গত শতকের অন্যতম সেরা ‘তথাকথিত অলৌকিক’ ঘটনা ছিল যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত। পৃথিবী জুড়ে অসামান্য আলোড়ন তুলেছিল। পৃথিবীর তিনভাগের এক ভাগ মানুষ যখন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী, তখন এমন ঘটনায় পৃথিবী কাঁপবে— এটাই তো স্বাভাবিক ।
ঘটনাটা শুনেছিলাম ঢাকায় বসেই। বিজ্ঞান চেতনা পরিষদের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম কুসংস্কার বিরোধী শিক্ষণশিবির পরিচালনা করতে, সঙ্গে সেমিনারে অংশ নিতে ও আড্ডা দিতে। খবরটা দিলেন সাংবাদিক বন্ধুরাই। তারিখটা ছিল ১৮ এপ্রিল ১৯৯৮ সাল।
১৯ এপ্রিল দমদমের ফ্ল্যাটে পা-দিতেই খবর পেলাম—বহু পত্রিকা অফিস থেকেই ফোন এসেছে সবাই জানতে চান— কবে ফিরছি।
ফিরেই প্রথম ফোনটি পেলাম পুষনগুপ্তের। ‘সোনার বাংলা’ দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর ইচ্ছে সোনার বাংলা পত্রিকার তরফ থেকে আমি সত্যানুসন্ধান চালাই। অর্থাৎ ‘এক্সক্লুসিভ স্টোরি’ করতে হবে। অন্য কোনও মিডিয়াকে এ বিষয়ে কিছু জানানো চলবে না। পূষন পুরোনো বন্ধু। ‘আজকাল’ পত্রিকার যখন থেকে সহযোগী সম্পাদক, তখন থেকে পরিচয়। ‘আজকাল’ পত্রিকা থেকে বেরিয়ে এসে ‘সোনার বাংলা’ দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করছেন।
ভদ্রতা থাকুক না কেন, যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষকে সহ্য করতে তারা নারাজ। কারণ প্রদীপের নিচেই সব অন্ধকার। যাবতীয় অলৌকিকতার পেছনে কেবল প্রতারণা। প্রবীর ঘোষকে পছন্দ হবে না এটাই তো স্বাভাবিক। এসব ক্ষেত্রে আমি একটা আলাদা তদন্ত টিম পাঠাই। তাঁরা আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়ে আলাদাভাবে তদন্ত শুরু করে দেন। আজ ওই তদন্ত টিমে ছিলেন অরূপ দে, জ্যোতি মুখার্জি এবং হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুমিত্রা পদ্মনাভন
ওরা দুপুরের মধ্যেই ঘটনাস্থল ৩৩ বি, আমহার্স্ট স্ট্রিটে পৌঁছে যান। আমার অন্য কিছু খোঁজখবরের দরকার ছিল। সে কারণে আমি দুপুরের দিকে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাটাই। এই অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামান্য কিছু যোগাযোগ আছে। আইনজীবী অজন্তা চ্যাটার্জি, যিনি প্রথম চিৎকার করে আশেপাশের বাড়ির লোকদের জানান যে, তাঁর যীশু মূর্তি থেকে রক্তপাত হচ্ছে, সেই মহিলার স্বামী দিলীপ চ্যাটার্জি কাজ করেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেকর্ড সেকশনে। এই খবরটা আমি সকালেই জানতে পারি। এই অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে যে কোনও নার্সিংহোম বা হাসপাতাল বা প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবের কিঞ্চিত যোগাযোগ আছে, সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সোনার বাংলার রবিবারের পাতার প্রতিবেদক। তিনি লিখেছিলেন, শুধু রক্ত পরীক্ষা করলে কিছুই বোঝা যাবে না, দরকার শ্রীমতী চ্যাটার্জির
