শ্লোকঃ ৭২
কচ্চিদেতৎ শ্রুতং পার্থ ত্বয়ৈকাগ্রেণ চেতসা ।
কচ্চিদজ্ঞানসম্মোহঃ প্রণষ্টস্তে ধনঞ্জয় ॥ ৭২ ॥
কচ্চিৎ—হয়েছে কি, এতং—এই শ্রুতম্—শ্রুত, পার্থ- হে পৃথাপুত্র; ত্বয়া – তোমার দ্বারা; একাগ্রেণ – একাগ্র, চেতসা — চিত্তে, কচ্চিৎ হয়েছে কি, অজ্ঞান- অজ্ঞান-জনিত; সম্মোহঃ – মোহ; প্রণষ্টঃ — বিদূরিত; তে— তোমার; ধনঞ্জয় – হে ধনঞ্জয় (অর্জুন)।
গীতার গান
ধনঞ্জয়, কহ এবে কিবা শঙ্কা হল দূর ।
একাগ্রেতে উপদেশ শুনিয়া প্রচুর ॥
হে পার্থ, কিবা তব অজ্ঞান অন্ধকার ।
প্ৰনষ্ট হইয়া গেল তব দুঃখ ভার ॥
অনুবাদঃ হে পার্থ ! হে ধনঞ্জয় ! তুমি একাগ্রচিত্তে এই গীতা শ্রবণ করেছ কি ? তোমার অজ্ঞান-জানিত মোহ বিদূরিত হয়েছে কি?
তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনের গুরুর মতো আচরণ করছিলেন। তাই, সমগ্র ভগবদ্গীতার যথাযথ অর্থ অর্জুন উপলব্ধি করতে পেরেছেন কি না তা জিজ্ঞেস করা কর্তব্য বলে তিনি মনে করেছিলেন। অর্জুন যদি তাঁর অর্থ ঠিক মতো না বুঝতেন, তা হলে ভগবান কোন বিশেষ বিষয় বা সম্পূর্ণ ভগবদ্গীতা প্রয়োজন হলে আবার ব্যাখ্যা করতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণ বা তাঁর প্রতিনিধি সদগুরুর কাছ থেকে ভগবদ্গীতা শ্রবণ করেন, তাঁর সমস্ত অজ্ঞানতা তৎক্ষণাৎ বিদূরিত হয়। ভগবদ্গীতা কোন কবি বা সাহিত্যিকের লেখা সাধারণ কোন গ্রন্থ নয়। তা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী। কেউ যদি সৌভাগ্যক্রমে শ্রীকৃষ্ণ বা তাঁর যথার্থ প্রতিনিধির কাছ থেকে এই বাণী শ্রবণ করেন, তিনি অবশ্যই মুক্ত পুরুষরূপে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হন।
শ্লোকঃ ৭৩
অর্জুন উবাচ
নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা ত্বৎপ্রসাদান্ময়াচ্যুত ।
স্থিতোহস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব ॥ ৭৩ ॥
অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; নষ্টঃ—দূর হয়েছে; মোহঃ — মোহ, স্মৃতিঃ—স্মৃতি; লব্ধা লাভ করেছি; অপ্রসাদাৎ — তোমার কৃপায়, ময়া – আমার দ্বারা, অচ্যুত— হে অচ্যুত; স্থিতঃ — যথাজ্ঞানে অবস্থিত অস্মি— হয়েছি; গত—দূর হয়েছে; সন্দেহঃ — সমস্ত সংশয়, করিষ্যে — আমি পালন করব, বচনম্—– আদেশ, তব— তোমার।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেনঃ
নষ্ট মোহ স্মৃতি লাভ তোমার প্রসাদে ।
অচ্যুত, সন্দেহ গেল নাহি সে বিষাদে ॥
স্থিত আমি নিজ কার্যে তোমার বচন ।
নিশ্চয়ই করিব আমি ঘুচিল বন্ধন ॥
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন-হে অচ্যুত ! তোমার কৃপায় আমার মোহ দূর হয়েছে এবং আমি স্মৃতি লাভ করেছি। আমার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে এবং যথাজ্ঞানে অবস্থিত হয়েছি। এখন আমি তোমার আদেশ পালন করব।
তাৎপর্যঃ অর্জুনের আদর্শস্বরূপ সমস্ত জীবেরই স্বরূপগত অবস্থায় পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করা উচিত। আত্মসংযম করা তাদের ধর্ম। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন যে, জীবের স্বরূপ হচ্ছে ভগবানের নিত্য দাস। সেই কথা ভুলে জীব জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু পরমেশ্বরের সেবা করার ফলে সে মুক্ত ভগৎ দাসে পরিণত হয়। দাসত্ব করাটাই হচ্ছে জীবের স্বাভাবিক ধর্ম। হয় সে মায়ার দাসত্ব করে, নয় পরমেশ্বর ভগবানের দাসত্ব করে। সে যখন পরমেশ্বরের দাসত্ব করে, তখন সে তার স্বরূপে অধিষ্ঠিত থাকে, কিন্তু সে যখন বহিরঙ্গা মায়া শক্তির দাসত্ব বরণ করে, তখন সে অবশ্যই বদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। মোহাচ্ছন্ন হয়ে জীব জড় জগতের দাসত্ব করে। সে তখন কামনা-বাসনার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তবু সে নিজেকে সমস্ত জগতের মালিক বলে মনে করে। একেই বলা হয় মায়া। মানুষ যখন মুক্ত হয়, তখন তার মোহ কেটে যায় এবং সে স্বেচ্ছায় পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হয়ে তাঁর ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করে। চরম মোহ অর্থাৎ জীবকে ধরে রাখবার জন্য মায়ার চরম ফাঁদ হচ্ছে নিজেকে ‘ভগবান বলে মনে করা। জীব মনে করে যে, সে আর বদ্ধ আত্মা নয়, সে ভগবান। সে এতই মুঢ় যে, সে ভেবে দেখে না যে, যদি সে ভগবান হত, তা হলে তার মনে এই সংশয় কেন? সেই কথা সে ভেবে দেখে না। তাই সেটিই হচ্ছে মায়ার চরম ফাঁদ। প্রকৃতপক্ষে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা এবং তাঁর আদেশ অনুসারে কর্ম করতে সম্মত হওয়া।
