শ্লোকঃ ৬৬
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥ ৬৬ ॥
সর্বধর্মান —সর্ব প্রকার ধর্ম; পরিত্যজ্য – পরিত্যাগ করে; মাম্—আমাকে; একম্— কেবল; শরণম্—শরণাগত, ব্রজ — হও; অহম্ — আমি; ত্বাম্ – তোমাকে, সর্ব- সমস্ত; পাপেভ্যঃ—পাপ থেকে; মোক্ষয়িষ্যামি — মুক্ত করব, মা করো না; শুচঃ -শোক।
গীতার গান
সর্ব ধর্ম ত্যাগি লও আমার শরণ ।
রক্ষিব তোমাকে আমি সদা সর্বক্ষণ ৷।
কোন চিন্তা না করিবে পাপ নাহি হবে ।
আমার শরণে তুমি পরা শান্তি পাবে ৷।
অনুবাদঃ সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না।
তাৎপর্যঃ ভগবান নানা রকম জ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, নানা রকম ধর্মের বর্ণনা করেছেন, ব্রহ্মজ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, পরমাত্মা জ্ঞানের বর্ণনা করেছেন, সমাজ জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ এবং আশ্রমের বর্ণনা করেছেন, সন্ন্যাস আশ্রমের জ্ঞান, বৈরাগ্যের জ্ঞান, মন ও ইন্দ্রিয়-দমন, ধ্যান আদি সব কিছুরই বর্ণনা করেছেন। তিনি বিবিধ উপায়ে নানা রকম ধর্মের বর্ণনা করেছেন। এখন, ভগবদ্গীতার সারাংশ বিশ্লেষণ করে ভগবান বলেছেন যে, অর্জুনের উচিত যে সমস্ত ধর্মের কথা তাঁর কাছে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা সবই পরিত্যাগ করা; তাঁর উচিত কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়া। সেই শরণাগতি তাঁকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবে, কেন না ভগবান নিজেই তাঁকে রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, যিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনিই কেবল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে পারেন। এভাবেই কেউ মনে করতে পারে যে, যদি না সে সব রকমের পাপ থেকে মুক্ত হচ্ছে, সে ভগবানের শরণাগতির পন্থা গ্রহণ করতে পারে না। সেই সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত না হয়েও থাকে, কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে তিনি আপনা হতেই সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হবেন। পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য অন্য কোন কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। আমাদের উচিত শ্রীকৃষ্ণকে সমস্ত জীবের পরম পরিত্রাতা বলে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করা। শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে আমাদের উচিত তাঁর প্রতি শরণাগত হওয়া।
শ্রীহরিভক্তিবিলাস (১১/৬৭৬) গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণের পদ্ধতি বর্ণনা করে বলা হয়েছে—
আনুকুল্যস্য সঙ্কল্পঃ প্রতিকূলাস্য বর্জনম্ ।
রক্ষিপ্যতীতি বিশ্বাসো গোত্বে বরণং তথা।
আত্মনিক্ষেপকার্পণ্যে ষড়বিধা শরণাগতিঃ ॥
ভক্তিযোগের পন্থায় কেবল এই সমস্ত ধর্মের আচরণ করা উচিত, যা পরিণামে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি প্রদান করবে। কেউ বর্ণ অনুসারে তাঁর স্বধর্মের অনুষ্ঠান করে যেতে পারেন, কিন্তু তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করার ফলে তিনি যদি কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তি লাভ না করেন, তা হলে তাঁর সমস্ত কর্মই অর্থহীন। যা কৃষ্ণভাবনাময় শুদ্ধ ভক্তি প্রদান করে না, তা পরিত্যজ্য। মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস থাকা উচিত যে, সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে শ্রীকৃষ্ণ সর্বতোভাবে