শ্লোকঃ ৬০

স্বভাবজেন কৌন্তেয় নিবন্ধঃ স্বেন কর্মণা ।

কর্তুং নেচ্ছসি যন্মোহাৎ করিষ্যস্যবশোঽপি তৎ ।। ৬০ ।।

স্বভাৰজেন—স্বভাবজাত; কৌন্তেয়—হে কুত্তীপুত্র; নিবন্ধঃ— বশবর্তী হয়ে, স্বেন- তোমার নিজের; কর্মণা—কর্মের দ্বারা, কতুম্ করতে, ন—না; ইচ্ছসি—ইচ্ছা করছ; যৎ—যা; মোহা—মোহবশত; করিষ্যসি — করবে; অবশঃ – অবশভাবে: অপি— যদিও; তৎ—তা।

গীতার গান

স্বভাবজ কর্ম তব অবশ্য সাধিবে ।

কৌন্তেয় নির্বন্ধ সব নিজ কর্মভাবে ।।

অতএব মোহবশে ইচ্ছা নাহি কর ।

অবশে করিবে সেই তুমি অতঃপর ৷।

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয় ! মোহবশত তুমি এখন যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করছ না, কিন্তু তোমার নিজের স্বভাবজাত কর্মের দ্বারা বশবর্তী হয়ে অবশভাবে তুমি তা করতে প্রবৃত্ত হবে।

তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে কেউ যদি কর্ম করতে রাজি না হয়, তা হলে সে প্রকৃতির যে গুণে অবস্থিত, সেই গুণ অনুসারে কর্ম করতে বাধ্য হয়। প্রত্যেকেই প্রকৃতির গুণের বিশেষ সংমিশ্রণের দ্বারা প্রভাবিত এবং সেভাবেই কাজ করছে। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশ অনুসারে নিজেকে নিযুক্ত করে, সে মহিমান্বিত হয়।

শ্লোকঃ ৬১

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঽর্জুন তিষ্ঠতি ৷

ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ।৷ ৬১ ৷৷

ঈশ্বরঃ—পরমেশ্বর ভগবান; সর্বভূতানাম্ — সমস্ত জীবের, হৃদ্দেশে — হৃদয়ে, অর্জুন– হে অর্জুন, তিষ্ঠতি — অবস্থান করছেন; ভ্রাময় — ভ্রমণ করান; সর্বভূতানি — সমস্ত জীবকে; যন্ত্র—যন্ত্রে; আরূঢ়ানি — আরোহণ করিয়ে; মায়য়া—মায়ার দ্বারা।

গীতার গান

ঈশ্বর আছে সে সর্বভূতের হৃদয়ে ।

কর্ম কর্মফল সব নিয়ন্ত্রণ করয়ে ।।

মায়ার যন্ত্রেতে তিনি সবারে ঘুরায় ।

ভুক্তি বাঞ্ছা করে জীব যেই যথা চায় ।।

অনুবাদঃ হে অর্জুন। পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।

তাৎপর্যঃ অর্জুন পরম জ্ঞাতা ছিলেন না এবং যুদ্ধ করা বা না করা সম্বন্ধে তাঁর বিবেচনা তাঁর সীমিত বিচার শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, জীবাত্মাই সর্বেসর্বা নয়। পরম পুরুষোত্তম ভগবান বা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা রূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে অবস্থান করে তাদের পরিচালনা করেন। দেহত্যাগ করার পর জীব তার অতীতের কথা ভুলে যায়। কিন্তু পরমাত্মা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞাতারূপে তার সমস্ত কর্মের সাক্ষী থাকেন। তাই, জীবের সমস্ত কর্মগুলি পরমাত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়। জীবের যা প্রাপ্য তা সে প্রাপ্ত হয় এবং পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে জড়া প্রকৃতিজাত এক-একটি দেহে আরূঢ় হয়ে এই জড় জগতে ভ্রমণ করতে থাকে। জীব যখনই একটি জড় শরীর প্রাপ্ত হয়, তখনই তাকে সেই শরীরের ধর্ম অনুসারে কর্ম করতে হয়। যেমন, কোন মানুষ যখন একটি দ্রুতগামী গাড়িতে বসে থাকেন, তখন তিনি মন্থরগামী গাড়ির আরোহী থেকে দ্রুতগতিতে গমন করেন, যদিও জীব বা গাড়ির চালক একই মানুষ হতে পারেন। তেমনই, পরমাত্মার নির্দেশ অনুসারে জড়া প্রকৃতি কোন নির্দিষ্ট জীবের জন্য কোন বিশেষ রকমের দেহ তৈরি করেন যাতে সে তার অতীতের বাসনা অনুসারে কর্ম করতে পারে। জীব স্বাধীন বা স্বতন্ত্র নয়। নিজেকে কখনই পরম পুরুষোত্তম ভগবান থেকে স্বাধীন বলে মনে করা উচিত নয়। জীব সর্বদাই ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই তার কর্তব্য হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা এবং সেটিই হচ্ছে পরবর্তী শ্লোকের নির্দেশ।

