শ্লোকঃ ৭

নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণো নোপপদ্যতে ।

মোহাত্তস্য পরিত্যাগস্তামসঃ পরিকীর্তিতঃ ।। ৭ ।।

নিয়তস্য— নিত্য; ভূ – কিন্তু; সন্ন্যাসঃ- ত্যাগ; কর্মণঃ–কর্মের; ন নয়; উপপদ্যতে—উপযুক্ত, মোহাৎ— মোহবশত, তস্য—তার পরিত্যাগঃ পরিত্যাগ; তামসঃ তামসিক; পরিকীর্তিতঃ বলা হয়।

গীতার গান

নির্দিষ্ট কর্মের ত্যাগ নহে সে বিধান ।

মোহেতে সে ত্যাগ হয় তামসিক জ্ঞান ।।

অনুবাদঃ কিন্তু নিত্যকর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। মোহবশত তার ত্যাগ হলে, তাকে তামসিক ত্যাগ বলা হয়।

তাৎপর্যঃ জড় সুখ ভোগের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত কর্ম তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কিন্তু যে সমস্ত কর্ম মানুষকে পারমার্থিক ক্রিয়াকলাপে উন্নীত করে, যেমন ভগবানের জন্য রান্না করা, ভগবানকে ভোগ নিবেদন করা এবং ভগবৎ প্রসাদ গ্রহণ করা অনুমোদন করা হয়েছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সন্ন্যাসীর নিজের জন্য রান্না করা উচিত নয়। নিজের জন্য রান্না করা নিষিদ্ধ, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের জন্য রান্না করতে কোন বাধা নেই। তেমনই, শিষ্যকে কৃষ্ণভাবনামৃত লাভের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবার জন্য সন্ন্যাসী বিবাহ-যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে পারেন। এই সমস্ত কর্মগুলিকে যদি কেউ পরিত্যাগ করে, তা হলে বুঝতে হবে যে, সে তমোগুণে কর্ম করছে।

শ্লোকঃ ৮

দুঃখমিত্যেব যৎ কর্ম কায়ক্লেশভয়াত্ত্যজেৎ।

স কৃত্বা রাজসং ত্যাগং নৈব ত্যাগফলং লভেৎ ।। ৮ ।।

দুঃখম্—দুঃখজনক, ইতি—এভাবে; এর—অবশ্যই: যৎ – যে, কর্ম— কর্ম, কায়- দৈহিক; ক্লেশ—ক্লেশের; ভয়াৎ — ভয়ে; ত্যজেৎ— ত্যাগ করেন; সঃ— তিনি; কৃত্বা- করে: রাজসম্—রাজসিক; ত্যাগম্ — ত্যাগ, ন–না; এব—অবশ্যই; ত্যাগ — আগের ফলম্ – ফল: লভেং—লাভ করেন।

গীতার গান

দুঃখ হয় তার জন্য কর্মত্যাগ করে ।

কিংবা কর্মত্যাগ করে কায়ক্লেশ ভরে ॥

রাজসিক ত্যাগ সেই ফল নাহি পায় ৷

সেই যে কহিনু যত শাস্ত্রের নির্ণয় ॥

অনুবাদঃ যিনি নিত্যকর্মকে দুঃখজনক বলে মনে করে দৈহিক ক্লেশের ভয়ে ত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই সেই রাজসিক ত্যাগ করে ত্যাগের ফল লাভ করেন না।

তাৎপর্যঃ অর্থ উপার্জন করাকে ফলাশ্রয়ী সকাম কর্ম বলে মনে করে কৃষ্ণভক্তের অর্থ উপার্জন পরিত্যাগ করা উচিত নয়। কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জন করে সেই অর্থ যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করা হয়, অথবা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা যদি পারমার্থিক কৃষ্ণভক্তির সহায়ক হয়, তা হলে সেই সমস্ত কর্মগুলি কষ্টদায়ক বলে তার ভয়ে সেগুলির অনুশীলন থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। এই ধরনের ত্যাগ রাজসিক মনোভাবাপন্ন। রাজসিক কর্মের ফল সব সময় ক্লেশদায়ক হয়ে থাকে। সেই মনোভাব নিয়ে কেউ যদি কর্ম পরিত্যাগ করেন, তা হলে তিনি ত্যাগের যথার্থ সুফল কখনই অর্জন করেন না।

শ্লোকঃ ৯

কার্যমিত্যেব যৎ কর্ম নিয়তং ক্রিয়তেহর্জুন ।

সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলং চৈব স ত্যাগঃ সাত্ত্বিকো মতঃ ।। ৯ ।।

কার্যম্—কর্তব্য; ইতি এব—এই মনে করে; যৎ— যে; কর্ম—কর্ম; নিয়তম্ — নিত্য ক্রিয়তে—অনুষ্ঠান করা হয়; অর্জুন – হে অর্জুন; সঙ্গম্ —আসক্তি; ত্যত্ত্বা— পরিত্যাগ করে; ফলম্ — ফল; চ–ও; এব—অবশ্যই; সঃ – সেই; ত্যাগঃ — ত্যাগ; সাত্ত্বিকঃ —সাত্ত্বিক; মতঃ—আমার মতে।

গীতার গান

কর্তব্য জানিয়া যেবা সর্ব কর্ম করে ।

ফলত্যাগ করিবারে সাত্ত্বিক নাম ধরে ॥

অনুবাদঃ হে অর্জুন ! আসক্তি ও ফল পরিত্যাগ করে কর্তব্যবোধে যে নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, আমার মতে সেই ত্যাগ সাত্ত্বিক।

তাৎপর্যঃ এমন মনোভাব নিয়ে সর্বদাই নিত্যকর্মের অনুষ্ঠান করা উচিত যেন ফলের প্রতি অনাসক্ত হয়ে কাজ করা হয়। এমন কি, কাজের ধরনের প্রতিও অনাসক্ত হওয়া উচিত। কৃষ্ণভাবনাময় কোন ভক্ত যদি কখনও কোন কারখানাতেও কাজ করেন, তখন তিনি কারখানার কাজের প্রতি আসক্ত হন না এবং কারখানার শ্রমিকদের প্রতিও আসক্ত হন না। তিনি কেবল শ্রীকৃষ্ণের জন্য কাজ করেন এবং যখন তিনি কর্মফল শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন, তখন তাঁর সেই কর্ম অপ্রাকৃত স্তরে অনুষ্ঠিত হয়।

error: Content is protected !!