা ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন

দেখতে ভালোবাসি। আমরা স্বপ্ন দেখি তরতাজা আদর্শবাদী

জীবন-পণ করা সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীরা গোত্রান্তরিত

তৃণভোজী এইসব নেতাদের হাত থেকে নেতৃত্ব

ছিনিয়ে নিয়ে সংগঠনকে আবার করে

তুলবে বঞ্চিত মানুষদের

সংগ্রামের সাথী।

জানি এত দীর্ঘ আলোচনার পরও কিছু কিছু সংস্কৃতিক-আন্দোলন কর্মীদের মনে হবে যে সব বিজ্ঞান ক্লাব ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি, বিচ্যুতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হল, তাদের ভালো কি কিছুই নেই? সবই খারাপ? তারাও তো সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে সমাজের জন্যে কিছু না কিছু করছে, তবে কেন তাদের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে না?

ধর্মশালা, দাতব্য চিকিৎসালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—এমনি কত প্রতিষ্ঠানই তো চালায় অনেক ভেজালদার, মুনাফাখোর শোষকরা। সমাজের জন্য ওরাও তো কিছু করেছে। তাই বলে আপনি আমি কী ওদের সঙ্গে নিয়ে ওদেরই বিরুদ্ধে (ওরাই শোষণের স্বার্থে সংস্কারগুলো চাপিয়ে রেখেছে) সংগ্রামে নামার কথা চিন্তা করব পাগলের মতো? একই কারণে রাষ্ট্রশক্তির দালাল মুখোশধারী এই সব আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়ে সংগ্রামের চিন্তা একেবারেই পাগলামি । এইসব মুখোশধারীরা অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদার বা জ্যোতিষীদের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর। কারণ অন্তর্ঘাতের জন্যেই এইসব বিক্রি হয়ে যাওয়া নেতারা তাদের সংস্থাগুলোকে কাজে লাগায়। নিরপেক্ষতার নামাবলি চাপিয়ে যাঁরা শোষকশ্রেণির মুখোশধারী দালালদের এবং শোষিত শ্রেণির সংস্কারমুক্তি আন্দোলনে সংগ্রামরতদের একই পর্যায়ে ফেলেন, তাঁরা প্রকারান্তরে ওইসব -দালালদেরই উৎসাহিত করেন। দালালরা উল্লসিত হয় এই ভেবে, কী অনায়াসে পঙ্গু করে দিয়েছি কিছু সম্ভাব্য সংস্কার-মুক্তির যোদ্ধাকে। ওইসব সংস্থার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেদিনই সংগ্রামে নামা সম্ভব যে-দিন ওরা হুজুরের শিবির পরিত্যাগ করবে। আর এসবই নেতৃত্ব বদলের আগে কখনই সম্ভব নয়— মানুষের রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ কি কখনও মানুষ মারা ছাড়ে, না মরা পর্যন্ত ? ওইসব শোষকদের, দালালদের সঙ্গে যাঁরা শোষিত মানুষদের জন্য মিলিজুলি আন্দোলন চালাতে বলেন, এঁদের অনেকেরই অজানা, ওইসব দালালরাই ধনতন্ত্রের স্পর্ধিত পদচারণার প্রধান ভিত্তিমূল। অনেকে জানেন, তবু বলেন-আন্দোলনে ক্যানসারের বীজ ঢোকাতেই এমনটা বলেন।

‘৯২-র জানুয়ারিতে কলিকাতা পুস্তকমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’-এর তৃতীয় খণ্ড। বইটির ‘কিছু কথা’ দ্বিতীয় বিজ্ঞান জাঠা নিয়ে এ-সবই লেখায় যে ঝড় উঠেছিল, সে ঝড় সামাল দেবার সাধ্য ছিল না জাঠার নেতাদের ও নেপথ্যের রাজনৈতিক স্টার-সুপারস্টারদের। ‘গণবিজ্ঞান’ ও ‘জনবিজ্ঞান’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বহু সংগঠনই জাঠার মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করে বিজ্ঞান আন্দোলনের মূল স্রোতকে ধ্বংস করার এই প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করতে রাজি হলেন না। এমন এক অসহনীয় চাপ থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বিড়লার চাপিয়ে দেওয়া সম্পাদক পদত্যাগ করলেন। এই পদত্যাগের ঘটনাটি ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক অসাধারণ বিজয়, ঐতিহাসিক বিজয়। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত সংগ্রামের কাছে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, রাষ্ট্রশক্তি ও হুজুরের দলের সম্মিলিত বাহিনীকে।

সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। যতই দিন যাচ্ছিল ততই বেশি বেশি করে বিজ্ঞান সংস্থাগুলো ‘জাঠা’র মূল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হচ্ছিল এবং জাঠায় অংশগ্রহণ যে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলনের, যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তা বুঝতে পেরে জাঠা-থেকে নিজেদের বি-যুক্ত করেছিল।

