শ্লোকঃ ২২
যত্তু কৃৎস্নবদেকস্মিন্ কার্যে সক্তমহৈতুকম্ ।
অতত্ত্বার্থবদল্পং চ তত্তামসমুদাহৃতম্ ।। ২২ ৷।
যৎ— যে, তু—কিন্তু, কৃৎস্নবং—পরিপূর্ণের ন্যায়; একস্মিন্ — কোন একটি কার্যে কার্যে; সত্তম—আসক্ত; অহেতুকম্—কারণ রহিত; অতত্ত্বার্থবৎ—প্রকৃত তত্ত্ব অবগত না হয়ে; অক্ষম্ তুচ্ছ, এবং; ভ – সেই, তামসম্—তামসিক, উদাহৃতম্— কথিত হয়।
গীতার গান
দেহকে সর্বস্ব বুঝি যে জ্ঞান উদ্ভব ৷
অতত্ত্বজ্ঞ অল্পবুদ্ধি তামসিক সব ।।
অনুবাদঃ আর যে জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত তত্ত্ব অবগত না হয়ে, কোন একটি বিশেষ কার্যে পরিপূর্ণের ন্যায় আসক্তির উদয় হয়, সেই তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে কথিত হয়।
তাৎপর্যঃ সাধারণ মানুষের ‘জ্ঞান’ সর্বদাই তমোগুণের দ্বারা আচ্ছা, কারণ বদ্ধ জীবনে প্রত্যেক জীব তমোগুণে জন্মগ্রহণ করে থাকে। যে মানুষ শাস্ত্রীয় অনুশাসন মতে কিংবা শ্রীগুরুদেবের কাছ থেকে প্রামাণ্য সূত্রে জ্ঞানের বিকাশ সাধন করেনি, দেহ সম্পর্কিত তার সেই জ্ঞান সীমাবদ্ধ। শাস্ত্রীয় অনুশাসন মতো কর্ম সাধনের কোন চিন্তাভাবনাই সে করে না। তার কাছে অর্থ-সম্পদই হচ্ছে ভগবান এবং জ্ঞান হচ্ছে দেহগত চাহিদার তৃপ্তিসাধন। পরম তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে এই ধরনের জ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। এটি অনেকটা সাধারণ একটি পশুর জ্ঞানেরই মতো— শুধুমাত্র আহার, নিদ্রা, আত্মরক্ষা ও মৈথুন সংক্রান্ত জ্ঞান। এই ধরনের জ্ঞানকে এখানে তমোগুণ প্রসূত বলে অভিহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বলা যেতে পারে যে, এই দেহের ঊর্ধ্বে চিন্ময় আত্মা সংক্রান্ত যে জ্ঞান, তাকে বলা হয় সাত্ত্বিক জ্ঞান। মনোধর্ম ও জাগতিক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে যে সমস্ত মতবাদ ও ধারণা সম্পর্কিত জ্ঞান, তা হচ্ছে রজোগুণাশ্রিত এবং কেবলমাত্র দেহসুখ ভোগের উদ্দেশ্যে যে জ্ঞান, তা হচ্ছে তমোগুণাশ্রিত।
শ্লোকঃ ২৩
নিয়তং সঙ্গরহিতমরাগদ্বেষতঃ কৃতম্ ।
অফলপ্রেপ্সুনা কর্ম যত্তৎসাত্ত্বিকমুচ্যতে ।। ২০ ।।
নিয়তম্—নিতা; সঙ্গরহিতম্ — আসক্তি রহিত হয়ে; অরাগদ্বেষতঃ–রাগ ও দ্বেষ বর্জনপূর্বক, কৃতম্ — অনুষ্ঠিত হয়; অফলপ্লেগুনা — ফলের কামনাশূন্য; কর্ম—কর্ম, যৎ— যে; তৎ—তাকে; সাত্ত্বিকম্—সাত্ত্বিক; উচ্যতে—বলা হয়।
গীতার গান
রাগ দ্বেষ সঙ্গ বিনা যে নিয়ত কর্ম ।
সে জানিবে সব সাত্ত্বিকের ধর্ম ।।
অনুবাদঃ ফলের কামনাশূন্য ও আসক্তি রহিত হয়ে রাগ ও দ্বেষ বর্জনপূর্বক যে নিত্যকর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয় ।
তাৎপর্যঃ শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুসারে সমাজের বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রম-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিধিবদ্ধ বৃত্তিমূলক কর্তব্যকর্মাদি অনাসক্তভাবে কর্তৃত্ববোধ বর্জন করে সম্পাদিত হলে এবং সেই কারণেই অনুরাগ অথবা বিদ্বেষমুক্ত হয়ে, পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি কিংবা আত্ম-উপভোগ রহিত হয়ে সম্পাদিত হলে, তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়।
শ্লোকঃ ২৪
যত্তু কামেপ্সুনা কর্ম সাহঙ্কারেণ বা পুনঃ ।
ক্রিয়তে বহুলায়াসং তদ্ রাজসমুদাহৃতম্ ॥ ২৪ ॥
যৎ- যে; তু—কিন্তু; কামেলুনা-ফলের আকাঙ্ক্ষা যুক্ত; কর্ম—কর্ম; সাহঙ্কারেণ— অহঙ্কার যুক্ত হয়ে; বা—অথবা; পুনঃপুনরায়; ক্রিয়তে অনুষ্ঠিত হয়, বহুলায়াসম্—বহু কষ্টসাধ্য; তৎ- সেই; রাজসম্—রাজসিক উদাহৃতম — অভিহিত হয়।
গীতার গান
ফলের কামনা কর্ম অহঙ্কার সহ ।
কষ্টসাধ্য যত রাজস সমূহ ।।
অনুবাদঃ কিন্তু ফলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ও অহঙ্কারযুক্ত হয়ে বহু কষ্টসাধ্য করে যে কর্মের অনুষ্ঠান হয়, সেই কর্ম রাজসিক বলে অভিহিত হয়।