বাড়ির সকলের রক্ত পরীক্ষা এবং বাড়ির কেউ হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কাজ করেন কিনা তা জানা। ইঙ্গিতটি আমার বড় উপকারে লেগেছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটু খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, গত একমাসে অন্তত ৭/৮ বার রেকর্ড সেকশনে নিজের অফিস ছেড়ে ব্লাডব্যাঙ্কে এক ‘বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন অজন্তা চ্যাটার্জির স্বামী দিলীপ চ্যাটর্জি।
ওই ‘বন্ধু’র কাছ থেকেই জানা গেল গত একমাস ধরে দিলীপবাবুর রক্ত সম্পর্কে বিশেষত শুকিয়ে যাওয়া রক্ত সম্পর্কে অনেক ইনফর্মেশনের দরকার হয়ে পড়েছিল। এমনকি রক্তের ডি এন এ টেস্ট করে কী ধরনের তথ্য জানা যায়, তাও জানতে চেয়েছিলেন দিলীপবাবু।
যে তথ্যগুলি জানার ছিল সেগুলি জেনে আমি যাই সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরির এক কর্তাব্যক্তির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য। এখানে গিয়ে জানা গেল, আরও এক বিস্ফোরক তথ্য। গতকাল সেন্ট্রাল ফরেনসিকের পক্ষ থেকে যীশু মূর্তির গা থেকে রক্তের যে স্যাম্পেল নেওয়া হয়েছে, তা গোয়েন্দা পুলিশের নির্দেশে নয়। এমনকি স্থানীয় আমহার্স্ট স্ট্রিট থানাও ফরেনসিককে একাজ করতে বলেনি। তবে কার নির্দেশে সেন্ট্রাল ফরেনসিক যীশু মূর্তির গা থেকে রক্ত নিল? রক্ত নিল হোলি ট্রিনিটি চার্চের যাজক পি পি মণ্ডল এবং স্বয়ং অজন্তা চ্যাটার্জির অনুরোধে। অসাধারণ কীর্তি। রিপোর্ট পাওয়ার পরই নিশ্চয়ই অজন্তাদেবী সগৌরবে প্রচার করবেন, দেখুন যীশু মূর্তির গা থেকে মানুষেরই রক্ত বেরচ্ছে। আমার আশঙ্কা ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সত্যি প্রমাণিত হল ।
৩৩বি, আমহার্স্ট স্ট্রিটের ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম ভালোরকম একটা ভিড় জমে আছে। দরজার পাশে কাগজে ইংরেজিতে লেখা নোটিশ, দর্শন নিষিদ্ধ। অতএব জনা দশেক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মহিলা বাইরে বসে প্রার্থনা করছেন। ওড়িশার গোদাপাড়া সেন্ট অ্যানেস চার্চের ও. এস. এ. সিস্টার আরতি জানালেন, বিভিন্ন রাজ্যে খবর গেছে। সিস্টাররা আরও অনেকেই আসছেন। বিদেশেও খবর পাঠানো হয়েছে। এই মূর্তিকে এখনই ইউরোপ বা আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা উচিত।
‘কেন?” আমি প্রশ্ন করি।
সিস্টার আরতি বলেন, ‘পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে, ভগবান যীশু ক্রুশবিদ্ধ হাত ও পা থেকে যে রক্তপাত হয়েছিল সেই হোলি ব্লাড সোনা ও রুপোর পানপাত্রে সংগ্রহ করে রেখেছিলেন পরমপিতার অতি ঘনিষ্ঠ সেবকরা। এখানে প্রভুর মূর্তি থেকে সেই পবিত্র রক্তপাত হচ্ছে। এই মূর্তির দাম অমূল্য। এক কোটি টাকাও হতে পারে।’
সিস্টার আরতির কথার্বাতা আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। ওর সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল, তা হচ্ছে কাঠের মূর্তিটির দাম চড়ছে। ১,০০০ টাকার মূর্তির দাম ১ কোটি না হোক রাতারাতি লাখখানেক হলে মন্দ কী? আর বিদেশেও যখন খবর পাঠানো শুরু হয়েছে।
ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে অজন্তাদেবীর তরুণ পুত্র সৈকত চ্যাটার্জি ওরফে বাবির সঙ্গে। ১৮ বছরের বাবি আমাকে না চিনলেও আমি ওকে চিনি। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ওর সম্পর্কেও কিছু খোঁজখবর আমায় নিতে হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, বাবি সম্পর্কে প্রতিবেশীদের ধারণা খুব একটা উচ্চস্তরের নয়। চোখের সামনে দেখলাম প্রতিবেশী হ্যারি প্যারিস ও আশিস মণ্ডলের সঙ্গে বেশ তর্কাতর্কিই হল বাবির। তাছাড়া মাসির সামনে যেভাবে মা অজন্তাদেবীকে কোন্ একটা বিশেষ কারণে টাকা দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করছিল বাবি, সেটাও খুব একটা শোভন দৃশ্য নয়। অজন্তাদেবী দোতলার জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে আমার সঙ্গে অত্যন্ত অনিচ্ছাসহকারে যে কথাগুলো বলেন—
অজন্তাদেবীঃ আপনার নামই তো প্রবীর ঘোষ? আমি কিন্তু আপনাকে ওপরে আসতে দেব না। আমি আইনজীবী, আমি আইন জানি।
আমিঃ ব্লাড টেস্টের রিপোর্টটা পেয়েছেন? হিউম্যান ব্লাড নিশ্চয়ই?
অজন্তাদেবীঃ হ্যাঁ হ্যাঁ হিউম্যান ব্লাড। আপনাকে সব বলব কেন?
আমিঃ আপনারা ব্লাড টেস্ট করাবেন? ডি এন এ টেস্ট?
অজন্তাদেবীঃ হোয়াই? আমি কেন ব্লাড টেস্ট করাব? এটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার । আমি আইনজীবী, আইন জানি। কে আপনাকে বাড়িতে ঢুকতে দিল? আপনি ট্রেসপাসার্স । আমি: চোখের সামনে মূর্তি থেকে রক্তপাত দেখাতে পারবেন?
অজন্তাদেবীঃ আপনি কে যে আপনাকে দেখাব? এই তো সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদার বুজরুকি বলেছিলেন—এখন দলে দলে স্টুডেন্ট পাঠাচ্ছেন—বলছেন যাও প্রভু যীশুর মহিমা দেখে এস। আপনি ট্রেসপাসার্স। এখান থেকে চলে যান।
এরপর উনি জানলা আটকে দেন। জানলা আটকে দিলেও আমার চোখ বেঁধে দিতে পারেননি। এই মুহূর্তে ওই বাড়ির অন্দরমহলের দুটি প্রধান খবর হলঃ (১) যীশু মূর্তির রক্ত লেগে থাকা জায়গায় একটু চলটা উঠে এসেছে। ভেতরে কাঠের রঙ। রক্ত নেই। (২) যীশু মূর্তির গা থেকে রক্তপাতের বেশ কিছু ফটোগ্রাফ তুলে ব্লোআপ করিয়েছেন অজন্তাদেবী। কিছু বিদেশে পাঠিয়েছেন। আর কিছু টাঙিয়ে দিয়েছেন একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে। কোন্ অলৌকিক মহিমা প্রচারে, তা উনিই জানেন। আমি শুধু যা জানি তা হল, কাঠের যীশু মূর্তির গায়ে যে রক্তের দাগ, সেই রক্ত এসেছে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে। ওই রক্তের ডি এন এ টেস্ট করলেই এটা ধরা পড়বে। কাঠের মূর্তি লাখ টাকায় বিক্রি করার বাসনা অজন্তাদেবীর আছে কিনা তা পুলিশ তদন্ত করে দেখুক, ওখানকার জমি নিয়ে কোনও গোলমাল আছে কিনা সেটাও পুলিশের ব্যাপার। আমি শুধু জানি যীশু মূর্তি থেকে কোনওদিনই রক্ত পড়েনি, পড়বেও না।