ইতিমধ্যে সর্ববৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী জাঠার পক্ষে হাওয়া তুলতে সর্বশক্তি নিয়ে আসরে নামল। ওদের দৈনিকের ‘রবিবাসরীয়’র পাতায় জাঠার উদ্যোক্তা সংগঠনগুলোকে নিয়ে ব্যাপক ফোলানো-ফাঁপানো প্রচার চালানো শুরু হল। একাধিক রবিবারে ঘুরে-ফিরে যারা প্রচারের আলোয় এল, সে-সব সংস্থা একটি সরকারের বড় শরিকের আপন সংগঠন, অন্য সংস্থাগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব এতই অকিঞ্চিৎকর যে তাদের সক্রিয় সদস্য গুনতে খুব বেশি হলে দু’হাতের আঙুলগুলোই যথেষ্ট। তবু ওরা প্রচারের আলোয় এল, ব্যাপকভাবেই এল, শহর ছেড়ে গ্রামে কোনও দিনও আন্দোলনের জন্য পা না বাড়িয়েই এল, ওদের নেতারা বুদ্ধিজীবী বলেই এল, এক-পা সরকারি সাহায্যের দড়িতে, অন্য-পা দেশি-বিদেশি ধন-কুবেরদের দড়িতে রেখে ব্যালেন্সের খেলা দেখাবার যোগ্যতা নিয়ে এল। দেশপ্রেম যখন অট্টহাস্যের বস্তু, আন্দোলন যখন বাজারের পণ্য, বুদ্ধিজীবীরা যখন বুদ্ধিবেচা জীব তখন এমনটা মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। একই সঙ্গে অপ্রত্যাশিত ছিল না রাজ্যসরকারের পত্রিকা ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এর জাঠাকে সার্থক করতে মাত্রাতিরিক্ত ছট-ফটানি। কিন্তু যেটা অপ্রত্যাশিত ছিল তা হল সম্মিলিত জাঠা শক্তির সমস্ত পরিকল্পনাকে ওলট-পালট করে সম্পূর্ণ জাঠাকে ধসিয়ে দিয়ে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে উত্থান ঘটবে এক নতুন শক্তির। আশি বছরে কমিউনিস্টরা এবং পঁয়তাল্লিশ বছরে ভারতের কর্ণধাররা যে সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেনি, যে যুক্তি-সচেতনতা গড়ে তুলতে পারেনি, যে ব্যক্তিস্বার্থ-চিন্তার অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে পারেনি, কয়েক মাসের মধ্যে যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মী ও বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মীরা তাই করে দেখাল। ‘সংগ্রাম’ শব্দটি বইয়ের পাতা থেকে লাফিয়ে নেমে এল মাটিতে। বাবু নেতাদের হটিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল গ্রাম-গঞ্জের এতদিনকার পিছিয়ে থাকা হাজার-হাজার তরুণ। এরা মেকি বিজ্ঞান আন্দোলন রুখতে যে ভাবে জাঠার সঙ্গে অসহযোগিতা করলো, সত্যি বলতে কি জাঠাকে ঘৃণা-ভরে প্রত্যাখ্যান করল তাতে এতদিনকার বিজ্ঞান আন্দোলনের বাবু নেতারা বেকুব। বেকুব কলকাতা, দিল্লির রাজপুরুষেরা, প্রচার বিশেষজ্ঞ পত্রিকাগোষ্ঠী ও দেশি-বিদেশি ধনকুবেররা, যাঁরা মানুষের ভাগ্য বানাতেন, ধসাতেন। সংগ্রামে নামা নতুন নতুন মুখগুলোকে সামাল দেবার ক্ষমতা ছিল না বাবু নেতাদের। ঠান্ডা ঘরে বসে বিজ্ঞান আন্দোলন, যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া, পত্রিকা প্রকাশ করা এক কথা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সার্থক রূপ দিতে দুর্নীতির অপসংস্কৃতির, শোষণের অপসংস্কৃতির, কুসংস্কারের অপসংস্কৃতির পালক শোষক ও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-আধা শহরে সত্যিই সংগ্রামে নামা আর এক কথা। নতুন নতুন মুখের সঙ্গে হাজির হতে লাগল নতুন নতুন কর্মসূচি। কলকাতার রাষ্ট্রীয় শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রে ‘প্রতীচ্য জ্যোতিষ মহা সম্মেলন’-এ (১৫.২.৯২) যুক্তিবাদীরা বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ করল। প্রতারক জ্যোতিষীরা বিক্ষোভ এড়াতে সাংবাদিকদের সামনেই ওই সম্মেলনে যুক্তিবাদীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিতর্কে নামবে কথা দিয়েও নিশ্চিত পরাজয় বুঝে শেষ পর্যন্ত পুলিশ পাহারায় রণে ভঙ্গ দিলেন। যুক্তিবাদীদের লাগাতার দাবি ও আন্দোলনের সামনে নতি স্বীকার করে কর্নাটক সরকার ১ মার্চ ’৯২ ঘোষণা করলেন শিমোগা জেলার দেবী শ্রীরেনুকাম্বা মন্দিরের যাত্রা মেলা নিষিদ্ধ। শ্রীরেনুকাম্বা যাত্রায় শত-শত ভক্ত নর-নারী সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মন্দিরে যেতেন পুজো দিতে। এমন এক অশ্লীল কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী দৃশ্য তারিয়ে-তারিয়ে, চেটে-পুটে উপভোগ করার মতো বিকৃতকাম দর্শকদের অভাব হত না। এমনকী, বিকৃত কামনা থেকেই নগ্ন-ভক্ত বনে যাওয়ার প্রবণতাও অনেকের মধ্যে অবশ্যই ছিল। ১৮ মার্চ ’৯২ কলকাতা দূরদর্শন সমস্ত ন্যায়-নীতিকে সপাটে লাথি কষিয়ে প্রচার করল ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ শিরোনামে জ্যোতিষ শাস্ত্রের পক্ষে জনগণের পকেট কেটে পঞ্চাশ মিনিটের এক বিনে পয়সার বিজ্ঞাপন। জনগণকে অদৃষ্টবাদী করে তোলার এই ঘৃণ্য চেষ্টার বিরুদ্ধে যুক্তিবাদীরা বিক্ষোভ জানিয়েছেন দূরদর্শন কেন্দ্রে। সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা, সাংবাদিক, চিত্র-পরিচালক, গ্রাম-গঞ্জের তরুণ-তরুণী, কে না ছিলেন বিক্ষোভ সমাবেশে ? দূরদর্শন কর্তৃপক্ষের কুশপুতুলে আগুন জ্বলে উঠল। জল গড়াল দিল্লি পর্যন্ত। অনুষ্ঠানটির প্রযোজিকার কাছে এই ব্যাপারে জবাব চেয়ে পাঠালেন কেন্দ্ৰীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক—কেন এমন এক বিজ্ঞান বিরোধী প্রচারমূলক প্রোগ্রামটি দূরদর্শনে সম্প্রচার করা হল? দীপঙ্কর দে পরিচালিত হিন্দি টেলিফিল্ম ‘জ্যোতিষী’ দূরদর্শন আটকে দিল। দূরদর্শনের মান্ডি হাউস কর্তৃপক্ষের বক্তব্য প্রকাশিত হল পত্র-পত্রিকায় কর্তৃপক্ষ কারণ হিসেবে জানাল “এ ছবিটি সম্প্রচার করা হলে কুসংস্কার এবং জ্যোতিষীকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এবং বুদ্ধিজীবীরা সম্প্রচারের পর গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে পারেন।” এমন সম্ভাবনার কথা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তর থেকেই পেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। দেশের মানুষ দেখল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা দপ্তর যুক্তিবাদীদের প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সঙ্গে নজরে রাখছে। ‘জ্যোতিষী’ ছবিটি দেখাবার অনুমতি পাওয়া গেল অনেক বিযুক্তি ও সংযুক্তির পর।

