শ্লোকঃ ২৫

অনুবন্ধং ক্ষয়ং হিংসামনপেক্ষ্য চ পৌরুষম্ ।

মোহাদারভ্যতে কর্ম যত্তত্তামসমুচ্যতে ॥ ২৫ ॥

অনুবন্ধম্—ভাবী বন্ধন: ক্ষয়ম্ — ক্ষয়: হিংসাম — হিংসা অনপেক্ষ্য— পরিণতির কথা বিবেচনা না করে; চ–ও; পৌরুষম্ – নিজ সামর্থ্যের; মোহাৎ— মোহবশত; আরভ্যতে—আরম্ভ হয়, কর্ম কর্ম, যৎ – যে, তৎ—তাকে, তামসা — তামসিক; উচ্যতে—বলা হয়।

গীতার গান

না বুঝিয়া মোহবশে অনুবন্ধ কর্ম ।

হিংসা পরতাপ আদি তামসিক ধর্ম ৷।

অনুবাদঃ ভাবী বন্ধন, ধর্ম জ্ঞানাদির ক্ষয়, হিংসা এবং নিজ সামর্থ্যের পরিণতির কথা বিবেচনা না করে মোহবশত যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে তামসিক কর্ম বলা হয়।

তাৎপর্যঃ রাষ্ট্রের কাছে বা পরমেশ্বর ভগবানের প্রতিনিধি যমদূতদের কাছে আমাদের সমস্ত কর্মের কৈফিয়ত দিতে হয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্ম হয়ে থাকে ধ্বংসাত্মক, কারণ তা শাস্ত্র-নির্দেশিত ধর্মের অনুশাসনাদি ধ্বংস করে। অনেক ক্ষেত্রেই তা হিংসাভিত্তিক হয় এবং অন্য জীবকে কষ্ট দেয়। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্ম করা হয়ে থাকে। একে বলা হয় মোহ এবং এই ধরনের সমস্ত মোহযুক্ত কাজই হচ্ছে তমোগুণ জাত।

শ্লোকঃ ২৬

মুক্তসঙ্গোহনহংবাদী ধৃত্যুৎসাহসমন্বিতঃ।

সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোনির্বিকারঃ কর্তা সাত্ত্বিক উচ্যতে ।। ২৬ ।।

মুক্তসঙ্গঃ—সমস্ত জড় আসত্তি থেকে মুক্ত; অনহংবাদী- অহঙ্কারশূন্য; ধৃতি স্মৃতি; উৎসাহ-উদ্যম, সমন্বিতঃ — সমন্বিত, সিদ্ধি — সিদ্ধি; অসিদ্ধ্যোঃ – অসিদ্ধিতে; নির্বিকারঃ— নির্বিকার; কর্তা–কর্তা; সাত্ত্বিকঃ — সাত্ত্বিক; উচ্যতে—বলা হয়।

গীতার গান

মুক্তসঙ্গ অনহঙ্কার ধৃতি উৎসাহপূর্ণ ।

নির্বিকার সিদ্ধাসিদ্ধি সাত্ত্বিক সে ধন্য ।।

অনুবাদঃ সমস্ত জড় আসক্তি থেকে মুক্ত, অহঙ্কারশূন্য, ধৃতি ও উৎসাহ সমন্বিত এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নির্বিকার —- এরূপ কর্তাকেই সাত্ত্বিক বলা হয়।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত সর্বদাই প্রকৃতির জড় গুণগুলির অতীত। তাঁর উপরে ন্যস্ত হয়েছে যে সমস্ত কর্ম, সেগুলির ফলের আকাঙ্ক্ষা তিনি করেন না। কারণ, তিনি গর্ব ও অহঙ্কারের ঊর্ধ্বে বিরাজ করেন। তবুও সেই কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি সর্বদাই উৎসাহ নিয়ে কাজ করে চলেন। যে দুঃখ-দুর্দশা, বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়, তার জন্য তিনি দুশ্চিন্তা করেন না। তিনি সর্বদাই উৎসাহী। তিনি সফলতা বা বিফলতা কোনটিরই পরোয়া করেন। না। তিনি সুখ ও দুঃখ উভয়ের প্রতিই সমভাবাপন্ন। এই ধরনের কর্তা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন।

শ্লোকঃ ২৭

রাগী কর্মফলপ্রেপ্সুদুর্লুব্ধো হিংসাত্মকোহশুচিঃ। 

হর্ষশোকান্বিতঃ কর্তা রাজসঃ পরিকীর্তিতঃ ॥ ২৭ ৷৷

রাগী—কর্মাসক্ত: কর্মফল—কর্মফলে: প্রেপ্সুঃ—আকাঙ্ক্ষী;: লুব্ধঃ—লোভী; হিংসাত্মকঃ— হিংসা-পরায়ণ, অশুচিঃ — অশুচি; হর্ষশোকান্বিতঃ — হর্য ও শোকযুক্ত, কর্তা–কর্তা; রাজসঃ রাজসিক, পরিকীর্তিতঃ — কথিত হয়।.

গীতার গান

কর্মাসক্ত ফলে লোভ হিংসুক অশুচি ।

রাজসিক কর্তা সেই হর্ষশোকে রুচি ॥

অনুবাদঃ কর্মাসক্ত, কর্মফলে আকাঙ্ক্ষী, লোভী, হিংসাপ্রিয়, অশুচি, হর্ষ ও শোকযুক্ত যে কর্তা, সে রাজসিক কর্তা বলে কথিত হয় ।

তাৎপর্যঃ বিশেষ কোন কর্মের প্রতি বা তার ফলের প্রতি কোন মানুষের গভীর আসক্ত হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে জড়-জাগতিক বিষয়াদি, ঘরবাড়ি ও স্ত্রী-পুত্রের প্রতি তাঁর অত্যধিক আসক্তি। এই ধরনের মানুষের উচ্চতর জীবনে উন্নীত হওয়ার কোন অভিলাষ নেই। তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এই পৃথিবীটিকে যতদূর সম্ভব জড়- জাগতিক পদ্ধতিতে আরামদায়ক করে তোলা। সে স্বভাবতই অত্যন্ত লোভী এবং সে মনে করে যে, যা কিছু সে লাভ করেছে তা সবই নিত্য এবং তা কখনই হারিয়ে যাবে না। এই ধরনের মানুষ অত্যন্ত পরশ্রীকাতর এবং ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের জন্য যে কোন জঘন্য কাজ করতে প্রস্তুত। তাই, এই ধরনের মানুষ অত্যন্ত অশুচি এবং তার উপার্জন পবিত্র না অপবিত্র, সেই সম্বন্ধে সে পরোয়া করে না। তার কাজ যদি সফল হয়, তখন সে খুব খুশি হয় এবং তাঁর কাজ যদি বিফল হয়, তা হলে তার দুঃখের অন্ত থাকে না। এই ধরনের কর্তা রজোগুণে আচ্ছন্ন।

error: Content is protected !!