২১ এপ্রিলঃ ভেবেছিলাম রহস্য ফাঁসের প্রথম কিস্তি বেরোবার পরই কলকাতা পুলিশ আর একটু যত্নবান হবেন। এখনও পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে কোনও তদন্ত শুরু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আশা করেছিলাম, প্রথম কিস্তি প্রকাশিত আমারার পর একটা দেবতার মূর্তির গায়ে মানুষের রক্ত মাখিয়ে অলৌকিকতা প্রমাণের বুজরুকিকে অন্তত পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন। তদন্ত করে দেখা হবে, কি উদ্দেশ্যে ঐ কাজ করা হচ্ছে? এর পেছনে কোন ধর্মব্যবসার পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে কি না। দুর্ভাগ্যবশত আজ পর্যন্ত সেই তদন্ত শুরু হল না। বরং কোনও এক রহস্যময় কারণ থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ৩৩বি, আমহারস্ট স্ট্রিটের ওর বাড়ির সামনে আর কোও পুলিশ পাহারা নেই।
আমি জেনেছি, বাড়ির মালকিন অজন্তা চ্যাটার্জির আপত্তিতেই বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ পাহারা তুলে নেওয়া হয়েছে। নির্বিবাদে পুলিশ পাহারা উঠে গেল অথচ ‘রক্তাক্ত যিশু’ দর্শন বন্ধ হল না। বরং পুলিশ সরে যাওয়া মাত্র আজ সকাল থেকে আরও অবাধ ও মালকিন অজন্তা চ্যাটার্জির পছন্দমত হয়ে উঠেছে। আমাদের তদন্তকারী টিমের প্রতিনিধিরা গতকালের মত আজও ভেতরে ঢুকেছেন। দোতলায় উঠেছেন এবং ‘রক্তাক্ত যিশু’ দর্শন করেছেন। আজ গতকালের তুলনায় ঘরের আলো আরও কমানো হয়েছে। সম্ভবত কম পাওয়ারের বাল্ব লাগানো হয়েছে। যীশু মূর্তির বুকের কাছে আজও চলটা। তবে তা লক্ষ্য করতে হলে সত্যান্বেষীর চোখ দরকার। চলটা উঠে গিয়ে ঘিয়ে রং বেরিয়ে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত যা ছিল কাঠের মূর্তি, আজ তা ফাইবার গ্লাসের বলে দাবী করছেন আইনজীবী অজন্তা দেবী ও তাঁর পুত্র। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আজ সকাল থেকে অজন্তা দেবীর ছেলে ওরফে বাবির জ্বর হয়েছে। প সারা দিনই আজ বাড়ির মধ্যে, দর্শনার্থীদের সেবায় ব্যস্ত। আজ কয়েকজন স্পেশাল দর্শনার্থীকে মিষ্টি ও শরবৎ খেতে দেওয়া হয়েছে। গতকাল অজন্তা দেবী কর্ণফিল্ড রোড থেকে আসা সিস্টার সরযূ গোমেজকে বোঝাচ্ছিলেন, ‘ভাবুন কাঠের মধ্যে দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত বেরিয়ে এল- একেবারে চোখের সামনে- ‘ভাবুন একবার’।
আজ বাবি বেশ চেঁচিয়েই বলল, ‘প্রবীর ঘোষ তো জানেই না মূর্তিটা ফাইবারগ্লাসের।’ যতসব গুলগল্প। আমি জানি না ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কি এমন ঘটল যাতে কাঠের মূর্তি ফাইবারগ্লাসের হয়ে গেল। ওরা যদি আগামীকাল বলে বসেন যে, আসলে মূর্তিটা প্ল্যাটিনামের, তাহলেও আমার
কিছু বলার নেই। কারণ, মূর্তিটি হাত দিয়ে ধরে পরীক্ষা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