২ মে ’৯২ কেরলের কোচিনে শুরু হল পুত্রকামেষ্টি যজ্ঞ। উদ্যোক্তা কোচিনের ‘দি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোলজিকাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’, সংক্ষেপে ‘CARD’ । নিঃসন্তান হাজার হাজার দম্পতির মধ্য থেকে ১১০০ দম্পতিকে বেছে নিয়েছিল। যুক্তিবাদীদের সরাসরি অভিযোগ ছিল দম্পতি নির্বাচনের সময় CARD তাদেরকেই নির্বাচিত করেছিল, যাদের সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিল সন্তান না হওয়ার জন্য দায়ী পুরুষের জন্মদানে অক্ষমতা। CARD তাদের ২০০ কর্মীর সাহায্যে জীববিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারেই সন্তান উৎপাদন করতে সহায়তা করবে, এবং মা হওয়ার তীব্র আকুতি থেকেই মাতৃত্ব লাভের পর রমণী সত্য গোপন করবেন-মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটাই স্বাভাবিক। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী কে. করুণাকরণ এই মহাযজ্ঞ উদ্বোধন করবেন, এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু করুণাকরণ কথা দিয়েও কথা রাখতে পারলেন না যুক্তিবাদীদের তুমুল বিরোধিতায় ।

‘মিষ্টিবাবার বিপুল উত্থানে ভারত কেঁপে উঠল। তামাম ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হল মহারাষ্ট্রের পুণে জেলার শহর বারামতির এক ধনী-কৃষক ভানুদাস গায়কোয়াড়ের কথা। একদিন স্বপ্নভঙ্গের পর ভানুদাস পেল এক অলৌকিক ক্ষমতা। ভানুদাসের সারা শরীর যেন মিষ্টি তৈরির কারখানা, যাতে হাত ছোঁয়ায় তাই মিষ্টি হয়ে যায়, তা সে স্টিলের কলম, মোটর-বাইকের হ্যান্ডেল, জল বা কাঁচালঙ্কা—যাই হোক না কেন । পুণে ও বোম্বের তা বড় ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা ভানুদাসকে পরীক্ষা করে হতবাক। রক্ত, ঘাম, মূত্র-কোনওটাতেই বিশেষ কোনও নিঃসরণের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। সব স্বাভাবিক। রক্ত ঘাম, মূত্র, থুতুর ওপর বিশেষ পরীক্ষা চালিয়েও আমেরিকার বিজ্ঞানীরা স্বাভাবিকত্বের বাইরে কিছুই পাননি। অথচ সাবান বা রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে হাত ভালো করে ধুইয়ে দিয়েও ভানুদাসের মিষ্টি তৈরির কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। এমন এক সারা জাগানো খবরকেও তাড়া করল যুক্তিবাদীরা। ভানুদাসকে ঘিরে গড়ে ওঠা ক্ষমতালোভীদের চক্রান্তকে ভেঙে মিষ্টি করার ক্ষমতাও হল অদৃশ্য ।

হুজুর সাইদাবাদী বাংলাদেশের সবচেয়ে বাঘা প্রচার পাওয়া অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদার। এ-দেশে এসে বে-আইনিভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অলৌকিক শক্তির প্রভাবে নানা রোগমুক্তির কথা ঘোষণা করত। প্রধান শক্তি অবশ্য ছিল নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তান দান। কলকাতায় হুজুর সাইদাবাদীর আনাগোনা শুরু হল। যুক্তিবাদীদের উৎপাত ঠেকাবার ভার সাইদাবাদী তুলে দিলেন স্থানীয় সমাজ-বিরোধী, খুনে ও মস্তানদের হাতে। রাত দুপুরে দামাল কিছু যুক্তিবাদী হুজুরের ভাড়াটে সেনাদের চোখের সামনে হুজুরের হোটেলের আশেপাশে হুজুরেরই বিরুদ্ধে এক গাদা পোস্টার সাঁটল। কলকাতার মস্তান রাতের শাসকরা সব কিছু দেখল, বুঝল তাদের সম্মানের কান-কাটা যাচ্ছে, তরতাজা বেপরোয়া যুক্তিবাদী ছেলেগুলোর মধ্যে তাদের সর্বনাশের যে ছায়া দেখেছিল, তাই বাচাল খুনেদেরও মূক করে রেখেছিল। যুক্তিবাদীরা হুজুরের বিরুদ্ধে ডেপুটেশন দিল বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে, ডাইরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশের কাছে, রাজ্য স্বরাষ্ট্র-সচিবের কাছে। পুলিশ নড়ে-চড়ে বসল না। সাইদাবাদী আবার ঘুরে যেতে লাগল। চালিয়ে যেতে লাগল এ-দেশের আইন ভেঙে মন্তরে রোগমুক্তি ও সন্তানদানের পক্ষে প্রচার। যুক্তিবাদী সমিতি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের ডি.জি ও পুলিশ কমিশনারকে জানাল, পুলিশ যদি হুজুরের এমন প্রতারণা বন্ধে সচেষ্ট না হয় তবে যুক্তিবাদী মানুষরাই নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে বাধ্য হবে। এ-বার কাজ হল। কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব মণীশ গুপ্তকে লেখা এক গোপন বার্তায় আবেদন জানালেন বাংলাদেশের নাগরিক মোহম্মদ সইদুর রহমান ওরফে হুজুর সাইদাবাদী ও তাঁর তিন পার্শ্বচরের ভারতে ঢোক বন্ধ করা হোক। যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন পুলিশ কমিশনার জানালেন আগামীবার যদি হুজুরের আগমন ঠেকাতে না পারি, ওকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তারের জন্য আপনাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই পরামর্শ করব।

যুক্তিবাদীরা হুজুরের সমস্ত ব্যূহ ভেদ করে হুজুরের মুখোমুখি হয়েছে, নানা প্রতারণার প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। আকস্মিক হানায় হুজুরের ভাড়াটে সেনারা যুক্তিবাদীদের শক্তির পরিমাপ করতে করতে যুক্তিবাদীরা কাজ শেষ করে জলে মাছের মতোই মিশে গেছে।

যুক্তিবাদীরা লড়াই শুরু করল শোষক ও শাসকদের বিরুদ্ধে। এ লড়াই কোনও আর্থিক দাবি আদায়ের লড়াই নয়। শোষণ প্রক্রিয়া চালু রাখার স্বার্থে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই। গণ-সংগীত, নাটক, মাইম, সাহিত্য—সব কিছুর সাহায্যেই সমাজ ‘সাফাই’ শুরু হল।

