যুক্তিবাদবিরোধীতার প্রকৃত উৎস কোথায়—এই বিষয়ে আন্দোলনকারীদের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য। যুক্তিবাদ আন্দোলনের পক্ষে জয় ছিনিয়ে আনতে হলে কে প্রধান শত্রু, কোন কোন শক্তি তার সহায়ক, কী তার শক্তিশালীতম অস্ত্র এ-সব বিষয়ে পরিষ্কার, স্পষ্টভাবে জানতে হবে।

যুক্তিবাদবিরোধিতার প্রধান উৎস অবশ্যই শোষকশ্রেণী। তার সহায়ক শক্তি বহু । শোষকশ্রেণীর কৃপাধন্য হওয়ার মত মানুষের অভাব নেই এই সমাজে। তবে কৃপা পাওয়ার জন্য কিছু ক্ষমতা চাই বই কী, তা সে বুদ্ধিবলই হোক, কী বাহুবলই হোক । প্রধান সহায়ক শক্তি অবশ্যই রাষ্ট্রক্ষমতা, সরকার—যারা শোষকদের অর্থে নির্বাচন জিতে এসে গদীতে বসে মুখে গবীব-দরদী এবং কাজে ধনীক-তোষণের ভূমিকা গ্রহণ করে। শত্রু শিবিরের অমোঘ অস্ত্রটির নাম ধর্ম, প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম। হিন্দু, ইসলাম খ্রিস্ট, বৌদ্ধ, শিখ, পার্শী ইত্যাদি ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ধর্মীয় বিশ্বাসীদের প্রতিষ্ঠানিক রূপ বা সংগঠনিক রূপ। ‘প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম হলো এইসব ধর্মীয় বিশ্বাসীদের প্রতিষ্ঠানিক রূপের ভিত্তিমূল। এই প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম বা তথাকথিত ধর্ম অবশ্যই যুক্তিবিরোধী, প্রগতির প্রতিবন্ধক, জ্ঞান ও মুক্তচিন্তার অন্তরায়, পুরুষকার বিরোধী, কুসংস্কারের স্রষ্টা এবং তাই শোষকশ্রেণীর শ্রেষ্ঠতম হাতিয়ার ।

(ঈশ্বর, পরমপিতা, পরদ বা ওই জাতীয় চিন্তার ধারক-বাহক তথাকথিত ধর্ম যে আক্ষরিক অর্থেই যুক্তিবিরোধী, প্রগতির অন্তরায়, জ্ঞান ও মুক্তচিন্তার প্রতিবন্ধক, পুরুষকার বিরোধী, কুসংস্কারের স্রষ্টা- এ বিষয়ে যে বিস্তৃত আলোচনা ও তথ্যপ্রমাণ হাজির করা প্রয়োজন, তা সবই নিয়ে হাজির হবার ইচ্ছে রইল চতুর্থ খণ্ডে। ‘কিছু কথা’ এমনিতেই কলেবর বৃদ্ধির ফলে ‘কিছু বেশি-কথা” হয়ে যাচ্ছে, সুতরাং একটা গোটা বই লেখার মত তথ্য এখানে হাজির করি কী করে ?)

‘ধর্ম’ ক্যানসারের চেয়েও মারক, পারমাণবিক বোমার
চেয়েও ধ্বংসকারী। শোষকশ্রেণীর শ্রেষ্ঠতম এই
হাতিয়ারকে ধ্বংস করতে না পারলে চেতনা-মুক্তির যুদ্ধ
জয় অধরাই থেকে যাবে-এই পরম সত্য প্রতিটি
চেতনা-মুক্তির আন্দোলনকারীকে বুঝতেই হবে।