রক্ষা করবেন। দেহ ও আত্মা একত্রে কিভাবে রক্ষা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই। শ্রীকৃষ্ণ সেটি দেখবেন। নিজেকে সর্বদা অসহায় বলে মনে করে শ্রীকৃষ্ণকে একমাত্র জীবনের প্রগতির ভিত্তি বলে বিবেচনা করা উচিত। যে মাত্র কেউ কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় নিজেকে ঐকান্তিকভাবে নিযুক্ত করেন, তৎক্ষণাৎ তিনি তাড়া প্রকৃতির সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হন। জ্ঞানের অনুশীলন ও যোগসাধনায় ধ্যান আদি অনুশীলনের মধ্যে বিভিন্ন রকমের ধর্মীয় পদ্ধতি ও শোধনকারী পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু যিনি শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁকে এই সমস্ত ধর্ম অনুষ্ঠান করতে হয় না। কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে তাঁকে অনর্থক সময় নষ্ট করতে হয় না। এভাবেই তৎক্ষণাৎ সমস্ত রকম উন্নতিসাধন করে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব সুন্দর রূপে আকৃষ্ট হওয়া উচিত। তাঁর নাম ‘শ্রীকৃষ্ণ’ কারণ তিনি সর্বাকর্ষক। যিনি শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব সুন্দর, সর্বশক্তিমান, সর্বাকর্ষক রূপে আকৃষ্ট হন, তিনি মহাভাগ্যবান। নানা রকম পরমার্থবাদী রয়েছে— তাঁদের মধ্যে কেউ নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতির প্রতি আসত, কেউ পরমাত্মা রূপের প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু যিনি পরমেশ্বর ভগবানের সবিশেষ রূপের প্রতি আকৃষ্ট এবং সর্বোপরি যিনি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট, তিনি সমস্ত পরমার্থবাদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পক্ষান্তরে বলা যায়, পূর্ণ চেতনায় কৃষ্ণভক্তি হচ্ছে গুহ্যতম জ্ঞান এবং সেটিই হচ্ছে সমস্ত ভগবদ্গীতার সারমর্ম। কর্মযোগী, জ্ঞানী, যোগী ও ভক্ত এদের সকলকেই বলা হয় পরমার্থবাদী, কিন্তু যিনি শুদ্ধ ভক্ত তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। যে বিশেষ শব্দটি এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে তা হচ্ছে, মা শুচঃ – “ভয় করো না, দ্বিধা করো না, উদ্বিগ্ন হয়ো না’, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেউ মনে করতে পারেন, সব রকমের ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়া কি করে সম্ভব, কিন্তু ঐ ধরনের দুশ্চিন্তা নিরর্থক।
শ্লোকঃ ৬৭
ইদং তে নাতপস্কায় নাভক্তায় কদাচন ।
ন চাশুশ্রুষবে বাচ্যং ন চ মাং যোহভ্যসূয়তি ॥ ৬৭ ॥
ইদম্—এই; তে—তোমা কর্তৃক, ন–নয়; অতপস্কায় — সংযমহীন ব্যক্তিকে; ন নয়; অভক্তায়—অভক্তকে; কদাচন—কখনও; ননয়; চ—ও অশুশ্ৰুষবে পরিচর্যাহীনকে; বাচ্যম্—বলা উচিত; ন নয়; চ—ও; মাম্—আমার প্রতি; যঃ — যে; অভ্যসূয়তি — বিদ্বেষ ভাবাপন্ন।
গীতার গান
অভক্ত বা অপস্ক পরিচর্যাহীন ।
আমার স্বরূপে এই যার শ্রদ্ধা ক্ষীণ ।।
উপদেশ না করিবে গীতার বচন ।
উপরোক্ত লোক সব অধিকারী নন ।।
অনুবাদঃ যারা সংযমহীন, অভক্ত, পরিচর্যাহীন এবং আমার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন, তাদেরকে কখনও এই গোপনীয় জ্ঞান বলা উচিত নয়।
