
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট থানারও একটি স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে। ভৌগোলিক দিক থেকে ভোলাহাট একেবারে ভারতের কোলঘেঁসে অবস্থিত এবং নদী দ্বারা বেষ্টিত। এ কারণে ভোলাহাট এলাকাটা যুদ্ধ চলাকালে শত্রুমুক্ত ছিল। ভোলাহাট থানায় গিলাবাড়ি নামক স্থানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অস্থায়ী হাসপাতাল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আসা নারী-পুরুষ প্রশিক্ষণ নিয়েছে এখানে। ভোলাহাটেরই এগারজন নারী এই ক্যাম্প থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং সক্রিয় অবদান রাখেন। এদের মধ্যে শরিফা খাতুন অন্যতম।
সরিফা খাতুনের সন্ধান দেন তাঁর সহযোদ্ধা মেহেরুন নেছা, সুরাইয়া বেগম, মেহেরুন নাহার, তসলিমাসহ অনেকে। সরিফা খাতুনের জন্ম ২১ জুলাই ১৯৫৪ সালে, ভোলাহাট থানার তেলিপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা হাফিজউদ্দিন মণ্ডল এবং মা এলাচী বেগম। আট ভাই-বোনের মধ্যে সরিফা খাতুন ষষ্ঠ।
সরিফা খাতুনের সাথে কথা হয় ভোলহাটে তাঁর বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান— মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল সতের বছর। একাত্তরের মে মাসে ভোলাহাটের পাশের থানা গোমস্তাপুরে পাক মিলিটারি অবস্থান গ্রহণ করে এবং রাজাকার নিয়োগ করে। ভোলাহাট থানা নদী দ্বারা বেষ্টিত ভারতের কোলঘেঁসে অবস্থিত বলে অন্যান্য থানার তুলনায় ছিল অনেকটা নিরাপদ । শরণার্থী ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আসা অগণিত মানুষের নিকট থেকে তারা পাকবাহিনীর অত্যাচারের সংবাদ জানতে পারতেন। পাকবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাদের সহযোগিতায় ঘরবাড়ি লুটপাট করছে রাজাকাররা। নির্যাতন করছে নারীদের।
পাকিস্তানিদের এই নির্মম নির্যাতন দেখে, সহযোদ্ধা বান্ধবীদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে এবং তাঁর দেশপ্রেম তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ক্ষেত্রে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করেছে— কমান্ডার হাফিজউদ্দিন হাসনু। ৭ নং সেক্টরের ৩ নং সাব-সেক্টরের আওতায় ছিলেন সরিফা খাতুন। তাঁদের যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন হাফিজউদ্দিন হাসনু এবং নিজাম উদ্দিন।
আগস্ট মাসের শেষদিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি রিক্রুট হন গিলাবাড়ি ক্যাম্পে। তাঁর প্রশিক্ষণ হয় প্রথমে গিলাবাড়ি ক্যাম্প এবং পরে ভারতের আদমপুর ক্যাম্পে। আদমপুর ক্যাম্প বাংলাদেশের গিলাবাড়ি ক্যাম্পের উল্টোদিকে অবস্থিত। তিনি প্রথমে নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নার্সিং প্রশিক্ষণ দেন ডা. ইয়াসিন, ডাক্তার বকুল এবং ডাক্তার জসিম। নার্সিং প্রশিক্ষণ হয় মূলত হাতে- কলমে। নার্সিং প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তিনি আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ে প্রশিক্ষণের মধ্যে পিটি-প্যারেড, গ্রেনেড ও রাইফেল চালনা অন্যতম। কমান্ডার হাফিজউদ্দিন হাসনু এবং কমান্ডার নিজাম উদ্দিন তাঁদের এই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তাঁদেরকে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।
আহতদের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা, ব্যান্ডেজ করা, নিয়মিত ঔষধ খাওয়ানো এবং সার্বক্ষণিক তদারকিই ছিল নার্স হিসেবে তাঁর নিয়মিত কাজ। ছোট ছোট অপারেশনের সময়ও তিনি ডাক্তারদের সাথে থেকে অপারেশন কাজে সহযোগিতা করেছেন। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত অতিশয় আন্তরিকতার সাথে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণে ডাক্তাররা অনেক সময় তাঁর কাজের প্রশংসা করতেন। তিনি কখনো ভাবতে পারেন নি এত দ্রুত দেশ স্বাধীন হবে।
আজ বত্রিশ বছর পর হাসপাতালে তাঁর কাজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের যে মনোবল ও দৃঢ়তা আমি দেখেছি এখন তরুণদের মধ্যে তেমনটি দেখা যায় না। অসুস্থ অবস্থায়ও তাদের দ্রুত সেরে ওঠার জন্য ছটফট করা এবং আবার যুদ্ধে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা; সে কী আকুতি! যা আমি কখনো ভুলব না।
যুদ্ধের সময় সবচেয়ে ভয়াবহ এবং হৃদয় বিদারক অবস্থা ছিল আহতদের আর্তনাদ। একাত্তরের স্মৃতি এখনো পীড়া দেয় সরিফাকে। গোমস্তাপুর থানার রহনপুর যুদ্ধক্ষেত্রে পাকবাহিনীর বাংকারে নির্যাতনের যে চিত্র দেখেছেন, তা আজও মনে হলে আঁতকে ওঠেন সরিফা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরে তিনি গর্বিত। কারণ দেশের জন্য, মানুষের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য কিছু করতে পেরেছেন তিনি। তবে যে আশা নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তা পূরণ হয় নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন— আজ অমুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়ে যাচ্ছে। আর নারী মুক্তিযোদ্ধা বলতে সমাজ এখনো বোঝে বীরাঙ্গনা নারীদের। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রকৃত সম্মান, শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সাথে বাঁচতে চান।