শ্লোকঃ ৬২

তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।

তপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥ ৬২ ॥

ভম্—তাঁর; এব—অবশ্যই; শরণম্ শরণ; গচ্ছ—গ্রহণ কর; সর্বভাবে— সর্বতোভাবে, ভারত—হে ভারত, তৎপ্রসাদাৎ- তাঁর প্রসাদে; পরাম্‌পরা; শান্তিম্ —শান্তি; স্থানম্ — ধাম; প্রাপ্স্যসি — প্রাপ্ত হবে; শাশ্বতম্ — নিত্য।

গীতার গান

তাঁহার চরণে লও সর্বতো শরণ ।

প্রসাদে ইইবে সর্ব বাঞ্ছিত পূরণ ॥

পরা শান্তি পাবে আর শাশ্বত যে স্থান।

সর্বলাভ সে প্রসাদে দুঃখ নিবারণ ॥

অনুবাদঃ হে ভারত ! সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে তুমি পরা শাস্তি এবং নিত্য ধাম প্রাপ্ত হবে।

তাৎপর্যঃ তাই প্রতিটি জীবের কর্তব্য, সকলের হৃদয়ে বিরাজ করছেন যে পরম পুরুষোত্তম ভগবান, তাঁর শরণাগত হওয়া এবং তার ফলে জীব জড় জগতের সমস্ত দুঃখ- দুর্দশা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। এই আত্ম-সমর্পণের ফলে জীব যে কেবল এই জীবনের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়, তাই নয়, পরিণামে সে পরমেশ্বর ভগবানকে লাভ করে। চিৎ-জগৎ সম্বন্ধে বর্ণনা করে বৈদিক শাস্ত্রে (ঋক্ বেদ ১/২২/ 20 ) বলা হয়েছে— তদ বিষ্ণোঃ পরমং পদম্। যেহেতু সমস্ত সৃষ্টিই ভগবানের রাজ্য, তাই জাগতিক সব কিছুই প্রকৃতপক্ষে চিন্ময়, কিন্তু পরমং পদ বলতে বিশেষ করে ভগবানের নিত্য ধামকে বোঝানো হচ্ছে, যাকে বলা হয় চিৎ-জগৎ বা বৈষ্ঠা।

ভগবদ্‌গীতায় পঞ্চদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ- ভগবান সকলের হৃদয়ে বিরাজমান। তাই, হৃদয়ের অন্তস্তলে বিরাজমান পরমাত্মার কাছে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করা। শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুন ইতিমধ্যেই পরমেশ্বর বলে মেনে নিয়েছেন। দশম অধ্যায়ে তাঁকে পরং ব্রহ্ম পরং ধাম রূপে স্বীকার করা হয়েছে। অর্জুন কেবল তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং সমস্ত জীবের পরম ধাম বলে গ্রহণ করেছেন, তাই নয়, নারদ, অসিত, দেবল, ব্যাস আদি সমস্ত মহাত্মারাও যে শ্রীকৃষ্ণকে সেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, তিনি সেই কথা উল্লেখ করেছেন।

error: Content is protected !!