তাৎপর্যঃ যে মানুষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তপশ্চর্যা করেনি, যে কখনও ভক্তিযোগে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার প্রচেষ্টা করেনি, যে কখনও শুদ্ধ ভক্তের পরিচর্যা করেনি এবং বিশেষ করে যারা শ্রীকৃষ্ণকে একটি ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মনে করে অথবা যারা শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, তাদেরকে কখনও এই গুহ্যতম জ্ঞানের কথা শোনানো উচিত নয়। অনেক সময় দেখা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরাও শ্রীকৃষ্ণের পূজা করছে ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এবং ভগবদ্গীতা পাঠ করার পেশা গ্রহণ করে ভগবদ্গীতার ভ্রান্ত বিশ্লেষণ করছে অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু যিনি যথার্থই শ্রীকৃষ্ণকে জানতে আগ্রহী, তাঁকে অবশ্যই ভগবদ্গীতার এই সমস্ত ভাষাগুলি বর্জন করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে যারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত, ভগবদ্গীতার যথার্থ উদ্দেশ্য তাদের বোধগম্য হয় না। এমন কি যে বিষয়াসক্তি ত্যাগ করে বৈদিক শাস্ত্র নির্দেশিত সংযত জীবন যাপন করছে, যদি সে কৃষ্ণভক্ত না হয়, তা হলে সেও শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। এমন কি যে কৃষ্ণভক্তির অভিনয় করে, কিন্তু ভক্তিযুক্ত কৃষ্ণসেবায় যুক্ত নয়, সেও শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না। বহু মানুষ আছে যারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, কারণ তিনি ভগবদ্গীতায় বিশ্লেষণ করেছেন যে, তিনিই হচ্ছেন পরম পুরুষ এবং তাঁর ঊর্ধ্বে বা তাঁর সমান আর কেউ নেই। বহু মানুষ আছে যারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। এই ধরনের মানুষদের কাছে ভগবদ্গীতা শোনানো উচিত নয়, কেন না তারা তা বুঝতে পারবে না। অবিশ্বাসী লোকদের পক্ষে ভগবদগীতা ও শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা অসম্ভব। নির্ভরযোগ্য প্রামাণিক শুদ্ধ ভক্তের কাছ থেকে শ্রীকৃষ্ণকে না জেনে ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা উচিত নয়।
শ্লোকঃ ৬৮
য ইদং পরমং গুহ্যং মদ্ভক্তেষভিধাস্যতি ।
ভক্তিং ময়ি পরাং কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ঃ ॥ ৬৮ ॥
যঃ—যিনি; ইদম্—এই; পরমম্ — পরম, গুহাম্― গোপনীয়; মহ— আমার; ভক্তেষু—ভক্তদের মধ্যে; অভিধাস্যতি — উপদেশ করেন, ভক্তিম্ভক্তি; ময়ি আমার প্রতি; পরাম্পরা; কৃত্বা করে; মাম্—আমার কাছে; এর – অবশ্যই; এষ্যতি —আসবেন; অসংশয়ঃ নিঃসংশয়ে।
গীতার গান
আমার ভক্তকে যেবা উপদেশ করে ।
পরা ভক্তি লাভ করি পাইবে আমারে ॥
অনুবাদঃ যিনি আমার ভক্তদের মধ্যে এই পরম গোপনীয় গীতাবাক্য উপদেশ করেন, তিনি অবশ্যই পরা ভক্তি লাভ করে নিঃসংশয়ে আমার কাছে ফিরে আসবেন।
তাৎপর্যঃ সাধারণত ভক্তসঙ্গে ভগবদ্গীতা আলোচনা করার উপদেশ দেওয়া হয়, কারণ অভক্তেরা না পারে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে, না পারে ভগবদ্গীতার মর্ম উপলব্ধি করতে। যারা শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপে শ্রীকৃষ্ণকে স্বীকার করতে চায় না এবং ভগবদ্গীতাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে চায় না, তাদের কখনই নিজের ইচ্ছামতো ভগবদ্গীতার বিশ্লেষণ করে অপরাধী হওয়া উচিত নয়। ভগবদ্গীতার অর্থ তাঁদেরই বিশ্লেষণ করা উচিত, যাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। এটি কেবল ভক্তদের বিষয়বস্তু, দার্শনিক জল্পনা-কল্পনাকারীদের জন্য নয়। যিনি ঐকান্তিকভাবে ভগবদ্গীতাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন, তিনি ভক্তিযোগে উন্নতি সাধন করে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি লাভ করবেন। এই শুদ্ধ ভক্তির ফলে তিনি নিঃসন্দেহে ভগবৎ-ধামে ফিরে যাবেন।