শ্লোকঃ ১৯

জ্ঞানং কর্ম চ কর্তা চ ত্রিধৈব গুণভেদতঃ

প্রোচ্যতে গুণসংখ্যানে যথাবচ্ছৃণু তান্যপি ॥ ১৯ ॥

জ্ঞানম্—জ্ঞান; কর্ম—কর্ম, চ–ও; কর্তা–কর্তা; চ–ও, ত্রিধা — ত্রিবিধ, এব অবশ্যই; গুণভেদভঃ——গুণভেদ হেতু; প্রোচ্যতে — কথিত হয়; গুণসংখ্যানে বিভিন্ন গুণ সম্বন্ধে; যথাবৎ যথাযথ রূপে; শৃণু — শ্রবণ কর; তানি— সেই সমস্ত অপি—ও।

গীতার গান

জ্ঞান আর কর্তা হয় ত্রিবিধ গুণ ভেদে ৷

কহিব সে ত্রিবিধ ভেদ তোমাকে সংক্ষেপে ৷।

অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা তিন প্রকার বলে কথিত হয়েছে। সেই সমস্তও যথাযথ রূপে শ্রবণ কর।

তাৎপর্যঃ চতুর্দশ অধ্যায়ে জড়া প্রকৃতির গুণের তিনটি বিভাগ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। সেই অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, সত্ত্বগুণ হচ্ছে জ্ঞানোদ্ভাসিত, রজোগুণ হচ্ছে জড় জাগতিক ও বৈষয়িক এবং তমোগুণ হচ্ছে আলস্য ও কর্ম বিমুখতার সহায়ক। জড়া প্রকৃতির সব কয়টি গুণই হচ্ছে বন্ধন। তাদের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা যায় না। এমন কি, সত্ত্বগুণের মধ্যেও মানুষ আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সপ্তদশ অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন গুণে অধিষ্ঠিত ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পূজা-পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্লোকে ভগবান প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রকমের জ্ঞান, কর্তা ও কর্ম সম্বন্ধে বর্ণনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

শ্লোকঃ ২০

সর্বভূতেষু যেনৈকৎ ভাবমবায়মীক্ষতে।

অবিভক্তং বিভক্তেষু তজজ্ঞানং বিদ্ধি সাত্ত্বিকম ।। ২০ ।।

সর্বভূতেষু — সমস্ত প্রাণীতে; যেন—যার দ্বারা; একম্–এক; ভাবম্ ভাব; অব্যয়ম্—অব্যয়; ঈক্ষতে—দর্শন হয়; অবিভক্তম্ — অবিভক্ত: বিভক্তেষু – পরস্পর ভিন্ন; তৎ—সেই; জ্ঞানম্ — জ্ঞানকে; বিদ্ধি— জানবে; সাত্ত্বিকম্—সাত্ত্বিক।

গীতার গান

এক জীব আত্মা নানা কর্মফল ভেদে ।

মনুষ্যাদি সর্বদেহে সে বর্তমান ক্ষেদে ৷৷

অব্যয় সে জীব হয় একতত্ত্ব জ্ঞান ৷

বিভিন্নতে এক দেখে সেই সাত্ত্বিক জ্ঞান ॥

অনুবাদঃ যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে এক অবিভক্ত চিন্ময় ভাব দর্শন হয়, অনেক জীব পরস্পর ভিন্ন হলেও চিন্ময় সত্তায় তারা এক, সেই জ্ঞানকে সাত্ত্বিক বলে জানবে। তাৎপর্য

তাৎপর্যঃ যিনি দেবতা, মানুষ, পশু, পাখি, জলজ বা উদ্ভিজ্জ সমস্ত জীবের মধ্যেই এক চিন্ময় আত্মাকে দর্শন করেন, তিনি সাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী। প্রতিটি জীবের মধ্যে একটি চিন্নয় আজা রয়েছে, যদিও জীবগুলি তাদের পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের দেহ অর্জন করেছে। সপ্তম অধ্যায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, পরমেশ্বর ভগবানের পরা প্রকৃতি বা উৎকৃষ্ট শক্তি থেকেই প্রত্যেক জীবের দেহে জীবনী- শক্তির প্রকাশ ঘটে। এভাবেই প্রতিটি জীবদেহে জীবনীশক্তি-স্বরূপ এক উৎকৃষ্টা পরা প্রকৃতিকে দর্শন করাই হচ্ছে সাত্ত্বিক দর্শন। দেহের বিনাশ হলেও সেই জীবনী- শক্তিটি অবিনশ্বর। জড় দেহের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়। যেহেতু বন্ধ জীবনে গড় অস্তিত্বের নানা রকম রূপ আছে, তাই জীবনীশক্তিকে ঐভাবে বহুধা বিভক্ত বলে মনে হয়। এই ধরনের নির্বিশেষ জ্ঞান হচ্ছে আত্ম- উপলব্ধিরই একটি অঙ্গ।

শ্লোকঃ ২১

পৃথতেন তু যজজ্ঞানং নানাভাবান্ পৃথগবিধান।

বেত্তি সর্বেষু ভূতেষু তজজ্ঞানং বিদ্ধি রাজসম্ ॥ ২১ ॥

পৃথনে—পৃথকরূপে; ভু—কিন্তু; যৎ- যে; জ্ঞানম্ — জান; নানাভাবান্—ভিন্ন ভিন্ন ভাব পৃথবিধান—নানাবিধ বেশি—জানে; সর্বেষু — সমস্ত ভূতেষু — প্রাণীতে; তৎ—সেই; জ্ঞানম্—জ্ঞানকে, বিথি — জানবে; রাজসম্—রাজসিক।

গীতার গান

বিভিন্ন জীবের যেই পৃথকত্ব দেখে ৷

রাজসিক তার জ্ঞান নানাভাবে থাকে ॥

অনুবাদঃ যে জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আত্মা অবস্থিত বলে পৃথকরূপে দর্শন হয়, সেই জ্ঞানকে রাজসিক বলে জানবে।

তাৎপর্যঃ জড় দেহটি হচ্ছে জীব এবং দেহটি নষ্ট হয়ে গেলে তার সঙ্গে সঙ্গে চেতনাও নষ্ট হয়ে যায় বলে যে ধারণা, তাকে বলা হয় রাজসিক জ্ঞান। সেই জ্ঞান অনুসারে দেহের বিভিন্নতার কারণ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন রকমের চেতনার প্রকাশ। এ ছাড়া পৃথক কোন আত্মা নেই, যার থেকে চেতনার প্রকাশ হয়। দেহটি হচ্ছে যেন সেই আত্মা এবং এই দেহের ঊর্ধ্বে পৃথক কোন আত্মা নেই। এই ধরনের জ্ঞান অনুসারে চেতনা হচ্ছে সাময়িক, অথবা স্বতন্ত্র কোন আত্মা নেই। কিন্তু সর্বব্যাপক এক আত্মা রয়েছে, যা পূর্ণ জ্ঞানময় এবং এই দেহটি হচ্ছে সাময়িক অজ্ঞানতার প্রকাশ, অথবা এই দেহের অতীত কোনও বিশেষ জীবাত্মা অথবা পরমাত্মা নেই। এই ধরনের সমস্ত ধারণাগুলিকেই রজোগুণ জাত বলে গণ্য করা হয়।

error: Content is protected !!