শ্লোকঃ ৬৩
ইতি তে জ্ঞানমাখ্যাতং গুহ্যাদ গুহ্যতরং ময়া ৷
বিমুশ্যৈতদশেষেণ যথেচ্ছসি তথা কুরু ॥ ৬৩ ॥
ইতি—এভাবেই; তে— তোমাকে; জ্ঞানম্ –জ্ঞান; আখ্যাতম্ —বর্ণিত হল; গুহ্যাৎ- গুহা থেকে; গুহাতরম্ — গুহাতর; ময়া— আমার দ্বারা: বিমৃশ্য বিবেচনা করে; এতৎ—এটি; অশেষেণ— সম্পূর্ণরূপে যথা—যা; ইচ্ছসি — ইচ্ছা কর; তথা ———তা; কুরুকর।
গীতার গান
গুহা গুহ্যতর জ্ঞান কহিলাম আমি ৷
ভালমন্দ বিচার যে সে করিবে তুমি ৷৷
বিচার করিয়া তুমি যাহা ইচ্ছা কর ৷
উপদেশ আমার সে নিত্য তুমি স্মর ॥
অনুবাদঃ এভাবেই আমি তোমাকে গুহা থেকে গুহ্যতর জ্ঞান বর্ণনা করলাম। তুমি তা সম্পূর্ণরূপে বিচার করে যা ইচ্ছা হয় তাই কর।
তাৎপর্যঃ ভগবান ইতিমধ্যেই অর্জুনের কাছে ব্রহ্মভূত সম্বয়ে জ্ঞানের বিশ্লেষণ করেছেন। যিনি ব্রহ্মভূত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি প্রসন্ন; তিনি কখনও অনুশোচনা করেন না, বা কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করেন না। গৃহ্য তত্ত্ব লাভ করার ফলে তা সম্ভব হয়। পরমাত্মা সম্বন্ধে জ্ঞানের রহস্যও শ্রীকৃষ্ণ উন্মোচিত করেছেন। এটিও ব্রহ্মজ্ঞান, কিন্তু এটি উচ্চতর।
এখানে যথেচ্ছসি তথা কুরু কথাটির অর্থ হচ্ছে—”বা ইচ্ছা হয় তাই কর”- ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ভগবান জীবের ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্রে হস্তক্ষেপ করেন না। ভগবদ্গীতায় ভগবান সর্বতোভাবে বিশ্লেষণ করেছেন কিভাবে জীবনের মান উন্নত করা যায়। অর্জুনকে প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপদেশ হচ্ছে, হৃদি-অন্তস্থ পরমাত্মার কাছে আত্মসমর্পণ করা। যথার্থ বিবেচনার মাধ্যমে পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হতে সম্মত হওয়া উচিত। তা মানব-জীবনের পরম সিদ্ধির স্তর কৃষ্ণভাবনামৃতে অধিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। যুদ্ধ করবার জন্য অর্জুন সরাসরিভাবে পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা আদিষ্ট হয়েছিলেন। পরম পুরুষোত্তম ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করাটা সমস্ত জীবের পরম স্বার্থ। এটি পরমেশ্বর ভগবানের স্বার্থ নয়। আত্মসমর্পণের পূর্বে বুদ্ধি দিয়ে এই সম্বন্ধে যথাসাধ্য বিচার করার স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে; পরম পুরুষোত্তম ভগবানের নির্দেশ গ্রহণ করার সেটিই হচ্ছে উত্তম পন্থা। এই নির্দেশ শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি সদগুরুর কাছ থেকেও প্রাপ্ত হওয়া যায়।
শ্লোকঃ ৬৪
সর্বগুহ্যতমং ভূয়ঃ শৃণু মে পরমং বচঃ ।
ইষ্টোহসি মে দৃঢ়মিতি ততো বক্ষ্যামি তে হিতম্ ।। ৬৪ ।।
সর্বগুহাতমম্—সবচেয়ে গোপনীয়; ভূয়ঃ— পুনরায় শৃণু — শ্রবণ কর; মে—আমার থেকে; পরমম্-পরম; বচঃ—উপদেশ; ইষ্টঃ— প্রিয়; অসি হও মে— আমার; দৃঢ়ম্—অতিশয়; ইতি—এভাবে, ততঃ– সেই হেতু, বক্ষ্যামি — বলছি; তে— তোমার; হিতম্—হিতের জন্য।
গীতার গান
তদপেক্ষা গুহ্যতম আর তুমি শুন ।
অত্যন্ত সে প্রিয় তুমি তাই সে বচন ॥
অনুবাদঃ তুমি আমার কাছ থেকে সবচেয়ে গোপনীয় পরম উপদেশ শ্রবণ কর। যেহেতু তুমি আমার অতিশয় প্রিয়, সেই হেতু তোমার হিতের জন্যই আমি বলছি।