বুদ্ধদেব, সঞ্জীব, সিরাজ, নবনীতা, প্রফুল্ল, কিন্নর রায়, সুপ্রিয় সেন, প্রমুখ বহু লেখকের গল্পে উপন্যাসে দেখা গেল যুক্তিবাদী চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করা একটি চরিত্রকে। দূরদর্শনের পর্দায় যুক্তিবাদীরা হাজির হল ‘টার্নিং পয়েন্ট”, ‘রজনী’, ‘ছোটো বড়ি বাতে’, বাংলা সিরিয়াল ‘প্রবাহ’-তে, সুমনের গানে, পত্র-পত্রিকার সংবাদে, সম্পাদকীয়তে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যুক্তিবাদীরা একটা বড় রকমের ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াল। বাম রাজনীতির বড় শরিক সমমনোভাবাপন্ন দলগুলোর কাছাকাছি আসার প্রচেষ্টা-আলোচনায় একাধিকবার উল্লেখ করলেন, জনগণের উপর যুক্তিবাদীদের দ্রুত-বর্ধমান প্রভাবের কথা। শহরে-আধাশহরে-গ্রামে-গঞ্জের সভায়, পথসভায় স্বতঃস্ফূর্ত শ্রোতা ও দর্শকদের সংখ্যা যে কোনও সভা-পথসভাকে বার বারই টেক্কা দিতে লাগল। না, এ-সব দর্শকরা কলকাতা দর্শন করবার মানসিকতা নিয়ে আসে না, দল থেকে কিছু পাওয়ার ধান্দা নিয়ে আসে না। এরা যুক্তিবাদী চিন্তাধারার আকর্ষণে আসে, আদর্শবাদী দামাল প্রাণতুচ্ছ করা যুক্তিবাদী আন্দোলনের মানুষগুলোর কাজ-কর্মে শ্রদ্ধা রেখে আসে। সরকার পক্ষ, বিরোধী পক্ষ পুলিশ সবাই অবাক। এরা চায় কী? সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রে যে ঘুম ভাঙার গান গাইছে, ঘর ভাঙার গান গাইছে, তাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংকেত নেই তো? উদ্বিগ্ন পুলিশের ও গোয়েন্দা দপ্তরের কাজ বাড়ল । যুক্তিবাদীদের বিরোধিতার ও জন-সচেতনতা মুখে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা পুজো উদ্বোধন ও জ্যোতিষ সম্মেলন উদ্বোধনের প্রচলিত ধারা থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীরা ভাগ হল, বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মীরা ভাগ হল, ছাত্র-ছাত্রীরা ভাগ হল, বুদ্ধিজীবীরা ভাগ হল, রাজনীতি ভাগ হল, সমাজ ভাগ হল, যুক্তিবাদী বাম রাজনীতিকরাই অ-যুক্তিবাদী বাম রাজনীতিকদের পুজো-কালচার, জ্যোতিষ কালচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হল। যুগটাই কেমন যেন পাল্টে গেল। স্কুল-কলেজের ছেলে মেয়েদের মধ্যে, যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে যুক্তিবাদীরা বাসা বাঁধল। সায়েন্স কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সর্বত্রই যুক্তিবাদীরা দ্রুত বংশ বিস্তার করল। পশ্চিমবঙ্গের বড় রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় মুখপত্রে যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতার চরিত্র হনন করে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে ধসাতে চাইল। পুরো পাতা জুড়ে তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হল একটিমাত্র উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতাকে আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করা ও নেতার চরিত্র হনন করা। প্রত্যাশা পূরণ তো হলই না বরং ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করল। তাদের দলেরই ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন, রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠন, লেখক ও শিল্পী সংগঠন ও শ্রমিক পত্রিকার এমন মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করল। নিজেদের দলীয় কর্মী ও নেতাদের সোচ্চার প্রতিবাদে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল ‘সত্যিই যুক্তিবাদীরা একটা ফ্যাক্টর’। গোয়েন্দারা কোন্ যুক্তিবাদীদের উপর নজর রাখবে—এটাই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। ওরা দেখল পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের ছেলে যুক্তিবাদী, ভাববাদে নিবেদিত প্রাণ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাক্তার ভোলানাথ চক্রবর্তীর ছেলে যুক্তিবাদী, মার্কসবাদী মন্ত্রী গৌতম দেবের স্ত্রী যুক্তিবাদী, বরেণ্য চিকিৎসক ডাক্তার আবিরলাল মুখার্জি যুক্তবাদী, বিশ্ববরেণ্য চিত্র-পরিচালক মৃণাল সেন, তপন সিংহ, গৌতম ঘোষ যুক্তিবাদী, রাজ্য সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের ডিরেক্টর দিলীপ বসু যুক্তিবাদী, সাংবাদিক খুশবন্ত সিং, জ্যোতির্ময় দত্ত যুক্তিবাদী। সাহিত্যিক ডঃ পবিত্র সরকার, মহাশ্বেতা দেবী, নারায়ণ সান্যাল, আবদুল জব্বার যুক্তিবাদী, প্রতুল মুখার্জি যুক্তিবাদী। যুক্তিবাদীরা যেন এল, দেখল জয় করল।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব যুক্তিবাদীদের কাছে যেন একটা উৎসব। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে নয়, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের মধ্যে দলে দলে যুবক-যুবতীরা গ্রামে-গঞ্জে সংগঠিত করতে লাগল আন্দোলন, সংগ্রাম। যুক্তিবাদী চিন্তাধারা যে আন্দোলন সৃষ্টি করল তা স্বতঃস্ফূর্ত । যতবার যুক্তিবাদীরা আক্রান্ত হয়েছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আক্রমণকারীদের ততবারই প্রবল তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। যুক্তিবাদী আন্দোলন নাড়িয়ে দিয়েছে সংসদীয় প্রণালীর সমস্ত দুর্নীতি ও ভণ্ডামিকে। বিধানসভায়, লোকসভায় যুক্তিবাদীদের কোনও নিজস্ব প্রতিনিধি নেই। তবু লোকসভা ও বিধানসভাকে অনেক সময়ই অতিমাত্রায় সচেতন থাকতে হয়েছে যুক্তিবাদীদের নিয়ে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলোর প্রচার মাধ্যমগুলোতেও বার বার উঠে আসতে লাগল ভারতের যুক্তিবাদী আন্দেলনের কথা। বাংলাদেশের প্রাচার মাধ্যমগুলোতেও আলোড়ন তুলল যুক্তিবাদীরা।

‘৯২-এর ১ মার্চ ‘যুক্তিবাদী দিবস’ পালন করল পৃথিবীর ২৭টি দেশ । পৃথিবীর কট্টরতম মৌলবাদী দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবের বাহারিন ও রিয়াধ থেকেও যুক্তিবাদীরা চিঠি দিয়ে ‘যুক্তিবাদী দিবস’ উদযাপনের কথা জানাল। ভারতের যুক্তিবাদীরা যে ১ মার্চকে ‘যুক্তিবাদী দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু করেছিল, তাই স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে হয়ে দাঁড়াল বাস্তবিকই ‘আন্তর্জাতিক যুক্তিবাদী দিবস’।

