শ্লোকঃ ১৩
পঞ্চৈতানি মহাবাহো কারণানি নিবোধ মে ।
সাংখ্যে কৃতান্তে প্রোক্তানি সিদ্ধয়ে সর্বকর্মণাম্ ॥ ১৩॥
পঞ্চ—পাঁচটি, এতানি—এই মহাবাহো – হে মহাবাহো; কারণানি—কারণ; নিবোধ—অবগত হও; মে—আমার থেকে: সাংখ্যে বেদান্ত শাস্ত্রে। বৃত্তান্তে সিদ্ধান্তে, প্রোক্তানি—কথিত: সিদ্ধয়ে সিন্ধির উদ্দেশ্যে সর্ব— সমস্ত: কর্মণাম- কর্মের।
গীতার গান
পঞ্চ সে কারণ হয় সকল কার্যের
মহাবাহো শুন সেই কহি সে তোমারে ॥
বেদান্ত সিদ্ধান্ত সেই শাস্ত্রের নির্ণয় ।
ভালমন্দ যাহা কিছু সেই সে পৰ্যায় ৷৷
অনুবাদঃ হে মহাবাহো। বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্তে সমস্ত কর্মের সিদ্ধির উদ্দেশ্যে এই পাঁচটি কারণ নির্দিষ্ট হয়েছে, আমার থেকে তা অবগত হও।
তাৎপর্যঃ প্রশ্ন হতে পারে যে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই যখন একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে, তা হলে এটি কিভাবে সম্ভব যে, কৃষ্ণভাবনাময় মানুষকে তার কর্মের ফলস্বরূপ সুখ বা দুঃখ কোনটিই ভোগ করতে হয় না? ভগবান বেদান্ত দর্শনের দৃষ্টান্ত দিয়ে এখানে বিশ্লেষণ করছেন কি করে তা সম্ভব। তিনি বলেছেন যে, সমস্ত কার্যের পিছনে পাঁচটি কারণ আছে এবং সমস্ত কার্যের সাফল্যের পিছনেও এই পাঁচটি কারণ আছে। বলে বিবেচনা করতে হবে। সাংখ্য কথাটির অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের বৃত্ত এবং বেদান্তকে সমস্ত আচার্যেরা জ্ঞানের চরম বৃত্ত বলে গ্রহণ করেছেন। এমন কি, শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেদান্ত-সূত্রকে এভাবেই স্বীকার করেছেন। তাই, এই সমস্ত শাস্ত্রের গুরুত্ব ও প্রামাণিকতা যথাযথভাবে আলোচনা করা উচিত।
সেই সম্বন্ধে সব কিছুর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ বা নিষ্পত্তি হচ্ছে পরমাত্মার ইচ্ছা। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে— সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ। তিনি সকলকে তার পূর্বের কর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নানা রকম কাজে নিযুক্ত করছেন। অন্তর্যামীরূপে তিনি যে নির্দেশ দেন, সেই নির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করলে, এই জন্মে বা পরজন্মে কোন কর্মফল উৎপাদন করে না।
শ্লোকঃ ১৪
অধিষ্ঠানং তথা কর্তা করণং চ পৃথগবিধম্ ।
বিবিধাশ্চ পৃথক্ চেষ্টা দৈবং চৈবাত্র পঞ্চমম্ ॥ ১৪॥
অধিষ্ঠানম্ — স্থান; তথা—ও; কর্তা–কর্তা; করণম্ করণ, চ–এবং পৃথবিধম্ – নানা প্রকার; বিবিধাঃ — বিবিধ চ—এবং পৃথক পৃথক, চেষ্টাঃ — প্রচেষ্টা; দৈবম্— দৈব; চ—ও, এব—অবশ্যই; অত্র — এখানে; পঞ্চমন— পাঁচটি।
গীতার গান
অধিষ্ঠান কর্তা আর করণ পৃথক ।
বিবিধ সে চেষ্টা দৈব এ পঞ্চশীর্ষক ।।
অনুবাদঃ অধিষ্ঠান অর্থাৎ দেহ, কর্তা, নানা প্রকার করণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ, বিবিধ প্রচেষ্টা ও দৈন অর্থাৎ পরমাত্মা—এই পাঁচটি হচ্ছে কারণ।
তাৎপর্যঃ অধিষ্ঠানম্ শব্দটির দ্বারা শরীরকে বোঝানো হয়েছে। শরীরের অভ্যন্তরস্থ আত্মা কর্মের ফলাদি সৃষ্টি করছেন এবং সেই কারণে তাঁকে বলা হয় কর্তা। আত্মাই যে জ্ঞাতা ও কর্তা, সেই কথা শ্রুতি শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। এষ হি দুষ্টা কষ্টা (প্রশ্ন উপনিষদ ৪/৯)। বেদান্ত-সূত্রের জ্ঞোহত এর (২/৩/১৮) এবং কর্তা শাস্ত্রার্থবত্ত্বাৎ (২/৩/৩৩) শ্লোকেও তা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে কাজ করার যন্ত্র এবং ইন্দ্রিয়গুলির সহায়তায় আত্মা নানাভাবে কাজ করে। প্রতিটি কাজের জন্য নানা রকম প্রয়াস করতে হয়। কিন্তু সকলের সমস্ত কার্যকলাপ নির্ভর করে পরমাত্মার ইচ্ছার উপরে, যিনি সকলের হৃদয়ে বন্ধুরূপে বিরাজ করছেন। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন পরম কারণ। এই অবস্থায়, যিনি অন্তর্যামী পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ-সেবা করে চলেছেন, তিনি স্বাভাবিকভাবেই কোন কর্মের বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ হন না। যাঁরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময়, তাঁদের কোন কর্মের জন্যই তারা নিজেরা শেষ পর্যন্ত দায়ী হন না। সব কিছুই নির্ভর করে পরমাত্মা বা পরম পুরুষোত্তম ভগবনের ইচ্ছার উপর।
শ্লোকঃ ১৫
শরীরবাত্মনোভির্যৎ কর্ম প্রারভতে নরঃ ।
ন্যায্যং বা বিপরীতং বা পঞ্চৈতে তস্য হেতবঃ ॥ ১৫ ॥
শরীর — দেহ; বাক্—বাক্য; মনোডিঃ —মনের দ্বারা; যৎ—যে; কর্ম-কর্ম, প্রারভতে—আরম্ভ করে; নরঃ – মানুষ, নায্যম্ ন্যায়যুক্ত, বা — অথবা; বিপরীতম্— বিপরীত; বা—অথবা; পঞ্চ-পাঁচটি; এতে — এই; তস্য—তার; হেতবঃ—কারণ।
গীতার গান
শরীর বচন মন কর্ম তৎ দ্বারা ।
ন্যায্য বা অন্যায্য যত কর্ম সারা ॥
সবার কারণ হয় সেই পঞ্চবিধ
সকল কার্যের হয় সেই সে হেত ॥
অনুবাদঃ শরীর, বাক্য ও মনের দ্বারা মানুষ যে কর্ম আরম্ভ করে, তা ন্যাযাই হোক অথবা অন্যায্যই হোক, এই পাঁচটি তার কারণ।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে উল্লিখিত ‘ন্যায্য’ এবং তার বিপরীত ‘অন্যায্য’ শব্দ দুটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ন্যায্য কর্ম শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং অন্যায্য কর্ম শাস্ত্রবিধির অবহেলা করে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু যে কাজই হোক না কেন, তার সম্যক্ অনুষ্ঠানের জন্য এই পঞ্চবিধ কারণ প্রয়োজন।