মানব সমাজের প্রগতির দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের এক বিপজ্জনক দিক হলো ধর্মের ভিত্তিতে মানবসমাজ বহু গোষ্ঠিতে বিভক্ত। ফলে শোষিত মানুষগুলোও আর এককাট্টা থাকে না, বহু ভাগে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠি-ভাগের সুযোগ নেয় শঠ রাজনীতিকরা। শঠ রাজনীতিকরা ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজ স্বার্থেই ধর্মান্ধতার অবসান চায় না। চাইতে পারে না। তারা নিপীড়িত মানুষদের বিক্ষোভ থেকে বাঁচতে অথবা ভোট কুড়োবার স্বার্থে বঞ্চিত মানুষগুলোকে ‘মুরগী লড়াই’তে নামায়। নিপুণ কুশলী প্রচারের ব্যাপকতায় সাধারণ মানুষ ভুলে যায়, যে কোনও ধর্মের যে কোনও জাতপাতের কালোবাজারীর একটাই পরিচয় হওয়া উচিত-কালোবাজারী, শোষক। যে কোনও ধর্মের যে কোনও জাতপাতের দরিদ্র শ্রমিক-কৃষকদের একটিই পরিচয়-দরিদ্র, শোষিত। দরিদ্র নিপীড়িত মানুষগুলো যখন নিজেদের মধ্যে জাতপাত বা ধর্ম নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন লাভের ক্ষীরটুকু জমা হয় শাসক ও শোষকের ঘরেই। গরীব মানুষদের বিরুদ্ধে গরীব মানুষদের লড়িয়ে দেবার জন্যে ধর্মের বিপুল প্রভাবের কথা মনে রেখেই শোষকশ্রেণী ধর্ম নামক অস্ত্রটিকে আরো শক্তিশালী করার গবেষণায় রত ।

ধর্মবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে যে পূর্বজন্ম, কর্মফল, ঈশ্বরবিশ্বাস, ঈশ্বর- নির্ভরতা, অলৌকিক বিশ্বাস গড়ে উঠেছে তারই ফলে ধর্মবিশ্বাসী বঞ্চিত মানুষগুলো তাদের বঞ্চনার কারণ হিসেবে আসল খল নায়কদের দায়ী না কবে দায়ী করেছে কল্পনার ভগবানের অভিশাপকে, পূর্বজন্মের কর্মফলকে। দুঃখে, অপমানে, সব হারাবার যন্ত্রণায়, ক্ষুব্ধতায় খান খান হতে গিয়েও ভেঙে না পড়ে পরমপিতা জাতীয় কারো চরণে সব ক্ষোভ, সব দুঃখ-যন্ত্রণা ঢেলে দিয়ে প্রার্থনা করেছে—মোরে সহিবারে দাও শক্তি। ধর্মের সমর্থক অনেকেই বলেন- পরমপিতা জাতীয় কারো কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যে রয়েছে অপার শান্তি, সহা করার শক্তি।

পুরুষকারহীন মানুষই জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত থেকে
মুক্তি পাবার আশায় পরমপিতা জাতীয়ের কারও কাছে
আত্মসমর্পণ করে পরিত্রাণ পেতে চায়। আপসপন্থী মানুষই
শান্তি খোঁজে
আত্মসমর্পণে। কাদা-নরম মেরুদণ্ডী মানুষই নিজ শক্তিতে
প্রতিরোধ না গড়ে আঘাত
সহ্য করার শক্তি খোঁজে পরের শ্রীচরণে।

ধর্মের সমর্থক অনেকে এ-কথাও বলেন—ধর্মই সমাজকে ধারণ করে বয়েছে, সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলেছে।

প্রাচীনকালে যখন রাজনৈতিক সংহতি, আইনের শাসন ছিল দুর্বল, তখন ধর্ম দিযে সমাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা হয়েছে, হয়ত বা তার কিছু প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি আইনের শাসন না থাকলে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষাও অসম্ভব হয়ে পড়ে— তা সে দেশের মানুষ যতই ধর্মভীরু হোক না কেন।