যুক্তিবাদের বিশাল উত্থানে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ও কেন্দ্রে শাসকের ভূমিকায় থাকা দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দর্শনের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ‘৯২-এর শেষ ভাগে এককাট্টা হল। যুক্তিবাদী দর্শনের বিজয়-রথের গতি প্রতিহত করতে ভাববাদী দর্শনের ব্যাপক প্রচারের জন্য বিবেকানন্দকে সামনে রেখে ‘রাষ্ট্রীয় চেতনা বর্ষ’ পালনের পরিকল্পনা নিল কংগ্রেস, বি. জে. পি, সি. পি. এম, সি. পি. আই, জনতা দল-সহ তথাকথিত বিপরীত মেরুর দলগুলো। সঙ্গে যোগ দিলেন বিপানচন্দ্র, হাবিব তবির প্রমুখ তথাকথিত প্রগতিশীলতার সিলমোহর দাগা বুদ্ধি বেচে খাওয়া বুদ্ধিজীবীরা। যুক্তিবাদী আদর্শের সর্বগ্রাসিতা থেকে দলের ক্যাডার বাঁচাতে বড় মার্কসবাদী দলের দৈনিক পত্রিকায় ’৯২-এর শেষ অর্ধে পুস্তক সমালোচনার নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ ফেঁদে বোঝানো হল— মার্কসবাদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধ আছে বলে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা একান্তই ভুল। ধর্মের সঙ্গে মার্কসবাদের কোনও বিরোধ নেই।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে এলেন খ্রিস্টান জগতের বিশাল অলৌকিকবাবা মরিস সেরুলো। স্টার টিভি’র এক ইন্টারভিউতে সেরুলো জানিয়েছিলেন, “না, এখনও পর্যন্ত ভারতের যুক্তিবাদী সমিতির মুখোমুখি হইনি”। ‘৯২-এর ১৩, ১৪, ১৫ অক্টোবর জনপ্রিয় বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় যথাক্রমে সিকি পাতা, আধ পাতা ও এক পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে সেরুলো জানালেন ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে সেরুলো অলৌকিক উপায়ে রোগীদের রোগ আরোগ্য করবেন, অন্ধকে দেবেন দৃষ্টি, বোবাকে দেবেন স্বর, বধিরকে দেবেন শ্রুতিশক্তি, খঞ্জকে চলার শক্তি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে খ্রিস্টান মিশনারিরা এ-নিয়ে লিফলেট বিলোলেন । সেরুলোর অলৌকিক ক্ষমতার জ্বরে গোটা পশ্চিমবঙ্গ থথর্ করে কাঁপতে লাগল। এমন অলৌকিক রোগমুক্তির বিজ্ঞাপন প্রকাশ যদিও The drug and magic remedies (Objectionable Advertisement) Act, 1954 অনুসারে বে-আইনি তবু পুলিশ ও প্রশাসন আইনের লঙ্ঘন দেখেও নীরব রইলেন। এমন অলৌকিক চিকিৎসা যদিও বে-আইনি তবু এই প্রকাশ্য সমাবেশে পুলিশ সরবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এল। সেরুলোর হয়ে লিফলেট বিলোল পুলিশ। দু-হাজার স্বেচ্ছাসেবক, একশো নিজস্ব দেহরক্ষী ও বিশাল পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সুসজ্জিত মঞ্চে সেরুলো এলেন। মঞ্চে হাজির ছিলেন সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রেল চার্চের বিশপ গড়াই ও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁদের মধ্যে আছেন সরকারি পদাধিকারীরাও। অন্তত তিরিশ হাজার দর্শকের ভিড়। ভিড়ের শতকরা প্রায় চল্লিশ ভাগই অন্ধ, মূক, বধির খঞ্জ, মানসিক প্রতিবন্ধী। শয্যাশায়ী রোগীও এসেছেন টেম্পো, মোটর, বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে বর্ধমান, বাঁকুড়া, শিলিগুড়ি থেকেও। যাত্রার অভিনেতার মতোই চড়া সুরের অনেক নাটকীয় মুহূর্ত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সেরুলো এক সময় জনতার মধ্যে এনে দিলেন গণ-উন্মাদনা। উন্মত্ত জনতা দু-হাত তুলে আবেগমথিত স্বরে আওয়াজ তুলল, ‘হালে লুইয়া’। সেরুলো জানালেন ঈশ্বরের দূতরা এই মুহূর্তে এই ময়দানে নেমে এসেছেন, প্রত্যেককে রোগমুক্ত করছেন। সেরুলোর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দিতে স্বেচ্ছাসেবকরা এরপর এক এক করে রোগী তুলতে লাগল মঞ্চে। এরা প্রত্যেকেই রোগমুক্তির কথা বলতে লাগল। এক যুক্তিবাদী তায়াম সাংবাদিক ও দর্শকদের সামনে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করল, মঞ্চের রোগীরা প্রত্যেকেই সেরুলোর সাজানো রোগী, অর্থাৎ প্রতারক। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে সেরুলো গর্জালেন, গর্জাল সেরুলোর দেহরক্ষীরা ও সেরুলোর পৃষ্ঠপোষক পুলিশ। অভিমন্যুর মতোই আটকা পড়ল মঞ্চের যুক্তিবাদী। দেহরক্ষীরা যুক্তিবাদীকে মঞ্চের মধ্যেই ঘিরে ফেলতে চাইল, একটু আড়াল, পেট ফেড়ে ফেল বা গলায় একটা পোঁচ—শব্দহীন মৃত্যু—গোলেমালে জনবিক্ষোভে মৃত্যু-বেনিফিট অফ ডাউট—হত্যাকারী কেউ নয় !

দর্শকদের মধ্যে রোগীদের মধ্যে মিশে থাকা যুক্তিবাদীদের হাতগুলো আকাশের দিকে ছুড়ে দিল প্রচারপত্র। মাঠ জুড়ে উড়তে লাগল প্রচারপত্র। পুলিশের ঢালের দেওয়াল ভেদ করে, স্বেচ্ছসেবক ও দেহরক্ষীদের প্রতিরোধের পাঁচিল চুরমার করে মঞ্চে উঠে আসতে লাগল যুক্তিবাদী তরুণরা। পুলিশের লাঠি নির্দয়ভাবে এসে আছড়ে পড়ছে যুক্তিবাদীদের শরীরে। যুক্তিবাদী কণ্ঠ মঞ্চের মাউথপিস ছিনিয়ে নিয়ে দাবিতে সোচ্চার হল—এই বুজরুকি পুলিশকেই বন্ধ করতে হবে, সেরুলোকে সহযোগিতা বন্ধ করতে হবে, সেরুলোকে ও তার দলবলকে প্রতারণার দায়ে গ্রেপ্তার করতে হবে। যুক্তিবাদীর সুরে সুর মিলিয়ে মঞ্চের ঠিক নিচে দাঁড়ানো সাংবাদিক ও চিত্র-সাংবাদিকরা সোচ্চার হলেন। জনতা ক্ষুব্ধ উত্তাল। গোটা ময়দান যেন শুধু যুক্তিবাদী, যুক্তিবাদী আর যুক্তিবাদীতে ভরা। জনা পঞ্চাশ যুক্তিবাদী হত । তবু মঞ্চের দখল নিল ওরা। মঞ্চ থেকে সেরুলোর ভাড়াটে সেনারা বুকের ব্যাজ পকেটে পুরে দ্রুত জনতার মধ্যে মিশে যেতে তৎপর হল। যুক্তিবাদীদের প্রতিজ্ঞা কঠোর মুখগুলোর দিকে চেয়ে এ-ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ওদের। যুক্তিবাদী, সাংবাদিক ও জনতার মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া দাবিকে নত-মস্তকে মেনে নিয়ে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মাইকে ঘোষণা করলেন—সেরুলোর বুজরুকি ধরা পড়েছে। আমরা ওকে আর বুজরুকি চালাতে দিতে পারি না। এখানেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করছি।