‘আজকের নতুন খবর হল, অজন্তা চ্যাটার্জির স্বামী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেকর্ড সেকশনের কর্মী দিলীপ চ্যাটার্জি সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর যাওয়ার ব্যাপারে বিদেশ সফরের জন্য প্রয়োজনীয় দরখাস্ত আবেদনের প্রাথমিক কাজকর্মও তিনি করে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিত, পুলিশও ওঁর এই সিঙ্গাপুর যাওয়ার চেষ্টার কথা জানেন। কারণ, যেসব জায়গায় আবেদনপত্র জমা পড়েছে, সেগুলি পুলিশের হাতে আসতে বাধ্য। কেন হঠাৎ এই সিঙ্গাপুর সফর? মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেকর্ড সেকশনের কর্মী হঠাৎ এত টাকাই বা পাচ্ছেন কোথা থেকে? অর্থের জোগান কোথা থেকে হচ্ছে, সে খবর নিক পুলিশ। আমি শুধু বলব, দিলীপবাবুর হঠাৎ সিঙ্গাপুর বেড়াতে যাওয়ার শখ হয়নি। তিনি খুব নির্দিষ্ট কারণেই সিঙ্গাপুর যেতে চাইছেন। সিঙ্গাপুরের একটি নামকরা চার্চে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের পবিত্র রক্ত তথা হোলি ব্লাডের দুটি আলাদা স্যাম্পেল সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। ২,০০০ বছর আগের সেই রক্তের হাল আপাতত কিরকম তা বলা মুশকিল, কিন্তু খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের একদল মানুষ বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর যেসব চার্চে প্রভু যীশুর হোলি ব্লাড সংরক্ষিত আছে, তার মধ্যে সিঙ্গাপুরের চার্চ একটি।
২২ এপ্রিলঃ পুলিশ প্রহরা উঠে যাওয়া মাত্র ঘটনাটা ঘটেছে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে। আমি একে কাকতালীয় বলব কিনা জানি না। কেননা ওই বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ প্রহরা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কার তা আমার জানা নেই। শুনেছি মালকিন আইনজীবী অজন্তা চ্যাটার্জির বাড়ির সামনে পুলিশ থাকাটা পছন্দ হয়নি। যেহেতু উনি আইন জানেন বলে দাবি করেন আর পুলিশ আইন জানা লোক দেখলেই কিঞ্চিৎ নার্ভাস হয়ে পড়েন, সম্ভবত তাই অজন্তাদেবী আপত্তি করামাত্রই
আজ আরও একটি নতুন বুজরুকি শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ধর্মপ্রাণার জন্য সাপ্লাই করা শুরু হয়েছে ‘রক্তাক্ত’ যীশু মূর্তির পায়ের ছাপ। এর আগে যীশু মূর্তির পায়ে রক্তের দাগ ছিল কেবল পায়ের পাতায়। আজ সকাল থেকে টাটকা রক্তে পায়ের তলাও ছাপিয়ে গেছে বলে দাবি করছেন অজন্তাদেবী। সত্যিই পায়ের তলাতেও রক্তের দাগ আছে কিনা জানি না। কেননা পরীক্ষা করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। মূর্তির পায়ের তলা দেখার জন্য কেউ ঝুঁকে পড়লেই তাদের বলা হচ্ছে ‘না না অমন করবেন না। মূর্তিতে ধাক্কা লাগতে পারে’। কারও সামনে অবশ্য অজন্তাদেবীকে মূর্তির পায়ের ছাপ নিতে দেখা গেল না। তিনি সবাইকেই জানিয়ে দিলেম, যার ওপর ছাপ নিতে চান তা জমা রাখুন।
আমি সময় মতো ছাপ তুলে রাখব। এত ভিড়ে এসব পবিত্র কাজ করা যায় না ।
