শ্লোকঃ ৭৫
ব্যাসপ্রসাদাচ্ছ্রবানেতদ্ গুহ্যমহং পরম্ ।
যোগং যোগেশ্বরাৎ কৃষ্ণাৎ সাক্ষাৎকথয়তঃ স্বয়ম্ ॥ ৭৫ ॥
ব্যাসপ্রসাদাৎ—ব্যাসদেবের কৃপায়, শ্রুতবান্—শ্রবণ করেছি; এতৎ—এ —এই; গুহাম্ গোপনীয়; অহম্—আমি; পরম— পরম; যোগম্ — যোগ, যোগেশ্বরাং – যোগেশ্বর; কৃষ্ণাৎ—শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে; সাক্ষাৎ—সাক্ষাৎ; কথয়তঃ —বর্ণনাকারী; স্বয়ম্- স্বয়ং ।
গীতার গান
ব্যাসের প্রসাদে আমি শুনিলাম সেই ।
পরম সে গুহ্যতম তুলনা যে নেই ৷।
এই যোগ যোগেশ্বর কৃষ্ণ সে কহিল ।
সাক্ষাৎ তাঁহার মুখে আমি সে শুনিল ৷।
অনুবাদঃ ব্যাসদেবের কৃপায়, আমি এই পরম গোপনীয় যোগ সাক্ষাৎ বর্ণনাকারী স্বয়ং যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করেছি।
তাৎপর্যঃ ব্যাসদেব ছিলেন সঞ্জয়ের গুরুদেব এবং সঞ্জয় এখানে স্বীকার করছেন যে, ব্যাসদেবের কৃপার ফলে তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরেছেন। অর্থাৎ, সরাসরিভাবে নিজের চেষ্টার দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারা যায় না। তাঁকে জানতে হয় শুরুদেবের কৃপার মাধ্যমে। ভগবৎ-তত্ত্ব দর্শনের উপলব্ধি যদিও সরাসরি, কিন্তু গুরুদেব হচ্ছেন তার স্বচ্ছ মাধ্যম। সেটিই হচ্ছে, গুরু-পরম্পরার রহস্য। সদগুরুর কাছে সরাসরিভাবে ভগবদ্গীতা শ্রবণ করা যায়, যেমন অর্জুন শ্রবণ করেছিলেন। সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক অতীন্দ্রিয়বাদী ও যোগী রয়েছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন যোগেশ্বর। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে—শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শরণাগত হও। যিনি তা করেন তিনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যোগী। ষষ্ঠ অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে সেই সত্য প্রতিপন্ন করে বলা হয়েছে— যোগিনামপি সর্বেষাম্।
নারদ মুনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের শিষ্য এবং ব্যাসদেবের গুরুদেব। তাই ব্যাসদেবও হচ্ছেন অর্জুনের মতো সৎ শিষ্য, কারণ তিনি গুরু-পরম্পরায় রয়েছেন আর সঞ্জয় হচ্ছেন ব্যাসদেবের শিষ্য। তাই, ব্যাসদেবের আশীর্বাদে সঞ্জয়ের ইন্দ্রিয়গুলি নির্মল হয়েছে এবং তিনি সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন এবং তাঁর কথা শ্রবণ করতে পেরেছেন। যিনি সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের বাণী শ্রবণ করতে পারেন, তিনি এই রহস্যাবৃত জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারেন। কেউ যদি গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান প্রাপ্ত না হন, তা হলে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারেন না। তাই তাঁর জ্ঞান সর্বদাই অসম্পূর্ণ, অন্তত ভগবদ্গীতা সম্বন্ধে।
ভগবদ্গীতায় কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ— সমস্ত যোগের পন্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন এই সমস্ত যোগের ঈশ্বর। আমাদের বুঝতে হবে যে, অর্জুন তাঁর অসীম সৌভাগ্যের ফলে সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পেরেছিলেন, তেমনই ব্যাসদেবের আশীর্বাদে সঞ্জয়ও শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে সরাসরিভাবে শ্রবণ করতে পেরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে সরাসরিভাবে শ্রবণ করা এবং ব্যাসদেবের মতো সদগুরুর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের বাণী শ্রবণ করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শ্রীগুরুদেব হচ্ছেন ব্যাসদেবেরও প্রতিনিধি। তাই, বৈদিক প্রথা অনুসারে শ্রীগুরুদেবের আবির্ভাব তিথিতে তাঁর শিষ্যরা ব্যাসপূজার অনুষ্ঠান করেন।