লোকেরা অবাক হয়ে দেখল, পুলিশরা হতবাক্ হল, এত বিশাল মাপের একটা সভা বন্ধ করতে যুক্তিবাদীরা না ছুড়ল বোমা, না চালাল গুলি। এল, বিশাল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জনগণ ও সাংবাদিকদের শক্তিকে নিজেদের সঙ্গে যূথবদ্ধ করল এবং সেরুলো ও পুলিশ বাহিনীর সম্মিলিত বিশাল শক্তিকে, বিরাট প্রতিরোধকে ভেঙে চুরমার করে জয় ছিনিয়ে আনল ।

সে রাতেই উদ্বাস্তু খোদ লালবাজার পুলিশ বাহিনী খুঁজে বের করলেন যুক্তিবাদীদের নেতাদের। লালবাজারেই আলোচনায় বসলেন পুলিশের বড়-মেজ কর্তারা। যুক্তিবাদীদের দাবি মেনে নিয়ে গ্রেপ্তার করা হল সেরুলোর দুই সঙ্গীকে। সেরুলোকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হল। রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন রাখল সেরুলোকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করার জন্য। খোদ পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করলেন— এ’বার থেকে ভাগ্য পরিবর্তন বা অলৌকিক চিকিৎসার দাবিদাররা প্রকাশ্য-সমাবেশ করতে চাইলে তাদের ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে যুক্তিবাদী সমিতির সামনে।

সেরুলোবাবার বিজয়রথের চাকা পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে, ভারতের মাদ্রাজ হয়ে কলকাতায় এসে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। এ খবর গোটা দেশের প্রতিটি বিখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশিত হল, বিদেশেও পৌঁছে গেল। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার, স্টেটস্ম্যান, আজকাল ও সংবাদ প্রতিদিন-এ যুক্তিবাদীদের এই বিজয় নিয়ে সম্পাদকীয় পর্যন্ত প্রকাশিত হল।

সেদিনের আন্দোলন যুক্তিবাদীদের সামনে আরও একটি বিজয় এনে দিয়েছিল। গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের নেতাদের হুইপ অমান্য করে সেরুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে সেদিন ময়দানে যুক্তিবাদী সমিতির পাশে সমিতির আরও বহু সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন গণবিজ্ঞান সমন্বয়কেন্দ্রের কিছু সদস্য। হতে পারেন তাঁরা মুষ্টিমেয়, তবু গণবিজ্ঞান সমন্বয়ের নেতারা এই খবর কাগজে পড়ে অবশ্যই হতচকিত হয়েছিলেন। যে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রকে আমরা চিঠিতে আন্দোলনে শামিল হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েও পাইনি জ্যোতিষীদের বেআইনি সম্মেলনের বিক্ষোভে, হুজুর সাইদাবাদীর অলৌকিক রোগ নিরাময় ও মাতৃত্ব দানের দাবির বিরুদ্ধে আন্দোলনে, দূরদর্শন হুজুর সাইদাবাদীর অলৌকিক রোগ নিরাময় ও মাতৃত্ব দানের দাবির বিরুদ্ধে আন্দোলনে, দূরদর্শন কেন্দ্রের ‘দ্যা ড্রাগ ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট’ ভঙ্গ করে গ্রহরত্নে রোগমুক্তির পক্ষে প্রচার চালানোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশে। যে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের নেতারা কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনে শামিল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই বলে তাদের বার্ষিক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, সেই সমন্বয় কেন্দ্রের ব্যানার নিয়ে সেদিন কিছু ছেলে আন্দোলনে শামিল হয়ে নেতৃত্বের মেকি আন্দোলনের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বেশ কিছু দিন ধরে পত্র-পত্রিকাগুলো যেভাবে সেরুলো নিয়ে প্রচুর নিউজ প্রিন্ট খরচ করলেন, প্রচুর কিছু লিখলেন তাতে গণবিজ্ঞান সমন্বয়ের নেতারা জনগণ ও সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে অথবা জনপ্রিয়তার স্রোতে গা ভাসাতে নিজেদের লাইন থেকে সরে এসে সেরুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখতে বাধ্য হলেন।

চার নভেম্বর ‘৯২ নতুন দিল্লি তোলপাড় করে পাইলটবাবা পাঁচ দিনের জল-সমাধি নিলেন একটি চৌবাচ্চায়। উদ্দেশ্য—বিশ্বশান্তি। বিহারের সাসারামের এই যোগী ‘৫৬ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে ন্যাট ও হান্টার চালিয়েছিলেন। ‘৬৫-তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।

দাবি করেন, ব্রহ্মের প্রথম দর্শন পান আকাশে বিমান চালানোর সময়। তারপর একাধিকবার ব্রহ্মদর্শন হয়েছে। ‘৭৩ থেকে হিমালয়ে সাধনা করে ৮০-তে সিদ্ধিলাভ। এখন জীবন উৎসর্গ করেছেন বিশ্বশান্তির কাজে। ৮৪-তে সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে ছিলেন সারা পৃথিবীতে শিষ্য সংখ্যা ১০ কোটি। আশা করা যায় এখন সংখ্যাটা আরও একটু বাড়িয়েই বলবেন। বর্তমান নিবাস বিকাশপুরী। বহু মন্ত্রী, রাজনীতিকরা তাঁর আশীর্বাদ নিতে ঘোরাঘুরি করেন। প্রধানত হিন্দি পত্র-পত্রিকায় পাইলটবাবা প্রচুর প্রচার পেয়ে সুপার স্টারের মর্যাদা অর্জন করেছেন। এমন এক বাবাজিও ছাড়া পেলেন না যুক্তিবাদীদের হাত থেকে। নতুন দিল্লির যুক্তিবাদীরাই চ্যালেঞ্জ জানাল পাইলটবাবাকে । বলল, চৌবাচ্চায় কৌশল রয়েছে, আর পাইলটবাবার রয়েছে বুজরুকি। কাচের চেম্বারে জলের নিচে দু-ঘণ্টা থেকে ক্ষমতার প্রমাণ দিতে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাল যুক্তিবাদীরা। কাগজে-কাগজে বিশাল হইচই। পাইলটবাবা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসার মতো বোকা সাহস না দেখিয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শনই বুদ্ধিমানের কাজ বলে ধরে নিলেন। দেশের পত্রিকাগুলো সে খবরও প্রকাশ করল।