খুবই প্রত্যাশিত ব্যবহার। সকলের সামনে রক্তের ছাপ নেওয়ার বিপদ আছে। বড়জোর একটি বা দুটি কাগজে ছাপ নেওয়ার পরই তো রক্ত ভ্যানিশ হয়ে যাবে। যেটুকু রক্ত লাগানো আছে, রক্তের পরিমাণ তো সেইটুকুই। সত্যিই তো আর রক্তপাত হচ্ছে না, যে যত চাইলাম তত কাগজে পরমপিতার রক্তমাখা ছাপ লাগিয়ে নিলাম। অলৌকিক রক্তপাতের সর্বনাশ হয়ে যাবে যে। তাই অজন্তাদেবীকে ‘পবিত্র সুযোগ ও সময়’-এর জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। এভাবে যদি চলতে থাকে, তবে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সুযোগ আসার মধ্যেই ৩৩বি, আমহার্স্ট স্ট্রিটকে অলৌকিক পুণ্যক্ষেত্রে পরিণত করা যাবে বলে মনে হচ্ছে। প্রসঙ্গত একটি কথা বলে রাখি। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না । যুক্তিবাদে বিশ্বাস করি। গতকাল আমার লেখায় ‘সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য’ শব্দ দুটি নেহাতই অনিচ্ছাকৃত মুদ্রণপ্রমাদ। পড়তে হবে ‘সুযোগ’ শব্দটি।
২৩ এপ্রিলঃ আইনজীবী অজন্তা চ্যাটার্জিকে সম্ভবত কোনও সিনিয়র আইনজীবী শিখিয়ে দিয়েছেন যে আপনি বলে যান এই যীশু মূর্তি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এটা আমার বাড়ির মধ্যে বসানো আছে। এটা আমি কাকে দেখতে দেব, কাকে দেখতে দেব না সেটাও আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি বলে যান যে আমি আমার যীশু মূর্তির ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিনি, কোনও প্রচার করিনি, কীভাবে প্রচার হয়েছে জানি না, আমি কাউকে আমন্ত্রণও করিনি। এইভাবে চলতে পারলে আপনাকে কেউ অলৌকিকতা প্রচার অথবা বুজরুকির দায়ে ধরতে পারবে না। সম্ভবত এই উপদেশ পাওয়ার ফলেই আজ অজন্তাদেবী বেশ চেঁচিয়েই দর্শনার্থীদের বলেন, ‘কীভাবে যে আগুনের মতো খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, জানি না – আমি কিছু জানি না। শুধু দেখলাম দলে দলে মানুষ আসছেন আমার বাড়িতে মূর্তি দর্শন করতে।’
আমি আইনজীবী নই অজন্তাদেবী। আমি যুক্তিবাদী। গত ২০ বছর ধরে আমি অন্তত ২০০ ভূত ধরেছি। অলৌকিকতার নামাবলি জড়ানো মানুষ ভূত ধরাই আমার নেশা। আইনের বেড়াজাল ছড়িয়ে কি আর ভূত প্রতিষ্ঠিত করা যায়? অনুগ্রহ করে আমার নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন কি ? ১) আজ সকাল থেকে কাগজ, টিস্যু পেপার আর তুলোতে করে যীশু মূর্তির পা-থেকে রক্তের
২৪ এপ্রিলঃ যুক্তিবাদীরা হিংস্র স্বভাবের নন, তারা নমনীয়। অজন্তাদেবী যদি ভেবে থাকেন, আমি তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের ওপর আঘাত করতে চাইছি, তবে তা ভুল। আগেও বলেছি আবার বলছি, কারও ধর্ম বিশ্বাসকে আক্রমণ করা আমার কাজ নয়। কোনওদিন আমি সে কাজ করিওনি। আর অজন্তাদেবীকে ব্যক্তিগত আক্রমণের তো প্রশ্নই নেই। উনি ওনার বাড়ির যীশুমূর্তি থেকে রক্তপাত ঘটিয়ে বিখ্যাত (অথবা কুখ্যাত) হতে না চাইলে তো আমি ওনার নামই জানতে পারতাম না। আমরা যুক্তিবাদীরা প্রতারককে আক্রমণ করি, বুজরুকিকে আক্রমণ করি, মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে নিয়ে যারা ধর্ম ব্যাবসা করে তাদের আক্রমণ করি, যারা অলৌকিকতা প্রচার করে টু-পাইস কামিয়ে নিতে চায় তাদের আক্রমণ করি। অজন্তাদেবী যদি প্রমাণ করে দিতে পারেন তাঁর বাড়ির যিশুমূর্তির গায়ে পেরেক ঠোকা হলে আবার রক্ত পড়বে, তবে আমি