এই প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট উদাহরণ টানছি। ১৯৮৮ সালে আমাদের দেশের ১০০জন অপারাধীর ওপর একটা অনুসন্ধান চালিয়েছিল ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’। বিভিন্ন ধরনের এই অপরাধীই বিশ্বাস করত ঈশ্বরের অস্তিত্বে, বিশ্বাস করত পাপ- পূর্ণে। বিশ্বাস করত পাপের ফল নরক-যন্ত্রণা। এই বিশ্বাস কিন্তু অপারাধীদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি ।

যে দেশে সর্বোচ্চ পদ থেকে সর্বনিম্ন পদে সাবলীলভাবে বয়ে চলেছে দুর্নীতির স্রোত; যে দেশে হত্যাকারী, নারী-ধর্ষক, গুণ্ডা, ছিনতাইবাজ, চোর-চোট্টা-চিটিংবাজ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকলে সাত খুন মাপ হয়ে যায়; যে দেশে গুণ্ডা- বদমাইশ পকেটে না থাকলে ৰাজনীতি করা যায় না, সে দেশের মানুষ দু-বেলা ঠাকুর প্রণাম সেজে, নমাজ পড়েও দূর্নীতি চালিয়ে যাবেই। এতক্ষণ উদাহরণ হিসেবে যে ধর্মপ্রাণ ভারতবর্ষের কথা বললাম, এটা বুঝতে নিশ্চয়ই সামান্যতম অসুবিধা হয়নি সমাজসচেতন পাঠক-পাঠিকাদের ।

প্রগতিবিরোধী চিন্তা এবং কুসংস্কারের উৎস ধর্ম, অধ্যাত্মচিন্তা। তাই কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে গেলে ধর্মকে আঘাত দিতেই হবে। ধর্মকে আঘাত না দিয়ে যাঁরা কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন, শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা হয় কল্পনাবিলাসী, নতুবা হুজুর শ্রেণীর চতুর দালাল ; শোষিত মানুষের আপনজন সেজে তাদের বিভ্রান্ত করে হুজুর-মজুর সম্পর্ককে বজায় রাখতে সচেষ্ট। এ তো বিষবৃক্ষের গোড়াকে বাঁচিয়ে রেখে আগা কাটতে কাঁচি চালান। এই সত্যকে ভুললে তো চলবে না-শোষণমুক্ত সমাজ গড়ারই একটি পর্যায়, একটি ধাপ শোষিত মানুষদের কুসংস্কারমুক্তি, শোষিত মানুষদের চেতনা- মুক্তি, যার আর এক নাম-সংস্কৃতিক বিপ্লব ।

যে সব সংস্থা ও ব্যক্তি মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত করতে, মানুষের ঘুম ভাঙাতে গান বাঁধছে, নাটক নিয়ে হাজির হচ্ছে, সভা কবে বক্তব্য রাখছে, হাতে-কলমে ঘটিয়ে দেখাচ্ছে বাবাজী-মাতাজীদের নানা অলৌকিক কাণ্ডকারখানা, ফাঁস করছে ওঝা গুণীনদের নানা কারসাজি- তাঁরা অবশ্যই খুব ভাল কাজ করছেন। অবশ্যই এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু কুসংস্কারের গোড়া ধরে টান দিতে হলে যে তথাকথিত ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ শ্রমজীবী বঞ্চিত মানুষদের সামনে তুলে ধরতে হবে একথাও মনে রাখতে হবে। সঠিক রণকৌশলের স্বার্থে তত্ত্বগতভাবে ধর্ম বিষয়ে জেনে নিতে হবে। তারপর ঠিক করতে হবে রণনীতি। কোথায়, কখন, কী পরিস্থিতে তথাকথিত ধর্মকে কতটা আঘাত হানব, কাদেরকে কেমনভাবে বোঝালে তথাকথিত ধর্মের স্বরূপ ফলপ্রশূ হবে সেটা নিতান্তই কৌশলগত প্রশ্ন। সে প্রসঙ্গ নিয়েও আপাতত বিস্তৃত আলোচনায় যাচ্ছি না ; তুলে রাখলাম পরবর্তী খণ্ডের জন্য। কারণ এই খণ্ডের মূল আলোচ্য বিষয় ধর্ম ।