বাঘ, সিংহ জ্যোতিষীরা প্রকাশ্য সভায়, সম্মেলনে, লিখিতভাবে স্বীকার করতে শুরু করে দিলেন— ‘জ্যোতিষ শাস্ত্র অবশ্যই বিজ্ঞান নয়, এখনও গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞান বলে প্রমাণিত হতে পারে, আবার নাও পারে।’ যুক্তিবাদীদের কঠিন কঠোর আক্রমণের মুখে মান বাঁচানোর মতো এ-ছাড়া আর কোনও পথই ছিল না জ্যোতিষী চূড়ামণিদের। বারাসাতের তাবিজ বেচা ফকির, কৃষ্ণনগরের বিষ পাথরের পাদ্রি চিকিৎসক, মুর্শিদাবাদের ওঝা, ঝাড়গ্রামের গুণিন, কুইলনের ভরবিষ্ট মাধবী, কাঞ্চিপুরমের অলৌকিকবাবা, শিলচরের পির, কামরূপের তান্ত্রিক, কামাখ্যার ভৈরবী, আগরতলার ফুলবাবা, পুরুলিয়ার অবাক মেয়ে মৌসুমি, এমনি শত-শত বাবা-মা-ওঝা-ফকির-পাদ্রিদের বুজরুকি বন্ধ হয়েছে—হচ্ছে হবে যুক্তিবাদীদের হাতে। পৃথিবীতে আর কোনও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

আন্দোলনের উপর বার বার আঘাত এসেছে নানা ভাবে। আর প্রতিবারই যুক্তিবাদীরা জয়কে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে কোয়ার্টার চান্সকেও কাজে লাগিয়ে এই আঘাত এসেছে অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের কাছ থেকে, জ্যোতিষীদের তরফ থেকে, ধর্মোন্মাদদের কাছ থেকে, রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে, শাসক দলের কাছ থেকে, শোষক দলের কাছ থেকে, শাসক ও শোষক দলের দালাল পত্রিকাগোষ্ঠীর কাছ থেকে, দালাল মেকি আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে। এই আক্রমণ কখনও এসেছে সরাসরি নেতাকে হত্যার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। এক একটি লোমহর্ষক, পরিকল্পিত হত্যার প্রচেষ্টা এবং তাকে ব্যর্থ করা নিয়েই লেখা যেতে পারে কল্পনার চেয়েও আকর্ষণীয় উপন্যাস। কখনও বা চেষ্টা চালানো হয়েছে নেতার চরিত্র হননের। গল্পে, উপন্যাসে চরিত্রকে বিকৃত করা হয়েছে। পত্রিকায় প্রবন্ধের নামে তথ্যের পরিবর্তে চূড়ান্ত মিথ্যাচারিতা করা হয়েছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রশক্তিকে সাহায্য করতে কোনও কোনও সংস্থাও এগিয়ে এসেছে। একটি মনোরোগ চিকিৎসার ইনস্টিটিউটের তরফ থেকে যুক্তিবাদী সমিতির বিশিষ্ট নেতার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, ওই নেতা মাঝেমধ্যে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে যে ডিগ্রিটি ব্যবহার করেন তা জাল। ডিগ্রি ব্যবহার করা বা না করা যে ডিগ্রির অধিকারীর ইচ্ছাধীন এবং অতি-প্রয়োজনে ছাড়া কোনও ডিগ্রি ব্যবহার না করার অর্থ অনেক সময় যে ‘অবৈধ’ নয়, আন্দোলনের স্বার্থেই নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রচেষ্টা’ বা ‘বিনয়’, এমন কথাটা আখের গোছানো মানুষদের কাছে মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক। রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাওয়ার পর কলকাতা পুলিশের বড় কর্তা নিজেও কম বিস্মিত হননি ঈর্ষার এমন রূপ দর্শনে। ব্যক্তি ঈর্ষা থেকে, না হুজুরদের গোলামি করার মানসিকতা থেকে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করতেই এমন অভিযোগ আনা-কে জানে? অথচ বর্তমান সমাজে এত প্রতারণা, এত দুর্নীতি দেখেও সোচ্চার হতে, আন্দোলন করতে তো ওই ইনস্টিটিউটটিকে বা ইনস্টিটিউটটির প্রাণপুরুষটিকে দেখলাম না? দেখলাম না শোষক ও শাসকদের বিরুদ্ধে একবারের জন্যেও সোচ্চার হতে! যা দেখেছি, সে তো প্রগতিশীলতার মুখোশের আড়ালে শাসকদলের চাটুকারিতা করে সরকারি সাহায্য আদায় করতে ও সরকারি পুরস্কার পেতে। একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে এ খবরও পেয়েছি ওই পত্রিকায় নাকি পত্র দিয়ে ওই ইনস্টিটিউটের তরফ থেকে জানানো হয়েছে ওই নির্দিষ্ট যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা জনৈকার শ্লীলতাহানিও করেছেন। কার শ্লীলতাহানি করা হল? তেমন কোনও নির্দিষ্টভাবে কারও নাম নাকি ছিল না। অভিযোগটি খাড়া করার মতো কোনও ‘হাফ-গেরস্ত’ এখনও পাওয়া যায়নি বলেই বোধহয় এখনও ওঁরা কেসটা নিয়ে কোর্টে যাননি। দোসর হিসেবে বাজারে শ্লীলতাহানির গুজব ছড়াতে ওই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে হাতে হাত মেলাল আমেরিকা থেকে কল টিপে চালানো স্বঘোষিত বিজ্ঞানমনস্ক মাসিক পত্রিকা গোষ্ঠী। ওই মাসিক পত্রিকা গোষ্ঠীর প্রাণ-পুরুষটি শুধুমাত্র হুজুরদের দালাল শ্রেণির লোক নন, পুলিশ বিভাগের পদস্থ অফিসারও। তবুও বেচারার ক্ষমতা হল না গুজবকে আইনের দরবারে হাজির করে চক্রান্তকে সার্থক রূপ দেওয়ার। সত্যিই, এদের বিরুদ্ধে কোনও ঘৃণাই উপযুক্ত নয়। সমাজের উপরতলায় বসে থাকা এই সমাজ-বিরোধীদের ভূমিকা ভাড়াটে খুনের চেয়েও ঘৃণ্য। এরা শুধু একজন ব্যক্তিকে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মাতেনি, মেতেছে একটা আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে। ওই আন্দোলন ছেড়ে দিলে নিশ্চিতভাবেই এইসব আঘাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যেত। আন্দোলন সঠিক পথে থাকলে নেতার উপর এই আঘাত অনিবার্য—এই কথাগুলো যুক্তিবাদীদের অজানা নয় ৷ এ কথাও তাদের কাছে অজানা নয়— যে নেতা অর্থ, ভয় বা নারীদেহের কাছে নিজের আদর্শকে বিক্রি করে দিতে পারে, সেই নেতাকে কিনে আন্দোলনকে নিজেদের লেজুড় করতে শাসক ও শোষকদের তো কোনও অসুবিধে হওয়ার কথাই নয়? তবে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে লাগাম পরাতে বার বার শাসক-শোষক জুটি কেন ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়ে চলেছে? যুক্তিবাদী আন্দোলনের গতিই সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব আপসহীন, নির্ভীক, সৎ সম্মিলিত বিশাল বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ শক্তি নিলেও লাগাতার জয় আনতে সক্ষম এবং এ লড়াই প্রতিটি সাধারণ মানুষের হক্ আদায় করার লড়াই—এই বিশ্বাস সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। এই সক্ষমতাই বিরোধী শিবিরে কাঁপন ধরিয়েছে। তাই নেতাকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে ধ্বংস করতেই চরিত্র হননের সেই পুরোনো খেলায় মেতেছে ওরা।