শ্লোকঃ ৭৬
রাজন সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য সংবাদমিমমদ্ভুতম।
কেশবার্জুনয়োঃ পুণ্যং হৃষ্যামি চ মুহুর্মুহু ।।
রাজন—হে রাজন; সংস্কৃত্য – স্মরণ করে; সংস্কৃত্য – স্মরণ করে; সংবাদম— সংবাদ; ইমম্—এই; অদ্ভুতম্ — অদ্ভুত; কেশব — শ্রীকৃষ্ণ; অনয়োঃ – এবং অর্জুনের, পুণ্যম্পুণ্যজনক: হৃয্যামি — হরষিত হচ্ছি; চ–ও, মুহুর্মুহুঃ বারংবার।
গীতার গান
স্মরণ করিয়া রাজা পুনঃ পুনঃ সেই
অদ্ভূত সংবাদ স্মরি হৃষ্ট আমি হই ৷৷
কেশব আর অর্জুন কথা পুণ্য গীতা ৷
মুহুর্মুহু শুনে নিত্য সর্বহিতে রতা ॥
অনুবাদঃ হে রাজন ! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই পুণ্যজনক অদ্ভূত সংবাদ স্মরণ করতে করতে আমি বারংবার রোমাঞ্চিত হচ্ছি।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতার উপলব্ধি এতই দিব্য যে, কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন সম্বন্ধে অবগত হন, তখনই তিনি পবিত্র হন এবং তাঁদের কথা আর তিনি ভুলতে পারেন না। এটিই হচ্ছে ভক্ত-জীবনের চিন্ময় অবস্থা। পক্ষান্তরে বলা যায়, কেউ যখন নির্ভুল উৎস সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে গীতা শ্রবণ করেন, তখনই তিনি পূর্ণ কৃষ্ণভাবনামৃত প্রাপ্ত হন। কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রভাবে উত্তরোত্তর দিব্যজ্ঞান প্রকাশিত হতে থাকে এবং পুলকিত চিত্তে জীবন উপভোগ করা যায়। তা কেবল ক্ষণিকের জন্য নয়, প্রতি মুহূর্তে সেই দিব্য আনন্দ অনুভূত হয়।
শ্লোকঃ ৭৭
তচ্চ সংস্কৃত্য সংস্কৃত্য রূপমত্যদ্ভুতং হরেঃ ।
বিস্ময়ো মে মহান্ রাজন্ হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ ॥ ৭৭ ॥
তৎ—তা; চ—ও; সংস্কৃত্য—স্মরণ করে; সংস্কৃত্য— স্মরণ করে। রূপম্ রূপ; অতি—অত্যন্ত, অদ্ভুতম্—অদ্ভুত, হরেঃ— শ্রীকৃষ্ণের বিস্ময়ঃ — বিস্ময়, যে আমার, মহান্—অতিশয়; রাজন্—হে রাজন; হৃস্যামি — হরষিত হচ্ছি; চ—ও; পুনঃ পুনঃ —বারংবার।
গীতার গান
স্মরণ করিয়া সেই অদ্ভুত স্বরূপ ৷
পুনঃ পুনঃ হৃষ্ট মন হয় অপরূপ ৷৷
অনুবাদঃ হে রাজন ! শ্রীকৃষ্ণের সেই অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে আমি অতিশয় বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি এবং বারংবার হরষিত হচ্ছি।
তাৎপর্যঃ এখানে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, ব্যাসদেবের কৃপায় সঞ্জয়ও সেই রূপ দর্শন করতে পেরেছিলেন। এই কথা অবশ্য বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ পূর্বে কখনও এই রূপ দেখাননি। তা কেবল অর্জুনকেই দেখানো হয়েছিল, তবুও শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তখন কতিপয় মহান ভক্তও তা দেখতে পেরেছিলেন এবং ব্যাসদেব ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ব্যাসদেব হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের একজন মহান ভক্ত এবং তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের শক্ত্যাবেশ অবতার বলে গণ্য করা হয়। যে অদ্ভুত রূপ অর্জুনকে দেখানো হয়েছিল, ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য সঞ্জয়ের কাছে সেই রূপ প্রকাশ করেছিলেন এবং সেই রূপ স্মরণ করে সঞ্জয় পুনঃ পুনঃ বিস্ময়ান্বিত হয়েছিলেন।
শ্লোকঃ ৭৮
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতিধ্রুবা নীতিমতিমম ।৷ ৭৮ ৷৷
যন্ত্র—যেখানে; যোগেশ্বরঃ— যোগেশ্বর; কৃষ্ণঃ—শ্রীকৃষ্ণ; যত্র— যেখানে; পার্থঃ— পৃথাপুত্র, ধনুর্ধরঃ—ধনুর্ধর, তত্র – সেখানে; শ্রী: – ঐশ্বর্য, বিজয়: — বিজয়, ভূতিঃ —অসাধারণ শক্তি; ধ্রুবা — নিশ্চিতভাবে; নীতিঃ—নীতি; মতিঃ মম — আমার অভিমত।
গীতার গান
যথা যোগেশ্বর কৃষ্ণ পার্থ ধনুর্ধর ।
তথা শ্রী বিজয় ভূতি ধ্রুব নিরন্তর ।।