তাৎপর্যঃ ভগবান অর্জুনকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা হচ্ছে গুহ্য (ব্রহ্মজ্ঞান) এবং ওহাতর (সকলের হৃদয়ের অন্তস্তলে বিরাজমান পরমাত্মার জ্ঞান) আর এখন তিনি দান করছেন গুহ্যতম জ্ঞান — পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ কর। নবম অধ্যায়ের শেষে তিনি বলেছেন, মন্থনাঃ- ‘সর্বদা আমার কথা চিন্তা কর।’ ভগবদ্গীতার মূল শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে এখানে সেই নির্দেশেরই পুনরুক্তি করা হয়েছে। ভগবদ্গীতার সারাংশরূপ এই যে পরম শিক্ষা, তা শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় শুদ্ধ ভক্ত ছাড়া সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পারে না। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের এটিই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ যা বলছেন, তা হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের সারাতিসার এবং তা কেবল অর্জুনের কাছেই গ্রহণীয় নয়, সমস্ত জীবের পক্ষেই তা গ্রহণীয়।
শ্লোকঃ ৬৫
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু ৷
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে ।। ৬৫ ।।
মন্মনাঃ—মদ্গতচিত্ত; ভব – হও; মদ্ভক্তঃ – আমার ভক্ত; মদ্যাজী — আমার পূজক; মাম্—আমাকে; নমস্কুর নমস্কার কর; মাম্—আমাকে; এর—অবশ্যই; এব্যসি— প্রাপ্ত হবে; সত্যম্——সত্যই, তে—তোমার কাছে; প্রতিজানে— প্রতিজ্ঞা করছি, প্রিয়ঃ —প্রিয়; অসি—তুমি হও, মে—আমার।
গীতার গান
মন্মনা মদ্ভক্ত হও মোরে নমস্কার ।
আমাকে পাইবে তুমি প্রতিজ্ঞা আমার ॥
অনুবাদঃ তুমি আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। এই জন্য আমি তোমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
তাৎপর্যঃ তত্ত্বজ্ঞানের গুহ্যতম অংশ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্ত হওয়া এবং সর্বদাই তাঁর চিন্তা করে তাঁর জন্য কর্ম সাধন করা। পেশাধারী ধ্যানী হওয়া উচিত নয়। জীবনকে এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত, যাতে সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করা যায়। সর্বক্ষণ এমনভাবে কাজকর্ম করা উচিত, যাতে সমস্ত দৈনন্দিন কার্যকলাপগুলি শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধে অনুষ্ঠান করা যায়। জীবনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা উচিত যাতে দিনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই শ্রীকৃষ্ণের কথা ছাড়া আর অন্য কোন চিন্তারই উদয় না হয়। ভগবান এখানে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, যিনি এভাবেই শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনা লাভ করেছেন, তিনি অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণের ধামে ফিরে যাবেন, যেখানে তিনি শ্রীকৃষ্ণের মুখোমুখি হয়ে তাঁর সঙ্গ লাভ করতে পারবেন। তত্ত্বজ্ঞানের এই গুঢ়তম অংশটি অর্জুনকে বলা হয়েছে, কারণ তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয় বন্ধু। অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলেই শ্রীকৃষ্ণের পরম বন্ধুতে পরিণত হতে পারেন এবং অর্জুনের মতো সার্থকতা অর্জন করতে পারেন।
এই কথাগুলিতে শ্রীকৃষ্ণের রূপে মনকে একাগ্র করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যে রূপে তিনি দ্বিভুজ মুরলীধর শ্যামসুন্দর গোপবালক, যাঁর মুখমণ্ডল অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত এবং মাথায় যার ময়ূরের পালক। ব্রহ্মসংহিতা ও অন্যান্য শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণের রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। ভগবানের আদিরূপ শ্রীকৃষ্ণে মনকে নিবদ্ধ করা উচিত। ভগবানের অন্যান্য রূপেও অভিনিবেশ করা উচিত নয়। বিষ্ণু, নারায়ণ, রাম, বরাহ আদি ভগবানের অনন্ত রূপ রয়েছে। কিন্তু অর্জুনের সম্মুখে যে রূপ নিয়ে ভগবান প্রকট হয়েছিলেন, ভক্তের উচিত সেই রূপেই মনকে একাগ্র করা। শ্রীকৃষ্ণের রূপে মনকে একাগ্র করাই হচ্ছে তত্ত্বজ্ঞানের গুহাতম অংশ এবং অর্জুনের কাছে ভগবান তা ব্যক্ত করেছিলেন, কারণ অর্জুন হচ্ছেন ভগবানের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।