এই যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতার বিরুদ্ধে দালাল শ্রেণির কয়েকজন তথাকথিত বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতা গুজব ছড়াতেও সচেষ্ট হয়েছে— “উনি ভাববাদের পক্ষেও লেখেন, বিপক্ষেও লেখেন।” অথচ গুজব রটনাকারীরা খুব ভালোরকমভাবেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন—ওই নেতা কোনও লোভ বা ভয়ের কাছে আদর্শ বেচেন না, অতএব ভাববাদী শিবিরের কাছে আদর্শ বেচারও প্রশ্নই ওঠে না। তবু ওঁরা গুজব ছড়ালেন, যদিও ওদের এও ভালোমতোই জানা, ওই একই নামের আর এক স্বল্প-পরিচিত লেখকের অস্তিত্বের কথা—যিনি রামকৃষ্ণ মিশন (নরেন্দ্রপুর) থেকে প্রকাশিত পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত এবং মাঝে-মধ্যে অন্য পত্রিকায়ও ভাববাদী বিষয় নিয়ে অল্প-স্বল্প লেখা-লেখি করে থাকেন। ঘৃণ্য এই মিথ্যা গুজব ছড়াবার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মীরা সচেষ্ট হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন তীব্র ঘৃণায় গুজব রটনাকারীদের পক্ষ থেকে প্রমাণ হাজির করতে না পারার অপরাধে—এও আমরা দেখলাম। এটা ‘গুজব-সংস্কৃতির’ বিরুদ্ধে যুক্তিবাদেরই বিজয় ৷

যুক্তিবাদী আন্দোলন আজ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে, পেয়েছে

নতুন গতিবেগ। এতাবৎকালের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের থেকে

ভিন্ন চরিত্রের এই আন্দোলনের নাম আমরা দিতেই পারি

‘তৃতীয় আন্দোলন’। এতাবৎকালের প্রচলিত দুটি আন্দোলন

ধারার একটি প্রতিক্রিয়াশীল এবং অপরটি তথাকথিত

প্রগতিশীল। এই দুই ধারার থেকে ভিন্নতর এই

‘তৃতীয় আন্দোলন’ ধারার মধ্যে রয়েছে

একটি সম্পূর্ণ জীবন-দর্শন প্রতিষ্ঠার

সংগ্রাম যা সরাসরি রাজনীতি, ভোট

ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত নয়, কিন্তু

রাজনীতিকে বিপুলভাবে

প্রভাবিত করার

ক্ষমতাধারী।

প্রয়োগ থেকে উদ্ভূত এবং প্রয়োগের মাধ্যমে পরীক্ষিত এই ‘তৃতীয় আন্দোলন’ আজ একই সঙ্গে আলোড়ন, বিস্ফোরণ এবং সংগ্রাম। এই আন্দোলনে যে স্বতঃস্ফূর্ততার জোয়ার এসেছে সেই জেয়ারের ঢেউ তীব্র আঘাত হেনেছে বর্তমান পচন ধরা সমাজের ভারসাম্যে ।

দেশে যখন বিপ্লবের পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে, তখন বিচ্ছিন্নতাবাদকে বিপ্লবে রূপান্তরিত করতে যা অনিবার্য ভাবে প্রয়োজনীয়, তা হল চেতনার অগ্রগতি, শোষণমুক্তির পথ খুঁজে পাওয়ার মতো চিন্তার স্বচ্ছতা—যা দিতে পারে যুক্তিবাদী চিন্তাধারা, যুক্তিবাদী আন্দোলন, তৃতীয় আন্দোলন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ বিভ্রান্তির সংস্কৃতিঃ বাঁচাও তাহারে মারিয়া

অধ্যায়ঃ দুই

♦ অপসংস্কৃতি ও সুস্থ সংস্কৃতিঃ পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হোক সুচেতনার পথে

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাংস্কৃতিক বিপ্লবঃ পৃথিবীর পথে হাজার বছর হাঁটা

অধ্যায়ঃ চার

♦ ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ কেউ কথা রাখেনি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ নকশালবাড়ির সংগ্রামে উব্ধুদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন, সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনঃ এসো আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই

অধ্যায়ঃ সাত

♦ ‘যুক্তিবাদ’ একটা সম্পূর্ণ দর্শন, একটা বস্তুবাদী বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতিঃ কুয়াশা কাটে, কাটে নেশা, আকাশের ঘষা-সূর্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়

অধ্যায়ঃ আট

♦ যুক্তির পথচলাঃ লোভের অন্ধকারে ঢোকে না দিনের আলো

অধ্যায়ঃ নয়

♦ অতি ব্যবহৃত কিছু শব্দঃ সিন্দুকেতে মন ভরেছে ভেতরে তার কি আছে কেই বা রাখে খোঁজ?

“সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও নির্মাণ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!