যেই নাম সেই কৃষ্ণ নাহি সে অন্তর ৷
শুদ্ধ নাম যার হয় সেই ধুরন্ধর ৷।
অনুবাদঃ যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত।
তাৎপর্যঃ ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের মাধ্যমে ভগবদ্গীতা শুরু হয়। তিনি ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ আদি মহারথীদের সাহায্য প্রাপ্ত তাঁর সন্তানদের বিজয় আশা করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, বিজয়লক্ষ্মী তাঁর পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা করার পরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় বললেন, “আপনি বিজয়ের কথা ভাবছেন, কিন্তু আমি মনে করি, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন রয়েছেন, সেখানে সৌভাগ্যলক্ষ্মীও থাকবেন।” তিনি সরাসরিভাবে প্রতিপন্ন করলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পক্ষের বিজয় আশা করতে পারেন না। অর্জুনের পক্ষে বিজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের অর্জুনের রথের সারথির পদ বরণ করা আর একটি ঐশ্বর্যের প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণ ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ এবং বৈরাগ্য হচ্ছে তাদের মধ্যে একটি। এই প্রকার বৈরাগ্যের বহু নিদর্শন রয়েছে, কেন না শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন বৈরাগ্যেরও ঈশ্বর।
প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ হচ্ছিল দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে। অর্জুন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ছিলেন, তাই যুধিষ্ঠিরের বিজয় অনিবার্য ছিল। কে পৃথিবী শাসন করবে তা স্থির করার জন্য যুদ্ধ হচ্ছিল এবং সঞ্জয় ভবিষ্যৎ বাণী করলেন যে, যুধিষ্ঠিরের দিকে শক্তি স্থানান্তরিত হবে। ভবিষ্যৎ বাণী করে আরও বলা হল যে, যুদ্ধজয়ের পরে যুধিষ্ঠির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করবেন। কারণ তিনি কেবল ধার্মিক ও পুণ্যবানই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর নীতিবাদীও। তাঁর সারা জীবনে তিনি একটিও মিথ্যা কথা বলেননি।
অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন অনেক মানুষ ভগবদ্গীতাকে যুদ্ধক্ষেত্রে দুই বন্ধুর কথোপকথন বলে মনে করে। কিন্তু সেই ধরনের কোন গ্রন্থ শাস্ত্র বলে গণ্য হতে পারে না।
কেউ প্রতিবাদ করতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে উত্তেজিত করেছিলেন, যা নীতিবিরুদ্ধ। কিন্তু এখানে প্রকৃত অবস্থাটি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবদ্গীতা হচ্ছে নীতি সম্বন্ধে চরম উপদেশ। নবম অধ্যায়ের চতুস্ত্রিংশত্তম শ্লোকে চরম নৈতিক উপদেশ দিয়ে বলা হয়েছে— মন্মনা ভব মতেঃ । মানুষকে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হতে হবে এবং সমস্ত ধর্মের সারমর্ম হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করা (সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ)। ভগবদ্গীতার নির্দেশ নীতি ও ধর্মের শ্রেষ্ঠ পন্থাকে স্থাপিত করছে। অন্যান্য সমস্ত পন্থা মানুষকে পবিত্র করতে পারে এবং এই পথে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু ভগবদ্গীতার শেষ উপদেশ হচ্ছে সমস্ত ধর্ম ও নীতির শেষ কথা— শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করা। সেটিই হচ্ছে অষ্টাদশ অধ্যায়ের সিদ্ধান্ত।