আমরা বঞ্চিত মানুষের দীর্ঘদিনের বহু অন্ধ সংস্কার, বহু স্পর্শকাতর সংস্কার নিয়ে বোঝাতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি ওঁরা বোঝার চেষ্টা করেন, ওঁরা ঝোঝেন, ওঁরা বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে সংস্কার মুক্তির লড়াইতে আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসেন, আমাদের নেতৃত্ব দেন। ওঁরা দেশী-বিদেশী পুঁথি পড়ে, ভাল বলতে কইতে বা লিখতে পারার সুবাদের ছাত্রনেতা থেকে জননেতা হননি, ওঁরা বুদ্ধি-বেচা ও ডিগবাজি খাওযা শেখেন নি। ওঁরা লড়াই করতে করতে লড়াকু হয়েছেন, ওরা জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শিক্ষা নিয়েছেন। ওরা জানতে বুঝতে শিখতে অনেক বেশি আগ্রহী, অনেক বেশি আন্তরিক। মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতা নিয়ে ‘সব জানি’, ‘সব বুঝি’ করে ‘কুয়োর ব্যাঙ’ হয়ে থাকতে নারাজ। সংগ্রাম যখনই ময়দানে নেমে আসে, নেমে আসে রান্নাঘরে বেয়োনেটের ফলা তখন মধ্যবিত্ত নেতাদের সীমাবদ্ধতা পঁচা ঘায়ের মতই ফুটে ওঠে। বঞ্চনার শিকার শ্রমিক-কৃষক লড়াকুরাই তখন নিজেদের অভিজ্ঞতার মূল্যে সঠিক পথ নির্দেশ করেন। তাঁরা নেতৃত্বে চলে আসেন। তাঁরা ইতিহাস ঘেঁটে নজির খোঁজেন না, তাঁরা নজির তৈরি করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ওঁদের হাতে নেতৃত্ব চলে যেতে থাকলে সবচেয়ে মুশকিল হয় শাসক শোসকশ্রেণীর। ওঁদের নেতাদের কেনা যায় না মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা নেতাদের মত। এখানেই শাসক-শোষকদের মুশকিল ।

আজ আমাদের সমিতির বহু শাখা সংগঠন ও সহযোগী সংস্থার নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক-শ্রেণীর বঞ্চিত বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন। ওঁদের লড়াইয়ের সাথী হিসেবে পেয়েছি, ওঁদের অন্ধ বিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার ফলেই। সুতরাং যাঁরা মনে করেন বঞ্চিত মানুষদের ধর্মীয় ধারণাকে আঘাত করলে আমরা বঞ্চিত মানুষদের থেকে বিছিন্ন হয়ে যাব, তাঁরা এ-কথা বলেন হয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাব থেকে, নতুবা তাঁরা কুসংস্কারমুক্তির আন্দোলন- আন্দোলন খেলা খেলতে চান এবং বাঁচিয়ে রাখতে চান কুসংস্কারের গোড়াটিকেই।

আমরা মনে করি, ধর্ম মানে শনি, শীতলার পুজো বা দরগার সিন্নি নয়। আগুনের ধর্ম যেমন ‘দহন’, তলোয়ারের ধর্ম যেমন ‘তীক্ষ্ণতা’, মানুষের ধর্ম তেমনই মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ। তাই মন্দিরে পুজো না করে, মসজিদে নামাজ না পড়ে, গীর্জা প্ৰাৰ্থনা না করেও মানুষের প্রগতিকামী, মনুষ্যত্বের বিকাশকামী যুক্তবাদীরাই প্রকৃত ধার্মিক। এই স্বচ্ছতা নিয়ে নিজ স্বার্থেই শ্রমজীবী শোষিত মানুষদের আজ তথাকথিত ধর্ম ও সেই ধর্ম থেকে সৃষ্ট ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার সময় হয়েছে।

error: Content is protected !!