এই শ্লোকে মোহ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যা জ্ঞানের বিরোধী, তাকে বলা হয় মোহ। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃত জ্ঞান হচ্ছে প্রতিটি জীবকে পরমেশ্বর ভগবানের দাস বলে জানতে পারা। কিন্তু নিজেকে সেই রকম চিন্তা করার পরিবর্তে জীব মনে করে যে, সে একজন দাস নয়, সে হচ্ছে এই জড় জগতের মালিক, কেন না সে জড় জগতের উপর আধিপত্য করতে চায়। সেটিই হচ্ছে তার মোহ। পরমেশ্বর ভগবান অথবা তাঁর শুদ্ধ ভক্তের কৃপার দ্বারা এই মোহ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। জীব যখনই এই মোহ থেকে মুক্ত হয়, তখন সে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করতে সম্মত হয়।
কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে কর্ম করা। বহিরঙ্গা মায়াশক্তির দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার ফলে বদ্ধ জীবাত্মা জানতে পারে না যে, পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সকলের প্রভু, যিনি পূর্ণ জ্ঞানময় এবং সব কিছুর অধীশ্বর। তিনি তাঁর ভক্তকে যা ইচ্ছা তাই দান করতে পারেন; তিনি সকলেরই বন্ধু এবং তাঁর ভক্তদের প্রতি তিনি বিশেষভাবে অনুরক্ত। তিনি এই জড়া প্রকৃতির ও সমস্ত জীবের নিয়ন্তা। তিনি অনন্ত কালেরও নিয়ন্তা এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্য ও সমগ্র শক্তিতে পরিপূর্ণ। পরম পুরুষোত্তম ভগবান ভক্তের কাছে নিজেকে পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে পারেন। যে তাঁকে জানে না, সে মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন; সে ভক্ত হতে পারে না—সে মায়ার দাস। কিন্তু পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছ থেকে ভগবদ্গীতা শ্রবণ করার পর অর্জুন সমস্ত মোহ থেকে মুক্ত হলেন। তিনি জানতে পারলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ কেবল তাঁর বন্ধুই নন, তিনি হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান । বাস্তবিকপক্ষে তখনই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারলেন। সুতরাং, ভগবদ্গীতা পাঠ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে যথাযথভাবে জানতে পারা। মানুষ যখন পূর্ণজ্ঞান লাভ করেন, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবে শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করেন। অর্জুন যখন বুঝতে পারলেন যে, অনাবশ্যক জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ এই পরিকল্পনা করেছিলেন, তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুসারে যুদ্ধ করতে সম্মত হলেন। তিনি আবার তাঁর অস্ত্র ধনুর্বাণ তুলে নিলেন পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নির্দেশ অনুসারে যুদ্ধ করবার জন্য।
শ্লোকঃ ৭৪
সঞ্জয় উৰাচ
ইত্যহং বাসুদেবস্য পার্থস্য চ মহাত্মনঃ ।
সংবাদমিমমশ্রৌষমভূতং রোমহর্ষণম্ ॥ ৭৪ ॥
সঞ্জয়ঃ উবাচ—সঞ্জয় বললেন; ইতি—এভাবেই; অহম্ — আমি; বাসুদেবস্য – শ্রীকৃষ্ণের; পার্থস্য—অর্জুনের: চ–ও: মহাত্মনঃ—দুই মহাত্মার; সংবাদ—সংবাদ, ইমম্—এই; অপ্রৌযম্ — শ্রবণ করেছিলাম; অদ্ভুতম্—অদ্ভুত; রোমহর্ষণম্— রোমাঞ্চকর।
গীতার গান
সঞ্জয় কহিলঃ
সেই যে শুনেছি আমি কৃষ্ণার্জুন কথা ।
অদ্ভুত সংবাদ রোমহর্ষণ সর্বথা ॥
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন—এভাবেই আমি কৃষ্ণ ও অর্জুন দুই মহাত্মার এই অদ্ভূত রোমাঞ্চকর সংবাদ শ্রবণ করেছিলাম।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতার শুরুতে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সচিব সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, “কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কি হল?” তাঁর গুরুদেব ব্যাসদেবের কৃপার ফলে সঞ্জয়ের হৃদয়ে সমস্ত ঘটনাগুলি প্রকাশিত হল। এভাবেই তিনি রণাঙ্গনের মূল ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা করলেন। এই বাক্যালাপ অপূর্ব, কারণ পূর্বে দুজন অতি মহান পুরুষের মধ্যে এই রকম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কখনই হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। এটি অপূর্ব, কারণ পরম পুরুষোত্তম ভগবান তাঁর স্বরূপ ও তাঁর শক্তি সম্বন্ধে তাঁর অতি মহান ভক্ত অর্জুনের মতো জীবের কাছে বর্ণনা করেছেন। আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণকে জানবার জন্য অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করি, তা হলে আমাদের জীবন সুখদায়ক ও সার্থক হবে। সঞ্জয় তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং যেমনভাবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেভাবেই তিনি সেই কথোপকথন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করেন। এখন এখানে স্থির সিদ্ধান্ত করা হচ্ছে যে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্ত অর্জুন বর্তমান, সেখানে বিজয় অবশ্যম্ভাবী।