ভগবদ্গীতা থেকে আমরা জানতে পারি যে, দার্শনিক মতবাদ ও ধ্যানের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান উপলব্ধি করা হচ্ছে একটি পন্থা, কিন্তু সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করাটা হচ্ছে সর্বোত্তম সিদ্ধি। সেটিই হচ্ছে ভগবদ্গীতার শিক্ষার সারমর্ম। বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুসারে বিধি-নিষেধের পন্থা জ্ঞানের গুহ্য পথ হতে পারে। যদিও ধর্মের আচার-আচরণ গুহা, কিন্তু ধ্যান ও জ্ঞানের অনুশীলন ওহাতর। আর কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভক্তিযোগে শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করাটা হচ্ছে গুহ্যতম নির্দেশ। সেটিই হচ্ছে অষ্টাদশ অধ্যায়ের সারমর্ম ।
ভগবদ্গীতার আর একটি দিক হচ্ছে যে, পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব। পরমতত্ত্ব তিনভাবে উপলব্ধ হন – নির্বিশেষ ব্রহ্ম, সর্বভূতে বিরাজমান পরমাত্মা এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। পরমতত্ত্বের পূর্ণজ্ঞান হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় জ্ঞান। কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারেন, তা হলে জ্ঞানের সমস্ত বিভাগই হচ্ছে সেই উপলব্ধির অংশ বিশেষ। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অপ্রাকৃত, কারণ তিনি সর্বদাই তাঁর নিত্য অন্তরঙ্গা শক্তিতে অধিষ্ঠিত। জীবসমূহ তাঁর শক্তির প্রকাশ এবং তারা দুভাবে বিভক্ত নিত্যবদ্ধ ও নিত্যমুক্ত। এই সমস্ত জীব অনন্ত এবং তারা শ্রীকৃষ্ণেরই অংশ-বিশেষ। জড়া প্রকৃতি চব্বিশটি তত্ত্বে প্রকাশিত। সৃষ্টি অনন্ত কালের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা তার সৃষ্টি হয় এবং তার লয় হয়। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের এই প্রকাশ পুনঃ পুনঃ দৃশ্য ও অদৃশ্য হয়।
ভগবদ্গীতায় পাঁচটি মুখ্য বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে— পরমেশ্বর ভগবান, জড়া প্রকৃতি, জীব, নিত্যকাল ও সর্বপ্রকার কর্ম। এই সবই পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপর নির্ভরশীল। পরমতত্ত্ব সম্বন্ধীয় সমস্ত ধারণা— নির্বিশেষ ব্রহ্ম, একস্থানে স্থিত পরমাত্মা এবং অন্য যে কোনরূপ চিন্ময় ধারণা পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করারই অন্তর্ভুক্ত। যদিও আপাতদৃষ্টিতে পরম পুরুষোত্তম ভগবান, জীব, জড়া প্রকৃতি ও কাল ভিন্ন বলে প্রতিভাত হয়, কিন্তু কোন কিছুই পরমেশ্বর ভগবান থেকে ভিন্ন নয়। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান সর্বদাই সব কিছু থেকে স্বতন্ত্র। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দর্শন হচ্ছে ‘অচিন্ত-ভেদাভেদ-তত্ত্ব। এই দর্শন পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান সমন্বিত ।
জীব তার স্বরূপে চিন্ময় শুদ্ধ আত্মা। সে পরমাত্মার অণুসদৃশ অংশ-বিশেষ । এভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সূর্যের সঙ্গে এবং জীব সমূহকে সূর্য-কিরণের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেহেতু বন্ধ জীব ভগবানের তটস্থা শক্তি, তাই তাদের অপরা প্রকৃতি অথবা পরা প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকার প্রবণতা রয়েছে। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, জীব ভগবানের দুই শক্তির মধ্যে অবস্থিত এবং যেহেতু জীব ভগবানের পরা প্রকৃতিজাত, তাই তার ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এই স্বাতন্ত্র্যের যথার্থ সদ্ব্যবহার করে সে সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণের পরিচালনাধীন হতে পারে। এভাবেই সে মুন্দিনী শক্তিতে তার স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করতে পারে।
ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।
শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ॥
ইতি ত্যাগ সাধনার সার্থক উপলব্ধি বিষয়ক ‘মোক্ষযোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।