যুক্তিবাদী হিসেবে ওনার সব কথা মেনে নেব, আমার তোলা যাবতীয় অভিযোগ প্রত্যাহার করে ক্ষমা চেয়ে নেব। আর শুধু তাই নয়, আগেও বলেছি আবার বলছি এই অলৌকিকতা যে প্রমাণ করতে পারবেন তাকে আমি ও বাংলাদেশের বিখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচ মিলে যৌথভাবে ২০ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেব। আমি যুক্তিবাদী, আমার হার স্বীকার করতে কোন লজ্জা নেই। আসুন অজন্তাদেবী আমাকে হারান। কিন্তু না হারাতে পারলে যে যুক্তিবাদীর কাছে আপনাকে হারতে হবে।
বিশ্বের কোনও কোনও চার্চে যিশুখ্রিস্টের রক্ত (হোলি ব্লাড) রাখা আছে সে ব্যাপারে আমি কিছু খোঁজখবর নিয়েছি। জানতে পেরেছি, রোমের ভ্যাটিকান সিটিতে যিশুখ্রিস্টের রক্ত সংরক্ষিত আছে। আপামর খ্রীস্টান ধর্মযাজকরা দাবি করেন, সেই রক্তের গ্রুপ এ বি পজিটিভ। এই তথ্যটি কলকাতায় বসেও জানা খুব কঠিন কাজ নয়। বিশিষ্ট ধর্মযাজকদের প্রায় প্রত্যেকেই এই তথ্যে বিশ্বাস করেন। ধরে নিতে হবে বিশ্বের আর যেসব চার্চেই যীশুর রক্ত সংরক্ষিত আছে তার সবকটিরই গ্রুপ এ বি পজিটিভ। কারণ একই মানুষের রক্তের গ্রুপ কখনও আলাদা হতে পারে না। বেচারা অজন্তাদেবী। ওঁর বাড়ির যীশু মূর্তির রক্তের গ্রুপ কিন্তু এ বি পজিটিভ নয়, ভ্যাটিকান সিটি থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিটে এসে রক্তের গ্রুপ পালটে গেছে, হয়েছে ও নেগেটিভ। না, এটি আমার তথ্য নয়। তথ্যটি প্রকাশ করেছেন ওই যীশু মূর্তির মালকিন স্বয়ং অজন্তাদেবী। তিনি দাবি করেছেন ‘ফরেনসিক রিপোর্টে দেখা গেছে মূর্তি থেকে
প্রথম খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !
অধ্যায়ঃ তিন
♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা
অধ্যায়ঃ নয়
অধ্যায়ঃ দশ
♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !
অধ্যায়ঃ বারো
♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়
অধ্যায়ঃ তেরো
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !
অধ্যায়ঃ ষোলো
অধ্যায়ঃ সতেরো
♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন
দ্বিতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ চার
♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…
অধ্যায়ঃ দশ
♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর
অধ্যায়ঃ বারো
♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা
অধ্যায়ঃ তেরো
তৃতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ
অধ্যায়ঃ দুই
♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন
চতুর্থ খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা
অধ্যায়ঃ দুই
♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল
অধ্যায়ঃ চার
♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি
অধ্যায়ঃ আট
♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’
অধ্যায়ঃ দশ
“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