শ্লোকঃ ১৬

তত্রৈবং সতি কর্তারমাত্মানং কেবলং তু যঃ।

পশ্যত্যকৃতবুদ্ধিত্বান্ন স পশ্যতি দুর্মতিঃ ॥ ১৬ ৷৷

তত্র–সেখানে, এবম্—এভাবে; সতি — হলেও; কর্তারম্—কর্তারূপে; আত্মানম্— নিজেকে; কেবলম্ – কেবল; তু– কিন্তু; মঃ— যে, পশ্যতি – দর্শন করে; অকৃতবুদ্ধিত্বাৎ—বুদ্ধির অভাববশত, ন-না; সঃ — সেই; পশ্যতি- দর্শন করতে পারে, দুর্মতিঃ—দুর্মতি।

গীতার গান

মূর্খ যারা কর্তা সাজে নিজ মনগড়া ।

না বুঝিয়া কারণ সে শুধু কর্তা ছাড়া ৷৷

অনুবাদঃ অতএব, কর্মের পাঁচটি কারণের কথা বিবেচনা না করে যে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে, বুদ্ধির অভাববশত সেই দুর্মতি যথাযথভাবে দর্শন করতে পারে না।

তাৎপর্যঃ কোন মূর্খ লোক বুঝতে পারে না যে, পরম বন্ধুরূপে পরমাত্মা তার হৃদয়ে বসে আছেন এবং তিনি তার সমস্ত কার্যকলাপ পরিচালনা করছেন। যদিও কর্মক্ষেত্র, কর্মকর্তা, প্রচেষ্টা ও ইন্দ্রিয়সমূহ—এই চারটি হচ্ছে জড় কারণ, কিন্তু পরম কারণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। সুতরাং, চারটি জড় কারণকেই কেবল দেখা উচিত নয়, পরম নিমিত্ত যে কারণ, তাকেও দেখা উচিত। যে পরমেশ্বরকে দেখতে পায় না, সে নিজেকেই কর্তা বলে মনে করে।

শ্লোকঃ ১৭

যস্য নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন লিপ্যতে ।

হত্বাপি স ইমাল্লোকান্ন হন্তি ন নিবধ্যতে ॥১৭ ॥

যস্য – যার; ন― নেই; অহংকৃতঃ – অহংকারের; ভাব: ভাব; বুদ্ধিঃ বুদ্ধি, যা- যাঁর, ন–না, নিপ্যতে — লিপ্ত হয়, হজ্ব। অপি—হত্যা করেও; সঃ— তিনি; ‘ইযান্— এই সমস্ত; লোকান্—প্রাণীকে; ন–না, হস্তি – হত্যা করেন, ন– না, নিধাতে- আবদ্ধ হন।

গীতার গান

অতএব যে না হয় অহঙ্কারে মত্ত ৷

বুদ্ধি যার অহংভাবে নাহি হয় লিপ্ত ॥

কর্তব্যের অনুরোধে যদি বিশ্ব মারে ।

কাহাকেও মারে না সে কিংবা কর্ম করে ॥

অনুবাদঃ যাঁর অহঙ্কারের ভাব নেই এবং যার বৃদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি এই সমস্ত প্রাণীকে হত্যা করেও হত্যা করেন না এবং হত্যার কর্মফলে আবদ্ধ হন না।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে ভগবান অর্জুনকে বলছেন যে, যুদ্ধ না করার যে বাসনা তা উদয় হচ্ছে অহঙ্কার থেকে। অর্জুন নিজেকেই কর্তা বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু তিনি অন্তরে ও বাইরে পরম অনুমোদনের কথা বিবেচনা করেননি। কেউ যদি পরম অনুমোদন সম্বন্ধে অবগত হতে না পারে, তা হলে তিনি কেন কর্ম করবেন? কিন্তু যিনি কর্মের করণ, নিজেকে কর্তা এবং পরমেশ্বর ভগবানকে পরম অনুমোদনকারী বলে জানেন, তিনি সব কিছু সুচারুভাবে করতে পারেন। এই ধরনের মানুষ কখনই মোহাচ্ছন্ন হন না। ব্যক্তিগত কার্যকলাপ এবং তার দায়িত্বের উদয় হয় অহঙ্কার, নাস্তিকতা অথবা কৃষ্ণভাবনার অভাব থেকে। যিনি পরমাত্মা বা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের পরিচালনায় কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করে চলেছেন, তিনি যদি হত্যাও করেন, তা হলেও তা হত্যা নয় এবং তিনি কখনই এই ধরনের হত্যা করার জন্য তার ফল ভোগ করেন না। কোন সৈনিক যখন তার সেনাপতির আদেশ অনুসারে শত্রুসৈনাকে হত্যা করে, তখন তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। কিন্তু কোন সৈনিক যদি তার নিজের ইচ্ছায় কাউকে হত্যা করে, তা হলে অবশ্য‍ই বিচারালয়ে তার বিচার হবে।

শ্লোকঃ ১৮

জ্ঞানং জ্ঞেয়ং পরিজ্ঞাতা ত্রিবিধা কর্মচোদনা ।

করণং কর্ম কর্তেতি ত্রিবিধঃ কর্মসংগ্রহঃ ॥ ১৮ ॥

জ্ঞানম্—জ্ঞান; জ্ঞেয়ম্ জ্ঞেয়; পরিজ্ঞাতা – জ্ঞাতা, ত্রিবিধা — তিন প্রকার; কর্ম- কর্মের চোদনা — প্রেরণা; করণম্ — ইন্দ্রিয়গুলি; কর্ম-কর্ম, কর্তা–কর্তা; ইতি— এই; ত্রিবিধঃ—তিন প্রকার; কর্ম–কর্মের, সংগ্রহঃ —আশ্রয়।

গীতার গান

কর্মের প্রেরণা হয় জ্ঞান, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা ।

কর্মের সংগ্রহ সে করণ কর্মকর্তা ॥

অনুবাদঃ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা—এই তিনটি কর্মের প্রেরণা, করণ, কর্ম ও কর্তা– এই তিনটি কর্মের আশ্রয়।

তাৎপর্যঃ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা—এই তিনের অনুপ্রেরণায় আমাদের সমস্ত দৈনন্দিন কাজকর্ম সাধিত হয়। কাজের সহায়ক উপকরণাদি, আসল কাজটি এবং তার কর্মকর্তা- এদের বলা হয় কাজের উপাদান। মানুষের যে কোন কাজকর্মে এই উপাদানগুলি থাকে। কাজ করার আগে খানিকটা উদ্দীপনা থাকে, যাকে বলা হয় অনুপ্রেরণা। কাজটি ঘটবার আগে যে মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায়, তা হচ্ছে সূক্ষ্ম ধরনেরই কাজ। তারপর কাজটি ক্রিয়ার রূপ নেয়। প্রথমে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও ইচ্ছা—এই সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং তাকে বলা হয় উদ্দীপনা। কর্ম করার অনুপ্রেরণা যদি শাস্ত্র বা গুরুদেবের নির্দেশ থেকে আসে, তা হলে তা অভিন্ন। যখন অনুপ্রেরণা রয়েছে এবং কর্তা রয়েছে, তখন মনসহ ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে প্রকৃত কার্য সাধিত হয়। মন হচ্ছে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্র। যে কোন কার্যের সমস্ত উপাদানগুলিকে বলা হয় কর্মসংগ্রহ।

error: Content is protected !!